খান মুহাম্মদ রুমেল:
জীবন কি আর সব সময় এক যায় রে পাগল!
রহিম চাচার বাণী আমাদের উদ্দেশ্যে। আমরা মানে—যারা এই এলাকার ছেলেপেলে। এই করোনাকালে আমাদের কোনো কাজ নেই বলে মাঝে মাঝে লকডাউন কেমন জিনিস তা দেখতে বের হই। না, বেশিদূর যাই না আমরা। গলির মাথায় রহিম চাচার টং দোকান পর্যন্ত দৌড় আমাদের। এই ধরেন এক কাপ চা খেলাম। রহিম চাচাকে ফাঁকি দিয়ে দোকানের পিচ্চির কাছ থেকে সিগারেট নিলাম একটা। এই রকম আর কি। করোনায় আজ কয়জন মারা গেলো, লকডাউন আরও বাড়ল কি-না, শপিংমল খুলবে কবে, খুললে কয়টা পর্যন্ত বেচাকেনা করা যাবে ইত্যাদি আমাদের জানার বিষয়। এসব খবর বাসায় বসেও নেওয়া যায়। তবুও রহিম চাচার দোকানে এলে এসব খবর পাক্কা নেওয়া যায়। আজকাল টিভি, পত্রিকাওয়ালারা তো লেখে সব মনগড়া বানানো খবর। এই যেমন পরশু দিন সাত নম্বর লেনের মোবারক ভাই যে করোনায় মারা গেলেন—তথ্যটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের মোট মৃত্যুর তালিকায় আছে কি-না, এটা কি কোনো পত্রিকা নিশ্চিত করে বলতে পারবে? সুতরাং আমাদের রহিম চাচার দোকানে আসতেই হবে প্রতিদিন।
আমাদের পাড়ার মেইন গলির একেবারে মাথায় রহিম চাচার দোকান। চুলের ক্লিপ থেকে শুরু করে কুসুম কুমারী তেল, মসুরের ডাল থেকে শুরু করে মতিচুর লাড্ডু, গমের লাল আটা থেকে শুরু করে খাঁটি সরিষার তেল—সব পাওয়া যায় এই দোকানে। এছাড়া এক কোণায় চায়ের সরঞ্জামের পাশে বিড়ি-সিগারেট নিয়ে বসে থাকে পিচ্চি পল্টু। দোকানের ঠিক মাঝখানে সিংহাসনের মতো চেয়ারে রহিম চাচা। সব দিকে কড়া নজর তার। একটি সেফটিপিনও দোকানের র্যাক থেকে এক ইঞ্চি এদিক-সেদিক নড়ে গেলে চাচা সাথে সাথে টের পেয়ে যায়। যদিও চাচার বয়স প্রায় সত্তর। সেই রহিম চাচা যখন বলেন, ‘দিন সব সময় এক যায় না রে পাগল!’ তখন বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তা করতেই হয়। একেবারে হালকা বিষয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না ব্যাপারটা।
তা, দিন সব সময় এক যায় না কেন? চাচাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ফাজিল রনি। চাচা এই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বাঁ হাতে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলেন, ‘তোর বাপের বয়স জানি কতো!’ ঠিক এই সময় বড় রাস্তার মাথায় পুলিশের গাড়ি একটি দেখা গেলে আমাদের সবারই বাসার জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে যায়। আস্তে আস্তে বাড়ির পথ ধরি আমরা। আলোচনা সেদিনের মতো শেষ। পরের দুদিন আর যাওয়া হয় না রহিম চাচার দোকানে। এরপর আমাদের বন্ধু খোকন করোনা পজিটিভ জানার পর তো বাসায় এক রকম কারফিউ জারি করেন বাবা। আমার বাইরে বের হওয়া তো বন্ধই—সারাদিন এবং প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত টো টো করে বেড়ানো ছোট চাচা পর্যন্ত দেখি ঘরের মধ্যেই শুয়ে আছে। এখানে একটা কথা বলে রাখি, ছোট চাচা টো টো করে বেড়ায় এটা বাবার কথা। ছোট চাচার কথা হলো তিনি ব্যবসার খোঁজে আছেন। চাকরি-বাকরি তার পোষাবে না। আচ্ছা এই আলোচনা থাক।
সাড়ে নয়টা না বাজতেই চারদিকে রোদের তেজ তীব্র। পুড়ছে চারপাশ। পাশের বাসার মিতিদের বাসার সামনে একটা পিকআপ দাঁড়ানো। পিকআপে হাড়ি, পাতিল, লেপ, তোশক থেকে শুরু করে টুকিটাকি নানা কিছুর লটবহর বোঝাই করা হচ্ছে। মিতিরা কি বাসা ছাড়ছে না-কি? এই করোনাকালে বাসা বদলের ঝামেলা কেন আবার! ঘর থকে বের হয়ে এগিয়ে যাই ওদের বাড়ির দিকে। না, বাসা না, ঢাকা ছাড়ছে মিতিরা। গ্রামে চলে যাচ্ছে। মিতির বাবা, জাফর চাচার চাকরি নেই আট মাস হলো। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে তিন মাস। মিতির কলেজ তো বন্ধ সেই কবে থেকে। স্কুলপড়ুয়া ছোট ভাইটাকে পড়াতে আসতো এক মাস্টার। তাকেও ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। সব মিলিয়ে দিশেহারা জাফর চাচা গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। যদি সেখানে কিছু করা যায়। গেলো তিরিশ বছর ধরে জাফর চাচা ঢাকায়। খুব বড় না হলেও ভালোই একটি চাকরি করতেন। কিন্তু এই লকডাউনকালে সেটা চলে যাওয়ায় খুব বিপদে পরিবারটি।
বসার ঘরের এক কোণায় টুকটাক কী একটা প্যাক করছিল মিতি। মুখটা খুব গম্ভীর। পাশের ঘর থেকে আন্টিকে সাথে নিয়ে বসার ঘরে আসে মা। মিতিদের চলে যাওয়ার খবর শুনে সকালেই চলে এসেছিলেন মা। ঘুমকাতর আমি টেরই পাইনি। চাচি এবং মা দু’জনই মুখভার করে আছেন। কিছুই বলতে পারি না। না চাচিকে, না মিতিকে। শুধু গলার কাছে কেমন ব্যথা ব্যথা করে। জ্বলতে থাকে চোখটাও। গেলো ১৬ বছর ধরে বাড়িটিতে থাকতো মিতিরা। রান্নাঘর কি বারান্দায় ভেজা কাপড় মেলে দেওয়ার সময় মায়ের আর রওশন চাচির কতো গল্প। কতোদিন দুপুরবেলা খেতে বসে তরকারি পছন্দ না হলে হইচই-চেঁচামেচি করেছি। মিনিট কয়েকের মধ্যে দেখা যেত একটি প্লাস্টিকের বাটিতে বেশখানিকটা তরকারি নিয়ে হাজির মিতি। রওশন চাচি পাঠিয়েছেন। কতোদিন সন্ধ্যা মেলাবার পর বাড়ি ফিরেছি বলে বকাবকি করতেন বাবা। তখন আড়াল হয়ে দাঁড়াতেন রওশন চাচি। তিনি হয়তো তখন শোয়ার ঘরে মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করছেন। ঈদে-পার্বণে, আনন্দ-দুঃখে কতো স্মৃতি পরিবারটির সঙ্গে।
বাড়ি থেকে যেদিন দাদা মারা যাওয়ার খবর এলো, আমার স্কুলে তখন ফাইনাল পরীক্ষা চলে। পরীক্ষা দিয়ে এসে দেখি বাবা-মা, ছোট চাচা সবাই বাড়ি চলে গেছে। আমাকে সেই কয়টা দিন আগলে রেখেছিলেন রওশন চাচি। জাফর চাচাকে পাঠাতেন আমার সঙ্গে ঘুমানোর জন্য। রাতে আমার সঙ্গে শুতে এসে গম্ভীর জাফর চাচা আমার বন্ধু হয়ে যেতেন। গল্প করতেন অনেক। তার ছোটবেলার গল্প। অফিসের গল্প। অফিস শেষে বাড়ি আসার পথে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে পড়ে নাকাল হওয়ার গল্পও বলতেন তিনি। সেই পরিবার আজ চলে যাচ্ছে। চলে যেতে হচ্ছে। কী নিদারুণ কষ্ট। বেলা চড়ে গেছে অনেকটা। সূর্য একেবারে মাথার ওপর। পিকআপওয়ালা তাড়া দিচ্ছে খুব। এখন রওয়ানা না দিলে রাস্তায় ঝামেলায় পড়তে হবে। ধীর পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন চাচি। জাফর চাচা আগেই বের হয়েছেন। চাচা যেন পাথর। কোনো রাগ-অভিমান, দুঃখ-বেদনা কিছু নেই তার চোখে। কারো সঙ্গে কথাও বলেন না। আনুষ্ঠানিক বিদায় নেন না কারো কাছ থেকে। ঘর থেকে বের হওয়ার পর হঠাৎ কি হয়—মিতির হাতটি ধরে ফেলি আমি। চোখের জলে চারপাশ ঝাপসা হয়ে যায়। মাথা নিচু করেও বুঝতে পারি কাঁদছে মিতিও। হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাই আমরা। অন্য সময় হলে কী হতো জানি না। কিন্তু আজ এ দৃশ্য দেখেও মা কিছু বলেন না।
হর্ন দিতে দিতে চলে যায় মিতিদের পিকআপ। ছোট্ট পিকআপে চেপে চলে যাচ্ছে রওশন চাচির তিন দশকের সংসার। চলে যাচ্ছে জাফর চাচার স্বপ্ন এবং সংগ্রাম। চলে যাচ্ছে মিতি।
সারাদুপুর বাসায়ই থাকি। বিকেলের দিকে রোদ কিছুটা মরে এসেছে। ছোট চাচা ঘুমাচ্ছেন অঘোরে। বাবা বাড়ি নেই। মায়ের ঘরে ফ্যান চলছে। কিন্তু বিছানাটা শূন্য। এ সময়ে তো মার একটু বিশ্রামের সময়। আজ কোথায় গেলেন হঠাৎ। খোঁজ করতেই দেখি, বারান্দায় বসে আছেন একটা বেতের মোড়ায়।
আমি একটু বাইরে গেলাম মা। দরজাটা লাগিয়ে দিও।
আচ্ছা।
অন্য সময় হলে এ সময়ে আমার বাইরে যাওয়া নিয়ে রাগারাগি করতেন মা। আজ কিছুই বলেন না। রহিম চাচার দোকানটি আজ একেবারেই ফাঁকা। বসে থাকি অনেকক্ষণ। চাচার সাথে গল্প করি। এর-তার খবর জানতে চাই। কেউই আসে না এখন দোকানে।
বুঝলা মিয়া করোনা অনেক বাড়সে। বাসা থেইক্যা কেউ বারায় না এহন। বেচাবিক্রিও প্রায় বন্ধ।
হ, চাচা। করোনা আসলেই বাড়সে।
তোমাদের পাশের বাড়ির জাফর সাবরা না-কি চইল্যা গেসে?
হুম, আজ সকালে।
এরপর আর গল্প জমে না। বাড়ির পথ ধরি আমি। অথচ সন্ধ্যা মেলাবার তখনো অনেক দেরি। এই তো কিছুদিন আগের কথা। মানুষে মানুষে গিজগিজ করতো আমাদের পাড়াটা। আর দিনভর কতো হাঁকডাক। তালা-চাবিওয়ালা, সবজিওয়ালা, ছাইওয়ালি, নষ্ট ল্যাপটপ, নষ্ট মনিটর কিনতে আসা সেই সুরেলা কণ্ঠের লোকটি—যাকে কখনো দেখিনি, শুধু গলা শুনেছি দিনের পর দিন, মালাই কুলফিওয়ালা—সবাই মিলে মুখর করে রাখতো। এখন কেমন সুনসান। কবরের নীরবতা।
বাসায় গিয়ে গোসল করে চুপচাপ শুয়ে থাকি। পরের দিন সকাল থেকে মন খারাপ ভাবটা কমতে থাকে। লকডাউনকালের নতুন বাস্তবতায় অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি। কাটছে একেকটা দিন।
মিতিরা চলে গেছে সপ্তাহ পেরিয়েছে। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় খুব খারাপ খবর আনলেন ছোট চাচা। গ্রামে যাওয়ার পথে অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল মিতিদের গাড়ি। সবাই ঠিক থাকলেও জাফর চাচা আর নেই। কীভাবে ঘটলো ঘটনাটি! কেউ বলে উল্টো দিক থেকে থাকা একটি নসিমনকে সাইড দিতে গিয়ে উল্টে পড়েছিল মিতিদের মিনিট্রাকটি। কেউ বলে এসব না, মিতিদের ভাড়া করা পিকআপের ড্রাইভারটি ফাঁকা রাস্তায় বেশি স্পিড দিতে গিয়ে রাস্তার পাশের খাঁদে উল্টো পড়েছে। ছোট চাচার কথায় খুব একটা বিশ্বাস করি না আমরা। চাচা কোত্থেকে কী শুনে এসেছে। হয়তো ছোটখাটো কোনো দুর্ঘটনা হয়ে থাকতে পারে। সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরলে আমরা নিশ্চিত হই, ছোট চাচার খবর মিথ্যা নয়। বাবার অফিসের এক কলিগের বাড়ি জাফর চাচার গ্রামে। তার কাছে বাবা শুনেছেন আজই। জাফর চাচা আর নেই। সড়ক দুর্ঘটনা নয়। গাড়ির মধ্যেই স্ট্রোক করেছিলেন মিতির বাবা।
‘বুঝলে, মানসিক চাপ। চাকরি হারানোর চাপটা নিতে পারেন নাই।’ মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন বাবা। উত্তরে মা কিছুই বলেন না। খুব গোপনে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে যায় হয়তো মায়ের বুক থেকে। আমরা টের পাই না।
সে রাতে আমাদের বাড়িতে রাতের খাবার খাওয়া হয় না কারোরই। অনেক রাতে চুপি চুপি ছাদে চলে যাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে রহিম চাচার কথা, ‘দিন সব সময় এক রকম যায় না রে পাগল!’ আসলেই দিন সব সময় এক যায় না। দিন বদলে যায়। জাফর চাচার পরিবারের দিনটিও কি বদলে যায় নিগাঢ় বিষাদে? বদলে যাওয়া দিনে মিতি কী করছে এখন? সূএ:জাগোনিউজ২৪.কম