ফাত্তাহ তানভীর রানা:আটষট্টি হাজার গ্রামের মতই খুব সাধারণ একটি গ্রাম আহমপুর। উপজেলা সদরেই অবস্থিত। তাই উপজেলার সব সুবিধাও ভোগ করে গ্রামের অধিবাসীরা। গ্রামের বুক চিড়ে বয়ে গেছে নদী, নাম বড়াল। নদীটির জৌলুস বর্তমানে ততটা নেই। তবে দেখলে অতীত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বড়াল হয়তো কোনো একসময়ে খরস্রোতা নদীর তালিকায় থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই প্রবাহমান ছিল বলে প্রতীয়মান। নদীতে লঞ্চ-স্টিমার কালেভদ্রে দেখা গেছে বলে জনশ্রুতি আছে। বর্ষার আগে বড়ালে স্রোত থাকে ক্ষীণ। বর্ষা বাড়ার সাথে সাথে স্রোতও বেড়ে যায়। অন্য সময় স্রোত থাকে কি না বোঝা মুশকিল। চৈত্র মাসে কোথাও কোথাও নদীর তলা বের হয়ে আসে। তখন মাঝনদীতে চলে বৈশাখী মেলা। বড়াল পদ্মার শাখা নদী বলে পরিচিত। পদ্মা থেকে বড়ালের প্রবেশপথ বন্ধ প্রায়। এ ছাড়া পলি পড়ে নদীর অনেকাংশ ভরাট হয়ে গেছে। কারখানাসহ অন্যান্য বর্জ্য ফেলার ফলে যারা নদী নির্ভর ছিলেন, তারা আজ আর নদীর ওপর নির্ভরশীল নন।
বড়ালকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো আহমপুরের জনজীবন। ঘাটে-ঘাটে নৌকা ভিড়তো। নৌকাগুলো পণ্য পরিবহন করতো। তখন আজকালের মতো যত্রতত্র কাঁচা-পাকা রাস্তা তৈরি হয়নি। একসময় বড়ালই ছিল যোগাযোগের মুখ্য সহায়ক। এখন দিন বদলে গেছে। পণ্য পরিবহন এবং যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে বড়ালের কথা আর কেউ ভাবে না। ঘাটে-ঘাটে ছোট-বড় নৌকার বাহারও আর দেখা যায় না। নৌকা হয়তো দু’চারটি চলে। তবে তা চোখে পড়ার মতো নয়। স্বাভাবিকভাবেই আহমপুরের জনজীবনে বড়ালের গুরুত্ব অনেক কমে এসেছে। আহমপুরের কোলজুড়ে আছে নয়নাভিরাম বাজার।
বড়ালপাড়ের মানুষ বড়ই শান্তি প্রিয়। বউ-ঝি, হিন্দু-মুসলিম, পুত্র-পিতা, বৃদ্ধ-জোয়ান একই ঘাটে স্নান করে। কেউ কারো প্রতি বিশেষ বিদ্বেষ পোষণ করে না। কেউ কেউ সুযোগ সন্ধানের চেষ্টা করলে বাকিরা তাদের নিবৃত করে। এখানে কতক হিন্দু মেয়ে মুসলিমের বউ হয়ে সংসার করছে। আহমপুরের মানুষ অন্যকে ভালোবাসতে জানে। প্রতারণা, হিংসা, সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। তারপরও সৃষ্টি হওয়া গোলযোগের সময়ান্তে সমাধানও হয়ে যায়।
শোনা গেল বাজারের নদীর ঘাটে বেশ ভিড় লেগেছে। বাজার থেকে একজন কী যেন বলাবলি করতে করতে আসছিল। এক যুবতীর লাশ নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। তা দেখতেই এতো ভিড় লেগেছে নদীর ঘাটে। সময়টা বর্ষার মৌসুম ছিল না। তাই নদীতে স্রোতও কম ছিল। সাধারণভাবে বলা যেতে পারে নদী ও লাশের গতি একই ছিল। এ কারণে সাধারণ মানুষ একটু বেশি সময় ধরে লাশটি দেখার সুযোগ পাচ্ছিল। অবশ্য দু’একজন আগেই সংবাদ পেয়েছিল উজান থেকে লাশ আসছে। লাশটি খুব বেশি ক্ষত-বিক্ষত হয়নি। হয়তো একদিন আগের লাশ হবে। যারা লাশ দেখেছেন; তারা বলছেন, লাশটি এখনো শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু আরও একদিন পরে হয়তো বোঝা কঠিন হয়ে যাবে।
এক ধরনের চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে আহমপুরের মানুষের ভেতর। খুন এবং বেওয়ারিশ লাশ! কার লাশ? কোন ঘরের মেয়ে? কার বউ? কে খুন করেছে? কেন খুন করেছে? কীভাবে খুন হয়েছে? এসব প্রশ্ন বিভিন্ন মানুষের মনে উদয় হতে লাগল। অনেকে অনুমান করল আত্মহত্যা বা অপহরণও হতে পারে। বিষয়টি সব ধরনের মানুষের মনকে নাড়া দিলো। বিশেষত নারী-শিশু-বৃদ্ধের কাছে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হলো। লাশ আসে এবং লাশ চলেও যায়। বাকি অনেক গল্প সাধারণ মানুষের কাছে অজানাই থেকে যায়।
ইদানিং নদীতে লাশ ভেসে আসতে কমই দেখা যায়। নদীর স্রোত কমার কারণে নয় বরং অন্য অনেক কারণেই এ সংখ্যা কমেছে। একসময় গুপ্তখুনের লাশ নদীতে ফেলার প্রচলন সত্যিই বেশি ছিল।
সাধারণ জনগণ লাশটি উদ্ধার না করলেও থানায় খবর দিয়েছে। এসব খবর অবশ্য দিতে হয় না, বাতাসের গতিতে ছড়ায়। থানার কর্মকাণ্ড খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হলো। নতুন কোনো ঘটনা ঘটেছে, কারও মৃত্যু হয়েছে। এতে কর্তব্য আছে এরকম কোনো ব্যাপার থানার ভেতরে লক্ষ্য করা গেল না। অবশ্য এ সমস্যাগুলো তাদের নিত্যদিনের। তাই আগ্রহ কম। সমাধান তো হবেই যে কোনোভাবে! হতে হবেই।
স্যার লাশটি ভেসে যাচ্ছে।
ভাসতে দাও।
বিকৃত হয়ে যাবে তো। বলল কনস্টেবল রাশেদ।
তাতে তোমার কী? ও কি তোমার আত্মীয়? বলল সাব-ইন্সপেক্টর বুলবুল।
মানুষ তো, এতো আমাদের দায়িত্ব।
এক ধরনের হাসি দিয়ে বুলবুল পত্রিকার পাতায় আবার নজর দিলো।
লাশটি জেলা সদরে সুরতহালের জন্য পৌঁছে দিয়ে পত্রিকায় একটা খবর ছাপানোর ব্যবস্থা কর। বলে আবার পত্রিকা পাঠে মন দিলো বুলবুল।
কিছুক্ষণ পর রাশেদকে উদ্দেশ্য করে বলল, কোথাকার কোন মেয়ে, তার চরিত্র কেমন, বংশ কী, ভালো না মন্দ! তার জন্য তোমার দরদ দেখি উথলে উঠেছে! দেখগে কোন পরিবারের মেয়ে। না হলে এইভাবে মরে?
ছি ছি স্যার, এভাবে বলবেন না।
ওই শোন। যা খোঁজ নিয়ে দেখ। হয় মেয়েটা মায়ের সাথে রাগ করে আত্মহত্যা করেছে অথবা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, না হয় কেউ রেপ করে নদীর জলে ফেলে দিয়েছে।
তাতে কী স্যার? ওই লাশটার আত্মীয়-স্বজনের কাছে যাবার এবং দাফন-কাফনের অধিকার তো আছে। বলল রাশেদ।
এটা কি আমি অস্বীকার করেছি, কী বলতে চাও তুমি?
লাশটা চেনার উপায় না থাকলে কীভাবে শনাক্ত করবেন। কীভাবে কী হবে স্যার?
তোমার স্বভাব খারাপ, বেশি কথা বলা। ওইসব মেয়ের জন্য তোমার সাথে আমি বাক-বিতণ্ডায় জড়াতে পারব না। তুমি যা খুশি করগে। আঙুল উঁচু করে রাশেদকে কথাগুলো শুনিয়ে দিলো বুলবুল।
মেয়েটি যে খারাপ আপনি নিশ্চিত হলেন কেমন করে স্যার? বলল রাশেদ।
আমার বন্ধুরা তো এরকম অনেক মেয়েই নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। আমি বিষয়গুলো ভালোভাবেই জানি আর কি!
বুলবুল রাশেদের দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, তোমার কিছু বলার থাকলে ওসি স্যারকে বলো, যাও।
রাশেদ মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। স্যার ঘুষ খেতে খেতে বিবেক-বোধ-বুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছেন। মনে মনে ভাবল রাশেদ। এরপর সে ওসি সাহেবকে বিষয়টি জানালো। ওসি সাহেব বিষয়টি জানেন বললেন। যথাসময়ে কাজ হবে বলেও আশ্বাস দিলেন। বিষয়টি নিয়ে থানার অন্য কারো মাথাব্যথা লক্ষ্য করল না রাশেদ। এরপর রাশেদের চিন্তা-চেতনা অন্য কিছুতে ধাবিত হলো।
রাশেদের চাকরি নতুন, বারোমাস এখনো পূর্ণ হয়নি। রাশেদ মেধাবী ছাত্র ছিল। নিতান্ত অভাবে পড়ে চাকরিতে আসা। দরিদ্র দিনমজুর বাবা, অবিবাহিত দুই বোন; যারা রাশেদের চেয়ে বয়সে বড়। আরও আছে ছোট এক ভাই ও এক বোন। এই তো রাশেদের সংসারের চিত্র। রাশেদ যখন কলেজে পড়ত; তখন সে সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করত, গানের গলাও তার ভালো। রাতে শুয়ে শুয়ে রাশেদ অতীত জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগল।
হঠাৎ করেই রাশেদের বুলবুলের কথা মনে পড়ে গেল। বুলবুলদের মতো মানুষ আছে বলেই আমাদের মতন মানুষের কষ্টের শেষ নেই, ভাবল রাশেদ। মানুষের যত নাভিশ্বাস, যত অভিশাপ তাদের কারণেই। সব জায়গায় তাদের মতো মানুষ আছে। তারা আমাদের দূরের কেউ নন। আমাদেরই কারো কারো স্বজন। এই সমাজেরই মানুষ। আবার অনেক মানুষের ব্যবহারে মন ভালো হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে রাশেদ কখন যে নিঃশব্দ ঘুমে নেতিয়ে পড়েছে, তা আমরা কেন রাশেদ নিজেই টের পেল না।
খুব সকালে মানুষের শোরগোলে রাশেদ থানা থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে কিছু আম-জনতার দেখা পেল। একটি লাশ এক প্রান্তে পড়ে আছে। নজরুল মাতব্বরের ঘাটে লাশটি থেমে যায়। এরপর উৎসুক জনতা লাশটি থানায় দেওয়ার ব্যবস্থা করে। সবাই নিজকে নিয়ে ব্যস্ত। তারপরও কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
লাশটি উদ্ধারের পর বাকি কাজ সম্পাদনের জন্য পুলিশি তৎপরতা যথা নিয়মেই চলতে লাগল। এসআই বুলবুলও যথারীতি বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ-খবর নিলো। কোন ঘাটে ভিড়ল? কে তুলল? কে নিয়ে এলো? কে প্রথম দেখল? কখন ভিড়ল? ইত্যাদি নানা ধরনের প্রশ্ন। বুলবুলকে দায়িত্বনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার হিসেবে সবাই লক্ষ্য করল। লাশের বাকি কাজ সম্পাদনের জন্য এএসআই বেলাল চিশতীকে দায়িত্ব দিলেন ওসি সাহেব।
বুলবুল হঠাৎ করেই সবার দৃষ্টি কেড়ে নিলো। বুলবুল চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বুলবুল বারবার লাশের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। অন্যরা তাকে বাধা দিচ্ছিল। লাশটি শনাক্ত করা প্রায়ই কঠিন হয়ে পড়েছে। তবুও সে বলছে, এটি তার বোন ফেন্সির লাশ। আপনজন ছাড়া এ অবস্থায় লাশ শনাক্ত করা কঠিন। যে ড্রেসটি ফেন্সির শরীরে ছিল। তা বুলবুলই কিনে দিয়েছে। বুলবুল শতভাগ নিশ্চিত, এটি ফেন্সির লাশ। বুলবুলের একমাত্র ছোট বোন ফেন্সি, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছিল।
বুলবুলের ভেতরে পুলিশসত্তাটি চাপা পড়ে গেল। ক্রমেই ভাইসত্তাটি জেগে উঠল। খানিক বাদে বুলবুলের ব্যক্তিত্বে ভাইসত্তা এবং পুলিশসত্তা উভয়েরই জাগরণ ঘটল বিস্ফোরিতভাবে।
রাশেদ অদূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করছিল। রাশেদের মনে অনেক ভাবনার আর্বিভাব ঘটল। আবার ভাবনাগুলো অচলও হয়ে গেল। অনেক কথা ছিল রাশেদের কিন্তু বলা হলো না। সূএ:জাগোনিউজ২৪.কম