বেইমানিতে পতন সিরাজের, বাহাদুর শাহ ট্র্যাজেডি

ছবি: সংগৃহীত

 

নঈম নিজাম:মীরজাফরের বেইমানিতে সিরাজের পতন হয়। মুর্শিদাবাদের পতনের পরও ভারতবর্ষের বড় শহরগুলো পুরো নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্রিটিশদের আরও শতবর্ষ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বাংলা নিয়ে কোনো সময় লাগেনি। বাংলার মাটি বেইমানির উর্বর ঘাঁটি। মুহূর্তে মন বদল হয় বাঙালির। একটা কিছু নিয়ে বাঙালি খুশি থাকতে পারে না। বেহেশত এনে দিলে আফসোস করে দোজখ দেখায়নি। বড় অদ্ভুত মনমানসিকতা। উপমহাদেশে ইংরেজ বণিকরা যাত্রা করেছিল বাংলা দিয়ে। অর্থসম্পদে বাংলা ছিল তখন সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। অভাব-অনটন ছিল না।  বাণিজ্য করতে ব্রিটিশ বেনিয়ারা কলকাতায় ঘাঁটি করল। তারা দেখল এ অঞ্চলের মানুষ শুধু ব্যবসা নয়, পুরো দেশ দিয়ে দিতে চায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুযোগ হাতছাড়া করল না। পথের কাঁটা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শুরু করল ষড়যন্ত্র। সেনাপতি বেইমানি না করলে ইংরেজ বণিকদের রুখে দিতে পারত নবাবের অনুগত বাহিনী। তারা তা করেনি। সেনাপতি গোপন সম্পর্ক করলেন ইংরেজ বেনিয়াদের সঙ্গে। ক্ষমতা বদলের সহায়তায় সন্ধি করলেন। সুযোগসুবিধা আদায়ের প্রতিশ্রুতি নিলেন। সিরাজের খালা ঘসেটি বেগমও ষড়যন্ত্রে তাল মেলালেন। যুক্ত হলেন মীরজাফরদের সঙ্গে।

 

দিল্লিতে মুঘলদের ক্ষমতা তখন ক্ষয়ে আসছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যাত্রার সময় দিল্লির মসনদে ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। তাঁর উত্তরসূরিদের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকল। বিশাল সাম্রাজ্য তাঁরা ধরে রাখতে পারলেন না। ধীরে ধীরে সব গুটিয়ে আসতে থাকল। নির্ভরতা তৈরি হলো ব্রিটিশ বেনিয়াদের ওপর। তার পরও বাংলার পতনের পর শতবর্ষ লাগল দিল্লির পতাকা নামাতে। সিপাহি বিদ্রোহের রেশ ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লি নিয়ন্ত্রণে নেয়। আটক হন দিল্লির শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। রেঙ্গুনে বাহাদুর শাহের মাজার জিয়ারতের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বাহাদুর শাহ পূর্বসূরিদের মতোই ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন আয়েশি মানুষ। তিনি কবিতা লিখতেন। সুফিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। শায়ের শুনতেন আসর জমিয়ে। বিয়ে করেছিলেন অনেক। সন্তানের সংখ্যাও কম ছিল না। শেষ দিকে ইংরেজদের প্রদত্ত লাখ রুপি ভাতা নিয়েই চলতেন। এ টাকায় আয়েশে সমস্যা হতো। তার পরও কোনো ধরনের ঝামেলা চাননি ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে। তিনি নীরবে সময় পার করতেন। খরচের হাত ছিল খোলা। তাই ভাতা বাড়ানোর অনুরোধ করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। তারা সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয় এবং বিভিন্নভাবে হেনস্তা শুরু করে। সম্রাট হিসেবে ক্ষমতা খর্ব করে। মর্যাদাহানি ব্যথিত করত মুঘল সম্রাটকে। তবু বলা ও করার কিছু ছিল না। বিষণ্ণ  বদনে সব মেনে নিয়ে প্রাসাদেই বেশি সময় থাকতেন বাহাদুর শাহ। কখনো কখনো বুঁদ হতেন আফিমের নেশায়। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতায় থাকত আক্ষেপের কথা।

 

বাহাদুর শাহ লিখলেন, ‘উমর দরাজ মাঁঙকে লায়েথে চারদিন/দো আরজুমে কাট গ্যয়ে, দো ইন্তেজার মেঁ।’ অর্থাৎ ‘চারদিনের আয়ু নিয়ে এসেছিলাম/দুদিন কাটল প্রত্যাশায়, আর দুদিন অপেক্ষায়।’ আধ্যাত্মিক চিন্তার বাহাদুর শাহ দেখলেন ক্ষণস্থায়ী আমাদের এ জীবন। চাওয়াপাওয়ার হিসাব মেলানোর আগেই সব শেষ হয়ে যায়। সিপাহি বিদ্রোহ বাহাদুর শাহের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে। সাদামাটা জীবনের মানুষটি ক্ষমতা নিয়েছিলেন সিপাহি বিদ্রোহের ২০ বছর আগে। ক্ষমতায় বসে দেখলেন মুঘল সাম্রাজ্য ক্ষয়ে গেছে। চারদিকে শুধু লোকদেখানো ভাব আর আভিজাত্য। বুঝতে পারলেন তাঁর পক্ষে পূর্বপুরুষের মতো লড়াই সম্ভব নয়। তাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি গেলেন না। সিপাহি বিদ্রোহ তাঁকে উৎকণ্ঠিত করল সহচরদের বড় অংশ জড়িয়ে পড়ায়। সম্রাটের নামেই তাঁর সেনারা জড়িয়েছিল। সিপাহিরা ক্ষুব্ধ ছিল ইংরেজ বণিকদের অত্যাচার-নির্যাতনে। আগুনে ঘি দিতে সামনে আসে সিপাহিদের ব্যবহার করা বন্দুকের গুলির কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি মেশানো ইস্যু। হিন্দু-মুসলমানের ধর্মরক্ষার আলোচনা থেকেই বিদ্রোহের সূচনা। পরে এ বিদ্রোহ দেশ উদ্ধারে রূপ নেয়। সিপাহিরা ঘোষণা দেয় তারা দিল্লির বাদশাহকে মানে। অন্য কাউকে নয়। ইংরেজদের শাসন তারা কোনোভাবে মানবে না। ইংরেজদের অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। দিল্লির বাদশাহের কাছে হস্তান্তর করতে হবে ক্ষমতা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শুরু হলো বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ। সবকিছু তছনছ করে ছুটল দিল্লি অভিমুখে। টার্গেট ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ইংরেজদের কাছ থেকে ফিরিয়ে বাদশাহকে হস্তান্তর।

 

কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নেয় ইংরেজ কোম্পানি। সবকিছু সামাল দিতে ঐক্যের প্রতীক শেষ মুঘল সম্রাটকে ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়। পূর্বপুরুষের কবরে প্রার্থনারত সম্রাটকে আটকের সময় চরম অপমান করা হয়। হেনস্তা করা হয় পুরো পরিবারকে। ১৮৫৮ সালের শেষ ভাগে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় বাদশাহের। মেজর হ্যারিওট নামে একজন ইংরেজ সেনা কর্মকর্তা বাহাদুর শাহের পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে ফাঁসির আদেশ দেন। দিল্লিবাসী বিচারের নামে দেখল এক প্রহসন। একদা সম্রাট জাহাঙ্গীর ভারতবর্ষে ব্যবসার অনুমতি দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে সেই ব্রিটিশরা বিচার করল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বংশধরদের। বিচারের নামে মুঘল পরিবারের অর্ধশত সদস্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল। ইংরেজদের টার্গেট ছিল আতঙ্ক তৈরি করা। মুঘল পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করা। তারা সফল হয়েছিল। ২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭ সালে দিল্লি নিয়ন্ত্রণে নিল ইংরেজরা।

 

চোখের সামনে তৈমুর বংশের ধ্বংস দেখে ভেঙে পড়লেন বাহাদুর শাহ। আটকের আগে তিনি চেষ্টা করলেন কিছু স্মৃতি রক্ষা করতে। বুঝতে পারলেন ইংরেজরা লালকেল্লায় অভিযান চালাবে। চিরতরে ধ্বংস করে দেবে তৈমুর বংশের উত্তরাধিকারসূত্রে রক্ষিত সব মুসলিম ও ঐতিহাসিক স্মৃতি। বাদশাহ কাউকে না জানিয়ে লালকেল্লা ত্যাগ করেন পানিপথ দিয়ে। তিনি প্রথমে যান হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে। মাজার জিয়ারত করলেন। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া দুর্লভ জিনিসপত্র ছিল সঙ্গে। পরিবারের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের অনুরোধ জানান খাদেমদের। তার মধ্যে ছিল মহানবী (সা.)-এর শ্মশ্রু মোবারক। তিনি বলেছিলেন, আগেই জানতাম এমন বিপদ হবে। তার পরও কেউ আমার কথা শুনল না। আমার অনুসারীরাও আলাপ করল না। সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় সংগঠিত ছিল না কেউ। তিনি খাদেমদের হাতে সবকিছু তুলে দেন। তাদের অনুরোধ করেন মুঘলদের সংগ্রহে থাকা ইসলামের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে। তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান পাশেই বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধিসৌধে।

 

দিল্লির নিজামুদ্দিনের কাছে হুমায়ুন সমাধি। এক বিকালে গিয়েছিলাম হুমায়ুন সমাধি দেখতে। নিজামুদ্দিনে জিয়ারত শেষ করে ভাবলাম হুমায়ুন সমাধিতে যাই। হুমায়ুনপত্নী হামিদা বানু এ সমাধি নির্মাণ করেন বাদশাহের মৃত্যুর নয় বছর পর। শিশুপুত্র আকবর তখন দিল্লির সম্রাট। বাদশাহ হুমায়ুন পুরো জীবন লড়েছেন সাম্রাজ্য রক্ষা করতে। এক কঠিন দুর্যোগে পুত্র আকবরের জন্ম। হামিদা বানু অনেক ভালোবাসতেন স্বামীকে। তখনকার দিনে তিনি এ সমাধি নির্মাণে খরচ করেন ১৫ লাখ টাকা। হুমায়ুন সমাধিতে তাঁর পত্নী হামিদা বানুও শায়িত আছেন। শাহজাহানপুত্র দারাশিকোর কবরও এখানে। সমাধিগুলো ঘুরতে ঘুরতে মনে পড়ছিল হুমায়ুন বাদশাহর জীবনের পুরোটাই ছিল ট্র্যাজেডিতে ভরা। বাংলায় এসে তাঁরও ভাগ্যবিপর্যয় হয়েছিল। তিনি রাজ্য হারিয়ে ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিলেন। ক্ষমতা ফিরে পেয়ে অল্প দিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে পুত্র আকবর মুঘল সম্রাটের দায়িত্ব নেন। হুমায়ুনের মৃত্যুর খবর ১৭ দিন গোপন রাখা হয়। প্রজাদের বুঝতে দেওয়া হয়নি বাদশাহ আর নেই। একটা আশঙ্কা ছিল নতুন করে কেউ ক্ষমতা দখলে হামলা করে কি না। এ কারণে সম্রাটের মতো দেখতে মুলা বেকশি নামে একজনকে বাদশাহের আসনে বসিয়ে রাখা হতো। বাদশাহ হুমায়ুন মাত্র ২৭ বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ১২ বছর বয়সে তাঁকে একটি প্রদেশের দায়িত্ব দেন পিতা সম্রাট বাবর। ১৭ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে যান যুদ্ধে। পিতা ও পুত্র একসঙ্গে যুদ্ধ জয় করেন। ক্ষমতা নেওয়ার পর ভাইদের বিরোধিতার মুখে পড়েন। ভাইদের বিশ্বাস করে হুমায়ুন ঠকেছিলেন। রাজ্যহারা হয়ে ঘুরেছিলেন পথে প্রান্তরে। স্ত্রী-পুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। সবকিছু ফিরে পাওয়ার পর ক্ষমতা আর ভোগ করতে পারেননি। লাইব্রেরির ছাদে যাচ্ছিলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। ছাদ থেকে নামার সময় মসজিদে আজানের ধ্বনি শেষ হয়। তিনি নামাজ পড়তে সিঁড়িতেই দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। হঠাৎ পোশাকে পা জড়িয়ে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়েন নিচে। তিন দিন পর তার মৃত্যু হয়। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে ক্ষমতা ফিরে পেয়েও আর ভোগ করা হলো না বাদশাহ হুমায়ুনের।

 

মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সূর্য অস্ত যাওয়ার মুহূর্তে হুমায়ুন বাদশাহের সমাধিতে গেলেন বাহাদুর শাহ। তিনি ঝরঝর করে কাঁদলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন পুত্র। তাদের তিনি বলেন, একদা সবকিছু আমার পূর্বপুরুষের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাঁরা অনেক কষ্ট করে এ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। রক্ষা করেছিলেন তৈমুর বংশের ঐতিহ্য। আজ সবকিছু শেষ হতে চলেছে। এখন আর কোনো কিছুই আমাদের নয়। আমি কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারলাম না। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। দোয়া করলেন নিজের সন্তান ও পরিবারের জন্য। এদিকে ইংরেজ সেনারা বাদশাহকে খুঁজতে শুরু করেছে ততক্ষণে। মাজারের খাদেমের বেইমানিতে ইংরেজরা জেনে গেল বাদশাহ কোথায় আছেন। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হাডসন অভিযান চালালেন হুমায়ুন সমাধিতে। তারা আটক করলেন শেষ বাদশাহ বাহাদুর শাহকে। আটকের পর নিয়ে যাওয়া হয় লালকেল্লায়। তার আগেই সেনাপতি হাডসন বাহাদুর শাহের দুই পুত্রকে বের করে রাজপথে দাঁড় করান। প্রকাশ্যে গুলি করে তাদের হত্যা করেন। চোখের সামনে এমন নিষ্ঠুরতা দেখে মৃত্যুর প্রস্তুতি নেন বাদশাহ। বিচারের নামে প্রহসন হলো। মুঘল পরিবারের কাউকে ফাঁসি, কাউকে জেল দেওয়া হয়। নির্বাসনে পাঠানোর রায় হয় শেষ মুঘল সম্রাটের। বাহাদুর শাহের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীদের সবাইকে তুলে দেওয়া হয় গরুর গাড়িতে। বন্দি বাহাদুর শাহকে নিয়ে যাওয়া হয় রেঙ্গুনে। সেই দিনটি ছিল ১৮৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। সব স্ত্রী পথে পথে সরে পড়লেন। কেউই কষ্টের জীবন বেছে নিতে সম্মত হলেন না। ছায়াসঙ্গী থাকলেন ছোট পত্নী জিনাতমহল ও তাঁর দুই সন্তান। অন্য স্ত্রী তাজমহলও ছিলেন সফরসঙ্গী। ভৃত্য রক্ষিতা মিলিয়ে মোট ৩১ জনকে নিয়ে যাত্রা হয়েছিল। জাফর ও তাঁর দুই পুত্র ছিলেন এক পালকিতে। সঙ্গে ব্রিটিশদের নিরাপত্তা। সবকিছু করা হচ্ছিল কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তায়। শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৫ জনকে নিয়ে বাহাদুর শাহ স্টিমারে উঠলেন। রেঙ্গুন ক্যান্টনমেন্টের কাছে চার রুমের বাড়িতে তাঁদের রাখা হয়।

 

নির্বাসিত বাদশাহ ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর রেঙ্গুনে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুঘল ইতিহাসের ৩৫০ বছরের অবসান হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ডেভিস গোপনীয়তা বজায় রেখে দাফন করেন বাদশাহকে। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর আরও ২০ বছর বেঁচে ছিলেন জিনাতমহল। বাহাদুর শাহের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। পুত্র মির্জা জওয়ান বখতও এখানে শায়িত। মৃত্যুর আগে কবিতা লিখে সময় কাটাতেন দিল্লির শেষ সম্রাট। তাঁর আক্ষেপ ছিল নিজের মাটিতে দাফন হবে না জেনে। সেই আক্ষেপের কবিতাটি তাঁর সমাধিতে বড় করে লেখা। তিনি লিখেছিলেন : ‘কিতনা বদ নসিব হ্যায় জাফর/দাফন কি লিয়ে দো গজ জমিন ভি না মিলি কু ইয়ার মে।’ বাংলা অর্থ : ‘জাফর তুমি কত দুর্ভাগা, নিজের দাফনের জন্য/প্রিয় জন্মভূমিতে দুই গজ মাটিও মিলল না।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ইন্দিরাপুত্র রাজীব গান্ধী গিয়েছিলেন রেঙ্গুন। তিনি বাহাদুর শাহের মাজারে যান। মাজারে বাহাদুর শাহের লেখা শায়ের পড়লেন। তারপর লিখলেন : ‘দো গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে/পার তেরি কোরবানি সে উঠি আজাদি কি আওয়াজ/বদ নসিব তো নাহি জাফর।/জুড়া হ্যায় তেরি নাম ভারত শান আউর শওকত মে/আজাদি কি পয়গাম সে।’ বাংলা অনুবাদ হলো : ‘হিন্দুস্তানে আপনি দুই গজ মাটি পাননি সত্য/তবে আপনার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল,/দুর্ভাগ্য আপনার নয় জাফর।/স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও/গৌরবের সঙ্গে আপনার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

 

রেঙ্গুনের জি ওয়াকো সড়কে বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারে একবার গিয়েছিলাম আমি ও ফরিদা ইয়াসমিন। ভারতবর্ষের ইতিহাসের ট্র্যাজেডির নায়ক বাহাদুর শাহ জাফর। ১৯০৫ সালে তাঁর সমাধি চিহ্নিত হয়।  রেঙ্গুনের মুসলমানদের দাবির মুখে সরকার বাধ্য হয় কবর চিহ্নিত করতে। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর খবর দিল্লিতে পৌঁছে বেশ কিছুদিন পর। এ খবর শুনে মির্জা গালিব দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন কবিতা। দিল্লিবাসীর কাছে তিনি খবরটা পৌঁছে দেন। আজ দিল্লির নিজামুদ্দিনে মির্জা গালিব আর রেঙ্গুনে বাহাদুর শাহ শায়িত আছেন। দুজনের কবর জিয়ারত করেছিলাম। প্রার্থনা করেছিলাম আল্লাহ যেন তাঁদের শান্তিতে রাখেন।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন ।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» রেলের ভাড়া বাড়ানো অযৌক্তিক ও অমানবিক : গোলাম মোহাম্মদ কাদের

» ছয় দিন ধরে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস

» রাজউকের প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে নতুন বিধিমালা

» ফিলিস্তিনি প্রতি বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

» যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে আমরা দায়মুক্ত হয়েছি : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

» পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতায় হয়রানি হলে সহায়তা দেবে তথ্য মন্ত্রণালয়

» নকল স্যালাইন উৎপাদনকারী একটি চক্রের ৩ সদস্য গ্রেফতার

» ভোটারবিহীন নির্বাচনে আনন্দ নেই, সৌন্দর্য্য নেই: ইসি রাশেদা

» আমি ব্রেকআপ করলাম: সুহানা খান

» লড়াইয়ের সর্বশেষ প্রস্তুতি নিন, নেতাকর্মীদের রিজভী

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বেইমানিতে পতন সিরাজের, বাহাদুর শাহ ট্র্যাজেডি

ছবি: সংগৃহীত

 

নঈম নিজাম:মীরজাফরের বেইমানিতে সিরাজের পতন হয়। মুর্শিদাবাদের পতনের পরও ভারতবর্ষের বড় শহরগুলো পুরো নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্রিটিশদের আরও শতবর্ষ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বাংলা নিয়ে কোনো সময় লাগেনি। বাংলার মাটি বেইমানির উর্বর ঘাঁটি। মুহূর্তে মন বদল হয় বাঙালির। একটা কিছু নিয়ে বাঙালি খুশি থাকতে পারে না। বেহেশত এনে দিলে আফসোস করে দোজখ দেখায়নি। বড় অদ্ভুত মনমানসিকতা। উপমহাদেশে ইংরেজ বণিকরা যাত্রা করেছিল বাংলা দিয়ে। অর্থসম্পদে বাংলা ছিল তখন সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। অভাব-অনটন ছিল না।  বাণিজ্য করতে ব্রিটিশ বেনিয়ারা কলকাতায় ঘাঁটি করল। তারা দেখল এ অঞ্চলের মানুষ শুধু ব্যবসা নয়, পুরো দেশ দিয়ে দিতে চায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুযোগ হাতছাড়া করল না। পথের কাঁটা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শুরু করল ষড়যন্ত্র। সেনাপতি বেইমানি না করলে ইংরেজ বণিকদের রুখে দিতে পারত নবাবের অনুগত বাহিনী। তারা তা করেনি। সেনাপতি গোপন সম্পর্ক করলেন ইংরেজ বেনিয়াদের সঙ্গে। ক্ষমতা বদলের সহায়তায় সন্ধি করলেন। সুযোগসুবিধা আদায়ের প্রতিশ্রুতি নিলেন। সিরাজের খালা ঘসেটি বেগমও ষড়যন্ত্রে তাল মেলালেন। যুক্ত হলেন মীরজাফরদের সঙ্গে।

 

দিল্লিতে মুঘলদের ক্ষমতা তখন ক্ষয়ে আসছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যাত্রার সময় দিল্লির মসনদে ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। তাঁর উত্তরসূরিদের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকল। বিশাল সাম্রাজ্য তাঁরা ধরে রাখতে পারলেন না। ধীরে ধীরে সব গুটিয়ে আসতে থাকল। নির্ভরতা তৈরি হলো ব্রিটিশ বেনিয়াদের ওপর। তার পরও বাংলার পতনের পর শতবর্ষ লাগল দিল্লির পতাকা নামাতে। সিপাহি বিদ্রোহের রেশ ধরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লি নিয়ন্ত্রণে নেয়। আটক হন দিল্লির শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। রেঙ্গুনে বাহাদুর শাহের মাজার জিয়ারতের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বাহাদুর শাহ পূর্বসূরিদের মতোই ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন আয়েশি মানুষ। তিনি কবিতা লিখতেন। সুফিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। শায়ের শুনতেন আসর জমিয়ে। বিয়ে করেছিলেন অনেক। সন্তানের সংখ্যাও কম ছিল না। শেষ দিকে ইংরেজদের প্রদত্ত লাখ রুপি ভাতা নিয়েই চলতেন। এ টাকায় আয়েশে সমস্যা হতো। তার পরও কোনো ধরনের ঝামেলা চাননি ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে। তিনি নীরবে সময় পার করতেন। খরচের হাত ছিল খোলা। তাই ভাতা বাড়ানোর অনুরোধ করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। তারা সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয় এবং বিভিন্নভাবে হেনস্তা শুরু করে। সম্রাট হিসেবে ক্ষমতা খর্ব করে। মর্যাদাহানি ব্যথিত করত মুঘল সম্রাটকে। তবু বলা ও করার কিছু ছিল না। বিষণ্ণ  বদনে সব মেনে নিয়ে প্রাসাদেই বেশি সময় থাকতেন বাহাদুর শাহ। কখনো কখনো বুঁদ হতেন আফিমের নেশায়। মাঝে মাঝে কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতায় থাকত আক্ষেপের কথা।

 

বাহাদুর শাহ লিখলেন, ‘উমর দরাজ মাঁঙকে লায়েথে চারদিন/দো আরজুমে কাট গ্যয়ে, দো ইন্তেজার মেঁ।’ অর্থাৎ ‘চারদিনের আয়ু নিয়ে এসেছিলাম/দুদিন কাটল প্রত্যাশায়, আর দুদিন অপেক্ষায়।’ আধ্যাত্মিক চিন্তার বাহাদুর শাহ দেখলেন ক্ষণস্থায়ী আমাদের এ জীবন। চাওয়াপাওয়ার হিসাব মেলানোর আগেই সব শেষ হয়ে যায়। সিপাহি বিদ্রোহ বাহাদুর শাহের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে। সাদামাটা জীবনের মানুষটি ক্ষমতা নিয়েছিলেন সিপাহি বিদ্রোহের ২০ বছর আগে। ক্ষমতায় বসে দেখলেন মুঘল সাম্রাজ্য ক্ষয়ে গেছে। চারদিকে শুধু লোকদেখানো ভাব আর আভিজাত্য। বুঝতে পারলেন তাঁর পক্ষে পূর্বপুরুষের মতো লড়াই সম্ভব নয়। তাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি গেলেন না। সিপাহি বিদ্রোহ তাঁকে উৎকণ্ঠিত করল সহচরদের বড় অংশ জড়িয়ে পড়ায়। সম্রাটের নামেই তাঁর সেনারা জড়িয়েছিল। সিপাহিরা ক্ষুব্ধ ছিল ইংরেজ বণিকদের অত্যাচার-নির্যাতনে। আগুনে ঘি দিতে সামনে আসে সিপাহিদের ব্যবহার করা বন্দুকের গুলির কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি মেশানো ইস্যু। হিন্দু-মুসলমানের ধর্মরক্ষার আলোচনা থেকেই বিদ্রোহের সূচনা। পরে এ বিদ্রোহ দেশ উদ্ধারে রূপ নেয়। সিপাহিরা ঘোষণা দেয় তারা দিল্লির বাদশাহকে মানে। অন্য কাউকে নয়। ইংরেজদের শাসন তারা কোনোভাবে মানবে না। ইংরেজদের অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। দিল্লির বাদশাহের কাছে হস্তান্তর করতে হবে ক্ষমতা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শুরু হলো বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ। সবকিছু তছনছ করে ছুটল দিল্লি অভিমুখে। টার্গেট ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ইংরেজদের কাছ থেকে ফিরিয়ে বাদশাহকে হস্তান্তর।

 

কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নেয় ইংরেজ কোম্পানি। সবকিছু সামাল দিতে ঐক্যের প্রতীক শেষ মুঘল সম্রাটকে ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়। পূর্বপুরুষের কবরে প্রার্থনারত সম্রাটকে আটকের সময় চরম অপমান করা হয়। হেনস্তা করা হয় পুরো পরিবারকে। ১৮৫৮ সালের শেষ ভাগে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় বাদশাহের। মেজর হ্যারিওট নামে একজন ইংরেজ সেনা কর্মকর্তা বাহাদুর শাহের পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে ফাঁসির আদেশ দেন। দিল্লিবাসী বিচারের নামে দেখল এক প্রহসন। একদা সম্রাট জাহাঙ্গীর ভারতবর্ষে ব্যবসার অনুমতি দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে সেই ব্রিটিশরা বিচার করল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বংশধরদের। বিচারের নামে মুঘল পরিবারের অর্ধশত সদস্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল। ইংরেজদের টার্গেট ছিল আতঙ্ক তৈরি করা। মুঘল পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করা। তারা সফল হয়েছিল। ২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭ সালে দিল্লি নিয়ন্ত্রণে নিল ইংরেজরা।

 

চোখের সামনে তৈমুর বংশের ধ্বংস দেখে ভেঙে পড়লেন বাহাদুর শাহ। আটকের আগে তিনি চেষ্টা করলেন কিছু স্মৃতি রক্ষা করতে। বুঝতে পারলেন ইংরেজরা লালকেল্লায় অভিযান চালাবে। চিরতরে ধ্বংস করে দেবে তৈমুর বংশের উত্তরাধিকারসূত্রে রক্ষিত সব মুসলিম ও ঐতিহাসিক স্মৃতি। বাদশাহ কাউকে না জানিয়ে লালকেল্লা ত্যাগ করেন পানিপথ দিয়ে। তিনি প্রথমে যান হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে। মাজার জিয়ারত করলেন। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া দুর্লভ জিনিসপত্র ছিল সঙ্গে। পরিবারের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের অনুরোধ জানান খাদেমদের। তার মধ্যে ছিল মহানবী (সা.)-এর শ্মশ্রু মোবারক। তিনি বলেছিলেন, আগেই জানতাম এমন বিপদ হবে। তার পরও কেউ আমার কথা শুনল না। আমার অনুসারীরাও আলাপ করল না। সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় সংগঠিত ছিল না কেউ। তিনি খাদেমদের হাতে সবকিছু তুলে দেন। তাদের অনুরোধ করেন মুঘলদের সংগ্রহে থাকা ইসলামের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে। তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান পাশেই বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধিসৌধে।

 

দিল্লির নিজামুদ্দিনের কাছে হুমায়ুন সমাধি। এক বিকালে গিয়েছিলাম হুমায়ুন সমাধি দেখতে। নিজামুদ্দিনে জিয়ারত শেষ করে ভাবলাম হুমায়ুন সমাধিতে যাই। হুমায়ুনপত্নী হামিদা বানু এ সমাধি নির্মাণ করেন বাদশাহের মৃত্যুর নয় বছর পর। শিশুপুত্র আকবর তখন দিল্লির সম্রাট। বাদশাহ হুমায়ুন পুরো জীবন লড়েছেন সাম্রাজ্য রক্ষা করতে। এক কঠিন দুর্যোগে পুত্র আকবরের জন্ম। হামিদা বানু অনেক ভালোবাসতেন স্বামীকে। তখনকার দিনে তিনি এ সমাধি নির্মাণে খরচ করেন ১৫ লাখ টাকা। হুমায়ুন সমাধিতে তাঁর পত্নী হামিদা বানুও শায়িত আছেন। শাহজাহানপুত্র দারাশিকোর কবরও এখানে। সমাধিগুলো ঘুরতে ঘুরতে মনে পড়ছিল হুমায়ুন বাদশাহর জীবনের পুরোটাই ছিল ট্র্যাজেডিতে ভরা। বাংলায় এসে তাঁরও ভাগ্যবিপর্যয় হয়েছিল। তিনি রাজ্য হারিয়ে ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে ছিলেন। ক্ষমতা ফিরে পেয়ে অল্প দিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে পুত্র আকবর মুঘল সম্রাটের দায়িত্ব নেন। হুমায়ুনের মৃত্যুর খবর ১৭ দিন গোপন রাখা হয়। প্রজাদের বুঝতে দেওয়া হয়নি বাদশাহ আর নেই। একটা আশঙ্কা ছিল নতুন করে কেউ ক্ষমতা দখলে হামলা করে কি না। এ কারণে সম্রাটের মতো দেখতে মুলা বেকশি নামে একজনকে বাদশাহের আসনে বসিয়ে রাখা হতো। বাদশাহ হুমায়ুন মাত্র ২৭ বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। ১২ বছর বয়সে তাঁকে একটি প্রদেশের দায়িত্ব দেন পিতা সম্রাট বাবর। ১৭ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে যান যুদ্ধে। পিতা ও পুত্র একসঙ্গে যুদ্ধ জয় করেন। ক্ষমতা নেওয়ার পর ভাইদের বিরোধিতার মুখে পড়েন। ভাইদের বিশ্বাস করে হুমায়ুন ঠকেছিলেন। রাজ্যহারা হয়ে ঘুরেছিলেন পথে প্রান্তরে। স্ত্রী-পুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। সবকিছু ফিরে পাওয়ার পর ক্ষমতা আর ভোগ করতে পারেননি। লাইব্রেরির ছাদে যাচ্ছিলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। ছাদ থেকে নামার সময় মসজিদে আজানের ধ্বনি শেষ হয়। তিনি নামাজ পড়তে সিঁড়িতেই দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। হঠাৎ পোশাকে পা জড়িয়ে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়েন নিচে। তিন দিন পর তার মৃত্যু হয়। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে ক্ষমতা ফিরে পেয়েও আর ভোগ করা হলো না বাদশাহ হুমায়ুনের।

 

মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সূর্য অস্ত যাওয়ার মুহূর্তে হুমায়ুন বাদশাহের সমাধিতে গেলেন বাহাদুর শাহ। তিনি ঝরঝর করে কাঁদলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন পুত্র। তাদের তিনি বলেন, একদা সবকিছু আমার পূর্বপুরুষের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাঁরা অনেক কষ্ট করে এ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। রক্ষা করেছিলেন তৈমুর বংশের ঐতিহ্য। আজ সবকিছু শেষ হতে চলেছে। এখন আর কোনো কিছুই আমাদের নয়। আমি কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারলাম না। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। দোয়া করলেন নিজের সন্তান ও পরিবারের জন্য। এদিকে ইংরেজ সেনারা বাদশাহকে খুঁজতে শুরু করেছে ততক্ষণে। মাজারের খাদেমের বেইমানিতে ইংরেজরা জেনে গেল বাদশাহ কোথায় আছেন। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হাডসন অভিযান চালালেন হুমায়ুন সমাধিতে। তারা আটক করলেন শেষ বাদশাহ বাহাদুর শাহকে। আটকের পর নিয়ে যাওয়া হয় লালকেল্লায়। তার আগেই সেনাপতি হাডসন বাহাদুর শাহের দুই পুত্রকে বের করে রাজপথে দাঁড় করান। প্রকাশ্যে গুলি করে তাদের হত্যা করেন। চোখের সামনে এমন নিষ্ঠুরতা দেখে মৃত্যুর প্রস্তুতি নেন বাদশাহ। বিচারের নামে প্রহসন হলো। মুঘল পরিবারের কাউকে ফাঁসি, কাউকে জেল দেওয়া হয়। নির্বাসনে পাঠানোর রায় হয় শেষ মুঘল সম্রাটের। বাহাদুর শাহের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীদের সবাইকে তুলে দেওয়া হয় গরুর গাড়িতে। বন্দি বাহাদুর শাহকে নিয়ে যাওয়া হয় রেঙ্গুনে। সেই দিনটি ছিল ১৮৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। সব স্ত্রী পথে পথে সরে পড়লেন। কেউই কষ্টের জীবন বেছে নিতে সম্মত হলেন না। ছায়াসঙ্গী থাকলেন ছোট পত্নী জিনাতমহল ও তাঁর দুই সন্তান। অন্য স্ত্রী তাজমহলও ছিলেন সফরসঙ্গী। ভৃত্য রক্ষিতা মিলিয়ে মোট ৩১ জনকে নিয়ে যাত্রা হয়েছিল। জাফর ও তাঁর দুই পুত্র ছিলেন এক পালকিতে। সঙ্গে ব্রিটিশদের নিরাপত্তা। সবকিছু করা হচ্ছিল কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তায়। শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৫ জনকে নিয়ে বাহাদুর শাহ স্টিমারে উঠলেন। রেঙ্গুন ক্যান্টনমেন্টের কাছে চার রুমের বাড়িতে তাঁদের রাখা হয়।

 

নির্বাসিত বাদশাহ ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর রেঙ্গুনে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুঘল ইতিহাসের ৩৫০ বছরের অবসান হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ডেভিস গোপনীয়তা বজায় রেখে দাফন করেন বাদশাহকে। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর আরও ২০ বছর বেঁচে ছিলেন জিনাতমহল। বাহাদুর শাহের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। পুত্র মির্জা জওয়ান বখতও এখানে শায়িত। মৃত্যুর আগে কবিতা লিখে সময় কাটাতেন দিল্লির শেষ সম্রাট। তাঁর আক্ষেপ ছিল নিজের মাটিতে দাফন হবে না জেনে। সেই আক্ষেপের কবিতাটি তাঁর সমাধিতে বড় করে লেখা। তিনি লিখেছিলেন : ‘কিতনা বদ নসিব হ্যায় জাফর/দাফন কি লিয়ে দো গজ জমিন ভি না মিলি কু ইয়ার মে।’ বাংলা অর্থ : ‘জাফর তুমি কত দুর্ভাগা, নিজের দাফনের জন্য/প্রিয় জন্মভূমিতে দুই গজ মাটিও মিলল না।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ইন্দিরাপুত্র রাজীব গান্ধী গিয়েছিলেন রেঙ্গুন। তিনি বাহাদুর শাহের মাজারে যান। মাজারে বাহাদুর শাহের লেখা শায়ের পড়লেন। তারপর লিখলেন : ‘দো গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে/পার তেরি কোরবানি সে উঠি আজাদি কি আওয়াজ/বদ নসিব তো নাহি জাফর।/জুড়া হ্যায় তেরি নাম ভারত শান আউর শওকত মে/আজাদি কি পয়গাম সে।’ বাংলা অনুবাদ হলো : ‘হিন্দুস্তানে আপনি দুই গজ মাটি পাননি সত্য/তবে আপনার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল,/দুর্ভাগ্য আপনার নয় জাফর।/স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও/গৌরবের সঙ্গে আপনার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

 

রেঙ্গুনের জি ওয়াকো সড়কে বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারে একবার গিয়েছিলাম আমি ও ফরিদা ইয়াসমিন। ভারতবর্ষের ইতিহাসের ট্র্যাজেডির নায়ক বাহাদুর শাহ জাফর। ১৯০৫ সালে তাঁর সমাধি চিহ্নিত হয়।  রেঙ্গুনের মুসলমানদের দাবির মুখে সরকার বাধ্য হয় কবর চিহ্নিত করতে। বাহাদুর শাহের মৃত্যুর খবর দিল্লিতে পৌঁছে বেশ কিছুদিন পর। এ খবর শুনে মির্জা গালিব দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন কবিতা। দিল্লিবাসীর কাছে তিনি খবরটা পৌঁছে দেন। আজ দিল্লির নিজামুদ্দিনে মির্জা গালিব আর রেঙ্গুনে বাহাদুর শাহ শায়িত আছেন। দুজনের কবর জিয়ারত করেছিলাম। প্রার্থনা করেছিলাম আল্লাহ যেন তাঁদের শান্তিতে রাখেন।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন ।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com