অন্ধকারের স্বপ্নেরা

মণিজিঞ্জির সান্যাল:
বাস থেকে নেমে হাঁটছিল বর্ষা। পাকা রাস্তাটা সোজা চলে গেছে বহুদূরে। অচেনা অজানা জায়গায় বেশ একটা উষ্ণ স্পন্দন সে টের পাচ্ছিল। এক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে এখানে আসা। আর আছে গুণীজন সংবর্ধনা। জায়গাটাতে বর্ষার আজ প্রথম আসা। নামটাও শোনেনি সে কোনদিন। কি যেন নামটা? মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়েছে বর্ষার, ‘কলাগাছ’। বাস থেকে নেমে আমন্ত্রণপত্রটা বের করে ঠিকানাটা আর একবার দেখে নিল। একদম নিস্তব্ধ চারপাশ, সুনসান জনপদ।

ভোরবেলা উঠে স্নান সেরে সেখানে যাবার একটা প্রস্তুতি চলছিল মনে মনে। মনটা সেদিন একা একাই কত কথা বলছিল। বর্ষা একবার ভাবল যাবে না, আর একবার ভাবল ‘না যাই।’ আয়োজকরা কত আগে থেকে নিমন্ত্রণ করেছেন। সে ডাকের মধ্যে আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সবকিছুই ছিল। তাদের আমন্ত্রণকে কি উপেক্ষা করা উচিত?

 

আসলে মনের সাথে অনবরত লড়তে হয় বর্ষাকে। ভীষণ একটা মন খারাপ করা রোগ আছে ওর। কথায় কথায় মন খারাপ, কেন যে এমন মন খারাপ হয় কে জানে। সব সময় মনে হয় যেখানে যাব, মন খারাপ নিয়ে ফিরে আসব না তো?

 

যে বাসটাতে বর্ষা এসেছিল সেটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেটা। আর কিছু ধুলো ছড়িয়ে দিল রাস্তার দু’ধারে। ঠিকানাটা ছিল ডি.বি.এম. ওল্ড এজ হোম অ্যান্ড ব্লাইন্ড স্কুল। আমন্ত্রণপত্র হাতে পেয়ে মনে হয়েছিল যত প্রতিকূলতাই থাক যেতে হবে সেখানে, অন্তত নিজেকে জানার জন্য তো যেতেই হবে।

একটা ভ্যান রিক্সা চলে গেল। মাটির একটা গন্ধ সে টের পেল তক্ষুনি। কোনদিনও ভ্যানে চড়েনি বর্ষা। হাত নাড়িয়ে থামাল চালককে। উঠে বসল সেই ভ্যানে। সামনে দুজন মধ্যবয়সী পুরুষ, পেছনে অল্প বয়সী এক গৃহবধূ। জীবনে প্রথম ভ্যানে চড়ে যাচ্ছে বর্ষা। কি যে মজা লাগছে। মাথার ওপর সুবিস্তৃত খোলা আকাশ, দুদিকে সবুজের সমারোহ, সে এক অদ্ভুত বাতাবরণ, যাকে ঠিক ভাষায় ব্যক্ত করা যায়না।

ভ্যানচালকের গানের সুরকে বর্ষা হঠাৎ যেন অনুভব করল, মনে হলো সুরটা কেমন যেন চেনা চেনা। মনে পড়ল, অনেকদিন আগে সে যখন গঙ্গায় লঞ্চে করে ঘুরছিল, ঠিক সেই সময় এক কিশোর আপন-মনে দেখে যাচ্ছিল প্রকৃতিকে, জলে দোলাচলকে। বর্ষা ভাবল আজও কি সেই কিশোর অপার বিস্ময় এই প্রকৃতিকে দেখে? প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের রহস্যকে কি সে আগের মত করেই অনুভব করে? কিংবা সেই সেবার দক্ষিণেশ্বর থেকে বেলুড় মঠে নৌকো করে যাবার পথে মাঝির সুরেলা কন্ঠস্বর, যা আজও চোখ বুজলে সে পরিষ্কার শুনতে পায়। আর মায়ের কোলে বসা ওই ছোট্ট শিশুর দুচোখ ভরা বিস্ময়, যে শিশুটি নৌকোর রূপের সাথে প্রকৃতির রূপকে মেলানোর চেষ্টা করছিল অনবরত। সে নিশ্চয়ই এতদিনে অনেক বড় গেছে। তার অনুভূতির জায়গাটা শৈশবের অনুভূতির মত বেঁচে আছে কি?

নৌকার মাঝির সেই সুরেলা কন্ঠস্বর কিভাবে যেন এসে মিশে গেল ভ্যানচালকের সুরের মধ্যে। বহু বছর আগের সেই সুর বাতাসের মধ্যে দিয়ে কিভাবে যেন এসে ধরা দিলো আজকের এই সুরের মধ্যে। সেই সুরের মধ্যে ধরা দিল অজস্র ছবি, স্মৃতিমধুর কত কথা, গান, কবিতা, আরো কতো কি। এখনো পরিস্কার মনে আছে সেইসব কথা, সেইসব দিনগুলোর ছবি …

সেদিন সুজনের কাঁধে মাথা রেখে বর্ষাও জলের স্পন্দনকে অনুভব করছিল, তির তির করে কাঁপছিলো বর্ষার ঠোঁট, সুজন তাতে স্পর্শ করছিল মাঝে মাঝে। আলতো করে জড়িয়ে ধরছিল বর্ষার কোমর। অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছিল বর্ষার শিরায় শিরায়। ভালো লাগার উষ্ণ স্পর্শে মাঝে মাঝেই চোখ বুঝছিল বর্ষা, মনে হচ্ছিল অনন্তকাল এইভাবে সুজনের সাথে ভেসে বেড়াবে নৌকার মধ্যে, আর মাঝি তার সুরেলা কন্ঠেস্বরের জাদু ছড়িয়ে দেবে আকাশে বাতাসে ওই দুর দুরান্তে।

বর্ষা হঠাৎ বলেছিল ‘আমাকে ছেড়ে তুমি কখনো চলে যাবে না তো ? আমি যে ভীষণ কষ্ট পাবো তাহলে!’

–কেন এসব ভাবছো সোনা? তোমার মত এমন একটা মিষ্টি মেয়েকে কখনও কষ্ট দেওয়া যায়?

–তবুও ভয় করে সুজন। এত গভীর ভাবে তোমার কাছে এসেছি।

সুজন আরো জোরে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলেছিল কতো কি। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছিল বর্ষা। 

পাহাড়ের কোলে একটা বাংলো বানাবে বলেছে সুজন। ছোট্ট একটা বাংলো, পাশে থাকবে গোলাপ আর গোলাপ। গোলাপের চাষ করবে সুজন। বর্ষাকে বলেছে তার স্বপ্নের কথাগুলো। “পাহাড়ি নদীর ধারে তোমার হাতে হাত রেখে অনন্ত কাল আমি বসে থাকব। আমি কবিতা লিখব আর তুমি তোমার কণ্ঠস্বর দিয়ে মাতিয়ে তুলবে সেই কবিতার মর্মস্পর্শী রূপকে। তোমার সেই কণ্ঠস্বর পাহাড়ি ঝর্ণার সাথে একাত্ম হবে। আমি তোমাকে চুমু খাব, আদর করব। সূর্যাস্ত এসে আমাদের শরীরের ওপর একটা লাল, হলুদ চাদর টেনে দেবে। সেই চাদরের লঙ ধীরে ধীরে কালো হবে, আমরা তখন আরো গাঢ় হবো, আরো আরো…”

বর্ষার দুচোখ জলে ভরে ওঠে। ওর মতো সহজ সরল একটা মেয়েকে এত স্বপ্ন দেখাতে পারে! এতটাই কাল্পনিক! সবটাই মিথ্যে!

— দিদি আপনি নামবেন না? এসে গেছে আপনার আশ্রম।

— হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো। কত ভাড়া? চমকে ওঠে বর্ষা।কতোদিন আগের সেই স্মৃতিগুলো এখনও কেমন জ্বলজ্বলে, ভেবে অবাক হয় বর্ষা।

— পাঁচ টাকা ।

— পাঁচ টাকা! পাঁচ টাকা আবার ভাড়া আছে নাকি? বর্ষা ভ্যানচালকের হাতে দশ টাকা দিতেই দেখতে পেল এক প্রশান্ত মুখ, তাতে কিছুটা বিস্ময়। কিছুক্ষণ পরেই একটা সুন্দর হাসি, যে হাসিটা বর্ষা অনেকদিন পরে দেখতে পেল, যে হাসিটা আজকের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যায় না, অদ্ভুত এক মন ভাল করা ওষুধ।

বর্ষা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল মূল অনুষ্ঠানের প্রাঙ্গণে। সবুজে সবুজে ঘেরা চারপাশ, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে আশ্রমটা, তাকে সাজানো হয়েছে রংবেরঙের কাপড়ে। সঞ্চালকের কণ্ঠস্বর এসে পৌঁছল ওর কানে। শেষবারের মতো দেখে নিল অনেক দূরে চলে যাওয়া যাত্রীবাহী সেই ভ্যান চালককে। মনে মনে ভাবল, আর কখনও কি দেখা হবে তার সাথে?

সুন্দর আয়োজন করেছেন আয়োজকেরা।

— শরীর মন দুটোই ভালো আছে তো ? 

আয়োজকের মুল কর্তা রসিক বটে, সবচেয়ে বড়কথা মনটাও চমৎকার। সবাই বড় ভালো, যেন একটা মন ভালো করা ওষুধ খেল বর্ষা। ওষুধটা হলো সেখানকার নিস্তব্ধ বাতাবরণ।

চোখে দেখতে না পাও ছোট ছোট শিশুগুলি গান শোনালো, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’।’ একেই কি বলে স্রষ্টার সৃষ্টি?

‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ’

এই কথাগুলো বলে বর্ষারই তো উচিত একটু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা, তা না করে বর্ষা নিজেই নিজের মনের আলো খুঁজে বেড়াতে লাগল।

আশ্রমের একদিকে গোলাপী, আর লাল গোলাপের সমারোহ। আর একদিকে সবুজের ছোঁয়া, কিন্তু আশ্চর্য এক কান্ড ঘটল, সব কিছুকেই বর্ষা অন্য রূপে, অন্য রঙ-এ দেখতে লাগল। চারপাশ ঘিরে কেমন যেন কালো! সবকিছু যেন অন্ধকার! 

ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চুপচাপ বসে আছে একদিকে। অন্যদিকে কবিতা, গল্প পাঠ হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। বর্ষার দৃষ্টি ওদের চলাফেরা, বসার দিকে। কেমন যেন ওদের হাবভাব, খুব অসহায় লাগছে বর্ষার। একটা মেয়ের মুখে একটা মাছি বসেছে ,ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা মেয়েটি কি বুঝতে পারছে না ওই মাছিটিকে?

বর্ষা হঠাৎ ছুটে গেল, মাছিটাকে তাড়িয়ে দিল। আয়োজকদের কেউ কেউ তাকে দেখছেন, কিন্তু বর্ষার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বর্ষা ওদের পাশে গিয়ে বসল। ছেলেমেয়েগুলোর হাত-পা-মুখ কে ভালো করে দেখতে লাগল। চোখগুলো কেমন যেন বন্ধ বন্ধ। চোখের মণিগুলোকে ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারছিল না।

বর্ষা একটা বাচ্চাকে স্পর্শ করল। ছোট্ট মেয়েটির একটি আঙুলকে সজোরে চেপে ধরল, আবার ছেড়ে দিল। ও চিৎকার করলো না কেন? বর্ষা ভাবল, ‘আচ্ছা মেয়েটি কেন প্রতিবাদ করল না? ব্যথা লাগলে তো যন্ত্রণার আওয়াজ দিতে হয়!’

বর্ষার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল, অন্ধত্ব কি ওদের প্রতিবাদের ভাষাকে কেড়ে নিয়েছে? নাকি ভয় পায়, প্রতিবাদ করলে যদি আবার ব্যাথা পায় কিংবা ব্যথা বলে কোনো অনুভূতি হয়তো তাদের থাকতে নেই। 

বর্ষা বুঝতে পারে না কোনটা ঠিক। আসলে এত অন্ধকারে থাকতে থাকতে ব্যথাটা হয়তো তাদের সহ্য হয়ে গেছে।

হঠাৎ বর্ষা পাশের ছোট্ট ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো ‘তোমার নাম কি ?’

— অজিত।

— আর তোমার ? বর্ষা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল পাশের রোগা কালো ছেলেটিকে।

— আমার নাম স্বপ্ন।

— স্বপ্ন ! বা ভারী সুন্দর নাম তো ! তুমি স্বপ্ন দেখো?

বর্ষার প্রশ্নে ও হেসে বলল, ‘দেখি তো । ‘

— কি দেখো?

— একটা বড় পৃথিবীকে ।

— বড় পৃথিবী! কত বড় পৃথিবী ?

— এইয়া বড়।

স্বপ্ন হাত দুটো বিস্তৃত করে দেখালো। 

বর্ষা অবাক হয়ে স্বপ্নকে দেখল কিছুক্ষণ, আনমনে ভাবল কতো কি! পৃথিবীর রূপ কেমন ভাবে ধরা পড়েছে ওদের চোখে? ভূগোলের পাতাগুলো কেমন ভাবে দেখতে পায় ওরা। চাঁদের কিরণকে কেমনভাবে উপভোগ করে অজিত, স্বপ্নরা? জ্যোৎস্নার রূপ, তারাদের ঝিকিমিকি, সবকিছুকে দেখতে পেয়েছে বর্ষা । বৃষ্টির পরে রোদ কেমনভাবে প্রকৃতিকে পালটে দেয় তা দুচোখ ভরে উপলব্ধি করেছে বর্ষা। কিন্তু ওরা জানেনা রোদ কি, তারাদের ঝিকিমিকি, মেঘের মধ্যে চাঁদের লুকোচুরি খেলা। কিচ্ছু ওরা দেখেনি। প্রকৃতিকে আজ খুব দামি মনে হচ্ছে বর্ষার।

— তোমার কষ্ট হয় ?

– কেন ?

— আকাশকে দেখনি বলে? সবুজকে দেখনি বলে? – – কে বলেছে দেখেনি?দেখেছি তো ।

– দেখেছ ?

— হ্যাঁ ….

বর্ষা আবার অবাক হয়। একরাশ প্রশ্ন তার মনের মধ্যে এসে ভিড় করে।

আচ্ছা রসগোল্লা খেয়েছো?

— হ্যাঁ …

— তোমরা সিনেমা দেখতে ইচ্ছা করে না?

— দেখি তো …

— দেখো! কিভাবে?

— শুনে শুনে…

— বুঝতে পারো?

— পারি তো। কী সুন্দর একটা হাসি ওর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল।

— তোমার মা আছে ?

— মা ছিল কিন্তু…

— কিন্তু কি হলো?

— মায়ের একটা পা ট্রেনে কাটা পড়েছিল। ভিক্ষা করত মা।

— তোমার বাবা?

— বাবাকে মনে নেই। কোনদিনও বাবার আওয়াজ পাইনি।

— এখন মা কোথায় আছে?

— মা নেই তো। একটা বড় অসুখ হলো মায়ের। সবাই বলতো খেতে না পেয়ে অসুখটা হয়েছে।

— মায়ের জন্য মন খারাপ করে ?

— আগে করত, এখন আর করে না।

— তোমার পাশে কেউ এসে পড়লে তুমি বুঝতে পারো?

— একটু একটু। নাম ধরে ডাকলে বুঝি।

— তোমার পেছনে কেউ এসে যদি দাঁড়ায়?

— মাঝে মাঝে টের পাই।

— তুমি কেমন দেখতে তা জানো না বলে তোমার কষ্ট হয় না ?

— জানি তো।

কথাটা বলে আবার হাসি।যেন কোনো আক্ষেপ নেই। হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘এই যে আমি হাঁটতে পারছি, দুটো হাত নাড়াতে পারছি, যারা হাঁটতে পারে না তাদের কত কষ্ট বলো তো? দিদি

আপনি …’

— হ্যাঁ বলো, থামলে কেন?

— দিদি …

— আপনি নয়, আমাকে ‘তুমি’বলো।

–তুমি সবুজ রঙের শাড়ি পরেছ?

— তুমি কিভাবে বুঝলে?

— মনে হল।

— তুমি বোঝো সবুজ কি?

— বুঝি তো।

— কিন্তু আমি কি রঙের শাড়ি পরেছি, তুমি বুঝলে কি করে?

–তুমি খুব ভালো বলে, তোমার মন খুব সুন্দর

বলে …

— আমার মন সুন্দর তুমি জানলে কি করে ?

— তোমার সাথে কথা বলে। তোমার হাসিটাও খুব সুন্দর, এমনকি তোমার চোখটাও। 

বর্ষা বিস্ময়ে হতবাক। সত্যিই তো সে সবুজ রঙয়ের শাড়ি পরেছে। দেখতে না পাওয়া ঐ বাচ্চাগুলো মনের চোখ দিয়ে তাহলে পুরো পৃথিবীটাকে দেখেছে। আর আমরা কাছের জিনিসকেও বুঝতে পারি না। চোখ কি তাহলে আমাদের মনের আলোকে কেড়ে নিয়েছে? হঠাৎ বর্ষা খেয়াল করল তাকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে। অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে খেয়ালই করেনি তার নাম বেশ কয়েকবার ঘোষণা করা হয়েছে। সেই মুহূর্তে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দুটো কবিতা বা গল্প পাঠকে বড় অর্থহীন মনে হতে লাগল। তার চেয়ে একটা দিনের যে অভিজ্ঞতা তার জীবনে সঞ্চিত হয়ে থাকল তার মূল্য পৃথিবীর যে কোনো দামি জিনিসের চেয়ে যে কোনো অংশে কম নয়, তা যেন বর্ষা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল। কিছুটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও বর্ষা উঠে দাঁড়াল। মঞ্চে প্রবেশ করল একদম ধীর পায়ে। সামনের সারিতে বসে রয়েছেন সমস্ত গুণীজন।

তাঁদের সবাইকে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বর্ষা দু চোখ বন্ধ করল। এক পৃথিবী অন্ধকারকে নিজের মতো করে অনুভব করে, বর্ষা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল।

হঠাৎ তার কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো অদ্ভুত সব শব্দ, যার বর্ণগুলো নানান রঙের মালা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল আকাশে বাতাসে, দূর দূরান্তে। নীল আকাশের অপার সৌন্দর্যের কথা ভাবতে ভাবতে কত কিছু খাওয়া হলো সেই আশ্রম প্রাঙ্গণে। ডাল, ভাত, পনির, বেগুন ভাজা আরো কত কী। বড় বড় গাড়িতে করে অনুষ্ঠানে আগত অতিথি, গুণীজনেরা কি তাঁদের গাড়ির পেট্রোলের গন্ধের মধ্যে একটু সোঁদামাটির গন্ধ টের পেয়েছিলেন? অনুভব করেছিলেন কি চোখে দেখতে না পাওয়া শিশুগুলোর অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা? পাবলিসিটি জোয়ারে যখন ভেসে যাচ্ছিল সব হিসেবনিকেশ, সোঁদামাটির গন্ধ যখন ফুরিয়ে যাচ্ছিল অচেনা গন্ধগুলোর পাশে, ঠিক তক্ষুনি দুটো ছেলে এসে বলল, ‘চলে যাচ্ছেন দিদি?’

— হ্যাঁ ভাই, খুব ভাল লাগল আজ তোমাদের এখানে এসে।

— আপনাকে একটু এগিয়ে দিই দিদি?

ওদের আন্তরিক ভালোবাসা ভরা চোখগুলো আজকের মন ভাল করার শেষ ওষুধ মনে করে নির্বাক দৃষ্টিতে বর্ষা চেয়ে রইল, তারপর চলতে শুরু করল একার সাথে একা। সবুজ ধানক্ষেতকে দুচোখ ভরে দেখল। হলুদ সর্ষে ফুলের মাথাগুলোর ওপর আলতো স্পর্শ করল।সুন্দর সুন্দর প্রজাপতি। রঙ বেরঙের পাখা, ডোরাকাটা কত কারুকার্য। 

এভাবে ভাবেনি তো বর্ষা কোনোদিন। আজকে সব কিছুকে কেন দুচোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে? হঠাৎ একরাশ কান্না এসে ভিড় করল বর্ষার হৃদয়ের অন্তরালে। জমে থাকা সমস্ত দুঃখ ,যন্ত্রণা, অভিমান বৃষ্টি হয়ে যেন অনেকটা হালকা করে দিলো বর্ষাকে। নিজের চাওয়া পাওয়া দানব অভিব্যাক্তিগুলোকে কোন এক অদৃশ্য শক্তি এক নিমেষে কোথায় যেন সরিয়ে দিল। সুজনের মত মানুষদেরকেও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে ইচ্ছে হলো। ঈশ্বরের কাছে আরও একবার তাদের সবার জন্যে মঙ্গল প্রার্থনা করে শুরু হলো পথ চলা।

পিছিয়ে পড়ল সেই মায়াবী পৃথিবী, সেই রংবেরঙের সমারোহ। কাঁচা রাস্তায় ছেড়ে পাকা রাস্তা ধরে এগোতে লাগল বর্ষা। নীল সবুজ লাল হলুদ সব ভুলে শুধু অন্ধকারকে অনুভব করবে বলে চলতে শুরু করল চোখ বন্ধ করে। কত শিশুর কোলাহল যেন বর্ষা স্পষ্ট অনুভব করল। কিন্তু কি আশ্চর্য, চোখ বন্ধ করেও বর্ষা সবকিছুকে দেখতে পাচ্ছে। কত রঙের খেলা। নীল আকাশ, সবুজ গাছ, সমুদ্র,পাহাড় সবকিছু দেখতে পাচ্ছে, সবকিছু। আর দেখতে পাচ্ছে স্বপ্ন অজিতের একমুখ হাসি…

লেখক: মণিজিঞ্জির সান্যাল শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।সূএ:পূর্বপশ্চিমবিডি

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইন্টারন্যাশনাল ডিজ্যাবিলিটি আর্ট ফেস্টিভ্যাল শুরু

» তীব্র গরমে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করলেন ইউএনও

» লালমনিরহাটে হিট স্ট্রোকে অটোচালকের মৃত্যু

» ইউএনওর ফোন নম্বর ক্লোন করে প্রার্থীদের সাথে প্রতারণার চেষ্টা

» দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করুন, আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রধানমন্ত্রী

» প্রতিক্রিয়াশীল চক্র গণতন্ত্রবিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে : পরশ

» আগামীকাল ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

» বন্দনা করা ছাড়া জাপার কোনো রাজনীতি নেই: ফিরোজ রশিদ

» বাংলাদেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে অথচ বিরোধী দল দেখে না: কাদের

» থাই পিএমও-তে প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

অন্ধকারের স্বপ্নেরা

মণিজিঞ্জির সান্যাল:
বাস থেকে নেমে হাঁটছিল বর্ষা। পাকা রাস্তাটা সোজা চলে গেছে বহুদূরে। অচেনা অজানা জায়গায় বেশ একটা উষ্ণ স্পন্দন সে টের পাচ্ছিল। এক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে এখানে আসা। আর আছে গুণীজন সংবর্ধনা। জায়গাটাতে বর্ষার আজ প্রথম আসা। নামটাও শোনেনি সে কোনদিন। কি যেন নামটা? মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়েছে বর্ষার, ‘কলাগাছ’। বাস থেকে নেমে আমন্ত্রণপত্রটা বের করে ঠিকানাটা আর একবার দেখে নিল। একদম নিস্তব্ধ চারপাশ, সুনসান জনপদ।

ভোরবেলা উঠে স্নান সেরে সেখানে যাবার একটা প্রস্তুতি চলছিল মনে মনে। মনটা সেদিন একা একাই কত কথা বলছিল। বর্ষা একবার ভাবল যাবে না, আর একবার ভাবল ‘না যাই।’ আয়োজকরা কত আগে থেকে নিমন্ত্রণ করেছেন। সে ডাকের মধ্যে আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সবকিছুই ছিল। তাদের আমন্ত্রণকে কি উপেক্ষা করা উচিত?

 

আসলে মনের সাথে অনবরত লড়তে হয় বর্ষাকে। ভীষণ একটা মন খারাপ করা রোগ আছে ওর। কথায় কথায় মন খারাপ, কেন যে এমন মন খারাপ হয় কে জানে। সব সময় মনে হয় যেখানে যাব, মন খারাপ নিয়ে ফিরে আসব না তো?

 

যে বাসটাতে বর্ষা এসেছিল সেটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেটা। আর কিছু ধুলো ছড়িয়ে দিল রাস্তার দু’ধারে। ঠিকানাটা ছিল ডি.বি.এম. ওল্ড এজ হোম অ্যান্ড ব্লাইন্ড স্কুল। আমন্ত্রণপত্র হাতে পেয়ে মনে হয়েছিল যত প্রতিকূলতাই থাক যেতে হবে সেখানে, অন্তত নিজেকে জানার জন্য তো যেতেই হবে।

একটা ভ্যান রিক্সা চলে গেল। মাটির একটা গন্ধ সে টের পেল তক্ষুনি। কোনদিনও ভ্যানে চড়েনি বর্ষা। হাত নাড়িয়ে থামাল চালককে। উঠে বসল সেই ভ্যানে। সামনে দুজন মধ্যবয়সী পুরুষ, পেছনে অল্প বয়সী এক গৃহবধূ। জীবনে প্রথম ভ্যানে চড়ে যাচ্ছে বর্ষা। কি যে মজা লাগছে। মাথার ওপর সুবিস্তৃত খোলা আকাশ, দুদিকে সবুজের সমারোহ, সে এক অদ্ভুত বাতাবরণ, যাকে ঠিক ভাষায় ব্যক্ত করা যায়না।

ভ্যানচালকের গানের সুরকে বর্ষা হঠাৎ যেন অনুভব করল, মনে হলো সুরটা কেমন যেন চেনা চেনা। মনে পড়ল, অনেকদিন আগে সে যখন গঙ্গায় লঞ্চে করে ঘুরছিল, ঠিক সেই সময় এক কিশোর আপন-মনে দেখে যাচ্ছিল প্রকৃতিকে, জলে দোলাচলকে। বর্ষা ভাবল আজও কি সেই কিশোর অপার বিস্ময় এই প্রকৃতিকে দেখে? প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের রহস্যকে কি সে আগের মত করেই অনুভব করে? কিংবা সেই সেবার দক্ষিণেশ্বর থেকে বেলুড় মঠে নৌকো করে যাবার পথে মাঝির সুরেলা কন্ঠস্বর, যা আজও চোখ বুজলে সে পরিষ্কার শুনতে পায়। আর মায়ের কোলে বসা ওই ছোট্ট শিশুর দুচোখ ভরা বিস্ময়, যে শিশুটি নৌকোর রূপের সাথে প্রকৃতির রূপকে মেলানোর চেষ্টা করছিল অনবরত। সে নিশ্চয়ই এতদিনে অনেক বড় গেছে। তার অনুভূতির জায়গাটা শৈশবের অনুভূতির মত বেঁচে আছে কি?

নৌকার মাঝির সেই সুরেলা কন্ঠস্বর কিভাবে যেন এসে মিশে গেল ভ্যানচালকের সুরের মধ্যে। বহু বছর আগের সেই সুর বাতাসের মধ্যে দিয়ে কিভাবে যেন এসে ধরা দিলো আজকের এই সুরের মধ্যে। সেই সুরের মধ্যে ধরা দিল অজস্র ছবি, স্মৃতিমধুর কত কথা, গান, কবিতা, আরো কতো কি। এখনো পরিস্কার মনে আছে সেইসব কথা, সেইসব দিনগুলোর ছবি …

সেদিন সুজনের কাঁধে মাথা রেখে বর্ষাও জলের স্পন্দনকে অনুভব করছিল, তির তির করে কাঁপছিলো বর্ষার ঠোঁট, সুজন তাতে স্পর্শ করছিল মাঝে মাঝে। আলতো করে জড়িয়ে ধরছিল বর্ষার কোমর। অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছিল বর্ষার শিরায় শিরায়। ভালো লাগার উষ্ণ স্পর্শে মাঝে মাঝেই চোখ বুঝছিল বর্ষা, মনে হচ্ছিল অনন্তকাল এইভাবে সুজনের সাথে ভেসে বেড়াবে নৌকার মধ্যে, আর মাঝি তার সুরেলা কন্ঠেস্বরের জাদু ছড়িয়ে দেবে আকাশে বাতাসে ওই দুর দুরান্তে।

বর্ষা হঠাৎ বলেছিল ‘আমাকে ছেড়ে তুমি কখনো চলে যাবে না তো ? আমি যে ভীষণ কষ্ট পাবো তাহলে!’

–কেন এসব ভাবছো সোনা? তোমার মত এমন একটা মিষ্টি মেয়েকে কখনও কষ্ট দেওয়া যায়?

–তবুও ভয় করে সুজন। এত গভীর ভাবে তোমার কাছে এসেছি।

সুজন আরো জোরে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলেছিল কতো কি। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছিল বর্ষা। 

পাহাড়ের কোলে একটা বাংলো বানাবে বলেছে সুজন। ছোট্ট একটা বাংলো, পাশে থাকবে গোলাপ আর গোলাপ। গোলাপের চাষ করবে সুজন। বর্ষাকে বলেছে তার স্বপ্নের কথাগুলো। “পাহাড়ি নদীর ধারে তোমার হাতে হাত রেখে অনন্ত কাল আমি বসে থাকব। আমি কবিতা লিখব আর তুমি তোমার কণ্ঠস্বর দিয়ে মাতিয়ে তুলবে সেই কবিতার মর্মস্পর্শী রূপকে। তোমার সেই কণ্ঠস্বর পাহাড়ি ঝর্ণার সাথে একাত্ম হবে। আমি তোমাকে চুমু খাব, আদর করব। সূর্যাস্ত এসে আমাদের শরীরের ওপর একটা লাল, হলুদ চাদর টেনে দেবে। সেই চাদরের লঙ ধীরে ধীরে কালো হবে, আমরা তখন আরো গাঢ় হবো, আরো আরো…”

বর্ষার দুচোখ জলে ভরে ওঠে। ওর মতো সহজ সরল একটা মেয়েকে এত স্বপ্ন দেখাতে পারে! এতটাই কাল্পনিক! সবটাই মিথ্যে!

— দিদি আপনি নামবেন না? এসে গেছে আপনার আশ্রম।

— হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো। কত ভাড়া? চমকে ওঠে বর্ষা।কতোদিন আগের সেই স্মৃতিগুলো এখনও কেমন জ্বলজ্বলে, ভেবে অবাক হয় বর্ষা।

— পাঁচ টাকা ।

— পাঁচ টাকা! পাঁচ টাকা আবার ভাড়া আছে নাকি? বর্ষা ভ্যানচালকের হাতে দশ টাকা দিতেই দেখতে পেল এক প্রশান্ত মুখ, তাতে কিছুটা বিস্ময়। কিছুক্ষণ পরেই একটা সুন্দর হাসি, যে হাসিটা বর্ষা অনেকদিন পরে দেখতে পেল, যে হাসিটা আজকের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যায় না, অদ্ভুত এক মন ভাল করা ওষুধ।

বর্ষা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল মূল অনুষ্ঠানের প্রাঙ্গণে। সবুজে সবুজে ঘেরা চারপাশ, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে আশ্রমটা, তাকে সাজানো হয়েছে রংবেরঙের কাপড়ে। সঞ্চালকের কণ্ঠস্বর এসে পৌঁছল ওর কানে। শেষবারের মতো দেখে নিল অনেক দূরে চলে যাওয়া যাত্রীবাহী সেই ভ্যান চালককে। মনে মনে ভাবল, আর কখনও কি দেখা হবে তার সাথে?

সুন্দর আয়োজন করেছেন আয়োজকেরা।

— শরীর মন দুটোই ভালো আছে তো ? 

আয়োজকের মুল কর্তা রসিক বটে, সবচেয়ে বড়কথা মনটাও চমৎকার। সবাই বড় ভালো, যেন একটা মন ভালো করা ওষুধ খেল বর্ষা। ওষুধটা হলো সেখানকার নিস্তব্ধ বাতাবরণ।

চোখে দেখতে না পাও ছোট ছোট শিশুগুলি গান শোনালো, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’।’ একেই কি বলে স্রষ্টার সৃষ্টি?

‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ’

এই কথাগুলো বলে বর্ষারই তো উচিত একটু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা, তা না করে বর্ষা নিজেই নিজের মনের আলো খুঁজে বেড়াতে লাগল।

আশ্রমের একদিকে গোলাপী, আর লাল গোলাপের সমারোহ। আর একদিকে সবুজের ছোঁয়া, কিন্তু আশ্চর্য এক কান্ড ঘটল, সব কিছুকেই বর্ষা অন্য রূপে, অন্য রঙ-এ দেখতে লাগল। চারপাশ ঘিরে কেমন যেন কালো! সবকিছু যেন অন্ধকার! 

ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চুপচাপ বসে আছে একদিকে। অন্যদিকে কবিতা, গল্প পাঠ হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। বর্ষার দৃষ্টি ওদের চলাফেরা, বসার দিকে। কেমন যেন ওদের হাবভাব, খুব অসহায় লাগছে বর্ষার। একটা মেয়ের মুখে একটা মাছি বসেছে ,ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা মেয়েটি কি বুঝতে পারছে না ওই মাছিটিকে?

বর্ষা হঠাৎ ছুটে গেল, মাছিটাকে তাড়িয়ে দিল। আয়োজকদের কেউ কেউ তাকে দেখছেন, কিন্তু বর্ষার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বর্ষা ওদের পাশে গিয়ে বসল। ছেলেমেয়েগুলোর হাত-পা-মুখ কে ভালো করে দেখতে লাগল। চোখগুলো কেমন যেন বন্ধ বন্ধ। চোখের মণিগুলোকে ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারছিল না।

বর্ষা একটা বাচ্চাকে স্পর্শ করল। ছোট্ট মেয়েটির একটি আঙুলকে সজোরে চেপে ধরল, আবার ছেড়ে দিল। ও চিৎকার করলো না কেন? বর্ষা ভাবল, ‘আচ্ছা মেয়েটি কেন প্রতিবাদ করল না? ব্যথা লাগলে তো যন্ত্রণার আওয়াজ দিতে হয়!’

বর্ষার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল, অন্ধত্ব কি ওদের প্রতিবাদের ভাষাকে কেড়ে নিয়েছে? নাকি ভয় পায়, প্রতিবাদ করলে যদি আবার ব্যাথা পায় কিংবা ব্যথা বলে কোনো অনুভূতি হয়তো তাদের থাকতে নেই। 

বর্ষা বুঝতে পারে না কোনটা ঠিক। আসলে এত অন্ধকারে থাকতে থাকতে ব্যথাটা হয়তো তাদের সহ্য হয়ে গেছে।

হঠাৎ বর্ষা পাশের ছোট্ট ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলো ‘তোমার নাম কি ?’

— অজিত।

— আর তোমার ? বর্ষা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল পাশের রোগা কালো ছেলেটিকে।

— আমার নাম স্বপ্ন।

— স্বপ্ন ! বা ভারী সুন্দর নাম তো ! তুমি স্বপ্ন দেখো?

বর্ষার প্রশ্নে ও হেসে বলল, ‘দেখি তো । ‘

— কি দেখো?

— একটা বড় পৃথিবীকে ।

— বড় পৃথিবী! কত বড় পৃথিবী ?

— এইয়া বড়।

স্বপ্ন হাত দুটো বিস্তৃত করে দেখালো। 

বর্ষা অবাক হয়ে স্বপ্নকে দেখল কিছুক্ষণ, আনমনে ভাবল কতো কি! পৃথিবীর রূপ কেমন ভাবে ধরা পড়েছে ওদের চোখে? ভূগোলের পাতাগুলো কেমন ভাবে দেখতে পায় ওরা। চাঁদের কিরণকে কেমনভাবে উপভোগ করে অজিত, স্বপ্নরা? জ্যোৎস্নার রূপ, তারাদের ঝিকিমিকি, সবকিছুকে দেখতে পেয়েছে বর্ষা । বৃষ্টির পরে রোদ কেমনভাবে প্রকৃতিকে পালটে দেয় তা দুচোখ ভরে উপলব্ধি করেছে বর্ষা। কিন্তু ওরা জানেনা রোদ কি, তারাদের ঝিকিমিকি, মেঘের মধ্যে চাঁদের লুকোচুরি খেলা। কিচ্ছু ওরা দেখেনি। প্রকৃতিকে আজ খুব দামি মনে হচ্ছে বর্ষার।

— তোমার কষ্ট হয় ?

– কেন ?

— আকাশকে দেখনি বলে? সবুজকে দেখনি বলে? – – কে বলেছে দেখেনি?দেখেছি তো ।

– দেখেছ ?

— হ্যাঁ ….

বর্ষা আবার অবাক হয়। একরাশ প্রশ্ন তার মনের মধ্যে এসে ভিড় করে।

আচ্ছা রসগোল্লা খেয়েছো?

— হ্যাঁ …

— তোমরা সিনেমা দেখতে ইচ্ছা করে না?

— দেখি তো …

— দেখো! কিভাবে?

— শুনে শুনে…

— বুঝতে পারো?

— পারি তো। কী সুন্দর একটা হাসি ওর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল।

— তোমার মা আছে ?

— মা ছিল কিন্তু…

— কিন্তু কি হলো?

— মায়ের একটা পা ট্রেনে কাটা পড়েছিল। ভিক্ষা করত মা।

— তোমার বাবা?

— বাবাকে মনে নেই। কোনদিনও বাবার আওয়াজ পাইনি।

— এখন মা কোথায় আছে?

— মা নেই তো। একটা বড় অসুখ হলো মায়ের। সবাই বলতো খেতে না পেয়ে অসুখটা হয়েছে।

— মায়ের জন্য মন খারাপ করে ?

— আগে করত, এখন আর করে না।

— তোমার পাশে কেউ এসে পড়লে তুমি বুঝতে পারো?

— একটু একটু। নাম ধরে ডাকলে বুঝি।

— তোমার পেছনে কেউ এসে যদি দাঁড়ায়?

— মাঝে মাঝে টের পাই।

— তুমি কেমন দেখতে তা জানো না বলে তোমার কষ্ট হয় না ?

— জানি তো।

কথাটা বলে আবার হাসি।যেন কোনো আক্ষেপ নেই। হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘এই যে আমি হাঁটতে পারছি, দুটো হাত নাড়াতে পারছি, যারা হাঁটতে পারে না তাদের কত কষ্ট বলো তো? দিদি

আপনি …’

— হ্যাঁ বলো, থামলে কেন?

— দিদি …

— আপনি নয়, আমাকে ‘তুমি’বলো।

–তুমি সবুজ রঙের শাড়ি পরেছ?

— তুমি কিভাবে বুঝলে?

— মনে হল।

— তুমি বোঝো সবুজ কি?

— বুঝি তো।

— কিন্তু আমি কি রঙের শাড়ি পরেছি, তুমি বুঝলে কি করে?

–তুমি খুব ভালো বলে, তোমার মন খুব সুন্দর

বলে …

— আমার মন সুন্দর তুমি জানলে কি করে ?

— তোমার সাথে কথা বলে। তোমার হাসিটাও খুব সুন্দর, এমনকি তোমার চোখটাও। 

বর্ষা বিস্ময়ে হতবাক। সত্যিই তো সে সবুজ রঙয়ের শাড়ি পরেছে। দেখতে না পাওয়া ঐ বাচ্চাগুলো মনের চোখ দিয়ে তাহলে পুরো পৃথিবীটাকে দেখেছে। আর আমরা কাছের জিনিসকেও বুঝতে পারি না। চোখ কি তাহলে আমাদের মনের আলোকে কেড়ে নিয়েছে? হঠাৎ বর্ষা খেয়াল করল তাকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে। অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে খেয়ালই করেনি তার নাম বেশ কয়েকবার ঘোষণা করা হয়েছে। সেই মুহূর্তে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দুটো কবিতা বা গল্প পাঠকে বড় অর্থহীন মনে হতে লাগল। তার চেয়ে একটা দিনের যে অভিজ্ঞতা তার জীবনে সঞ্চিত হয়ে থাকল তার মূল্য পৃথিবীর যে কোনো দামি জিনিসের চেয়ে যে কোনো অংশে কম নয়, তা যেন বর্ষা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল। কিছুটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও বর্ষা উঠে দাঁড়াল। মঞ্চে প্রবেশ করল একদম ধীর পায়ে। সামনের সারিতে বসে রয়েছেন সমস্ত গুণীজন।

তাঁদের সবাইকে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বর্ষা দু চোখ বন্ধ করল। এক পৃথিবী অন্ধকারকে নিজের মতো করে অনুভব করে, বর্ষা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল।

হঠাৎ তার কন্ঠ থেকে উচ্চারিত হলো অদ্ভুত সব শব্দ, যার বর্ণগুলো নানান রঙের মালা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল আকাশে বাতাসে, দূর দূরান্তে। নীল আকাশের অপার সৌন্দর্যের কথা ভাবতে ভাবতে কত কিছু খাওয়া হলো সেই আশ্রম প্রাঙ্গণে। ডাল, ভাত, পনির, বেগুন ভাজা আরো কত কী। বড় বড় গাড়িতে করে অনুষ্ঠানে আগত অতিথি, গুণীজনেরা কি তাঁদের গাড়ির পেট্রোলের গন্ধের মধ্যে একটু সোঁদামাটির গন্ধ টের পেয়েছিলেন? অনুভব করেছিলেন কি চোখে দেখতে না পাওয়া শিশুগুলোর অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা? পাবলিসিটি জোয়ারে যখন ভেসে যাচ্ছিল সব হিসেবনিকেশ, সোঁদামাটির গন্ধ যখন ফুরিয়ে যাচ্ছিল অচেনা গন্ধগুলোর পাশে, ঠিক তক্ষুনি দুটো ছেলে এসে বলল, ‘চলে যাচ্ছেন দিদি?’

— হ্যাঁ ভাই, খুব ভাল লাগল আজ তোমাদের এখানে এসে।

— আপনাকে একটু এগিয়ে দিই দিদি?

ওদের আন্তরিক ভালোবাসা ভরা চোখগুলো আজকের মন ভাল করার শেষ ওষুধ মনে করে নির্বাক দৃষ্টিতে বর্ষা চেয়ে রইল, তারপর চলতে শুরু করল একার সাথে একা। সবুজ ধানক্ষেতকে দুচোখ ভরে দেখল। হলুদ সর্ষে ফুলের মাথাগুলোর ওপর আলতো স্পর্শ করল।সুন্দর সুন্দর প্রজাপতি। রঙ বেরঙের পাখা, ডোরাকাটা কত কারুকার্য। 

এভাবে ভাবেনি তো বর্ষা কোনোদিন। আজকে সব কিছুকে কেন দুচোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে? হঠাৎ একরাশ কান্না এসে ভিড় করল বর্ষার হৃদয়ের অন্তরালে। জমে থাকা সমস্ত দুঃখ ,যন্ত্রণা, অভিমান বৃষ্টি হয়ে যেন অনেকটা হালকা করে দিলো বর্ষাকে। নিজের চাওয়া পাওয়া দানব অভিব্যাক্তিগুলোকে কোন এক অদৃশ্য শক্তি এক নিমেষে কোথায় যেন সরিয়ে দিল। সুজনের মত মানুষদেরকেও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে ইচ্ছে হলো। ঈশ্বরের কাছে আরও একবার তাদের সবার জন্যে মঙ্গল প্রার্থনা করে শুরু হলো পথ চলা।

পিছিয়ে পড়ল সেই মায়াবী পৃথিবী, সেই রংবেরঙের সমারোহ। কাঁচা রাস্তায় ছেড়ে পাকা রাস্তা ধরে এগোতে লাগল বর্ষা। নীল সবুজ লাল হলুদ সব ভুলে শুধু অন্ধকারকে অনুভব করবে বলে চলতে শুরু করল চোখ বন্ধ করে। কত শিশুর কোলাহল যেন বর্ষা স্পষ্ট অনুভব করল। কিন্তু কি আশ্চর্য, চোখ বন্ধ করেও বর্ষা সবকিছুকে দেখতে পাচ্ছে। কত রঙের খেলা। নীল আকাশ, সবুজ গাছ, সমুদ্র,পাহাড় সবকিছু দেখতে পাচ্ছে, সবকিছু। আর দেখতে পাচ্ছে স্বপ্ন অজিতের একমুখ হাসি…

লেখক: মণিজিঞ্জির সান্যাল শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।সূএ:পূর্বপশ্চিমবিডি

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com