অমৃতস্য বয়ান

ইশরাত তানিয়া:

ঐশ্বর্য নেই, গৌরব নেই। নেই ভাষা-ভাষ্য। তবু এক অধিকার থাকে। এমন এক অধিকার যা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা সম্ভব নয়। এটি হলো ছেড়ে যাবার, বিলুপ্ত হবার একান্ত অধিকার। চলে যাওয়ার এই একটি অধিকার আছে বলেই ভূমিস্পর্শ করে শুয়ে আছে কেউ। উপুড় হয়ে।

আমি বলব কিছুগন্ধের কথা। তারপর যে শুয়ে আছে তার কথা। এসব কথার মাঝেই তুমি অনুভব করবে আমি আসলে কে।এটুকু আমি বলতে পারি, ধুলোবালুর পৃথিবীতে সমস্তটা জুড়ে আছি।তোমাকে ঘিরেই আমি।

যখন তোমার পাশে এসে দাঁড়াই, প্রিয় একটা গন্ধ পাও। হতে পারে সেটি যে কোনো ফুলের, ঝাঁঝালো অ্যামোনিয়ার, কাঠ কিংবা নাড়া পোড়ানোর, বরফের, শশার, চাঁদের। যেমন তুমি ভালোবাসো। আমি ঘ্রাণশক্তিহীন।

এই তো আমি। মুহূর্তে ঢুকে যাই তোমার চুলে কিংবা বুকের ফুসফুসে। বেরিয়ে আসি। এক গভীর খেলা চলে তোমার সাথে। শুয়ে আছে যে, এবার এলাম তার ভেতর থেকে।

পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ও কাঁচা মেহেদীপাতার গন্ধ পেল। ঠান্ডা, ভেজা সুবাস।

মাথাটা ডানদিকে কাত করে, খোলা চোখে তাকিয়ে সে। দৃষ্টি আনুভূমিক আর বহুদূরে উধাও। সে দৃষ্টি ধরে এগিয়ে গেলে, পরিষ্কার দেখা যায় সীমাহীন রেললাইনের স্লীপার।কিছু ঘাস, পিঁপড়া নড়ছে। নুড়িপাথর পড়ে আছে দুটো পাতের আশেপাশে। আরেকটু দূরে স্টেশনের লালরঙা দালান। শুয়ে যে তার নাম আতাহার আলী।
পাশে শুয়ে আতাহার আলীর মেয়ে। দীর্ঘ আঁখিপল্লবে ঘেরাবিস্মিত দুটি চোখ। ডান পা ভাঁজ করা। ফ্রক বেশ খানিকটা উঠে গেছে। নীল হাফপ্যান্টের ইলাস্টিক ঢিলা হলেও কোমরে আটকে আছে। চুলে মুখ কিছুটা ঢাকা। হাতের মুঠোয় একটা লজেন্স। লজেন্সের মোড়কের যেটুকু বেরিয়ে আছে আলগা হয়ে, ঝিকমিক করছে রোদ পেয়ে।

কিছুক্ষণ আগে তিস্তা এক্সপ্রেস চলে গেছে। রক্তের ধারা ছিটকে পড়েছে লজেন্সের মোড়কে, ঘাসপাতায় আর নুড়ি পাথরে। গলগল করে বাকিটুকু স্লীপার উপচে বাইরে এসে পড়েছে। তাজা, লাল।

আমি সেই নোনা গন্ধ নিয়ে যাই হাসপাতালের মর্গে, থানায়।
জামরুল গাছের তলে শুকনো পাতার ধোঁয়ায়।

উঠানে মেলে দেয়া জমিলার একসময়ের ফুলছাপ, এখন রংজ্বলা সস্তা শাড়ির সুতায়।

চাঁদের হিসাবে দিন যায়। দিন প্রবিষ্ট হয় রাতে। রাত ফের দিনের সংখ্যা বদলে দেয়। দুনিয়াদারীর এত কিছু বোঝে না আতাহার। সে ভূমিহীন চাষি। অন্যের জমিতে বছরভর বর্গা খাটে। গরীব মানুষই রয়ে গেল আজনম। আধপেটা খেয়ে দিন যায়। আজানের আগেই ঘুম ভাঙে তার। সেই কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা অব্দি ঘাম ঝরায় জমিতে।

ভারী লাঙ্গল ঠেলে ক্ষেত চষা, হালের বলদগুলোর যত্ন নেয়াকিংবালাউয়ের মাচায় শিমের লতা তুলে দেয়া কোনো কাজেই অবহেলা নেই। মাটির মন জানে আতাহার, হাওয়ার মর্জি বোঝে। এবারও ধান ভালো না হলে মুশকিল। জমিলাকে ঝিয়ের কাজ করতে হবে ব্যাপারীর বাড়িতে। একমুঠো চালের জন্য।

বাড়ি ফিরে আতাহার চাপকল থেকে পানি এনে দেয় জমিলাকে। পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে ভুস করে মাথা তোলে। পর পর দুই ডুব দেয়। গামছা ভিজিয়ে গা ডলে। এশার নামাজ পড়েই গোগ্রাসে ভাত গিলে। কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে।

একদানা ভাতও থালায় পড়ে থাকেনা। সাথে সামান্য শুঁটকি ভর্তা নইলে শাকপাতা। জিভের ছোঁয়ায় স্বাদ টের পাওয়ার আগেই পেটে চালান হয়ে যায় সবকিছু। বাপের আমলের পিতলের এক বদনা আছে। সেটি উঁচু করে পানি ঢালে গলার ভেতর। কন্ঠহাড়ের ওঠানামায় গলাবেয়ে পানি ঢকঢক নেমে যায়।  ‘চোখে পিছলে যায় পিতলের উজ্জ্বলতা। অল্পবিস্তর ঘুম লেগে থাকে চোখের পাতায়।

রাতে জমিলা নিবিড় হয়ে আসে- আদর দিবা না? সেসব রাতে পুরুষ হয়ে ওঠে আতাহার। বউমাটিতে বীজ ছড়ায়।বছর ঘুরে যায়। নতুন মুখ আসে না। জমিলার মা ডাক শোনা হয় না।
আমি ততটুকুই বলবো।
আতাহারের ফিসফিস যতটা মিশেছে কিংবা হারিয়েছে পূবালী বাতাসে।
চাঁদের কথা কিংবা হারিয়ে যাওয়া শ্রীপুর।
ফের ভেসে আসে বিগত যা কিছু,শুয়ে থাকা আতাহারের খোলা চোখে।
রেললাইনের ওপরে। আলোয় দুচোখ ধুয়ে যায়। বাতাস শুকিয়ে দেয় আর্দ্রতাটুকু।

সকাল থেকেই কড়া মেজাজ সূর্যের আর রাত ছিল ঝড়ের। রাজানগর থেকে প্রায় দুমাইল লম্বা আলকাতরা মাখা রাস্তা। সেই রাস্তা থেকে ওরা নেমেছে। তখন প্রায় বিকেল। মাটির পথে আধ ঘণ্টা হাঁটলে শ্রীপুর গ্রাম।কখনও চওড়া কখনও সরু মাটির পথ। সরু এমনই যে স্কুটার, রিকশা, ভ্যান কাঁচাপথে এঁটে ওঠে না। খুশি আর উদ্বেগের চাপ চাপ জলে ডুবছে ভাসছে আতাহারের মন।

নিরালা রাস্তা ঢেকে আছে দুপাশের ঘন বাঁশঝাড়। ভেজা পাতার মতো আধ ময়লা পাঞ্জাবীটা ওরবুকে লেপ্টে আছে। বৃষ্টিভেজা ছেঁড়া পাতা যেমন সেঁটে থাকে এখানে সেখানে।হাওয়া যেন সব হাঁপরের বুক থেকে বেরিয়ে চারদিক পুড়িয়ে দেয়।

সন্ধ্যার পর কালবৈশাখী। তারপর টিনের চাল উড়ল এক ঘরের। মড়াৎ মড়াৎ ডাল ভেঙে পড়ল উঠানে, গোয়ালে, যেখানে যেখানে সম্ভব। এত কিছুর মধ্যে জমিলাকে ঠিকঠাক দেখতেই পেল না আতাহার। গুড়ের বাতাসা খেলো আর কাগজী লেবুর শরবত। টিমটিমে হারিকেনের আলোয় জলকাদার মধ্যেই ওর বিয়ে হয়ে গেল। তারপর মুরগীর ঝাল সালন দিয়ে সাদা মোটা ভাত।

বহুদিন পর আতাহারের মনে পড়ে শাড়ীর পুটলীর মধ্যে তেল জবজবে চুল, চিকন লম্বা নিখুঁত সিঁথি। পানপাতার মতো মুখ তুলতেই থেবড়ে যাওয়া কুমকুম টিপ, চোখের চারদিকে কাজল ছড়িয়েছে। ঝড় থেমেছে বহুক্ষণ আগেই। চাঁদ ঢলে পড়েছে। ওদিকে আকাশে, এদিকে আতাহারের বুকের চাতালে।

পরীবানু উড়ে বেড়ায়। শালিকের বাচ্চা মুঠোয় ধরে বাসায় তুলে দেয়। প্রাণের  ধুকপুকেও মটুকু হাতে লেগে থাকে। সাতবছরের চোখ দিয়ে বহুবর্ণিল জগৎ দেখে। বিস্মিত হয়ে ভাবে কেমন করে নদী চমকায়।খেলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় আমলকী গাছের তলায়। হালকা সবুজ পাতার দিকে তাকিয়ে ভাবে আমলকীর স্বাদ বিচ্ছিরি, কিন্তু খেয়েপানি খেলে,কী মিষ্টি! পানির স্বাদ বেড়ে যায় কত। তখন একটু একটু করে গ্লাসের পানিতে চুমুক দেয় পরী।

মেয়ে বিইয়ে মা মরে গেলে, জমিলা হাঁ করে দেখছিল সদ্যজাত পরীকে। মুখ থেকে কটি শব্দ উড়ে যায় ওর- মা গো মা! আসমানের পরী নাইমা আইছে। সেই যে জমিলার বুকের নরমে ঘুমিয়ে পড়ে পরী, এখনও মায়ের বুকে মুখ না ডুবালে ঘুম আসে না। বুকে আগলে আগলে ওকে এতটা বড় করেছে আতাহার-জমিলা। বাপজান আর মায়ের আদরআহ্লাদের সীমা নাই মেয়েকে নিয়ে। আজ স্কুল বন্ধ। সারাদিন টো টো করে পরী দুপুরে এলো, তখন উনুনে ভাত বলকায়। কাঠের খুন্তি দিয়ে জমিলা কয়েকটা ভাত উঠায়। টিপে দেখে সিদ্ধ হলো কিনা। বাকি ভাতগুলো পাতিলে ডুবিয়ে দেয়। খুন্তিরাখে ঢাকনার ওপর। পা খুঁড়িয়ে পরী হাঁটছে। সকালের পান্তা ভরা পেট চুপসে গেছে। মুখ শুকিয়ে এতটুকু।
‘ও পরী এদিক আয়, কি অইছে পায়ো?’

‘কাইট্টা গেছে।’ টপটপ রক্ত পড়ছে ডান পায়ের গোড়ালী থেকে।
‘আ’লো বেডি, দেখিসে, কেমনে কাটছে?’

‘জহির ভাই জোর কইরা সাইকেলো উডাইছে। জঙ্গলের দিকে যাওন ধরছে। নামতে গিয়া চেইনেবাইজ্জা পাও কাইট্টা গেছে।’

মলিন টিনের জগ থেকে জমিলা পানি ঢালে পরীর পায়ে। দুর্বাঘাস দাঁতে পিষে। এতটা কেটে হাঁ হয়ে আছে। ব্যান্ডেজ করা লাগবে হয়তো। আরো গভীর দুশ্চিন্তার বুদবুদ মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়। কয়েক মাস ধরে জহির সুযোগ পেলেই পরীকে উতক্ত্য করছে। কিন্তু আজকের মতো বাড়াবাড়ি আগে করে নাই। মহাউৎপাত শুরু করেছে জহির। বখাটেপনার একটা বিহিত করা দরকার।

ভাতের পাতিল মাটির উনুন থেকে নামিয়ে রাখার কথা জমিলা ভুলে যায়। গলা ভাত জুটবে সবার পাতে। রক্তধোয়া গোলাপি জল শুষে নেয় তেতে ওঠা রুখাশুখা মাটি।

রেলওয়ে পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা ওদের নিয়ে যাবে।তার আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।বাপ-মেয়ের অপেক্ষায় জেগে থাকে মেডিক্যালকলেজ হাসপাতালের হিমশীতল মর্গ। ষাট পাওয়ারের হলুদ আলো হিম অন্ধকারকে পুরো চূর্ণ-বিচূর্ণ করতেপারেনা। সেই ক্ষীণ আলোতেই ময়নাতদন্ত হবে।
শবাগারে ঢুকে আতাহারের নৈঃশব্দ্য মিশে যাবে আলো হাওয়ায়। আবরণহীন কাটাছেঁড়া মৃতদেহের ভেতরে যে মন, তার কথা শুনব আমি। ক্রমশ আমার আগ্রহ বাড়ে। বলব সেই নীরবতাটুকু।

আষাঢ়ের মাখামাঝি। মাঠজুড়ে সবুজ পাটক্ষেত মানুষ সমান লম্বা। দাঁড়িয়ে আছে নীল আকাশের নিচে। জল ঝরিয়ে মেঘগুলো পুব দিকে ভেসে গেছে। যুতসই বৃষ্টিপাত আর গনগনে তাপে পাটগাছ আরো বাড়ন্ত।

ওর সংজ্ঞাহীন শরীর ঘন পাটগাছের ফাঁদে দেখা যায় না।
ওর চোখ থেকে জলের দাগ ধুলোলেপা মুখে এঁকেবেঁকে চিবুক অব্দি নেমে গেছে।
ওর জামা চটচটে থেকে ক্রমশ শক্ত হয়ে গেছে রক্তের স্রোতে।
ওর হাফপ্যান্ট পড়ে আছে ঘাসের আড়ালে।

একটা সাইকেল চলে যায় পাটক্ষেত পেরিয়ে। মাঠেরধার ঘেঁষে। মৃদু ক্যাঁচক্যাঁচে শব্দ নিয়ে দুটো চাকা গড়ায় ইটের সোলিং রাস্তায়।
পুরু মেঘগুলোরোদবুজিয়েবৃষ্টিঝরায়।আকাশধূসরতা ছড়ালে চারদিক আরো ঘোলাটে। আতঙ্কে নীলাভ হয়ে যায় পরীর মন। মানুষের ছায়া দেখলে কেঁপে ওঠে ছোট্ট শরীর। ভাগ্যের জোরে বেঁচে আছে পরী। বলা ভালো, মরে যাওয়া হলো না। হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। সারাদিন শুয়েই থাকে। পায়ের দুপাশে ময়লা বালিশ। ওয়েল ক্লথ ভেসে যায় রক্তে-প্রস্রাবে। দোজখের আগুন জ্বলে ক্ষতবিক্ষত অপরিণত যোনীতে।

জহিরেরবাপ বিশাল ভুঁড়ির খাটো মানুষ। প্রভাবশালীদের গা থেকে অতিরিক্ত তাপ বেরোয়। যথেষ্ট দূরে বসেও আতাহার সেই আঁচ টের পায়।বৈঠকঘরের এক মাত্র টেবিলের ওপর খালি চায়ের কাপ। চায়ের সর লেগে আছে। নিজ গরজে মাছি উড়ছে বসছে কাপের ওপর। ক্রোধে জ্বলজ্বল করে জহিরের বাপের দুই চোখ। ক্ষিপ্ত গলায় বলে, ‘কুন সাহসে তুই জহিরের বিচার চাস? তুই হইলি পাগল।মাথার তার ছিড়া। কথাবাতরার ঠিক নাই।’
কোনো ভয় না, কিছু অস্থির লাগে আতাহারের, জহিরের বাপের কথা শুনে।

‘জহির কি ইচ্ছা কইরা এইডা করছে? পরীর স্বভাব ভালা না। ছিনাল মাগীতর মাইয়্যা। মরে তো নাই, বাইচ্যাআছে।’

রাজানগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফরিদউল্লা। সিগারেট না জ্বালিয়ে তর্জনী আর মধ্যমার মাঝখানে নাড়াচাড়া করে। প্লাস্টিকের চেয়ারের পেছনের দুই পা ওপরে উঠে যায়। নিজের পায়ে ভর দিয়ে সে সামনে ঝুঁকে। কিছু কথা বলে জহিরের বাপকে। তার গলায় রাগ, ক্ষোভ নাই। খুবই অন্তরঙ্গভাবে আপোষ মীমাংসার কথা বলে আতাহারকে। পাঁচ হাজার টাকায় আপোষ করাতে চায়। আতাহার নারাজ হয়। রাজী না হয়েই ফিরে আসে। ম্যাচের কাঠি আর বারুদের এক টক্করে জ্বলে ওঠে ফরিদউল্লার হাতের গোল্ডলিফ।

দুমাস পার হলো। দেশে আইন-কানুন আছে। ন্যায়বিচার সে পাবেই। কিন্তু থানায় গিয়ে আতাহার বহু চেষ্টাতেও অভিযোগ দায়ের করতে পারে না। মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে তো কী হয়েছে? ডিউটি অফিসার আর ওয়্যারলেস অপারেটর ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় ওকে।পড়তে গিয়েও দরজার চৌকাঠ ধরে নিজেকে সামলে নেয়।
পরী ধর্ষিত হলেই কী, নাহলেই বাকী? জীবিত বা মৃত পরীর কী গুরুত্ব আছে স্বার্থপর সমাজে? স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ দূর দূর করে তাড়ায়। কার কাছে নালিশ জানাবে আতাহার? দিন দিন দৌরাত্ম্য বাড়ে জহিরের।

এক কাল্পনিক ঘটনার জের ধরে, জহিরের লোকজন তিনটা ভেসপা চালিয়ে আসে। এসে হুমকী  দেয় পরীকে তুলে নিয়ে যাবে। ধর্ষণ করবে, রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করবে। এত সাহস চাষার পুতের, দারোগা-পুলিশ দেখায়। ঘটনা হলো আতাহারের গরু নাকি জহিরের বাপের ক্ষেতের বেড়া ভেঙেছে। বাঙ্গীর ক্ষেত খেয়ে ফেলেছে। অথচ গরু তখন গোয়ালে লেজ দিয়ে মাছি তাড়ায়। জাবর কাটে।

কোথায় তুমি থাকো আতাহার? জানো না, এখানে সবাই সবকিছু পায় না। সহায়তা নেই, সহমর্মিতা নেই। সেই অনাদিকাল থেকে ভেসে ভেসে কত কথা ইথারে নিয়ে ঘুরছি। হারিয়ে যায়নি একটি কথাও। শুধু সময়ের গহ্বরে প্রাচীনতা হারিয়ে গেছে আর বর্বরতা রয়ে গেছে পৌরুষ প্রকাশে। তুমি জানো না প্রাচীন ভারতে ধর্ষণের শাস্তি ছিল পুরুষদের উপস্থচ্ছেদ। এ শাস্তির বিরোধিতা করেছে অধিকাংশ আধুনিক পুরুষ। যারা অনেকেই মানবাধিকারকর্মী আর ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ। এ নাকি লঘু পাপে গুরুদণ্ড। তুমি সে খবর রাখো না। তাই হেঁটে বেড়াও এখানে সেখানে। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশায়। সামান্য আশ্বাসের জন্য ঘোরো দুয়ারে দুয়ারে। কেউ শুনতে চায় না। তাড়িয়ে দেয়।হাঁটতে হাঁটতে বড় ক্লান্ত তুমি এক সময়।

আসমানে মেঘের পর্বত ভাঙছে। বৃষ্টির টানা ধস শুরু হয়েছে তিনদিন ধরে। দলবলসহ জহির দা-লাঠি নিয়ে দিনভর আতাহারকে খোঁজাখুঁজি করে। পায় না। ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আতাহার আলী পালিয়ে বেড়ায়। রাতের কালো যখন হালকা হয়, ঘরে ফিরে আসে সে। দেখে গোয়ালঘরে গরু নাই।

শুনেই পরী কাঁপতে থাকে, আতঙ্কে অথবা জ্বরে। তেল চিটচিটে কাঁথার ভেতর ঢুকে যায়। জমিলা কাঁদে করুণ বিলাপ করে। শেষ সম্বল খুইয়ে থম ধরে বসে থাকে আতাহার।

হাওয়ায় পাশের ঘরের শুকনা মরিচের ঝাঁঝ। আজ হঠাৎ তেজপাতার ফোঁড়ন দেয়া ঢ্যালা খিচুড়ি খেতে মন চায়। নাক বেয়ে ঝাঁঝ মাথায় পৌঁছলে কাশি শুরু হয় আতাহারের।

কাশি থামলে একবার শুধু বলে, ভাত দেও। থালায় পানিভাত ডুবু ডুবু, যেমন ধান গাছের ডগাছুঁই ঢলের পানিনদী থেকে জমিনে উঠে আসে।

লবণ মেখে এক গাল ভাত খায়। কাঁথা সরিয়ে মেয়ের মুখে ভাত তুলে দেয়। শুকনা মরিচ ডলে পানিভাতে। ভাবে, গরু চুরীর বিচার করবে কে? এটা হয়তো আদৌ কোনো অপরাধ নয়। ধন্দ লাগে আতাহারের মনে। কোন এক দৈবযোগে জেনে গেছে এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। বুঝে গেছে আবারও ধর্ষিত হবে মেয়ে। পালাক্রমে ধর্ষিত হয়ে হয়তো খুনই হয়ে যাবে।

আর কত হাজার বছর অপেক্ষা করবে আতাহার আলী? ধোঁয়ারঙা আসমান থেকে হঠাৎ কোন উছিলায় গায়েবী মীমাংসা নামে। মৌসুমী হাওয়ায় কিছু একটা হয়ে ওঠে শরীরে, মনে। আবাদী জমির মাটির মন বোঝা বড় সহজ নয়। সেটা এবার দিব্যি বোঝা যায়। আর মেয়েমানুষের বুকের মতো হাত দিয়ে আদর করে দেখতে হয় না। প্যাঁককাদা হয়ে পায়ে লেগে থাকে।

এইডা অইল আসমানী রঙ, নিজের মনে বলে পরী। ঘোলাটে আকাশ বৃষ্টির নেশা কাটিয়ে রোদ্দুরে মাখামাখি। পরীর খুব ভালো লাগে। কতদিন পর বাপজানের হাতের আঙুল ধরে হাঁটছে। ওই দুটা পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আসলে উড়ে চলছে।

লম্বা ছায়া পড়েছে দুজনের। বড় বড় পা ফেলে নিজের ছায়া মাড়াতে চায় পরী। পারে না। সকাল বেলায় দুমুঠোপান্তা খেয়ে বাপ-মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে লাল দালানের রেলস্টেশানে চলে এসেছে।বাপ দুটো লজেন্স কিনে দিল। একটা মুখে পুরে আরেকটা মুঠোয় রাখল পরী। মায়ের জন্য।
অভিমান নেই, অভিযোগ নেই। নেই অক্ষমতা, অপমানবোধ। আছে শুধু এক অধিকার। ছেড়ে যাবার, বিলুপ্ত হবার একান্ত অধিকার। চলে যাবার এই একটি অধিকার আছে বলেই তিস্তা এক্সপ্রেস আসার ঠিক আগে,রেললাইনের পাশে বসে আতাহার আলী। একবার কত কী ভাবে আরেকবার ভাবে না কিছুই।

দ্বীন দুনিয়ার মালিক আল্লাহপাক বলেছেন- প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে তারপর আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। আল্লাহ’র এ কথা বিশ্বাস করে আতাহার। কী শান্ত মায়াবী উচ্চারণ! খরা কাটিয়ে দিলদরিয়ায় বয়ে যায় শীতল ধারা। অবশ্যই কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিদান দেয়া হবে।
মুহূর্তে আতাহার আলী মেহেদীর গন্ধ পায়। ঠাণ্ডা, ভেজা প্রিয় খুশবুতে মায়ের হাত ফিরে আসে। শবেবরাতের রাতে হালুয়ার গন্ধ ছাপিয়ে,মায়ের হাতের পাতা এই নরম সুবাস ছড়ায়।

গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে রেললাইনে সে মাথা পেতে দেয় নির্বিকার, পালিত কন্যার হাত ধরে।
কিছু ঘাস, পিঁপড়া নড়ছে আর কী অপূর্ব আলো ফেলেছে আকাশ! নিষ্প্রাণবাপ-মেয়ে আর রেললাইনের স্লীপারের ওপরে।

সূএ:ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ৫১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি

» এই সরকার ব্যর্থ হলে দেশ ব্যর্থ হবে : মির্জা ফখরুল

» স্বৈরাচার হাসিনা পালালেও তার লেজ রয়ে গেছে : তারেক রহমান

» বিচার যেন বিগত দিনের মতো না হয় : জয়নুল আবদিন ফারুক

» ঝালকাঠি থেকে ১১ রুটে বাস চলাচল বন্ধ

» অভিষেক ছাড়তে চেয়েছিলেন অভিনয়, ফেরালেন কে?

» রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেলেন সদ্য সাবেক আইজিপি ময়নুল

» ইসকন ইস্যুতে দেশি-বিদেশি ইন্ধন থাকতে পারে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

» আইনজীবী হত্যার তদন্তের নির্দেশ, দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

» ‌আমরা কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে দেব না : হাসনাত আব্দুল্লাহ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

অমৃতস্য বয়ান

ইশরাত তানিয়া:

ঐশ্বর্য নেই, গৌরব নেই। নেই ভাষা-ভাষ্য। তবু এক অধিকার থাকে। এমন এক অধিকার যা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা সম্ভব নয়। এটি হলো ছেড়ে যাবার, বিলুপ্ত হবার একান্ত অধিকার। চলে যাওয়ার এই একটি অধিকার আছে বলেই ভূমিস্পর্শ করে শুয়ে আছে কেউ। উপুড় হয়ে।

আমি বলব কিছুগন্ধের কথা। তারপর যে শুয়ে আছে তার কথা। এসব কথার মাঝেই তুমি অনুভব করবে আমি আসলে কে।এটুকু আমি বলতে পারি, ধুলোবালুর পৃথিবীতে সমস্তটা জুড়ে আছি।তোমাকে ঘিরেই আমি।

যখন তোমার পাশে এসে দাঁড়াই, প্রিয় একটা গন্ধ পাও। হতে পারে সেটি যে কোনো ফুলের, ঝাঁঝালো অ্যামোনিয়ার, কাঠ কিংবা নাড়া পোড়ানোর, বরফের, শশার, চাঁদের। যেমন তুমি ভালোবাসো। আমি ঘ্রাণশক্তিহীন।

এই তো আমি। মুহূর্তে ঢুকে যাই তোমার চুলে কিংবা বুকের ফুসফুসে। বেরিয়ে আসি। এক গভীর খেলা চলে তোমার সাথে। শুয়ে আছে যে, এবার এলাম তার ভেতর থেকে।

পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ও কাঁচা মেহেদীপাতার গন্ধ পেল। ঠান্ডা, ভেজা সুবাস।

মাথাটা ডানদিকে কাত করে, খোলা চোখে তাকিয়ে সে। দৃষ্টি আনুভূমিক আর বহুদূরে উধাও। সে দৃষ্টি ধরে এগিয়ে গেলে, পরিষ্কার দেখা যায় সীমাহীন রেললাইনের স্লীপার।কিছু ঘাস, পিঁপড়া নড়ছে। নুড়িপাথর পড়ে আছে দুটো পাতের আশেপাশে। আরেকটু দূরে স্টেশনের লালরঙা দালান। শুয়ে যে তার নাম আতাহার আলী।
পাশে শুয়ে আতাহার আলীর মেয়ে। দীর্ঘ আঁখিপল্লবে ঘেরাবিস্মিত দুটি চোখ। ডান পা ভাঁজ করা। ফ্রক বেশ খানিকটা উঠে গেছে। নীল হাফপ্যান্টের ইলাস্টিক ঢিলা হলেও কোমরে আটকে আছে। চুলে মুখ কিছুটা ঢাকা। হাতের মুঠোয় একটা লজেন্স। লজেন্সের মোড়কের যেটুকু বেরিয়ে আছে আলগা হয়ে, ঝিকমিক করছে রোদ পেয়ে।

কিছুক্ষণ আগে তিস্তা এক্সপ্রেস চলে গেছে। রক্তের ধারা ছিটকে পড়েছে লজেন্সের মোড়কে, ঘাসপাতায় আর নুড়ি পাথরে। গলগল করে বাকিটুকু স্লীপার উপচে বাইরে এসে পড়েছে। তাজা, লাল।

আমি সেই নোনা গন্ধ নিয়ে যাই হাসপাতালের মর্গে, থানায়।
জামরুল গাছের তলে শুকনো পাতার ধোঁয়ায়।

উঠানে মেলে দেয়া জমিলার একসময়ের ফুলছাপ, এখন রংজ্বলা সস্তা শাড়ির সুতায়।

চাঁদের হিসাবে দিন যায়। দিন প্রবিষ্ট হয় রাতে। রাত ফের দিনের সংখ্যা বদলে দেয়। দুনিয়াদারীর এত কিছু বোঝে না আতাহার। সে ভূমিহীন চাষি। অন্যের জমিতে বছরভর বর্গা খাটে। গরীব মানুষই রয়ে গেল আজনম। আধপেটা খেয়ে দিন যায়। আজানের আগেই ঘুম ভাঙে তার। সেই কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা অব্দি ঘাম ঝরায় জমিতে।

ভারী লাঙ্গল ঠেলে ক্ষেত চষা, হালের বলদগুলোর যত্ন নেয়াকিংবালাউয়ের মাচায় শিমের লতা তুলে দেয়া কোনো কাজেই অবহেলা নেই। মাটির মন জানে আতাহার, হাওয়ার মর্জি বোঝে। এবারও ধান ভালো না হলে মুশকিল। জমিলাকে ঝিয়ের কাজ করতে হবে ব্যাপারীর বাড়িতে। একমুঠো চালের জন্য।

বাড়ি ফিরে আতাহার চাপকল থেকে পানি এনে দেয় জমিলাকে। পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে ভুস করে মাথা তোলে। পর পর দুই ডুব দেয়। গামছা ভিজিয়ে গা ডলে। এশার নামাজ পড়েই গোগ্রাসে ভাত গিলে। কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে।

একদানা ভাতও থালায় পড়ে থাকেনা। সাথে সামান্য শুঁটকি ভর্তা নইলে শাকপাতা। জিভের ছোঁয়ায় স্বাদ টের পাওয়ার আগেই পেটে চালান হয়ে যায় সবকিছু। বাপের আমলের পিতলের এক বদনা আছে। সেটি উঁচু করে পানি ঢালে গলার ভেতর। কন্ঠহাড়ের ওঠানামায় গলাবেয়ে পানি ঢকঢক নেমে যায়।  ‘চোখে পিছলে যায় পিতলের উজ্জ্বলতা। অল্পবিস্তর ঘুম লেগে থাকে চোখের পাতায়।

রাতে জমিলা নিবিড় হয়ে আসে- আদর দিবা না? সেসব রাতে পুরুষ হয়ে ওঠে আতাহার। বউমাটিতে বীজ ছড়ায়।বছর ঘুরে যায়। নতুন মুখ আসে না। জমিলার মা ডাক শোনা হয় না।
আমি ততটুকুই বলবো।
আতাহারের ফিসফিস যতটা মিশেছে কিংবা হারিয়েছে পূবালী বাতাসে।
চাঁদের কথা কিংবা হারিয়ে যাওয়া শ্রীপুর।
ফের ভেসে আসে বিগত যা কিছু,শুয়ে থাকা আতাহারের খোলা চোখে।
রেললাইনের ওপরে। আলোয় দুচোখ ধুয়ে যায়। বাতাস শুকিয়ে দেয় আর্দ্রতাটুকু।

সকাল থেকেই কড়া মেজাজ সূর্যের আর রাত ছিল ঝড়ের। রাজানগর থেকে প্রায় দুমাইল লম্বা আলকাতরা মাখা রাস্তা। সেই রাস্তা থেকে ওরা নেমেছে। তখন প্রায় বিকেল। মাটির পথে আধ ঘণ্টা হাঁটলে শ্রীপুর গ্রাম।কখনও চওড়া কখনও সরু মাটির পথ। সরু এমনই যে স্কুটার, রিকশা, ভ্যান কাঁচাপথে এঁটে ওঠে না। খুশি আর উদ্বেগের চাপ চাপ জলে ডুবছে ভাসছে আতাহারের মন।

নিরালা রাস্তা ঢেকে আছে দুপাশের ঘন বাঁশঝাড়। ভেজা পাতার মতো আধ ময়লা পাঞ্জাবীটা ওরবুকে লেপ্টে আছে। বৃষ্টিভেজা ছেঁড়া পাতা যেমন সেঁটে থাকে এখানে সেখানে।হাওয়া যেন সব হাঁপরের বুক থেকে বেরিয়ে চারদিক পুড়িয়ে দেয়।

সন্ধ্যার পর কালবৈশাখী। তারপর টিনের চাল উড়ল এক ঘরের। মড়াৎ মড়াৎ ডাল ভেঙে পড়ল উঠানে, গোয়ালে, যেখানে যেখানে সম্ভব। এত কিছুর মধ্যে জমিলাকে ঠিকঠাক দেখতেই পেল না আতাহার। গুড়ের বাতাসা খেলো আর কাগজী লেবুর শরবত। টিমটিমে হারিকেনের আলোয় জলকাদার মধ্যেই ওর বিয়ে হয়ে গেল। তারপর মুরগীর ঝাল সালন দিয়ে সাদা মোটা ভাত।

বহুদিন পর আতাহারের মনে পড়ে শাড়ীর পুটলীর মধ্যে তেল জবজবে চুল, চিকন লম্বা নিখুঁত সিঁথি। পানপাতার মতো মুখ তুলতেই থেবড়ে যাওয়া কুমকুম টিপ, চোখের চারদিকে কাজল ছড়িয়েছে। ঝড় থেমেছে বহুক্ষণ আগেই। চাঁদ ঢলে পড়েছে। ওদিকে আকাশে, এদিকে আতাহারের বুকের চাতালে।

পরীবানু উড়ে বেড়ায়। শালিকের বাচ্চা মুঠোয় ধরে বাসায় তুলে দেয়। প্রাণের  ধুকপুকেও মটুকু হাতে লেগে থাকে। সাতবছরের চোখ দিয়ে বহুবর্ণিল জগৎ দেখে। বিস্মিত হয়ে ভাবে কেমন করে নদী চমকায়।খেলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় আমলকী গাছের তলায়। হালকা সবুজ পাতার দিকে তাকিয়ে ভাবে আমলকীর স্বাদ বিচ্ছিরি, কিন্তু খেয়েপানি খেলে,কী মিষ্টি! পানির স্বাদ বেড়ে যায় কত। তখন একটু একটু করে গ্লাসের পানিতে চুমুক দেয় পরী।

মেয়ে বিইয়ে মা মরে গেলে, জমিলা হাঁ করে দেখছিল সদ্যজাত পরীকে। মুখ থেকে কটি শব্দ উড়ে যায় ওর- মা গো মা! আসমানের পরী নাইমা আইছে। সেই যে জমিলার বুকের নরমে ঘুমিয়ে পড়ে পরী, এখনও মায়ের বুকে মুখ না ডুবালে ঘুম আসে না। বুকে আগলে আগলে ওকে এতটা বড় করেছে আতাহার-জমিলা। বাপজান আর মায়ের আদরআহ্লাদের সীমা নাই মেয়েকে নিয়ে। আজ স্কুল বন্ধ। সারাদিন টো টো করে পরী দুপুরে এলো, তখন উনুনে ভাত বলকায়। কাঠের খুন্তি দিয়ে জমিলা কয়েকটা ভাত উঠায়। টিপে দেখে সিদ্ধ হলো কিনা। বাকি ভাতগুলো পাতিলে ডুবিয়ে দেয়। খুন্তিরাখে ঢাকনার ওপর। পা খুঁড়িয়ে পরী হাঁটছে। সকালের পান্তা ভরা পেট চুপসে গেছে। মুখ শুকিয়ে এতটুকু।
‘ও পরী এদিক আয়, কি অইছে পায়ো?’

‘কাইট্টা গেছে।’ টপটপ রক্ত পড়ছে ডান পায়ের গোড়ালী থেকে।
‘আ’লো বেডি, দেখিসে, কেমনে কাটছে?’

‘জহির ভাই জোর কইরা সাইকেলো উডাইছে। জঙ্গলের দিকে যাওন ধরছে। নামতে গিয়া চেইনেবাইজ্জা পাও কাইট্টা গেছে।’

মলিন টিনের জগ থেকে জমিলা পানি ঢালে পরীর পায়ে। দুর্বাঘাস দাঁতে পিষে। এতটা কেটে হাঁ হয়ে আছে। ব্যান্ডেজ করা লাগবে হয়তো। আরো গভীর দুশ্চিন্তার বুদবুদ মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়। কয়েক মাস ধরে জহির সুযোগ পেলেই পরীকে উতক্ত্য করছে। কিন্তু আজকের মতো বাড়াবাড়ি আগে করে নাই। মহাউৎপাত শুরু করেছে জহির। বখাটেপনার একটা বিহিত করা দরকার।

ভাতের পাতিল মাটির উনুন থেকে নামিয়ে রাখার কথা জমিলা ভুলে যায়। গলা ভাত জুটবে সবার পাতে। রক্তধোয়া গোলাপি জল শুষে নেয় তেতে ওঠা রুখাশুখা মাটি।

রেলওয়ে পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা ওদের নিয়ে যাবে।তার আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।বাপ-মেয়ের অপেক্ষায় জেগে থাকে মেডিক্যালকলেজ হাসপাতালের হিমশীতল মর্গ। ষাট পাওয়ারের হলুদ আলো হিম অন্ধকারকে পুরো চূর্ণ-বিচূর্ণ করতেপারেনা। সেই ক্ষীণ আলোতেই ময়নাতদন্ত হবে।
শবাগারে ঢুকে আতাহারের নৈঃশব্দ্য মিশে যাবে আলো হাওয়ায়। আবরণহীন কাটাছেঁড়া মৃতদেহের ভেতরে যে মন, তার কথা শুনব আমি। ক্রমশ আমার আগ্রহ বাড়ে। বলব সেই নীরবতাটুকু।

আষাঢ়ের মাখামাঝি। মাঠজুড়ে সবুজ পাটক্ষেত মানুষ সমান লম্বা। দাঁড়িয়ে আছে নীল আকাশের নিচে। জল ঝরিয়ে মেঘগুলো পুব দিকে ভেসে গেছে। যুতসই বৃষ্টিপাত আর গনগনে তাপে পাটগাছ আরো বাড়ন্ত।

ওর সংজ্ঞাহীন শরীর ঘন পাটগাছের ফাঁদে দেখা যায় না।
ওর চোখ থেকে জলের দাগ ধুলোলেপা মুখে এঁকেবেঁকে চিবুক অব্দি নেমে গেছে।
ওর জামা চটচটে থেকে ক্রমশ শক্ত হয়ে গেছে রক্তের স্রোতে।
ওর হাফপ্যান্ট পড়ে আছে ঘাসের আড়ালে।

একটা সাইকেল চলে যায় পাটক্ষেত পেরিয়ে। মাঠেরধার ঘেঁষে। মৃদু ক্যাঁচক্যাঁচে শব্দ নিয়ে দুটো চাকা গড়ায় ইটের সোলিং রাস্তায়।
পুরু মেঘগুলোরোদবুজিয়েবৃষ্টিঝরায়।আকাশধূসরতা ছড়ালে চারদিক আরো ঘোলাটে। আতঙ্কে নীলাভ হয়ে যায় পরীর মন। মানুষের ছায়া দেখলে কেঁপে ওঠে ছোট্ট শরীর। ভাগ্যের জোরে বেঁচে আছে পরী। বলা ভালো, মরে যাওয়া হলো না। হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। সারাদিন শুয়েই থাকে। পায়ের দুপাশে ময়লা বালিশ। ওয়েল ক্লথ ভেসে যায় রক্তে-প্রস্রাবে। দোজখের আগুন জ্বলে ক্ষতবিক্ষত অপরিণত যোনীতে।

জহিরেরবাপ বিশাল ভুঁড়ির খাটো মানুষ। প্রভাবশালীদের গা থেকে অতিরিক্ত তাপ বেরোয়। যথেষ্ট দূরে বসেও আতাহার সেই আঁচ টের পায়।বৈঠকঘরের এক মাত্র টেবিলের ওপর খালি চায়ের কাপ। চায়ের সর লেগে আছে। নিজ গরজে মাছি উড়ছে বসছে কাপের ওপর। ক্রোধে জ্বলজ্বল করে জহিরের বাপের দুই চোখ। ক্ষিপ্ত গলায় বলে, ‘কুন সাহসে তুই জহিরের বিচার চাস? তুই হইলি পাগল।মাথার তার ছিড়া। কথাবাতরার ঠিক নাই।’
কোনো ভয় না, কিছু অস্থির লাগে আতাহারের, জহিরের বাপের কথা শুনে।

‘জহির কি ইচ্ছা কইরা এইডা করছে? পরীর স্বভাব ভালা না। ছিনাল মাগীতর মাইয়্যা। মরে তো নাই, বাইচ্যাআছে।’

রাজানগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফরিদউল্লা। সিগারেট না জ্বালিয়ে তর্জনী আর মধ্যমার মাঝখানে নাড়াচাড়া করে। প্লাস্টিকের চেয়ারের পেছনের দুই পা ওপরে উঠে যায়। নিজের পায়ে ভর দিয়ে সে সামনে ঝুঁকে। কিছু কথা বলে জহিরের বাপকে। তার গলায় রাগ, ক্ষোভ নাই। খুবই অন্তরঙ্গভাবে আপোষ মীমাংসার কথা বলে আতাহারকে। পাঁচ হাজার টাকায় আপোষ করাতে চায়। আতাহার নারাজ হয়। রাজী না হয়েই ফিরে আসে। ম্যাচের কাঠি আর বারুদের এক টক্করে জ্বলে ওঠে ফরিদউল্লার হাতের গোল্ডলিফ।

দুমাস পার হলো। দেশে আইন-কানুন আছে। ন্যায়বিচার সে পাবেই। কিন্তু থানায় গিয়ে আতাহার বহু চেষ্টাতেও অভিযোগ দায়ের করতে পারে না। মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে তো কী হয়েছে? ডিউটি অফিসার আর ওয়্যারলেস অপারেটর ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় ওকে।পড়তে গিয়েও দরজার চৌকাঠ ধরে নিজেকে সামলে নেয়।
পরী ধর্ষিত হলেই কী, নাহলেই বাকী? জীবিত বা মৃত পরীর কী গুরুত্ব আছে স্বার্থপর সমাজে? স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ দূর দূর করে তাড়ায়। কার কাছে নালিশ জানাবে আতাহার? দিন দিন দৌরাত্ম্য বাড়ে জহিরের।

এক কাল্পনিক ঘটনার জের ধরে, জহিরের লোকজন তিনটা ভেসপা চালিয়ে আসে। এসে হুমকী  দেয় পরীকে তুলে নিয়ে যাবে। ধর্ষণ করবে, রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করবে। এত সাহস চাষার পুতের, দারোগা-পুলিশ দেখায়। ঘটনা হলো আতাহারের গরু নাকি জহিরের বাপের ক্ষেতের বেড়া ভেঙেছে। বাঙ্গীর ক্ষেত খেয়ে ফেলেছে। অথচ গরু তখন গোয়ালে লেজ দিয়ে মাছি তাড়ায়। জাবর কাটে।

কোথায় তুমি থাকো আতাহার? জানো না, এখানে সবাই সবকিছু পায় না। সহায়তা নেই, সহমর্মিতা নেই। সেই অনাদিকাল থেকে ভেসে ভেসে কত কথা ইথারে নিয়ে ঘুরছি। হারিয়ে যায়নি একটি কথাও। শুধু সময়ের গহ্বরে প্রাচীনতা হারিয়ে গেছে আর বর্বরতা রয়ে গেছে পৌরুষ প্রকাশে। তুমি জানো না প্রাচীন ভারতে ধর্ষণের শাস্তি ছিল পুরুষদের উপস্থচ্ছেদ। এ শাস্তির বিরোধিতা করেছে অধিকাংশ আধুনিক পুরুষ। যারা অনেকেই মানবাধিকারকর্মী আর ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ। এ নাকি লঘু পাপে গুরুদণ্ড। তুমি সে খবর রাখো না। তাই হেঁটে বেড়াও এখানে সেখানে। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আশায়। সামান্য আশ্বাসের জন্য ঘোরো দুয়ারে দুয়ারে। কেউ শুনতে চায় না। তাড়িয়ে দেয়।হাঁটতে হাঁটতে বড় ক্লান্ত তুমি এক সময়।

আসমানে মেঘের পর্বত ভাঙছে। বৃষ্টির টানা ধস শুরু হয়েছে তিনদিন ধরে। দলবলসহ জহির দা-লাঠি নিয়ে দিনভর আতাহারকে খোঁজাখুঁজি করে। পায় না। ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আতাহার আলী পালিয়ে বেড়ায়। রাতের কালো যখন হালকা হয়, ঘরে ফিরে আসে সে। দেখে গোয়ালঘরে গরু নাই।

শুনেই পরী কাঁপতে থাকে, আতঙ্কে অথবা জ্বরে। তেল চিটচিটে কাঁথার ভেতর ঢুকে যায়। জমিলা কাঁদে করুণ বিলাপ করে। শেষ সম্বল খুইয়ে থম ধরে বসে থাকে আতাহার।

হাওয়ায় পাশের ঘরের শুকনা মরিচের ঝাঁঝ। আজ হঠাৎ তেজপাতার ফোঁড়ন দেয়া ঢ্যালা খিচুড়ি খেতে মন চায়। নাক বেয়ে ঝাঁঝ মাথায় পৌঁছলে কাশি শুরু হয় আতাহারের।

কাশি থামলে একবার শুধু বলে, ভাত দেও। থালায় পানিভাত ডুবু ডুবু, যেমন ধান গাছের ডগাছুঁই ঢলের পানিনদী থেকে জমিনে উঠে আসে।

লবণ মেখে এক গাল ভাত খায়। কাঁথা সরিয়ে মেয়ের মুখে ভাত তুলে দেয়। শুকনা মরিচ ডলে পানিভাতে। ভাবে, গরু চুরীর বিচার করবে কে? এটা হয়তো আদৌ কোনো অপরাধ নয়। ধন্দ লাগে আতাহারের মনে। কোন এক দৈবযোগে জেনে গেছে এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। বুঝে গেছে আবারও ধর্ষিত হবে মেয়ে। পালাক্রমে ধর্ষিত হয়ে হয়তো খুনই হয়ে যাবে।

আর কত হাজার বছর অপেক্ষা করবে আতাহার আলী? ধোঁয়ারঙা আসমান থেকে হঠাৎ কোন উছিলায় গায়েবী মীমাংসা নামে। মৌসুমী হাওয়ায় কিছু একটা হয়ে ওঠে শরীরে, মনে। আবাদী জমির মাটির মন বোঝা বড় সহজ নয়। সেটা এবার দিব্যি বোঝা যায়। আর মেয়েমানুষের বুকের মতো হাত দিয়ে আদর করে দেখতে হয় না। প্যাঁককাদা হয়ে পায়ে লেগে থাকে।

এইডা অইল আসমানী রঙ, নিজের মনে বলে পরী। ঘোলাটে আকাশ বৃষ্টির নেশা কাটিয়ে রোদ্দুরে মাখামাখি। পরীর খুব ভালো লাগে। কতদিন পর বাপজানের হাতের আঙুল ধরে হাঁটছে। ওই দুটা পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আসলে উড়ে চলছে।

লম্বা ছায়া পড়েছে দুজনের। বড় বড় পা ফেলে নিজের ছায়া মাড়াতে চায় পরী। পারে না। সকাল বেলায় দুমুঠোপান্তা খেয়ে বাপ-মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে লাল দালানের রেলস্টেশানে চলে এসেছে।বাপ দুটো লজেন্স কিনে দিল। একটা মুখে পুরে আরেকটা মুঠোয় রাখল পরী। মায়ের জন্য।
অভিমান নেই, অভিযোগ নেই। নেই অক্ষমতা, অপমানবোধ। আছে শুধু এক অধিকার। ছেড়ে যাবার, বিলুপ্ত হবার একান্ত অধিকার। চলে যাবার এই একটি অধিকার আছে বলেই তিস্তা এক্সপ্রেস আসার ঠিক আগে,রেললাইনের পাশে বসে আতাহার আলী। একবার কত কী ভাবে আরেকবার ভাবে না কিছুই।

দ্বীন দুনিয়ার মালিক আল্লাহপাক বলেছেন- প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে তারপর আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। আল্লাহ’র এ কথা বিশ্বাস করে আতাহার। কী শান্ত মায়াবী উচ্চারণ! খরা কাটিয়ে দিলদরিয়ায় বয়ে যায় শীতল ধারা। অবশ্যই কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিদান দেয়া হবে।
মুহূর্তে আতাহার আলী মেহেদীর গন্ধ পায়। ঠাণ্ডা, ভেজা প্রিয় খুশবুতে মায়ের হাত ফিরে আসে। শবেবরাতের রাতে হালুয়ার গন্ধ ছাপিয়ে,মায়ের হাতের পাতা এই নরম সুবাস ছড়ায়।

গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে রেললাইনে সে মাথা পেতে দেয় নির্বিকার, পালিত কন্যার হাত ধরে।
কিছু ঘাস, পিঁপড়া নড়ছে আর কী অপূর্ব আলো ফেলেছে আকাশ! নিষ্প্রাণবাপ-মেয়ে আর রেললাইনের স্লীপারের ওপরে।

সূএ:ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com