রাজনীতির বিবর্তন! বানর থেকে বিজ্ঞানী

ফাইল ছবি

 

গোলাম মাওলা রনি  : ঘটনাটি যে এভাবে ঘটবে, তা আমরা কেউই কল্পনা করতে পারিনি। আমার জীবনে এমনতরো দুর্ঘটনা কোনো দিন ঘটেনি। অন্যদিকে আমার সঙ্গী-সাথিরাও ঘটনার আকস্মিকতায় রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। ঘটনার রাতে আমরা একটি টেলিভিশন টক শো শেষে নিচে নামার জন্য লিফটে উঠছিলাম। আমি সাধারণত ভদ্রতা করে সঙ্গী-সাথিদের আগে লিফটে উঠতে দিই, তারপর নিজে উঠি। কোথাও বসা, কোনো কামরায় ঢোকা, একত্রে পথ চলা কিংবা খানাপিনার সময় সেই বালকবেলা থেকে আজ পর্যন্ত সাধারণভাবে নিজেকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করি, যেন কোনো কিছুতেই কাউকে পেছনে ফেলে, কাউকে ধাক্কা মেরে অথবা সবার আগে বসে পড়া অথবা সবার আগে উঠে পড়ার মতো কাণ্ড আমার দ্বারা না হয়।

 

উল্লেখিত কর্ম করতে গিয়ে আমার অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি; বরং প্রায় সব ক্ষেত্রে লাভ হয়েছে। কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়নি; স্বার্থ বা প্রাপ্তি নিয়ে কারো সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়নি; এমনকি কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়নি। শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে সম্মুখ সারিতে থেকে যাঁরা ফাঁকা শ্যুট করেন অথবা গুঁতাগুঁতি করে নেতা-নেত্রীর পাশে দাঁড়ান, তাঁদের মতো করে কোনোকালে আমার একটা ফটো তোলা হয়নি। সেই ১৯৮২ সাল থেকে রাজা-বাদশাহ আমির-ওমরাহ হাতি-ঘোড়া পাইক-পেয়াদা দেশে আসছে। তারপর ১৯৮৬ সাল থেকে ক্ষমতার অন্দরমহলে যাতায়াত এবং ২০০১ সাল থেকে ক্ষমতা, রাজনীতি এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু একটা ফটো তোলার সুযোগ হয়নি, অথবা কোনোকালে মনে হয়নি যে কারো সঙ্গে আমার একটি যুগলবন্দি ছবি থাকা দরকার।

আমি অজপাড়াগাঁ থেকে আসা একজন গেঁয়ো মানুষ। অভাব আমার কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষা-অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমি আজ ও প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। গ্রাম থেকে থানা-শহর, তারপর জেলা-বিভাগ হয়ে রাজনীতি। তারপর বিদেশের বড় বড় শহর, বড় বড় অট্রালিকা, বড় বড় মানুষ- বিচিত্র প্রকৃতি, বিচিত্র পরিবেশ এবং অসংখ্য শ্রেণি-পেশার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, জীবন যৌবন অর্থবিত্ত ক্ষমতা কাম ক্রোধের সীমা-পরিসীমা খুবই সীমিত ও স্বল্পস্থায়ী। ফলে বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা, ধন-সম্পদ, ক্ষমতা অর্জনের অবারিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, অথবা অন্যের জন্য উপকারী নয়, ওসব কোনো কিছুই আমাকে আকর্ষণ করেনি।

 

আমার ব্যবসা যখন তুঙ্গে তখন আমি যেমন ছিলাম, এখনো তেমনই আছি। অথবা যখন আমার অর্থবিত্ত ক্ষমতা জৌলুসের বন্যা শুরু হয়নি তখন যেভাবে চলতাম, ঠিক একইভাবে সারাটি জীবন চলেছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম বর্ষের জীবনাচরণ এবং হাল-আমলের জীবনযাত্রার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। আজকের নিবন্ধের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কেন তেতো কথা বললাম তা স্পষ্ট করার জন্য চলুন সেই রাতে টেলিভিশন টক শো শেষে লিফটে উঠতে গিয়ে কী ঘটেছিল, তা সংক্ষেপে বলি।

 

অনুষ্ঠানে আমরা তিনজন অতিথি ছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজক আমাদের বিদায় দিচ্ছিলেন। ভদ্রতা করে আমি দুজন মেহমানকে আগে লিফটে উঠতে দিয়ে যেই না নিজে ওঠার জন্য পা বাড়ালাম, অমনি পেছন থেকে কে যেন আমাকে টেনে ধরল, তারপর আমাকে ধাক্কা মেরে সে নিজে লিফটে উঠে পড়ল। ভদ্রলোকের গায়ে ডিবি বা এসএসএফের আদলে তৈরি পোশাক। অনুমান করলাম, তিনি হয়তো কারো বডিগার্ড। একটু পরে বুঝলাম, আমার এক সহ-আলোচক, যিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, তাঁরই বডিগার্ডরূপে আলোচিত লোকটি আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে তাঁর মালিকের বডি রক্ষায় নিজের বাহাদুরি প্রদর্শন করছিলেন। বিষয়টি আমি খুব স্বাভাবিকভাবে নিলাম। কারণ আমার পরিচিত অনেকেই হঠাৎ টাকা-পয়সা বা ক্ষমতার নাগাল পেয়েই বডিগার্ড ভাড়া করেন, কেউ কেউ জার্মান শেফার্ড কেনেন। নিজেদের অভিজাত প্রমাণের জন্য নিয়মিত পাঁচতারা হোটেলের আড্ডায় জড়ান এবং জুয়া-সাকিতে আসক্ত হয়ে পড়েন। ওসব দৃশ্য দেখে আমার প্রতিক্রিয়া হয় না। কারণ সাত-আট বছর পর ওসব লোক হয় দেউলিয়া হয়ে পড়ে, নতুবা ভাগ্য বিপর্যয়ে জেলের ঘানি টানে। সুতরাং বডিগার্ডের ধাক্কা খেয়ে আমি দুকদম পিছিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার সহ-আলোচক সেই রাজনৈতিক নেতা চিৎকার করে তাঁর বডিগার্ডকে গালমন্দ করলেন এবং নিজে লিফট থেকে নেমে এসে আমার হাত ধরে দুঃখ প্রকাশ করে আমাকে লিফটে ওঠালেন। লজ্জায় তাঁর মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি নিচে নেমে আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলেন। আমার গাড়ির প্রশংসা করলেন এবং ভদ্রতা করে আমার গাড়ির দরজা নিজ হাতে বন্ধ করে আমাকে বিদায় জানিয়ে তারপর নিজের গাড়ির দিকে রওনা হলেন।

 

ঘটনা যেভাবে ঘটল, তাতে আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো আমার মন খারাপ হয়ে গেল। বডিগার্ডওয়ালা রাজনৈতিক নেতার ভদ্রতা ও বিনয় দেখে মনে হলো, আমি বোধ হয় গলাধাক্কা খেয়ে অপমানিত হয়েছি। অথচ তাঁর বডিগার্ডের আচরণ আমার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল। ভদ্রলোকের বিনয় কেন আমার মন খারাপ করে দিল, তা আমি এখনো বুঝতে পারছি না। সেই রাতে গাড়িতে বসে আমি নিদারুণ অস্থিরতা অনুভব করলাম। আকাশকুসুম কল্পনা এবং এলোমেলো চিন্তায় আমার মন  ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। এমন সময় স্ত্রী মহাদয়ার একটি অতীত স্মৃতি মনে করে হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেল। আমার বিয়ে হয়েছে ১৯৮৬ সালে। বিয়ের প্রথম কয়েক বছর খুব ঝগড়া করতাম। যেদিন কাজকর্ম থাকত না, সেদিন ছোট কোনো ছলছুতায় ঝগড়া শুরু করে দিতাম। এটা ছিল আমার কর্মহীন সময়ের চরম বিনোদন এবং এক অর্থে বিরাট অর্জন। আমার আজকের বাকপটুতা এবং ধীরস্থির স্বভাব আমি দাম্পত্যের সেই খুনসুটি থেকেই অর্জন করেছি। সেই দিনগুলোতে আমি একটা-দুটো ফোড়ন কাটতাম, তারপর উনার জবানে ঘূর্ণিঝড় শুরু হতো এবং আমি চুপচাপ বসে তা উপভোগ করতাম। তো, এমনই এক ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি বলে বসলেন, ‘তোমার চেহারায় একটা কাঙাল কাঙাল ভাব আছে। আমি বলে সহ্য করছি, অন্য কোনো মেয়ে তোমাকে দারোয়ান হিসেবেও নিয়োগ দিত না।’ রাজনৈতিক নেতার বডিগার্ডের আচরণের সঙ্গে সেই কাঙাল কাঙাল ভাবের মিল খুঁজে পাওয়ার পর আমার মন থেকে বিষাদের ছায়া কর্পূরের মতো উবে গেল।

 

এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করি। ‘বিবর্তন’ শব্দটি আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও দর্শনশাস্ত্রে যতবার ব্যবহার করা হয়, ততবারই চার্লস ডারউইনের বানরতত্ত্ব সামনে চলে আসে। লাখ লাখ বছর ধরে একেকটি বানর প্রজাতি কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করে ধীরে ধীরে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন সারা দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। বানর প্রজাতির প্রাণীর রূপান্তর ঘটেছে মানুষরূপে- এ কথা পৃথিবীর কোনো ধর্মমত গ্রহণ না করলেও বিবর্তন গাছের আলোচনা আজ পর্যন্ত থামেনি। এটা নিয়ে নাটক সিনেমা গল্প উপন্যাস- কত কী যে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু একটি বিষয় আমার জানা নেই, অথবা চার্লস ডারউইনের মতো কোনো বিজ্ঞানী এই ধরনের গবেষণা করেছেন কি না তা-ও বলতে পারব না, আর তা হলো- কোনো মনুষ্য সম্প্রদায় লড়াই-সংগ্রাম করে নিজেদের রূপান্তরিত মানবিক সত্তাকে বিবর্তনের মাধ্যমে আবার বানরের পর্যায়ে নিয়ে গেছে কি না।

 

মানুষের মধ্যে যদি বানর হওয়ার ইচ্ছা থাকত, তাহলে কোন শ্রেণির মানুষ সবার আগের বানর হতো, অথবা কোন অঞ্চল, কোন আবহাওয়া এবং কোন প্রকৃতি ও পরিবেশ মানুষকে অতি দ্রুত বানরে রূপান্তরে সহযোগিতা করে, এ বিষয় নিয়ে যদি আমার গবেষণার সুযোগ থাকত, তাহলে আমি দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বানর নাচ এবং বানরের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতাম। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতাম কিভাবে রাজনীতিবিদের লজ্জা-শরম-হায়া চলে যায়। তাঁরা জেলখানায় ঢুকে কেন এবং কিভাবে ভেংচি কেটে দাঁত বের করে হাসে এবং সুযোগ পেলে বিডিং বিডিং করে লম্ফঝম্প করে। আবার জেলখানা থেকে মুক্ত হওয়ার পর কিভাবে তারা লোকজনের কাঁধের ওপর চেপে বসে এবং অন্যের বাগানের কাঁঠাল এনে তা বাগান মালিকের মাথায় ভেঙে মনের আনন্দে ভক্ষণ করে থাকে। তারা দলে দলে হঠাৎ গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে কিভাবে লুটপাট করে এবং দাঁত কেলিয়ে বিশেষ অঙ্গ দুলিয়ে প্রকাশ্যে লুটের মালপত্র নিয়ে উল্লাস করে।

 

রাজনীতিকে ব্যবহার করে কিছু মানুষের অর্থ উপার্জন, সম্পদ দখল এবং ভোগবিলাস ও আনন্দফুর্তির সঙ্গে বানরের কী কী অন্তঃমিল রয়েছে, তা নিয়েও আমি গবেষণা করতাম। মানুষরূপী একটি শ্রেণি কী পরিমাণ পরের সম্পদ চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি করার জন্য রাজনীতিকে ব্যবহার করে টানা কত বছর কুকর্ম করলে বানরদের স্বভাবকে হার মানাতে পারবে এবং ধীরে ধীরে বংশপরম্পরায় মানুষ থেকে বানরে রূপান্তরিত হতে পারবে, তা নিয়েও গবেষণা করতাম।

লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।,  সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিএনপি হতাশ : সালাহউদ্দিন

» বিমানবন্দরের বোর্ডিং ব্রিজে লন্ডনগামী বিমানের ধাক্কা

» নারীর অদম্য সাহসেই গড়ে উঠবে জলবায়ু সহনশীল বাংলাদেশ : উপদেষ্টা রিজওয়ানা

» নাতিজামাই ও তার সহযোগীদের ছুরিকাঘাতে বৃদ্ধ নিহত,শ্বাশুড়িসহ ৪জন আহত

» আরও এক মামলায় গ্রেফতার সাবেক খাদ্যমন্ত্রী

» ঘুমন্ত অবস্থায় অটোচালককে কুপিয়ে হত্যা

» যমুনায় নির্বাচন প্রস্তুতি বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত

» হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত পলাতক আসামি গ্রেফতার

» মাইক্রোবাস খাদে পড়ে ৫ জন আহত

» গুলিসহ একনলা আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার

 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

রাজনীতির বিবর্তন! বানর থেকে বিজ্ঞানী

ফাইল ছবি

 

গোলাম মাওলা রনি  : ঘটনাটি যে এভাবে ঘটবে, তা আমরা কেউই কল্পনা করতে পারিনি। আমার জীবনে এমনতরো দুর্ঘটনা কোনো দিন ঘটেনি। অন্যদিকে আমার সঙ্গী-সাথিরাও ঘটনার আকস্মিকতায় রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। ঘটনার রাতে আমরা একটি টেলিভিশন টক শো শেষে নিচে নামার জন্য লিফটে উঠছিলাম। আমি সাধারণত ভদ্রতা করে সঙ্গী-সাথিদের আগে লিফটে উঠতে দিই, তারপর নিজে উঠি। কোথাও বসা, কোনো কামরায় ঢোকা, একত্রে পথ চলা কিংবা খানাপিনার সময় সেই বালকবেলা থেকে আজ পর্যন্ত সাধারণভাবে নিজেকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করি, যেন কোনো কিছুতেই কাউকে পেছনে ফেলে, কাউকে ধাক্কা মেরে অথবা সবার আগে বসে পড়া অথবা সবার আগে উঠে পড়ার মতো কাণ্ড আমার দ্বারা না হয়।

 

উল্লেখিত কর্ম করতে গিয়ে আমার অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি; বরং প্রায় সব ক্ষেত্রে লাভ হয়েছে। কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়নি; স্বার্থ বা প্রাপ্তি নিয়ে কারো সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়নি; এমনকি কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়নি। শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে সম্মুখ সারিতে থেকে যাঁরা ফাঁকা শ্যুট করেন অথবা গুঁতাগুঁতি করে নেতা-নেত্রীর পাশে দাঁড়ান, তাঁদের মতো করে কোনোকালে আমার একটা ফটো তোলা হয়নি। সেই ১৯৮২ সাল থেকে রাজা-বাদশাহ আমির-ওমরাহ হাতি-ঘোড়া পাইক-পেয়াদা দেশে আসছে। তারপর ১৯৮৬ সাল থেকে ক্ষমতার অন্দরমহলে যাতায়াত এবং ২০০১ সাল থেকে ক্ষমতা, রাজনীতি এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু একটা ফটো তোলার সুযোগ হয়নি, অথবা কোনোকালে মনে হয়নি যে কারো সঙ্গে আমার একটি যুগলবন্দি ছবি থাকা দরকার।

আমি অজপাড়াগাঁ থেকে আসা একজন গেঁয়ো মানুষ। অভাব আমার কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষা-অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমি আজ ও প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। গ্রাম থেকে থানা-শহর, তারপর জেলা-বিভাগ হয়ে রাজনীতি। তারপর বিদেশের বড় বড় শহর, বড় বড় অট্রালিকা, বড় বড় মানুষ- বিচিত্র প্রকৃতি, বিচিত্র পরিবেশ এবং অসংখ্য শ্রেণি-পেশার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, জীবন যৌবন অর্থবিত্ত ক্ষমতা কাম ক্রোধের সীমা-পরিসীমা খুবই সীমিত ও স্বল্পস্থায়ী। ফলে বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা, ধন-সম্পদ, ক্ষমতা অর্জনের অবারিত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, অথবা অন্যের জন্য উপকারী নয়, ওসব কোনো কিছুই আমাকে আকর্ষণ করেনি।

 

আমার ব্যবসা যখন তুঙ্গে তখন আমি যেমন ছিলাম, এখনো তেমনই আছি। অথবা যখন আমার অর্থবিত্ত ক্ষমতা জৌলুসের বন্যা শুরু হয়নি তখন যেভাবে চলতাম, ঠিক একইভাবে সারাটি জীবন চলেছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম বর্ষের জীবনাচরণ এবং হাল-আমলের জীবনযাত্রার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। আজকের নিবন্ধের শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কেন তেতো কথা বললাম তা স্পষ্ট করার জন্য চলুন সেই রাতে টেলিভিশন টক শো শেষে লিফটে উঠতে গিয়ে কী ঘটেছিল, তা সংক্ষেপে বলি।

 

অনুষ্ঠানে আমরা তিনজন অতিথি ছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজক আমাদের বিদায় দিচ্ছিলেন। ভদ্রতা করে আমি দুজন মেহমানকে আগে লিফটে উঠতে দিয়ে যেই না নিজে ওঠার জন্য পা বাড়ালাম, অমনি পেছন থেকে কে যেন আমাকে টেনে ধরল, তারপর আমাকে ধাক্কা মেরে সে নিজে লিফটে উঠে পড়ল। ভদ্রলোকের গায়ে ডিবি বা এসএসএফের আদলে তৈরি পোশাক। অনুমান করলাম, তিনি হয়তো কারো বডিগার্ড। একটু পরে বুঝলাম, আমার এক সহ-আলোচক, যিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, তাঁরই বডিগার্ডরূপে আলোচিত লোকটি আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে তাঁর মালিকের বডি রক্ষায় নিজের বাহাদুরি প্রদর্শন করছিলেন। বিষয়টি আমি খুব স্বাভাবিকভাবে নিলাম। কারণ আমার পরিচিত অনেকেই হঠাৎ টাকা-পয়সা বা ক্ষমতার নাগাল পেয়েই বডিগার্ড ভাড়া করেন, কেউ কেউ জার্মান শেফার্ড কেনেন। নিজেদের অভিজাত প্রমাণের জন্য নিয়মিত পাঁচতারা হোটেলের আড্ডায় জড়ান এবং জুয়া-সাকিতে আসক্ত হয়ে পড়েন। ওসব দৃশ্য দেখে আমার প্রতিক্রিয়া হয় না। কারণ সাত-আট বছর পর ওসব লোক হয় দেউলিয়া হয়ে পড়ে, নতুবা ভাগ্য বিপর্যয়ে জেলের ঘানি টানে। সুতরাং বডিগার্ডের ধাক্কা খেয়ে আমি দুকদম পিছিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার সহ-আলোচক সেই রাজনৈতিক নেতা চিৎকার করে তাঁর বডিগার্ডকে গালমন্দ করলেন এবং নিজে লিফট থেকে নেমে এসে আমার হাত ধরে দুঃখ প্রকাশ করে আমাকে লিফটে ওঠালেন। লজ্জায় তাঁর মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি নিচে নেমে আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলেন। আমার গাড়ির প্রশংসা করলেন এবং ভদ্রতা করে আমার গাড়ির দরজা নিজ হাতে বন্ধ করে আমাকে বিদায় জানিয়ে তারপর নিজের গাড়ির দিকে রওনা হলেন।

 

ঘটনা যেভাবে ঘটল, তাতে আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো আমার মন খারাপ হয়ে গেল। বডিগার্ডওয়ালা রাজনৈতিক নেতার ভদ্রতা ও বিনয় দেখে মনে হলো, আমি বোধ হয় গলাধাক্কা খেয়ে অপমানিত হয়েছি। অথচ তাঁর বডিগার্ডের আচরণ আমার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল। ভদ্রলোকের বিনয় কেন আমার মন খারাপ করে দিল, তা আমি এখনো বুঝতে পারছি না। সেই রাতে গাড়িতে বসে আমি নিদারুণ অস্থিরতা অনুভব করলাম। আকাশকুসুম কল্পনা এবং এলোমেলো চিন্তায় আমার মন  ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। এমন সময় স্ত্রী মহাদয়ার একটি অতীত স্মৃতি মনে করে হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেল। আমার বিয়ে হয়েছে ১৯৮৬ সালে। বিয়ের প্রথম কয়েক বছর খুব ঝগড়া করতাম। যেদিন কাজকর্ম থাকত না, সেদিন ছোট কোনো ছলছুতায় ঝগড়া শুরু করে দিতাম। এটা ছিল আমার কর্মহীন সময়ের চরম বিনোদন এবং এক অর্থে বিরাট অর্জন। আমার আজকের বাকপটুতা এবং ধীরস্থির স্বভাব আমি দাম্পত্যের সেই খুনসুটি থেকেই অর্জন করেছি। সেই দিনগুলোতে আমি একটা-দুটো ফোড়ন কাটতাম, তারপর উনার জবানে ঘূর্ণিঝড় শুরু হতো এবং আমি চুপচাপ বসে তা উপভোগ করতাম। তো, এমনই এক ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি বলে বসলেন, ‘তোমার চেহারায় একটা কাঙাল কাঙাল ভাব আছে। আমি বলে সহ্য করছি, অন্য কোনো মেয়ে তোমাকে দারোয়ান হিসেবেও নিয়োগ দিত না।’ রাজনৈতিক নেতার বডিগার্ডের আচরণের সঙ্গে সেই কাঙাল কাঙাল ভাবের মিল খুঁজে পাওয়ার পর আমার মন থেকে বিষাদের ছায়া কর্পূরের মতো উবে গেল।

 

এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করি। ‘বিবর্তন’ শব্দটি আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও দর্শনশাস্ত্রে যতবার ব্যবহার করা হয়, ততবারই চার্লস ডারউইনের বানরতত্ত্ব সামনে চলে আসে। লাখ লাখ বছর ধরে একেকটি বানর প্রজাতি কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই-সংগ্রাম করে ধীরে ধীরে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন সারা দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। বানর প্রজাতির প্রাণীর রূপান্তর ঘটেছে মানুষরূপে- এ কথা পৃথিবীর কোনো ধর্মমত গ্রহণ না করলেও বিবর্তন গাছের আলোচনা আজ পর্যন্ত থামেনি। এটা নিয়ে নাটক সিনেমা গল্প উপন্যাস- কত কী যে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু একটি বিষয় আমার জানা নেই, অথবা চার্লস ডারউইনের মতো কোনো বিজ্ঞানী এই ধরনের গবেষণা করেছেন কি না তা-ও বলতে পারব না, আর তা হলো- কোনো মনুষ্য সম্প্রদায় লড়াই-সংগ্রাম করে নিজেদের রূপান্তরিত মানবিক সত্তাকে বিবর্তনের মাধ্যমে আবার বানরের পর্যায়ে নিয়ে গেছে কি না।

 

মানুষের মধ্যে যদি বানর হওয়ার ইচ্ছা থাকত, তাহলে কোন শ্রেণির মানুষ সবার আগের বানর হতো, অথবা কোন অঞ্চল, কোন আবহাওয়া এবং কোন প্রকৃতি ও পরিবেশ মানুষকে অতি দ্রুত বানরে রূপান্তরে সহযোগিতা করে, এ বিষয় নিয়ে যদি আমার গবেষণার সুযোগ থাকত, তাহলে আমি দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বানর নাচ এবং বানরের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতাম। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতাম কিভাবে রাজনীতিবিদের লজ্জা-শরম-হায়া চলে যায়। তাঁরা জেলখানায় ঢুকে কেন এবং কিভাবে ভেংচি কেটে দাঁত বের করে হাসে এবং সুযোগ পেলে বিডিং বিডিং করে লম্ফঝম্প করে। আবার জেলখানা থেকে মুক্ত হওয়ার পর কিভাবে তারা লোকজনের কাঁধের ওপর চেপে বসে এবং অন্যের বাগানের কাঁঠাল এনে তা বাগান মালিকের মাথায় ভেঙে মনের আনন্দে ভক্ষণ করে থাকে। তারা দলে দলে হঠাৎ গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে কিভাবে লুটপাট করে এবং দাঁত কেলিয়ে বিশেষ অঙ্গ দুলিয়ে প্রকাশ্যে লুটের মালপত্র নিয়ে উল্লাস করে।

 

রাজনীতিকে ব্যবহার করে কিছু মানুষের অর্থ উপার্জন, সম্পদ দখল এবং ভোগবিলাস ও আনন্দফুর্তির সঙ্গে বানরের কী কী অন্তঃমিল রয়েছে, তা নিয়েও আমি গবেষণা করতাম। মানুষরূপী একটি শ্রেণি কী পরিমাণ পরের সম্পদ চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-রাহাজানি করার জন্য রাজনীতিকে ব্যবহার করে টানা কত বছর কুকর্ম করলে বানরদের স্বভাবকে হার মানাতে পারবে এবং ধীরে ধীরে বংশপরম্পরায় মানুষ থেকে বানরে রূপান্তরিত হতে পারবে, তা নিয়েও গবেষণা করতাম।

লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।,  সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com