লক্ষ্মীপুরে ইটভাটা উচ্ছেদে মানবিক সংকট: বিকল্প ছাড়া বন্ধ না করার দাবি শ্রমিক-মালিকদের

অ আ আবীর আকাশ, লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান থাকলেও এতে ভয়াবহ মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন হাজারো শ্রমিক ও ইটভাটা মালিক। পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিকল্প কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া একের পর এক ইটভাটা ভাঙার ফলে জেলার নিম্নআয়ের মানুষ চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছেন।

অভিযানকালে বিভিন্ন সময়ে ১৮ দিনে ৩৬টি, ১৫ দিনে ২৯টি এবং তিন মাসে ৮২টির বেশি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। পাশাপাশি ভাটা মালিকদের কাছ থেকে প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা জরিমানাও আদায় করা হয়েছে। জেলা জুড়ে শতাধিক অবৈধ ইটভাটার মধ্যে প্রায় ৮০ থেকে ৮৮টি ভাটা ইতোমধ্যে ধ্বংস করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। যদিও অভিযান এখনো চলমান থাকায় নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ কঠিন।

ইটভাটা মালিকদের দাবি, হঠাৎ করে উচ্ছেদ অভিযানের ফলে তারা আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক মালিক ব্যাংক ঋণ কিংবা ব্যক্তিগতভাবে টাকা লগ্নি করে ভাটা স্থাপন করেছিলেন। ভাটা ভেঙে দেওয়ায় সেই বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না। অনেকে দাদনের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে সামাজিক ও আইনি ঝুঁকিতে পড়ছেন।

শুধু মালিক নয়, সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ইটভাটায় কর্মরত হাজারো শ্রমিক। এসব শ্রমিকের অধিকাংশই দিনমজুর, যাদের একমাত্র জীবিকার উৎস ছিল ইটভাটা। ভাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বেকার হয়ে পড়েছেন। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। অনেক শ্রমিক বলছেন, কাজ না থাকায় সংসার চালাতে গিয়ে ঋণের বোঝা বাড়ছে, দারিদ্র্যের হারও দিন দিন বাড়ছে।

স্থানীয়দের মতে, বেকারত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের প্রবণতাও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কর্মহীন যুবকদের একটি অংশ ভুল পথে জড়িয়ে পড়তে পারে—এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জনপ্রতিনিধি ও সমাজসচেতন মহল।

এদিকে, ইটভাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদীভাঙনের বাস্তবতা। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষ জীবিকার তাগিদে ইটভাটায় কাজ করতেন। এখন ভাটা বন্ধ হওয়ায় তাদের কষ্ট আরও বেড়েছে। নদীভাঙনে ঘর হারিয়ে যারা ইতোমধ্যে নিঃস্ব, তারা নতুন করে জীবিকা সংকটে পড়ছেন।

ইটভাটা মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে প্রস্তুত। সরকারের পক্ষ থেকে সময় ও নীতিগত সহায়তা পেলে আধুনিক জিগজ্যাগ বা হাইব্রিড হফম্যান প্রযুক্তিতে ভাটা রূপান্তর করা সম্ভব। কিন্তু কোনো ধরনের পূর্ব নোটিশ বা পুনর্বাসন পরিকল্পনা ছাড়া ভাটা ভেঙে দেওয়ায় তারা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

একজন ভাটা মালিক বলেন, “আমরা আইন মানতে চাই। কিন্তু হঠাৎ ভাটা ভেঙে দিলে আমাদের পুঁজি, শ্রমিকদের জীবন—সব শেষ হয়ে যায়। অন্তত সময় দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করার সুযোগ দেওয়া দরকার।”

শ্রমিক নেতাদের দাবিও একই। তারা বলছেন, পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। বিকল্প কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ বা পুনর্বাসন ছাড়া ইটভাটা উচ্ছেদ মানবিক সংকট তৈরি করছে।

সচেতন মহলের মতে, সরকার চাইলে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। অবৈধ ভাটা বন্ধের পাশাপাশি বৈধকরণ প্রক্রিয়া, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর, সহজ শর্তে ঋণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে একদিকে পরিবেশ রক্ষা হবে, অন্যদিকে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান টিকে থাকবে।

সবশেষে ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা প্রশাসনের কাছে একটাই দাবি জানাচ্ছেন—“আর যেনো ইটভাটা না ভাঙে।” তারা চান আইন ও পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মানবিক সমাধান। কারণ উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন সেখানে মানুষের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা থাকে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৫ দফা দাবিতে এনসিপির মশাল মিছিল শনিবার

» জামায়াতে ইসলামীর ২ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা

» নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ হবে না: আমান

» হাদি হত্যায় জড়িতদের বিচার নিশ্চিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে ছাত্রদলের স্মারকলিপি

» ‘সরকারকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আগে থেকেই নেওয়া উচিত ছিল’

» পিস্তলের গুলির খোসাসহ যুবদলের তিন কর্মী গ্রেফতার

» যুদ্ধবিরতির মধ্যে কাতার-মিশর-তুরস্কের সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র

» ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ-স্বচ্ছ তদন্ত চায় জাতিসংঘ

» ওসমান হাদির জানাজায় আগতদের জন্য ডিএমপির ট্রাফিক নির্দেশনা

» প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলায় বিএফইউজে-ডিইউজের গভীর উদ্বেগ

 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

লক্ষ্মীপুরে ইটভাটা উচ্ছেদে মানবিক সংকট: বিকল্প ছাড়া বন্ধ না করার দাবি শ্রমিক-মালিকদের

অ আ আবীর আকাশ, লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান থাকলেও এতে ভয়াবহ মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন হাজারো শ্রমিক ও ইটভাটা মালিক। পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিকল্প কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া একের পর এক ইটভাটা ভাঙার ফলে জেলার নিম্নআয়ের মানুষ চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছেন।

অভিযানকালে বিভিন্ন সময়ে ১৮ দিনে ৩৬টি, ১৫ দিনে ২৯টি এবং তিন মাসে ৮২টির বেশি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। পাশাপাশি ভাটা মালিকদের কাছ থেকে প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা জরিমানাও আদায় করা হয়েছে। জেলা জুড়ে শতাধিক অবৈধ ইটভাটার মধ্যে প্রায় ৮০ থেকে ৮৮টি ভাটা ইতোমধ্যে ধ্বংস করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। যদিও অভিযান এখনো চলমান থাকায় নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ কঠিন।

ইটভাটা মালিকদের দাবি, হঠাৎ করে উচ্ছেদ অভিযানের ফলে তারা আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক মালিক ব্যাংক ঋণ কিংবা ব্যক্তিগতভাবে টাকা লগ্নি করে ভাটা স্থাপন করেছিলেন। ভাটা ভেঙে দেওয়ায় সেই বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না। অনেকে দাদনের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে সামাজিক ও আইনি ঝুঁকিতে পড়ছেন।

শুধু মালিক নয়, সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ইটভাটায় কর্মরত হাজারো শ্রমিক। এসব শ্রমিকের অধিকাংশই দিনমজুর, যাদের একমাত্র জীবিকার উৎস ছিল ইটভাটা। ভাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বেকার হয়ে পড়েছেন। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। অনেক শ্রমিক বলছেন, কাজ না থাকায় সংসার চালাতে গিয়ে ঋণের বোঝা বাড়ছে, দারিদ্র্যের হারও দিন দিন বাড়ছে।

স্থানীয়দের মতে, বেকারত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের প্রবণতাও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কর্মহীন যুবকদের একটি অংশ ভুল পথে জড়িয়ে পড়তে পারে—এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জনপ্রতিনিধি ও সমাজসচেতন মহল।

এদিকে, ইটভাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদীভাঙনের বাস্তবতা। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষ জীবিকার তাগিদে ইটভাটায় কাজ করতেন। এখন ভাটা বন্ধ হওয়ায় তাদের কষ্ট আরও বেড়েছে। নদীভাঙনে ঘর হারিয়ে যারা ইতোমধ্যে নিঃস্ব, তারা নতুন করে জীবিকা সংকটে পড়ছেন।

ইটভাটা মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে প্রস্তুত। সরকারের পক্ষ থেকে সময় ও নীতিগত সহায়তা পেলে আধুনিক জিগজ্যাগ বা হাইব্রিড হফম্যান প্রযুক্তিতে ভাটা রূপান্তর করা সম্ভব। কিন্তু কোনো ধরনের পূর্ব নোটিশ বা পুনর্বাসন পরিকল্পনা ছাড়া ভাটা ভেঙে দেওয়ায় তারা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

একজন ভাটা মালিক বলেন, “আমরা আইন মানতে চাই। কিন্তু হঠাৎ ভাটা ভেঙে দিলে আমাদের পুঁজি, শ্রমিকদের জীবন—সব শেষ হয়ে যায়। অন্তত সময় দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা করার সুযোগ দেওয়া দরকার।”

শ্রমিক নেতাদের দাবিও একই। তারা বলছেন, পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। বিকল্প কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ বা পুনর্বাসন ছাড়া ইটভাটা উচ্ছেদ মানবিক সংকট তৈরি করছে।

সচেতন মহলের মতে, সরকার চাইলে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। অবৈধ ভাটা বন্ধের পাশাপাশি বৈধকরণ প্রক্রিয়া, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর, সহজ শর্তে ঋণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে একদিকে পরিবেশ রক্ষা হবে, অন্যদিকে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান টিকে থাকবে।

সবশেষে ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা প্রশাসনের কাছে একটাই দাবি জানাচ্ছেন—“আর যেনো ইটভাটা না ভাঙে।” তারা চান আইন ও পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মানবিক সমাধান। কারণ উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন সেখানে মানুষের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা থাকে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com