সংগৃহীত ছবি
নিরঞ্জন রায় : আমাদের গ্রামদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে যে ঝড়ের সময় আম কুড়াতে হয়। কথাটি শুধু গ্রামের আম কুড়ানোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমন নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে, এমনকি অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। উন্নত বিশ্বেও এই কথার মর্মার্থ বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায়। উন্নত বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দার ঝড় শুরু হয়, তখন যদি আম কুড়ানোর মতো সুযোগ কাজে লাগানো যায়, তাহলে বেশ ভালোই লাভবান হওয়া যায়।
যেমন—২০০৮ সালে যখন আমেরিকার সাবপ্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারির কারণে আর্থিক মন্দার ঝড় উঠেছিল, তখন যারা বাড়ি ক্রয় করেছিল, তারা আজ কয়েক মিলিয়ন ডলারের মালিক। একইভাবে ২০২০ সালে করোনা অতিমারির কারণে উন্নত বিশ্বে যখন স্টক মার্কেট ক্রাশ বা বিপর্যয়ের ঝড় শুরু হয়েছিল, তখন যারা শেয়ার ক্রয় করে রেখেছিল, তারাও আজ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের মালিক। এ কারণেই ঝড়ের আতঙ্ক, তা সে প্রাকৃতিক দুর্যোগই হোক বা অর্থনৈতিক মন্দাই হোক, তাতে বিচলিত না হয়ে এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করাই উত্কৃষ্ট পন্থা। অবশ্য চাইলেই তো ঝড়ের সময় আম কুড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানো যাবে না।
এ জন্য ভালো কৌশল জানতে হবে এবং থাকতে হবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। আমাদের ছোটোবেলায় দেখেছি, অনেক ছেলে-মেয়ে ঝড়ের সময় প্রতিটি আমগাছের দিকে ছুটেছে ঠিকই, কিন্তু একটি আমও সংগ্রহ করতে পারেনি। আবার যারা আম কুড়ানোর ভালো কৌশল জানত, তারা অনেক আম সংগ্রহ করতে পেরেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
যাদের সঠিক কৌশল জানা আছে এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকে, তারাই অর্থনৈতিক মন্দার ঝড় থেকে ভালো সুবিধা নিতে পারে।
ছোটোবেলায় শেখা এই কথাটি এখন খুব বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয় যখন দেখি যে শুল্কহারের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ঝড়ে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তা সম্ভবত হাতছাড়া হয়ে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউসে এসে নির্বিচারে উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে বিশ্বব্যাপী চরম অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে রেখেছেন। এই অস্থিরতার কারণে অনেক দেশ যেমন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ক্ষতির সম্মুখীন, তেমনি অনেক দেশের জন্য দেখা দিয়েছে কিছু সুযোগ। যেমন—কানাডা, মেক্সিকো, ইউরোপের অনেক দেশ মারাত্মক অসুবিধার মধ্যে পড়ে গেছে।
আবার যুক্তরাজ্য, আর্জেন্টিনা, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো কিছু দেশ বেশ সুবিধাও নিতে পেরেছে। এমনকি সম্প্রতি ট্রাম্প যে এশিয়া সফর করলেন, সেখানেও এ রকম কিছু সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, যা কাজে লাগাতে পরেছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ভারত।
ট্রাম্প নির্বিচারে বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করলেও মূল লক্ষ্য হচ্ছে চীন। কেননা চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, যার অবস্থান আমেরিকার পরেই। কিন্তু যদি দুই দেশের রাষ্ট্রীয় ঋণ বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে চীনের অর্থনীতি আমেরিকার ওপরেই থাকবে। কেননা আমেরিকার অর্থনীতি ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার, আর চীনের অর্থনীতি ২০ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু আমেরিকার রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমাণ ৩৮ ট্রিলিয়ন ডলার, অথচ চীনের রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমাণ ১৯ ট্রিলিয়ন ডলার। এ কারণেই চীন আমেরিকার সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। চীন একদিকে সুপারপাওয়ার এবং অন্যদিকে বৃহৎ অর্থনীতি। ফলে আমেরিকা অন্যান্য দেশকে যেভাবে ডিল করবে, চীনকে সেভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। চীনের ক্ষেত্রে আমেরিকাকে যথেষ্ট কৌশলী হতে হয় এবং হয়েছেও তাই। বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে তাদের এক অস্থিরতার মধ্যে রেখে চীনের ওপর কৌশলী শুল্কহার ঠিকই বজায় রেখেছে। সম্প্রতি ট্রাম্পের এশিয়া সফরের সময় ট্রাম্প-শি সরাসরি আলোচনায় শুল্কহার ১০ শতাংশ কমিয়ে চীনের বেশির ভাগ পণ্যের ওপর শুল্কহার হ্রাস করে ৪৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অনেক দেশের চেয়ে বেশি। আর এখানেই আমেরিকার বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক দেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ভারত ধরতে পারলেও আমাদের দেশ পারেনি।
ট্রাম্পের উচ্চ শুল্কহারের কারণে সৃষ্ট বিশ্ব অর্থনীতির ঝড়ের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশ মোটেও প্রস্তুত ছিল না এবং সে রকম কৌশলও অবলম্বন করেনি। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আন্তরিকতা ও চেষ্টার হয়তো কমতি ছিল না। কিন্তু সরকারি তরফ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা ও তৎপরতা থাকার কথা ছিল, সেটি আমরা লক্ষ করিনি। সরকারি তৎপরতা বলতে এমন নয় যে সরকার সবকিছু নিজে করবে। সরকার ব্যবসায়ীদের দিয়ে কাজটি করাবে। ব্যবসায়ীরা সামনে থাকবেন, আমেরিকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন, কৌশল নির্ধারণ করবেন এবং সে অনুযায়ী ব্যাবসায়িক চুক্তি সম্পন্ন করবেন। এসব কাজে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষ সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে। আমাদের দেশকে এ রকম উদ্যোগ নিতে দেখিনি। আজ পর্যন্ত দেখলাম না যে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা আমেরিকার ট্রেড বিশেষজ্ঞ, আলোচক ও এ সংক্রান্ত বিভিন্ন থিংকট্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
ট্রাম্পের এশিয়া সফরকে কেন্দ্র করে আমেরিকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ট্রেড বিশেষজ্ঞ, ট্রেড আলোচক বা নেগোশিয়েটর এবং অনেক থিংকট্যাংক এশিয়ায় উপস্থিত থেকে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানির বিভিন্ন কৌশল নিয়ে কাজ করেছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এসব ব্যক্তি বা গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, এ রকম খবর আমরা দেখিনি। আর ব্যবসায়ীরা এই উদ্যোগ নেবেন কীভাবে। এ রকম পদক্ষেপ নিতে হলে তো তাঁদের দেশের বাইরে গিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে আলোচনা এবং দেনদরবার করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এই সুযোগ বেশ সীমিত। ব্যাবসায়িক প্রয়োজন তো দূরের কথা, অনেক ব্যবসায়ী নিজেদের চিকিৎসার জন্যও দেশের বাইরে যাওয়ার সাহস দেখান না। অথচ বিদেশের ব্যবসায়ী ও এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা এবং সে অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করতে পারলে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারত।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের তৈরি পোশাক শিল্প সৃষ্ট সুযোগ তো কাজে লাগাতেই পারেনি, উল্টো এই খাতের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন। গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর সার্বিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরো অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। আমেরিকার অনেক আমদানিকারক ক্রয় আদেশ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। ফলে আগামী দিনে তৈরি পোশাক খাতের জন্য তেমন ভালো দিন তো নেই-ই, বরং আরো খারাপ অবস্থাই অপেক্ষা করছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠনের নেতারা প্রকাশ্যে তাঁদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন। তাঁরা এই খাতের শোচনীয় অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন, যা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের উদ্বেগের মধ্যে রপ্তানি আদেশ না পাওয়া এবং অন্য দেশে চলে যাওয়া এই মুহূর্তে দেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় ধরনের অশনিসংকেত।
একবার তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশ অন্যত্র চলে গেলে, তা খুব সহজে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। বিষয়টি এই খাতের ব্যবসায়ীরা খুব ভালোভাবেই আঁচ করতে পেরেছেন এবং বেশ বিচলিতও হয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই অনিশ্চয়তা শিগগিরই যে কেটে যাবে, তেমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। কারণ এই সংকটের মূলে আছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং চরম বিভাজনের রাজনীতি। আগামী দিনে যে জাতীয় নির্বাচন হতে চলেছে, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে না আসে এবং চরম রাজনৈতিক বিভাজন যদি দূর না হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতির জন্য খারাপ দিনই অপেক্ষা করছে। আর এ রকম অবস্থায় দেশের তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ যে কী হবে, তা হয়তো এই মুহূর্তে কল্পনা করাও কঠিন।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন







