সংগৃহীত ছবি
ধর্ম ডেস্ক : মৃত্যু মানব জীবনের চূড়ান্ত ও অবশ্যম্ভাবী সত্য। ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী; তারপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা আনকাবুত: ৫৭) ইসলামের দৃষ্টিতে মৃত্যু মানে জীবনের সমাপ্তি নয়, বরং চূড়ান্ত জীবনের সূচনা। পবিত্র কোরআন ও সহিহ হাদিসে মৃত্যুর আগের মুহূর্তের অবস্থা, লক্ষণ ও আত্মিক পরীক্ষা বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।
মৃত্যুর আগমন ও ফেরেশতার উপস্থিতি
ইসলামে মৃত্যুর আগমনের সময় বা স্থান মানুষ পূর্বানুমান করতে পারে না। কে কখন-কোথায়-কীভাবে মারা যাবে তা কেবল আল্লাহই জানেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কেউ জানে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন দেশে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত।’ (সুরা লুকমান: ৩৪)
অসুস্থতা বা দুর্ঘটনা যেভাবেই মৃত্যু আসুকনা কেন ওই মুহূর্তে মালাকুল মউত (আজরাইল আ.) এবং অন্যান্য ফেরেশতা উপস্থিত হন। মুমিনের কাছে তারা উজ্জ্বল ও সৌন্দর্যপূর্ণ চেহারায় আসেন, জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেন এবং আত্মাকে সহজভাবে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা বলে আল্লাহ আমাদের প্রভু; অতঃপর তারা তাতে অটল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা এসে বলে, তোমরা ভয় পেয়ো না, চিন্তিত হও না, জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো।’ (সুরা ফুসসিলাত: ৩০)
পাপীদের জন্য ফেরেশতাদের উপস্থিতি ভীতিকর হয়ে দাঁড়ায়। কোরআনে উল্লেখ আছে, ‘যেদিন তারা ফেরেশতাদের দেখতে পাবে সেদিন অপরাধীদের জন্য কোনো সুসংবাদ থাকবে না এবং তারা বলবে, রক্ষা করো, রক্ষা করো।’ (সুরা ফুরকান: ২২)
এই সময় মানুষ তার জীবনের প্রতিফলন অনুভব করে, শারীরিক দুর্বলতা এবং মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যায়। চোখের পর্দা সরানো হয়। ফলে সে বাস্তব জীবন দেখতে পায়। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘অবশ্যই তুমি এ দিবস সম্পর্কে উদাসীন ছিলে, অতএব আমি তোমার পর্দা তোমার থেকে উন্মোচন করে দিলাম। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি খুব প্রখর।’ (সুরা কাফ: ২২)
মৃত্যুযন্ত্রণা ও শারীরিক পরিবর্তন
মৃত্যুর যন্ত্রণার সত্যতা কোরআন-হাদিসে স্পষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর মৃত্যু-যন্ত্রণা অবশ্যই আসবেই, যা থেকে তুমি পলায়ন করতে চাইতে।’ (সুরা কাফ: ১৯)
মৃত্যুর প্রক্রিয়ায় শরীর নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। প্রাণ কণ্ঠনালীতে সীমিত হয়, পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে যায়, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং চোখ ঘূর্ণায়মান হয়ে স্থির হয়। শরীর শীতল হয়ে যায় এবং মানুষ উপলব্ধি করে যে বিদায়ক্ষণ নিকটে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কখনো নয়, যখন প্রাণ কণ্ঠগত হবে এবং বলা হবে, কে তাকে রক্ষা করবে? তখন তার প্রত্যয় হবে যে এটি বিদায়ক্ষণ।’ (সুরা কিয়ামা: ২৬-৩০)
ভালো মৃত্যুর প্রস্তুতি
আল্লাহর ইবাদত করা ও হারাম বিষয় থেকে দূরে থাকা, পাপ হয়ে গেলে দ্রুত তাওবা করা, সুন্দর মৃত্যুর জন্য দোয়া করা, দান-সদকা করা, সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করা এবং মৃত্যুর কথা স্মরণ করা সুন্দর মৃত্যুর জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা অধিক পরিমাণে জীবনের স্বাদ হরণকারী অর্থাৎ মৃত্যুকে স্মরণ করো।’ (ইবনে মাজাহ: ৪২৫৮) ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা করো না এবং সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার সময় তোমার পীড়িত অবস্থার জন্য প্রস্তুতি নাও। আর তোমার জীবিত অবস্থায় তোমার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নাও। (বুখারি: ৬৪১৬)
এক কথায়, সুন্দর মৃত্যুর জন্য জীবনকে ধারাবাহিকভাবে পরকালের দৃষ্টিতে সাজানো উচিত।
মুমিনের উত্তম মৃত্যু
ভালো মৃত্যুর আলামত কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত। মৃত্যুর সময় সর্বশেষ কথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, কপালের ঘাম বের হওয়া, জুমার দিনে মৃত্যু হওয়া এবং আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হওয়া। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির সর্বশেষ কথা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৩১১৬)
শহিদ মৃত্যু হিসেবে গণ্য হয়: প্লেগ, পেটের পীড়া, পানিতে ডুবে মৃত্যু, ধ্বসে পড়ে মৃত্যু, সন্তান প্রসবকালে মৃত্যু, এবং আল্লাহর রাস্তায় নিহত হওয়া। (বুখারি: ২৮২৯; মুসলিম: ১৯১৫)
এই লক্ষণগুলো মুমিনের জন্য সান্ত্বনার বার্তা বহন করে, তবে নিশ্চিতভাবে জান্নাত প্রাপ্তি কেবল আল্লাহর অনুমতি অনুযায়ী হবে।
মৃত্যুর আগে জরুরি করণীয়
মৃত্যুর আগে প্রয়োজনীয় ওসিয়ত, তাওবা ও ইস্তেগফার অপরিহার্য। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ বান্দার তাওবা গ্রহণ করেন, যতক্ষণ না তার গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়।’ (তিরমিজি: ৩৫৩৭) এছাড়াও সন্তান ও আত্মীয়দের উচিত মৃত্যুর সময় কলেমা উচ্চারণের জন্য উৎসাহিত করা। (মুসলিম: ৯১৬)
মৃত্যু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোরআন ও সুন্নাহ অনুসারে মৃত্যুর আগে আত্মিক প্রস্তুতি এবং মৃত্যুর মুহূর্তের উপলব্ধিই পরকালীন সাফল্যের চাবিকাঠি। মুসলিম হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো নেক কাজ বৃদ্ধি, তাওবা ও দোয়ার মাধ্যমে মৃত্যু এবং পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত থাকা।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে মৃত্যু দেওয়ার আগেই তওবা করার তাওফিক দিন, মৃত্যুর সময় কলেমা উচ্চারণ করার শক্তি দিন এবং মৃত্যু-পরবর্তী সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ইহজীবনে সুন্দর প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমিন।







