ভ্রষ্ট পথিক

সুলেখা আক্তার শান্তা :
নঈম একটি বেসরকারি ব্যাংকে আইটিতে চাকরি করে। সুদর্শন তরুণ। স্মার্ট কর্মদক্ষতায় প্রতিষ্ঠিত। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে বিদেশে ট্রেনিংয়ের অফার পেল। স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় ছয় মাসের ট্রেনিং। নঈম উত্তেজনা লুকিয়ে রেখে কথাটা স্ত্রীকে বলে। প্রথমে শিউলি পুলকিত হলেও নানা অজানা আশঙ্কায় উৎসাহ হারায়। বলে, তোমাকে ছাড়া এতদিন থাকবো কি করে। নঈম উজ্জল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। শিউলি সম্মত হয়। নঈম প্রস্তুতি শেষ করে যাত্রা করে আমেরিকায়।
নিউইয়র্ক শহর যেন পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র। নঈম অপার বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে। ট্রেনিং শুরু হলে বুঝতে পারে যত কঠিন মনে করেছিল ততটা নয়। সবকিছু তার আয়ত্তের মধ্যেই। সপ্তাহে দুদিন ছুটি কোন কোন দিন সকালে দুই ঘন্টা ক্লাস। সারাদিন অখন্ড অবসর। একদিন ট্যাক্সি চড়েলে পরিচয় হয় বাংলাদেশের ছেলে জহিরের সঙ্গে। জহির উচ্চ শিক্ষিত হয়েও কেন ট্যাক্সি চালায় জানতে চায়। দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়টি বুঝতে পেরে বলে, ট্যাক্সি চালানো এখানে কোন অমর্যাদার কাজ নয় আর উপার্জনও অনেক বেশি। স্বাধীন কাজ। নিউইয়র্কে পার্কিং সমস্যা প্রকট। নিজের গাড়ি নিয়ে বের হাওয়ার এখানে বিরাট বিরম্বনা। নঈম সুপ্ত বাসনা প্রকাশ করে। সারাদিন প্রায় বসেই থাকতে হয়। কোন কাজ পেলে মন্দ হতো না। জহির বিস্তারিত শুনে জিজ্ঞেস করে, গাড়ী চালাতে পারেন? শুধু পারা নয় খুব ভালোভাবে কাজটা পারে পারি। কাজে লাগতে পারে ভেবে আসার সময় ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্সটাও করে নিয়ে এসেছে। জহির সংকোচ কাটিয়ে বলে আগ্রহী হলে ড্রাইভিং এর কাজের ব্যবস্থা হয়তো করা যেতে পারে। তা করতে পারব কিন্তু রাস্তাঘাট চিনব কি করে? এখানে যারা থাকে তারাও সবাই রাস্তাঘাট চেনে না। জিপিএস এর নির্ভুল দিকনির্দেশনাতে সবাই চলাফেরা করে। জিপিএস এখন দেশেও বহুল পরিচিত এবং ব্যবহৃত। নঈম জানে চেনাদের ও ভুল হয় কিন্তু জিপিএস ভুল করে না।
হিতৈষী জহির খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নঈমকে দুদিন ট্রেনিং দিল। দেশে গাড়ি চলে বাঁ দিক এখানে ডানে। এটাই একটু খেয়াল রাখতে হবে। জহিরের আন্তরিকতা দেখে আশ্চর্য হয়ে নঈম। শুরুতে একটু খটকা লাগলেও দুদিনে ঠিক হয়ে যায়। মনে পড়ে বন্ধু তারেকের কথা তার চেষ্টাতেই নঈমের আইটি পড়াশোনা আর ড্রাইভিং শেখা। জীবনে আজ খুব সফলভাবে কাজে লাগলো বিদ্যা গুলো। নঈম খুশি মনে স্ত্রী শিউলিকে জানায়, একটা কাজ করছি ভালোই ইনকাম হবে।
একদিন একটা ফোন কল পেল ট্যাক্সির জন্য। একজন মহিলাকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে। যথাসময়ে সেখানে পৌঁছে গেল নঈম। বিরাট বাড়ি। গাড়ি সামনে আসতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেট খুলে গেল। একজন মধ্যবয়সী সুন্দরী মহিলা যাত্রী। নামকরা এক হসপিটালে যাবে। কিছুদুর যাওয়ার পর জিপিএস রুটে লাল দেখায় অর্থাৎ সামনে প্রচুর জ্যাম। গন্তব্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। বিকল্প রাস্তায় গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। যাত্রীর সম্মতি নিয়ে বিকল্প রাস্তা ধরে হসপিটালে পৌঁছে গেল এবং উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা প্রশংসিত হলো। নির্দিষ্ট ভাড়ার উপর মহিলা তাকে দুই শত ডলার অতিরিক্ত দিল। টিপস দেওয়ার একটা প্রচলন আছে কিন্তু পরিমাণটা একটু বেশি। নঈম আশ্চর্য হয়। মহিলা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। নঈমের সন্দেহ হলো মহিলা টোলে পড়ে যেতে পারে। সে মহিলাকে গাড়িতে বসতে বলে হুইল চেয়ার নিয়ে এসে নিজেই হসপিটালের ভেতরে পৌঁছে দিলো। মহিলা ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে আবার ফেরত নিয়ে যেতে পারবে কিনা ক্ষীণকণ্ঠে জানতে চাইল। নঈম সম্মতি জানিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। মহিলা ফিরে এসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। এখানে ব্যক্তিগত বিষয় জানতে চাওয়ার অসৌজন্যতা সম্পর্কে সে সচেতন ছিল। তবুও কৌতুহল দমন করতে না পেরে অসুস্থতা নিয়ে কথা বলে। জানতে পারে মহিলা ক্যান্সার আক্রান্ত। পরেরদিন তাকে আবার হসপিটালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা জানতে চায় মহিলা। নঈম জানায় সেটা সম্ভব। বাড়িতে পৌঁছে আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অতিরিক্ত দুই শত ডলার দেয়। হিসাব করে দেখে আজ নঈমের আয় প্রায় এক লক্ষ টাকা। ভাগ্য প্রসন্ন হওয়ায়র উত্তেজনা নিয়ে রাত্রে শিউলিকে ফোন করে। টাকার অংকের কথা জানাতেও ভুল করে না। শিউলির কাছে বড় অঙ্কের টাকা পাঠায়।
পরদিন যথারীতি নঈম উপস্থিত হয় মহিলার বাড়িতে। হসপিটালে পৌঁছে সে হুইল চেয়ারের প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চায়। মহিলার একটু হেসে বলে আজ সে প্রয়োজন নাই। অনুরোধ করে ফেরত যাত্রায় তাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা। নঈম জিজ্ঞেস করে, তোমার কি খুব বেশি দেরি হবে। মহিলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওভার ওয়েটিং চার্জ পরিশোধ করা হবে বলে জানায়। আগের লেনদেনের বর্ধিত পরিমাণ নিয়ে সে যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিল। দুদিন পরে আবার বুকিং নিয়ে ফিরে যায় নঈম। বিষয়টা নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। মহিলাকে হাসপাতালে আনা নেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন প্রয়োজনে ডাক পড়ে তার। কথা প্রসঙ্গে জানে মহিলার নাম এলিজাবেথ। সৌন্দর্যের বিচারে যথেষ্ট সুন্দরী সে। রোগক্লিষ্টতায় সেই সৌন্দর্য এতোটুকু ম্লান হয়নি। নঈমের ভালোই লাগে মহিলার শান্ত সৌম্য আচরণ। উভয়ের আবশ্যকতা তৈরি করে সৌজন্যমূলক এক আন্তরিক সম্পর্ক। এলিজাবেথের স্বামী এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্বামীর সকল ধন সম্পদের মালিক হয় স্ত্রী। এলিজাবেথের শরীরে বাসা বাঁধা মরণব্যাধি তার সমস্ত সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে। এলিজাবেথের জীবন কাহিনী শুনে নঈমের মন ভারাক্রান্ত হয়। নির্ভরতা সম্পর্কে দায়িত্ববোধের সৃষ্টি করে। হয়তো মমতার বন্ধনও।
সময় বয়ে চলে। নঈমের দেশে ফেরার সময় এগিয়ে আসে। হঠাৎ একদিন জরুরী ফোন আসে। এলিজাবেথ গুরুতর অসুস্থ। নঈম দ্রুত উপস্থিত হয়। অবস্থাদৃষ্টে বুঝতে পারে ট্যাক্সি নয় অ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে হসপিটালে নিতে হবে। এম্বুলেন্সে এলিজাবেথ শক্ত করে নঈমের হাতটা ধরে রাখে। আকুতি জানায় সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেন তাকে ছেড়ে না যায় নঈম। কিন্তু সেটা হবার নয় সেদিনই নঈমের দেশে ফেরার ফ্লাইট। এলিজাবেথের মুমূর্ষ অবস্থায় সে চুপ করে থাকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এখনো যথেষ্ট সময় আছে। হয়তো এর মধ্যেই এলিজাবেথ সুস্থ হয়ে উঠবে। হসপিটালের ভেতর নিয়ে যাবার সময় এলিজাবেথ কাতর কণ্ঠে বলে, ডোন্ট লিভ মি এলোন। সম্মতি সূচক মাথা নাড়লে এলিজাবেথ নঈমের হাত ছেড়ে দেয়, তাকে হসপিটালে ভেতর নেওয়া হয়। এলিজাবেথের সুস্থতা এবং ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে আসা নিয়ে নঈমের উদ্বেগের মুহূর্ত কাটতে থাকে। এলিজাবেথের করুণ আর্তি, আমাকে একা ছেড়ে যেও না প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তার মনে। কিছু করার নেই। একেবারে প্রান্তিক সময় হাতে নিয়ে সে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দেয়। নঈমের দুর্ভাগ্য, জ্যামের কারণে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে বিলম্ব হাওয়ায় সে ফ্লাইট মিস করে। তার ভিসার মেয়াদও সেই দিন শেষ। অর্থাৎ তাকে এক বিরাট আইনি জটিলতার মধ্যে পড়তে হবে। নিজেকে একটু গুছিয়ে হসপিটালে গেল এলিজাবেথকে দেখতে। এলিজাবেথের চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। তার কারণ কতটুকু রোগ-যন্ত্রণা আর কতটুকু নঈমের ফিরে আসা বোঝা গেল না।
একটু সুস্থ হওয়ার পর এলিজাবেথ বিভিন্ন অফিসে ঘুরে নঈমের স্বদেশ যাত্রার বাধা নিরসনের চেষ্টা করে। ব্যাপারটা খুব সহজ না হাওয়ায় সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রিতার। তবে কালক্ষেপণ নঈম আর এলিজাবেথকে অদৃশ্য এক মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করতে থাকে। দেশে ফেরা নিয়ে আইনি জটিলতায় হতাশ হয়ে পড়ে নঈম। এক সময় তার জেলে যাবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঘটনার সন্ধিক্ষণে এলিজাবেথ অদ্ভুত এক প্রস্তাব করে বসে। তুমি আমাকে বিয়ে করো। আইনি জটিলতা মুক্ত হতে এমন ব্যবস্থার কথা সে শুনেছে কিন্তু তা আজ তার নিজের সামনেই হাজির। নঈম নিজের সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে হয়তো এই অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না। মৃত্যুপথযাত্রী একজনকে কল্পনা ভঙ্গের ব্যথা না দিয়ে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করে সে। যেকোনো সময় এলিজাবেথের জীবনে অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত হতে পারে। জীবনের যে কটা দিন অবশিষ্ট আছে আনন্দে থাকার আকুতি জানায়। বিস্ময়কর মানুষের মন আরো বিস্ময়কর মানুষের সিদ্ধান্ত। নঈম আর এলিজাবেথের বিয়ে হয়। জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সঙ্গে শুরু হয় বৈধতার কাগজপত্র তৈরি, গ্রীন কার্ড, পাসপোর্ট ইত্যাদি প্রক্রিয়া।
দেশে শিউলির অধৈর্য অপেক্ষার সময় একদিন হঠাৎ প্রতিঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। বিয়ে বাড়ির এক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে। শিউলি তার কাছ থেকে নিউ ইয়র্কে নঈমের বিয়ের কথা জানতে পারে। নঈমের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় শিউলি। অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারে না নঈম। এরমধ্যে কেটে যায় চার বছর। বৈধ সব কাগজপত্র তখন নঈম পেয়ে গেছে। কিন্তু এলিজাবেথের অসুস্থতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্তিম মুহূর্তে এসে হাজির। এলিজাবেথ শায়িত হয় অন্তিম শয়ানে। বিশাল সম্পদ সম্পত্তির দায়িত্ব এসে পড়ে নঈমের কাঁধে। সমস্ত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে সে যখন দেশের পথে পা বাড়ায় দেখে সময় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। দেশে গিয়ে অনেক খোঁজ করেও শিউলির কোন সন্ধান পায় না নঈম। একদিন অভিজাত এক শপিং মলে নঈম দেখতে পায় শিউলিকে। বাচ্চা কোলে স্বামীর সঙ্গে মার্কেটিং এ ব্যস্ত। দীর্ঘশ্বাস চেপে এগিয়ে যেতে গিয়েও পিছিয়ে আসে সে। জীবনের গোলকধাঁধা তাকে উপহার দিয়েছে বিচিত্র এক ভাগ্য। সে ফিরে গেল নিউ ইয়র্কে। এলিজাবেথের কবরে ফুল দিয়ে নীরবে তাকিয়ে রইল। ভাবে জীবনটা কেন এমন এলোমেলো হলো।
Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বিএনপির আন্দোলন সফল হবে না, পরিষ্কার ধারণা ছিল : জিএম কাদের

» চিফ হিট অফিসার ডিএনসিসির কেউ নন : মেয়র আতিক

» হলিউডের সিনেমাকে ‘না’ বললেন ক্যাটরিনা!

» আগামীকাল থেকে খুলছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, তাপদাহে যেভাবে চলবে ক্লাস

» ৪৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম কালবৈশাখী এপ্রিলে

» আজকের খেলা

» উন্নয়নের ভেলকিতে বাংলাদেশ এখন মৃত্যু উপত্যকা: রিজভী

» মেয়র আতিক চিফ হিট অফিসারের পরামর্শে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ ব্যবস্থা

» শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

» শেরে বাংলার কর্মপ্রচেষ্টা নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ভ্রষ্ট পথিক

সুলেখা আক্তার শান্তা :
নঈম একটি বেসরকারি ব্যাংকে আইটিতে চাকরি করে। সুদর্শন তরুণ। স্মার্ট কর্মদক্ষতায় প্রতিষ্ঠিত। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে বিদেশে ট্রেনিংয়ের অফার পেল। স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় ছয় মাসের ট্রেনিং। নঈম উত্তেজনা লুকিয়ে রেখে কথাটা স্ত্রীকে বলে। প্রথমে শিউলি পুলকিত হলেও নানা অজানা আশঙ্কায় উৎসাহ হারায়। বলে, তোমাকে ছাড়া এতদিন থাকবো কি করে। নঈম উজ্জল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। শিউলি সম্মত হয়। নঈম প্রস্তুতি শেষ করে যাত্রা করে আমেরিকায়।
নিউইয়র্ক শহর যেন পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র। নঈম অপার বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে। ট্রেনিং শুরু হলে বুঝতে পারে যত কঠিন মনে করেছিল ততটা নয়। সবকিছু তার আয়ত্তের মধ্যেই। সপ্তাহে দুদিন ছুটি কোন কোন দিন সকালে দুই ঘন্টা ক্লাস। সারাদিন অখন্ড অবসর। একদিন ট্যাক্সি চড়েলে পরিচয় হয় বাংলাদেশের ছেলে জহিরের সঙ্গে। জহির উচ্চ শিক্ষিত হয়েও কেন ট্যাক্সি চালায় জানতে চায়। দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়টি বুঝতে পেরে বলে, ট্যাক্সি চালানো এখানে কোন অমর্যাদার কাজ নয় আর উপার্জনও অনেক বেশি। স্বাধীন কাজ। নিউইয়র্কে পার্কিং সমস্যা প্রকট। নিজের গাড়ি নিয়ে বের হাওয়ার এখানে বিরাট বিরম্বনা। নঈম সুপ্ত বাসনা প্রকাশ করে। সারাদিন প্রায় বসেই থাকতে হয়। কোন কাজ পেলে মন্দ হতো না। জহির বিস্তারিত শুনে জিজ্ঞেস করে, গাড়ী চালাতে পারেন? শুধু পারা নয় খুব ভালোভাবে কাজটা পারে পারি। কাজে লাগতে পারে ভেবে আসার সময় ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্সটাও করে নিয়ে এসেছে। জহির সংকোচ কাটিয়ে বলে আগ্রহী হলে ড্রাইভিং এর কাজের ব্যবস্থা হয়তো করা যেতে পারে। তা করতে পারব কিন্তু রাস্তাঘাট চিনব কি করে? এখানে যারা থাকে তারাও সবাই রাস্তাঘাট চেনে না। জিপিএস এর নির্ভুল দিকনির্দেশনাতে সবাই চলাফেরা করে। জিপিএস এখন দেশেও বহুল পরিচিত এবং ব্যবহৃত। নঈম জানে চেনাদের ও ভুল হয় কিন্তু জিপিএস ভুল করে না।
হিতৈষী জহির খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নঈমকে দুদিন ট্রেনিং দিল। দেশে গাড়ি চলে বাঁ দিক এখানে ডানে। এটাই একটু খেয়াল রাখতে হবে। জহিরের আন্তরিকতা দেখে আশ্চর্য হয়ে নঈম। শুরুতে একটু খটকা লাগলেও দুদিনে ঠিক হয়ে যায়। মনে পড়ে বন্ধু তারেকের কথা তার চেষ্টাতেই নঈমের আইটি পড়াশোনা আর ড্রাইভিং শেখা। জীবনে আজ খুব সফলভাবে কাজে লাগলো বিদ্যা গুলো। নঈম খুশি মনে স্ত্রী শিউলিকে জানায়, একটা কাজ করছি ভালোই ইনকাম হবে।
একদিন একটা ফোন কল পেল ট্যাক্সির জন্য। একজন মহিলাকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে। যথাসময়ে সেখানে পৌঁছে গেল নঈম। বিরাট বাড়ি। গাড়ি সামনে আসতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেট খুলে গেল। একজন মধ্যবয়সী সুন্দরী মহিলা যাত্রী। নামকরা এক হসপিটালে যাবে। কিছুদুর যাওয়ার পর জিপিএস রুটে লাল দেখায় অর্থাৎ সামনে প্রচুর জ্যাম। গন্তব্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। বিকল্প রাস্তায় গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। যাত্রীর সম্মতি নিয়ে বিকল্প রাস্তা ধরে হসপিটালে পৌঁছে গেল এবং উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা প্রশংসিত হলো। নির্দিষ্ট ভাড়ার উপর মহিলা তাকে দুই শত ডলার অতিরিক্ত দিল। টিপস দেওয়ার একটা প্রচলন আছে কিন্তু পরিমাণটা একটু বেশি। নঈম আশ্চর্য হয়। মহিলা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। নঈমের সন্দেহ হলো মহিলা টোলে পড়ে যেতে পারে। সে মহিলাকে গাড়িতে বসতে বলে হুইল চেয়ার নিয়ে এসে নিজেই হসপিটালের ভেতরে পৌঁছে দিলো। মহিলা ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে আবার ফেরত নিয়ে যেতে পারবে কিনা ক্ষীণকণ্ঠে জানতে চাইল। নঈম সম্মতি জানিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। মহিলা ফিরে এসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। এখানে ব্যক্তিগত বিষয় জানতে চাওয়ার অসৌজন্যতা সম্পর্কে সে সচেতন ছিল। তবুও কৌতুহল দমন করতে না পেরে অসুস্থতা নিয়ে কথা বলে। জানতে পারে মহিলা ক্যান্সার আক্রান্ত। পরেরদিন তাকে আবার হসপিটালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা জানতে চায় মহিলা। নঈম জানায় সেটা সম্ভব। বাড়িতে পৌঁছে আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অতিরিক্ত দুই শত ডলার দেয়। হিসাব করে দেখে আজ নঈমের আয় প্রায় এক লক্ষ টাকা। ভাগ্য প্রসন্ন হওয়ায়র উত্তেজনা নিয়ে রাত্রে শিউলিকে ফোন করে। টাকার অংকের কথা জানাতেও ভুল করে না। শিউলির কাছে বড় অঙ্কের টাকা পাঠায়।
পরদিন যথারীতি নঈম উপস্থিত হয় মহিলার বাড়িতে। হসপিটালে পৌঁছে সে হুইল চেয়ারের প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চায়। মহিলার একটু হেসে বলে আজ সে প্রয়োজন নাই। অনুরোধ করে ফেরত যাত্রায় তাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা। নঈম জিজ্ঞেস করে, তোমার কি খুব বেশি দেরি হবে। মহিলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওভার ওয়েটিং চার্জ পরিশোধ করা হবে বলে জানায়। আগের লেনদেনের বর্ধিত পরিমাণ নিয়ে সে যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিল। দুদিন পরে আবার বুকিং নিয়ে ফিরে যায় নঈম। বিষয়টা নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। মহিলাকে হাসপাতালে আনা নেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন প্রয়োজনে ডাক পড়ে তার। কথা প্রসঙ্গে জানে মহিলার নাম এলিজাবেথ। সৌন্দর্যের বিচারে যথেষ্ট সুন্দরী সে। রোগক্লিষ্টতায় সেই সৌন্দর্য এতোটুকু ম্লান হয়নি। নঈমের ভালোই লাগে মহিলার শান্ত সৌম্য আচরণ। উভয়ের আবশ্যকতা তৈরি করে সৌজন্যমূলক এক আন্তরিক সম্পর্ক। এলিজাবেথের স্বামী এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্বামীর সকল ধন সম্পদের মালিক হয় স্ত্রী। এলিজাবেথের শরীরে বাসা বাঁধা মরণব্যাধি তার সমস্ত সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে। এলিজাবেথের জীবন কাহিনী শুনে নঈমের মন ভারাক্রান্ত হয়। নির্ভরতা সম্পর্কে দায়িত্ববোধের সৃষ্টি করে। হয়তো মমতার বন্ধনও।
সময় বয়ে চলে। নঈমের দেশে ফেরার সময় এগিয়ে আসে। হঠাৎ একদিন জরুরী ফোন আসে। এলিজাবেথ গুরুতর অসুস্থ। নঈম দ্রুত উপস্থিত হয়। অবস্থাদৃষ্টে বুঝতে পারে ট্যাক্সি নয় অ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে হসপিটালে নিতে হবে। এম্বুলেন্সে এলিজাবেথ শক্ত করে নঈমের হাতটা ধরে রাখে। আকুতি জানায় সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেন তাকে ছেড়ে না যায় নঈম। কিন্তু সেটা হবার নয় সেদিনই নঈমের দেশে ফেরার ফ্লাইট। এলিজাবেথের মুমূর্ষ অবস্থায় সে চুপ করে থাকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এখনো যথেষ্ট সময় আছে। হয়তো এর মধ্যেই এলিজাবেথ সুস্থ হয়ে উঠবে। হসপিটালের ভেতর নিয়ে যাবার সময় এলিজাবেথ কাতর কণ্ঠে বলে, ডোন্ট লিভ মি এলোন। সম্মতি সূচক মাথা নাড়লে এলিজাবেথ নঈমের হাত ছেড়ে দেয়, তাকে হসপিটালে ভেতর নেওয়া হয়। এলিজাবেথের সুস্থতা এবং ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে আসা নিয়ে নঈমের উদ্বেগের মুহূর্ত কাটতে থাকে। এলিজাবেথের করুণ আর্তি, আমাকে একা ছেড়ে যেও না প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তার মনে। কিছু করার নেই। একেবারে প্রান্তিক সময় হাতে নিয়ে সে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দেয়। নঈমের দুর্ভাগ্য, জ্যামের কারণে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে বিলম্ব হাওয়ায় সে ফ্লাইট মিস করে। তার ভিসার মেয়াদও সেই দিন শেষ। অর্থাৎ তাকে এক বিরাট আইনি জটিলতার মধ্যে পড়তে হবে। নিজেকে একটু গুছিয়ে হসপিটালে গেল এলিজাবেথকে দেখতে। এলিজাবেথের চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। তার কারণ কতটুকু রোগ-যন্ত্রণা আর কতটুকু নঈমের ফিরে আসা বোঝা গেল না।
একটু সুস্থ হওয়ার পর এলিজাবেথ বিভিন্ন অফিসে ঘুরে নঈমের স্বদেশ যাত্রার বাধা নিরসনের চেষ্টা করে। ব্যাপারটা খুব সহজ না হাওয়ায় সৃষ্টি হয় নানা জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রিতার। তবে কালক্ষেপণ নঈম আর এলিজাবেথকে অদৃশ্য এক মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করতে থাকে। দেশে ফেরা নিয়ে আইনি জটিলতায় হতাশ হয়ে পড়ে নঈম। এক সময় তার জেলে যাবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঘটনার সন্ধিক্ষণে এলিজাবেথ অদ্ভুত এক প্রস্তাব করে বসে। তুমি আমাকে বিয়ে করো। আইনি জটিলতা মুক্ত হতে এমন ব্যবস্থার কথা সে শুনেছে কিন্তু তা আজ তার নিজের সামনেই হাজির। নঈম নিজের সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে হয়তো এই অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না। মৃত্যুপথযাত্রী একজনকে কল্পনা ভঙ্গের ব্যথা না দিয়ে চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করে সে। যেকোনো সময় এলিজাবেথের জীবনে অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত হতে পারে। জীবনের যে কটা দিন অবশিষ্ট আছে আনন্দে থাকার আকুতি জানায়। বিস্ময়কর মানুষের মন আরো বিস্ময়কর মানুষের সিদ্ধান্ত। নঈম আর এলিজাবেথের বিয়ে হয়। জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সঙ্গে শুরু হয় বৈধতার কাগজপত্র তৈরি, গ্রীন কার্ড, পাসপোর্ট ইত্যাদি প্রক্রিয়া।
দেশে শিউলির অধৈর্য অপেক্ষার সময় একদিন হঠাৎ প্রতিঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। বিয়ে বাড়ির এক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে। শিউলি তার কাছ থেকে নিউ ইয়র্কে নঈমের বিয়ের কথা জানতে পারে। নঈমের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় শিউলি। অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারে না নঈম। এরমধ্যে কেটে যায় চার বছর। বৈধ সব কাগজপত্র তখন নঈম পেয়ে গেছে। কিন্তু এলিজাবেথের অসুস্থতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্তিম মুহূর্তে এসে হাজির। এলিজাবেথ শায়িত হয় অন্তিম শয়ানে। বিশাল সম্পদ সম্পত্তির দায়িত্ব এসে পড়ে নঈমের কাঁধে। সমস্ত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে সে যখন দেশের পথে পা বাড়ায় দেখে সময় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। দেশে গিয়ে অনেক খোঁজ করেও শিউলির কোন সন্ধান পায় না নঈম। একদিন অভিজাত এক শপিং মলে নঈম দেখতে পায় শিউলিকে। বাচ্চা কোলে স্বামীর সঙ্গে মার্কেটিং এ ব্যস্ত। দীর্ঘশ্বাস চেপে এগিয়ে যেতে গিয়েও পিছিয়ে আসে সে। জীবনের গোলকধাঁধা তাকে উপহার দিয়েছে বিচিত্র এক ভাগ্য। সে ফিরে গেল নিউ ইয়র্কে। এলিজাবেথের কবরে ফুল দিয়ে নীরবে তাকিয়ে রইল। ভাবে জীবনটা কেন এমন এলোমেলো হলো।
Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com