কার্ডনেটের ১৭ নম্বর বাড়ির সামনে এসে থামলো রাউল। এই ভবনের চারতলার একটি ফ্ল্যাটে যাবে সে। দরোজার সামনে এসে কলিংবেল চাপলো। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর আবারও সুইচ টিপলো, কারো কোনো খবর নেই। তৃতীয়বার বেল টেপার পর দরোজা খুলে মুখ বের করলেন এক বৃদ্ধা।কপালের ভাঁজ মনে হচ্ছে, কোনো কারণে মহাবিরক্ত তিনি। তবে রাউলকে দেখার পর ফরাসি বৃদ্ধার ভাজ পড়া চেহারাটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো।
বুড়ি হাসিমুখেই দরোজা খুলে তাকে ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বললো, ‘শুভ সকাল, মঁশিয়ে’। ‘ধন্যবাদ, এলিস।’ হাসিমুখে জবাব দিল রাউল।
এলিস ফ্লাটের দরোজা বন্ধ করে রাউলকে নিয়ে এলো লিভিংরুমে। বললো-
‘মঁশিয়ে, আপনি একটু বসুন। আমি মাদাম সিমনকে খবর দিচ্ছি। একটু পরেই ওনার সঙ্গে আপনার দেখা হবে।’
‘মাদাম সিমন কি এখন ব্যস্ত? কি করছেন তিনি?’ জানতে চাইলো রাউল।
‘তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন।’
‘এই অসময়ে বিশ্রাম করছেন! মাদামের কি শরীর খারাপ হয়েছে?’
উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠলো রাউল। সেটা খেয়াল করে আরো গম্ভির হয়ে গেল এলিস। বললো-
‘মাদামের শরীর খারাপের কারণ নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। যা শুরু করেছেন আপনারা, শরীর তো খারাপ হবেই।’
‘মানে, বুঝলাম না।’ বললো রাউল।
‘মাদামের শরীর তো খারাপ হবেই, এরকম বারবার প্ল্যানচেটে বসতে হলে কার শরীর আর ভাল থাকে!’
বুড়ি এবার বক্তৃতা শুরু করলো।
‘এটা ঠিক হচ্ছে না, বুঝলেন। আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করছি। পরলোক থেকে আত্মা ডেকে এনে ঈশ্বরের নিয়মের বিরোধিতা করছি। এ কারণে শয়তানের দৃষ্টি পড়েছে আমার মাদামের ওপর। দেখছেন না, দিনদিন কেমন রোগা আর ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছেন, তার শরীরটা রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। শয়তানে কুনজরে এটা হচ্ছে। ইদানিং উনার মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়, মাথা ব্যাথায় ঘুমাতে পারেন না, বিছানায় শুয়ে রাতভর ছটফট করেন।’
‘রাগ করছ কেন এলিস’, বৃদ্ধা পরিচারিকাটিকে নরম গলায় বলল রাউল। ‘ব্যাপারটা আসলে তুমি ঠিকঠাক বুঝতে পারছ না। এর সঙ্গে শয়তানের কোনও যোগাযোগ নেই। অনর্থক শয়তান বেচারাকে নিয়ে টানাটানি করছ কেন?’
রাউলের কথা কানেই নিল না এলিস। নিচু গলায় বলল, ‘যাই বলেন মঁশিয়ে এসব আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না। মনের ভেতর কু-ডাক শুনতে পাচ্ছি। অশুভ কিছু ঘটার আগে এমন ডাক আমি শুনতে পাই।
ঠোঁটের হাসিটাকে ধাপাচাপা দিতে একটু কষ্টই হলো রাউলের। এই কুসংস্কারচ্ছন্ন বুড়ি পরিচারিকার কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তবে হ্যাঁ, সে খুব বিশ্বাসী আর দায়িত্ব সচেতন। সিমনের খুব কেয়ার নেয়।
‘ওইসব শয়তানী কান্ডকারখানা আর করা ঠিক হবে না’। বুড়ির ঘ্যান ঘ্যানানি থামছেই না।
‘মাদাম সিমোনের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখুন একবার – দেখুন দিনেদিনে উরার শরীরের কি হাল হচ্ছে। আমরা ইহজগতের মানুষ। পরলোকের আত্মাদের নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার কি? আমাদের এটুকু জানলেই হল যে, ভালো আত্মারা স্বর্গে যায় আর খারাপ আত্মাদের স্থান হয় নরকে।’
রাউল একবার ভাবলো, বুড়ি ধমক দিয়ে থামিয়ে দেবে নাকি! নাহ, তাকে এখন কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ এ মুহর্তে সিমনকে দেখভাল করার মতো আর কেউ নেই। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো, ‘ভালো। পরকাল আর আত্মা নিয়ে তোমার চিন্তাভাবনা শুনে খুব ভালো লাগলো।
বুড়ি এবার রাউলের চোখের দিকে তাাকিয়ে বলে,‘একটা কথা সত্যি করে আমাকে বলবেন মঁশিয়ে আপনাদের বিয়ের পরে আর এসব প্রেতাত্মা টেতাত্মা নিয়ে চক্র বসাবেন না তো?’
‘আরে, না। একদম না।’
এলিসের দিকে তাকিয়ে হাসল রাউল।
সংশয় তবু কাটে না বৃদ্ধার, ‘সত্যি বলছেন?’
রাউল তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে, ‘অবশ্যই এলিস। বিয়ের পর সব বন্ধ। চোখ বুজে সংসারে ডুব দেব।’
একটু থেমে রাউল প্রশ্ন করলো, ‘তুমি মাদামকে খুব ভালবাসো, তাই না এলিস?’
বৃদ্ধা পরিচারিকা মাথা নাড়লো। জানালো, আপন সন্তানের মতোই সে সিমনকে ভালোবাসে। রাউল অবশ্য ভালো করেই জানে। আরও জানে, এই বৃদ্ধাকে তার হবু স্ত্রী সিমনও পছন্দ করে। খুব বিশ্বাস করে।
বৃদ্ধার আশঙ্কাকে উড়িয়ে না দিয়ে সে বলে, ‘একদম টেনশন করবে না এলিস। তোমার মাদাম সিমনের সঙ্গে ভালোই ভালোই আমার বিয়েটা হয়ে যাক। দেখবে, এসব প্রেতাত্মা আর পরলৌকিক বিষয় নিয়ে আর কেউই মাথা ঘামাতে দেব না। কোনও ঝামেলাতেই আমরা যাবো না।’
এবার বোধহয় রাউলের কথায় আস্থা ফিরে পেল এলিস। বলিরেখায় ভরা মুখখানা বৃদ্ধার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মাদামের হবু বরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। ঘাড় ঝাঁকিয়ে মাদামকে ডাকতে লিভিং রুম থেকে বের হয়ে গেল।
একা একা বসে থেকে ভালোবাসার মানুষটির কথা ভাবতে থাকে রাউল ডুবারেল, সিমনের মধ্যে সত্যিই একটা অদ্ভুত অলৌকিক ক্ষমতা আছে। আর সেই ক্ষমতার প্রয়োগও করা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু আর নয়। এবার সত্যিই এ ব্যাপারে ইতি টানা দরকার।
রাউল নিজেকে প্রশ্ন করে, আমি কি সিমনকে ভালবাসি?
নিজের মনেই উত্তর খুঁজে। অবশ্যই ভালোবাসি কোন সন্দেহ নেই । অনেক অনেক ভালোবাসি। তাহলে আমি কেনো ওর ওপর অবিচার করছি? সিমনের অবস্থা কেন আমার চোখে পড়ছে না? দিন দিন ও যে রোগা আর ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। এটা আমার নজর এড়ায়নি। আমি জানি প্ল্যানচেটের সময় একজন মিডিয়মের দেহ আর মনের ওপর কি প্রচণ্ড চাপ পড়ে। সেই অমানসিক স্নায়ুবিক চাপ সহ্য করা খুবই কঠিন। কিন্তু দেখতে হালকাপাতলা হলে কি হবে, সিমন হলো প্যারিস শহরের; এমনকি গোটা ফ্রান্সে সবচেয়ে শক্তিশালি মিডিয়ম। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে তার নাম। দেশ-বিদেশ থেকে লোকজন তার কাছে আসে। তারা জানে, এ্ই মিডিয়মের কাছে কোনও ভণ্ডামি বা জালিয়াতি নেই। এই মিডিয়মের কাছে কোনওভাবেই ঠকবেন না তারা।
ধোঁয়া ওঠা কফির পেয়ালা নিয়ে ফিরে আসে বুড়ি এলিস। জানায়, তার মাদাম ফ্রেশরুমে আছেন। টেবিলে ওপর কফির কাপ রাখলো। তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। রাউলের মনে হলো, বৃদ্ধা পরিচারিকা তাকে আরও কিছু বলতে চায়।
বুড়ির দ্বিধা দূর করতে কফিতে চুমুক দিয়ে সে বলে, ‘বাহ, চমৎকার কফি বানাতে পারো তো তুমি। এলিস আমার মনে হচ্ছে, তুমি বোধহয় আমাকে আরও কিছু বলেতে চাইছো।’
‘মঁশিয়ে ঠিক ধরেছেন’। বৃদ্ধার চোখ মুখে একধরনের ভীতি। ‘একটা বিষয় নিয়ে সেই কখন থেকে ভাবছি।’
‘আরে এতো ভাবাভাবির কিছু নেই, কিছু বলতে চাইলে বলে ফেলো।’
এলিস বলে,‘ মঁশিয়ে। আপনি তো বলছেন, মাদাম সিমন প্রেতাত্মাদের সঙ্গে কাজ কারবার আর করবেন না। ওসব ছেড়ে দেবেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রেতাত্মারা যদি মাদাম’কে ছেড়ে না দেয়?’
‘মানে?’ চমকে উঠলো রাউল,‘কি বলতে চাইছ তুমি?’
চাপা কণ্ঠে এলিস বলে- ‘মঁশিয়ে, পরলোকের বাসিন্দাদের নিয়ে যারা ঘাটাঘাটি করে তাদের ওপর মন্দ আত্মা ভর করে। সময় তারা আর মিডিয়মকে ছাড়তে চায় না। আমার ভয় সেখানেই।’
পুরো বিষয়টা এলিসকে আরেকবার গুছিয়ে বলতে বললো রাউল।
আতঙ্ক নিয়ে এলিস বলে, ‘এখানে যেসব ঘটে, তার মধ্যে কোনও ছলচাতুরি নেই। যা যা দেখা যায়, তা সত্যি সত্যিই দেখা যায়। আর সেজন্যই আমার ভয় হয়, খুব ভয় লাগে। মঁশিয়ে, এইসব প্ল্যানচেট ফ্যানচেট, প্রেতাত্মা টেতাত্মা নিয়ে কাজ করা মোটেও ঠিক নয়। ইহজগৎ আর পরজগতের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন সম্পূর্ণ প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করছি। এ কাজ করছি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এইসব অস্বাভাবিক কাজের জন্য একদিন চরম মূল্য দিতেই হবে।’
বুড়ো কাজের মহিলাকে সাহস দিয়ে রাউল বলে, ‘ভয়ের কিছু নেই এলিস, পরকাল থেকে আত্মার দেহ থাকে না। দেহ না থাকলে শক্তিও না, কাজেই মানুষকে ভয় দেখানো ছাড়া তাদের কোনো ক্ষমতাই থাকে। কিছু অতৃপ্ত আত্মা এই ভয় দেখানোর কাজটা করে আনন্দ পায়। শোনো, তোমায় একটা সুসংবাদ দিই। আজই শেষবারের মতো আমরা প্ল্যানচেট করবো। এরপর কথা দিচ্ছি, আর কোনো দিন ভূতপ্রেত বা পরলোক নিয়ে কোনও চক্র টক্র বসবে না।’
‘হায় ঈশ্বর’, আতঙ্কে একার প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে এলিস। ‘আজকেও আবার চক্র বসবে?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু এটাই শেষ চক্র।’
‘দুঃখিত, মাদাম আজকে চক্রে বসবেন না।’
‘মানে, কেনো?’
‘মঁশিয়ে, আপনি কেনো বুঝতে পারছেন না আমার মাদাম অসুস্থ।’
‘খুব বেশি অসুস্থ কি?’
‘জি, মাথার যন্ত্রণায় তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। আজ চক্রে বসলে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’‘কিন্তু আমরা যে কথা দিয়েছি ঐ ভদ্রমহিলাকে।’ চিন্তিত হয়ে পড়লো রাউল, ‘এমনকি আগাম টাকা পর্যন্ত নিয়েছি।’
‘তাতে কি, জানিয়ে দিন মিডিয়ম অসুস্থ।’ যেন মামলার রায় ঘোষণা করছে এলিস। ‘টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিন, মাদাম আজ চক্রে বসতে পারবেন না। প্রয়োজনে আগাম নেয়া টাকা ফিরিয়ে দিন।’
ওদের কথাবার্তার মাঝেই নিরবে দরোজা খুলে ঘরে ঢুকল অপূর্ব লাবণ্যময় এক তরুণী। তাকে দেখে রাউলের চোখমুখ ঝলমল করে উঠলো। এলিস আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বুড়ির বিবেচনা বোধ আছে দেখা যায়।
গভীর আবেগে রাউল ডাক দেয়, ‘সিমন!’
সেই ডাকে সাড়া সিমনও তার প্রাণের মানুষের নাম ধরে ডাকলো, ‘রাউল’।
সিমনের ধবধবে সাদা দু’হাত টেনে নিয়ে চুমু খায় রাউল। তারপর ঠোঁট রাখে ঠোঁট। এই যুগলকে দেখলে মনে হতেই পারে, এরা বুঝি একে অন্যের জন্যই পৃথিবীতে এসেছে।
আবেগের প্রথম ধাপ শেষে রাউলের চোখের মণি আটকে য়ায় সিমনের চেহারায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে সে বলে, ‘সিমন, তোমার চেহারাটা বড্ড ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। এলিসের কাছে শোনলাম, তোমার মাথায় নাকি খুব যন্ত্রণা । মাথাব্যথায় সারারাত ঘুমাতে পারোনি। তাই অবেলায় বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছো। তোমার শরীর এতো খারাপ, তুমি আমাকে খবর পাঠাওনি কেনো সিমন? ‘না, খুব বেশি অসুস্থ নই’, দ্বিধাভরা গলায় বলল সিমন। ‘আসলে বুড়িটা সব সময় একটু বেশি বাড়িয়েই বলে। আমাকে বেশি ভালোবাসে বলে টেনশনটা ও’ একটু বেশিই করে সব সময়।’
রাউলের দিকে তাকিয়ে হাসলো সে এবং সেই হাসিটা ছিল ফ্যাকাশে। উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল রাউলের। সিমনের হাত ধরে সোফায় বসাল, নিজেও বসলো পাশে। জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি করে বলো তো, কি হয়েছে তোমার?’
জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে সিমন। রাউল চোখ থেকে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে বলে.‘আমার কিচ্ছু। কিছু দুঃস্বপ্ন দেখি। ওটা এমন কিছু না। ওসব কথা শুনলে তুমি আমায় বোকা মনে করবে।’
‘সিমন তোমাকে বোকা মনে করার তো প্রশ্নই ওঠে না।রাউলের কণ্ঠে বিস্ময়। ’তোমাকে আমি চিনি, আর খুব ভালোই জানি কতোটা মেধাবী তুমি।’
সিমনের মুখ আরও ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে নিচু গলায় সে বলো , ‘আমার ভীষণ ভয় লাগছে রাউল। আমি ভয় পাচ্ছি, অনেক বেশি ভয় পাচ্ছি।’
রাউল আরো কথা শোনার আগ্রহ নিয়ে সিমনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু মুহূর্ত কেটে যায় নিরবতায়। সিমন আর কিছু বলছে না দেবার তাকে সাহস দেবার জন্য বলে ওঠে-
‘ভয়! কিসের ভয়! কাকে ভয়?’
‘জানি না, সত্যি আমি জানি না। তবে ভীষণ ভয় পাচ্ছি।’
‘সিমন, প্লিজ তোমার এই ভয় পাওয়ার কারণটা আমাকে খুলে বলো।’
‘বিশ্বাস করো রাউল, আমি জানি না। কিচ্ছু জানি না। কিসের ভয়, কেন ভয়? আমি নিজেও জানি না।’
‘সিমন, আমার কাছে কিছুই তো তুমি লুকাও না। ভয় পাওয়র ব্যাপারটাও বলো, সবকিছু খুলে বলো।’
‘আগে কখনো এমন হয়নি। আজকাল সারাক্ষণ ভয় ভয় লাগে, কোনো এক অজানা আতঙ্কের কালো মেঘ যেন আমার মনের আকাশকে ছেয়ে ফেলছে। মনে হচ্ছে, আমার জীবনে একটা ভয়ঙ্কর কিছু অমঙ্গল ঘটতে যাচ্ছে। একে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, তার ওপর এই অজানা আতঙ্ক! রাউল, আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
শূন্য দৃষ্টিতে সিমন তাকিয়ে থাকে। সাহসী রাউলও ঘাবড়ে যায। কিন্তু সে ঘাবড়ে গেলে চলবে কিভাবে? দুর্ভাবনা মাথা থেকে তাড়িয়ে এগিয়ে যায় সিমনের দিকে। গভীর আলিঙ্গনে প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরে রাউল বলে- ‘দুর্ভাবনাকে পাত্তা দিতে হয় না সিমন। আসলে কিচ্ছু হয়নি তোমার। উল্টাপাল্টা ভেবে মন ভাঙলে কিভাবে হবে! তোমার কি হয়েছে আমি বুঝতে পারছি। আসলে টানা পরিশ্রমে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। এরকম ক্লান্তি মিডিয়মদের জীবনে কখনো কখনো নেমে আসতেই পারে। তোমার এখন যা দরকার তা হলো বিশ্রাম… পুরোপুরি বিশ্রাম। বিশ্রামেই তোমার সব ভয় কেটে যাবে, মানসিক শান্তিও ফিরিয়ে দেবে।
প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সাহস সিমনকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিল। রাউলের দিকে তাকিয়ে সে বলে,তুমি ঠিকই বলেছ, রাউল। সত্যিই আমি ক্লান্ত আমার এখন দরকার পরিপূর্ণ বিশ্রাম। একটানা কয়েকদিন আমি বিশ্রাম নেব আর এতেই আমার সব দুর্ভাবনা কেটে। মনে শান্তি ফিরে পাবো।’।
গভীর আবেগে চোখ বুজে রাউলের বাহুতে মাথা রাখল সিমন। হৃদয়ের সবটুকু মাধূর্য্য নিয়ে সে বললো, আমি তোমার ওপর এমনি করে নির্ভর করে থাকতে চাই,রাউল। আমার চাহিদাও খুব বেশী নয় রাউল, শুধু একটুখানি সুখ।’
রাউল এবার সিমনকে জড়িয়ে ধরলো। সিমন থামলো না। আজকে সে তার সব কষ্টের প্রিয় মানুষটির কাছে। সিমন অস্ফুট কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘একজন মিডিয়মের জীবনের সবকিছু তুমি জানো না রাউল। কতোটা ঝুঁকির মধ্যে মিডিয়মকে থাকতে হয়, কতোটা চাপ তাকে নিতে হয় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। মিডিয়মের জীবন বড় দুর্বিসহ বড় ভয়ঙ্কর।’
রাউলের মনে হলো তার আলিঙ্গনে বাঁধা সিমনের দেটা যেন ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠছে, একটা আড়ষ্টতা যেন আচ্ছন্ন করে ফেলছে তার সুন্দর দেহটিকে। রাউলের আলিঙ্গন থেকে নিজে ছাড়িয়ে নিল সিমন। চোখের তারায় কেমন যেন ঘোর। ভোতা দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই কথা বলতে থাকলো সে।
‘ছোট্ট একখানা ঘর। তার মধ্যে আমি বসে থাকি। অপেক্ষা করি। আমার চারপাশে পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার। বড় ভয়ঙ্কর নিরন্ধ্র অন্ধকার। এ অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে কেবল শূন্যতা আর শূন্যতা। স্বেচ্ছায় এই অন্ধকারের রাজ্যে নিজেকে ছেড়ে দিই। আমার চারপাশে অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আরও ঘন হয়ে ওঠে। সেই অন্ধকারে অপেক্ষা করতে করতে আমার চেতনার ওপরেও ধীরে ধীরে নেমে আসে অন্ধকার। আমি অচেতন হয়ে পড়ি। তারপর যা ঘটে তার কিছুই জানতে পারি না আমি। আমার কোনও অনুভূতি থাকে না। শেষপর্যন্ত ধীরে ধীরে অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ফিরে আসে আমার চেতনা, মনে হয় আমি যেন দীর্ঘ ঘুমের পর জেগে উঠলাম। তারপর এক সীমাহীন ক্লান্তিতে আমার দেহ-মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।’
‘জানি সিমন। আমি কিছুটা হলেও জানি’, নরম গলায় বলল রাউল। ‘প্ল্যানচেটের সময় একজন মিডিয়ম হিসেবে তোমার কিরকম কষ্ট হয়, আমি জানি।’
‘সেটা যে কতোটা সর্বগ্রাসী ক্লান্তি তা আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না’, নিস্তেজ গলায় বলল সিমন। বলতে বলতে তার শরীরটা যেন আরও এলিয়ে পড়ল।
রাউল তাকে আবারও সাহস দেয়। ‘তুমি তুলনাহীন সিমন, তুমি অনন্যা। সিমোনের হাতদুটো চেপে ধরে রাউল বলল, ‘এটা মানতেই হবে, তুমি পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী মিডিয়ম। এ ব্যাপারে তোমার শ্রেষ্ঠত্ব সবাই স্বীকার করতে বাধ্য।’
সিমন একটু হাসলো, নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল।
এইফাঁকে রাউল পকেট থেকে দুটো চিঠি বের করে সিমনের সামনে মেলে ধরলো। বলল, ‘এই যে দেখো এই চিঠিখানা এসেছে অধ্যাপক রোশের কাছ থেকে আর এই চিঠিখানা এসেছে ডক্টর জেনি’র কাছ থেকে, দু’জনেই একই অনুরোধ করেছেন। তারা চান তাদের গবেষণার সহায়তায় একবারের জন্যে হলেও তাদের প্রেতচক্রে অংশ নাও।’
‘অসম্ভব। কিছুতেই না… মোটেও না!’ সোফা ছেড়ে এক লাফে উঠে দাঁড়াল সিমন, ‘ওসব প্ল্যানচেটে আমি আর কক্ষনো বসবো না। সবকিছুরই একটা সীমা আছে। একেবারে শেষসীমায় আমি পৌছে গেছি। এবার একাজে ইতি টানা দরকার। তুমি নিজেও তো আমায় কথা দিয়েছ রাউল।’
সিমনের এই তীব্র প্রতিক্রিয়ায় অবাক হলো রাউল। দেখলো ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপছে সে। ওকে কোণঠাসা প্রাণীর মতোই।
আহা, খুব মায়া লাগলো মেয়েটার জন্য। সোফা থেকে উঠে ওর হাত ধরল রাউল, আবারও সাহস দিতে চাইল ওকে। আশ^াস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ওইসব প্রেতচক্র আর প্ল্যানচেটের ব্যাপারগুলো তো শেষই হয়ে গিয়েছে। তোমায় নিয়ে আমার খুব অহঙ্কার ছিল, তাই চিঠিদুটো দেখালাম। কত বড় বড় ব্যক্তিত্ব তাঁদের পরলৌকিক গবেষণার জন তোমার শরণাপন্ন হতে চান, সেটাই দেখালাম।’
রাউলের কথার মধ্যে ফাঁক ছিল, সেটা বন্ধ করতেই সিমন বলে, ‘তাহলে এটাই ধরে নিচ্ছি যে তুমি আর কখনো আমায় প্ল্যানচেটে বসতে বলবে না।’
‘না, না। কখনোই আমি তোমাকে আগের মতো প্রফেশনাল মিডিয়ম হতে বলবো না।’ বেশ কৌশলের সঙ্গে বললো রাউল। ‘তবে গবেষণার বৃহত্তর স্বার্থে এবং বিখ্যাত ব্যক্তির সনির্বন্ধ অনুরোধে স্বেচ্ছায় মাঝেমধ্যে মিডিয়ম হতেই পারো, তাই না?’ ‘না, না, মোটেও না। আর কখনো চক্রে বসব না আমি’, এবার বেশ সঙ্গে কথা বললো সিমন। ‘ তুমি জানো না রাউল,এসব প্রেতচক্রে বসার মধ্যে অনেক বিপদ আছে। ভয়ঙ্কর বিপদের বার্তা আমি পেয়েছি! ওসবের মধ্যে আর যাবো না।’
একটু থামলো সিমন। রাউলের হাত দুটো টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে করুণ আকুতি জানিয়ে বললো, ‘কথা দাও, আর কখনো আমাকে তুমি প্রেতচক্রে বসতে বলবে না।’
রাউল এবার তার হাত দুটো সিমনের দু কাঁধের ওপর রেখে বলল, ‘ঠিক আছে সিমন, তুমি যখন চাচ্ছো না। দরকার নেই আর ওসবে বসার। এই আমি তোমাকে কথা দিলাম, আজ রাতের পর আর কোনওদিন তোমায় প্রেতচক্রে বসতে হবে না।’
‘আজ বসতে হবে’, অস্ফুট কণ্ঠে বললো সিমন। ‘হ্যাঁ, আজকেই তো মাদাম একস-এর আসবার কথা। আমি তো একদম ভুলেই গিয়েছিলাম ’
রাউল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ মাদাম একসের আসবার সময় হয়ে গেছে। যে কোনও মুহূর্তে তিনি এসে পড়বেন তিনি। কিন্তু সিমন, তোমার যদি শরীর ঠিক না থাকে…।’
রাউলের কথা যেন সিমন শুনতে পায়নি। কয়েকবার বিড় বিড় করে মাদাম একসের নাম জপলো সিমন। এরপর স্পষ্টই বলে ওঠলো, ‘ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। এই মাত্র মনে হল। মাদাম একসের সঙ্গে আমার ভয় পাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে।’
একটু থেমে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো সিমন। তাকে শিউরে উঠতে দেখলো রাউল। সিমন বললো, ‘হ্যা, এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই ভয় আমাকে তাড়া করছে। মাদাম একসকে যখন প্রথম দেখলাম, তখন থেকেই আতঙ্কের অনুভূতি আমার মনে বাসা বাঁধে।মাদাম একসের হাত দুটো দেখেছো নাকি? মোটা মোটা হাত। কি বলিষ্ঠ! একেবারে পুরষের মতো। মনে হচ্ছে আমার দুঃস্বপ্নে একাধিকবার ঐ হাত হানা দিয়েছে।’ কেঁপে ওঠলো সিমন।
‘ছি, এভাবে বলো না সিমন। উনি একজন সন্তান হারা মা।’ রাউলের গলায় স্পষ্ট ভর্ৎসনা। ‘মা হলো অত্যান্ত পবিত্র একটি শব্দ। সন্তানহারা শোকাতুর মা সম্পর্কে এরকম ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। তুমি যদি সত্যিই অসুস্থ থাকো, সেক্ষেত্রে চক্রে বসা না-বসাটা তোমার ইচ্ছাধীন। কিন্তু একবার ভেবে দেখো, মাদাম একস একজন মা। এই মা সদ্য সদ্য তাঁর সন্তানকে হারিয়েছেন। তিনি যদি শেষবারের মতো তাঁর সন্তানকে দেখতে চান, তুমি তাঁকে দেখবার সুযোগ দেবে না?
স্কুল-শিক্ষকদের মতো রাউল বলে যায়, তুমি তো নিজে একজন নারী, একদিন তুমি মা হবে। একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর প্রতি তোমার সহানুভূতি এবং সমবেদনা থাকা উচিত। ভদ্রমহিলা সদ্য তার মেয়েকে হারিয়েছেন। সন্তানহারা একজন শোকাহত মায়ের ওপর তোমার দয়া হয় না? হওয়া তো উচিত, তাই না?’
সিমন উত্তেজিতভাবে বলতে লাগল, ‘তোমায় আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে না, মহিলাকে দেখলেই আমার কেন জানি মনে হয়, উনি আমার জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারেন। তোমার বোধহয় মনে আছে, ওনার সঙ্গে প্রেতচক্রে বসতে আমি থমে ইতস্তত করেছিলাম, রাজি হয়েছিলাম অনেক পরে।’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে রাউল বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই জানো না যে, মাদাম একস-এর সাথে তুমি যে’কয়টা প্রেতচক্রে বসেছ, তার সবকটাই খুব সুন্দরভাবে সফল হয়েছে। ছোট্ট এমিলি-র বিদেহী আত্মা খুব সহজেই তোমার ভেতর চলে এসেছিল এবং এমিলির দেহধারণ করেছিল অতি চমৎকারভাবে। ‘দেহধারণের বিষয়টা যদি একটু আমাকে খুলে বলতে’ বললো সিমন।
উৎসাহে কাঁধ ঝাঁকাল রাউল। প্রথম দিকের কয়েকটা প্রেতচক্রে ছোট্ট এমিলি-কে দেখা যাচ্ছিল একটা অস্পষ্ট কুয়াশার বৃত্তের মধ্যে। তাকে ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু শেষবারের চক্রে যা দেখা গেল, তা একেবারেই অকল্পনীয়। শেষবারে বাচ্চা মেয়েটা যেন একেবারে রক্তমাংসের শরীর নিয়ে এসেছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, শিশুটি যেন সত্যিই জীবন্ত! খুব স্পর্শ করার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু এতে তোমার ক্ষতি হতে পারে ভেবে বিরত থেকেছি।
সিমন অসহায়ের ভঙ্গিতে বলে, ‘এই যে কাজগুলো কি ঠিক হচ্ছে। ঈশ্বর যাকে দুনিয়া থেকে পরলোকে নিয়ে গেলেন। তাকে আবার পৃথিবীতে আনা। এলিস কি বলে জানো? বলে, আমরা নাকি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কাজ করছি।’
রাউল হো হো হাসল। বলল, ‘ঈশ্বর মানুষকে জ্ঞান দিয়েছে তা কাজে লাগানোর জন্য। তুমি যে প্রেতচক্রে বসছ, এর দ্বারা জ্ঞানের একটা নতুন দিগন্ত খোলা হচ্ছে আর এতে অবদান রয়েছে তোমার। আত্মত্যাগের মাধ্যম দিয়েই জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।’
সিমন বুঝলো কোনভাবেই রাউলকে কোনোভাবে তার মনের অবস্থার কথা বোঝাতে পারবে না। যেহেতু সে কথা দিয়েছে, আজই শেষ চক্র। যতো কষ্টই হোক না কেন চক্রে সে বসবে। অসহায়ের মতো যেন হাল ছেড়ে দিলো সে।
রাউল দেখলো সিমনের আগের উত্তেজনা অনেকটাই কেটে গেছে। তার ভিতর একটা ধীরস্থির ভাব চলে এসেছে। এটাকে রাউল নিজের বিজয় হিসেবে গ্রহণ করে মনে মনে উৎফুল্ল হলো। মাদাম একস-এর চলে আসার সময় হয়েছে। গভীর হতাশায় প্রেতচক্রে বসার প্রস্তুতি নিতে সিমন ভেতরের কক্ষে চলে গেল।
রাউল বসবার ঘরের দরজা খুলে চলে এল পাশের হলঘরে। ছোট হলঘরটা পার হয়ে এবার সে চলে এল পাশের আরেকখানা ঘরে। এই ঘরটার একপ্রান্তে আছে একটা ছোট কুঠুরি। সেই কুঠুরির মধ্যে রয়েছে একখানা বড় হাতলওয়ালা ইজিচেয়ার। কালো ভেলভেটের পর্দাগুলো এমনভাবে সাজানো যে ইচ্ছে করলে যে কোনও মুহূর্তে এই ঘরখানাকে ঢেকে ফেলে দেওয়া যায়। বৃদ্ধা পরিচারিকা এলিস ঘরটাকে সাজাচ্ছিল। কুঠুরির সামনে দুখানা চেয়ার, একখানা গোল টেবিল। আর সেই টেবিলের ওপর রয়েছে একটা খঞ্জনি, একটা শিঙে, কয়েকখানা কাগজ আর পেন্সিল। রাউলকে দেখে এলিস বলল, ‘মঁশিয়ে, এই কিন্তু শেষ প্রেতচক্র। আজকের ব্যাপারটা ভালয় ভালয় মিটে গেলে রক্ষা পাই।’
এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠল তীক্ষ্ণ স্বরে এলিসকে উদ্দেশ্য করে রাউল বলল, ‘যাও তো এলিস, দেখো গিয়ে কেউ এসেছেন। মনে হয় মাদাম একসই এসেছেন। যদি উনি হন, ভেতরে নিয়ে এস।’ ‘ঐ মহিলা তো গীর্জায় গিয়ে সন্তানের আত্মার মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করলেই পারেন। এখানে কেন যে মরতে আসে।’ গজগজ করতে করতে এলিস দরোজার দিকে চলে গেল।
একটু পরেই এলিস ফিরে এল। সঙ্গে একজন ভারিক্কী চেহারার মহিলা। ইনিই সেই ধনাঢ্য মাদাম একস। ভদ্রমাহিলা একটা সোফায় বসতে বলে সিমনকে খবর দিতে ভেতরে চলে গেল এলিস।
রাউল এগিয়ে গেল মাদাম একসের সঙ্গে করমর্দন করার জন্য। বিশাল ভারী চেহারা ভদ্রমহিলার। যেমন লম্বা তেমনি মোটা। হ্যান্ডশেক করার সময় সে টের পেল. সিমন ঠিকই বলেছে। হাত দুখানা সত্যিই পুরষালি। চামড়া রুক্ষè ও খসখসে। প্যারিসে অভিজাত পরিবারের নারীদের মতোই পরনেকালো পোশাক। মহিলার কন্ঠস্বরও অত্যন্ত গম্ভীর।
‘আমার বোধহয় আসতে একটু দেরি হয়ে গেল’, গমগমে গলায় বললেন মাদাম একস।
‘হ্যাঁ, দেরি একটু হয়েছে।’ হাসিমুখে বলল রাউল। ‘তবে বেশি নয়। মাত্র কয়েক মিনিট ’।
মাদাম একস জানতে চাইলেস, ‘মাদাম সিমন কোথায়?’
‘মাদাম সিমোনের শরীরটা সুস্থ নয়। তিনি শুয়ে আছেন’।
খপ করে রাউলের হাতটা চেপে ধরলে মাদাম এক। গম্ভীর অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও তাই বুঝি? তা মাদাম সিমনআজ চক্রে বসতে পারবেন তো?’
দ্রুত উত্তর দিল রাউল, ‘নিশ্চয়ই বসবেন’।
মহিলা ঘোত করে আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। মাথার কালো আবরণটার বাঁধন খুলতে খুলতে একখানা চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। নিচু গলায় বললেন, ‘মঁশিয়ে রাউল, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না এরকম প্রেতচক্র আমার মনে কত আনন্দের সৃষ্টি করে। আমি অবাক হয়ে যাই। আমার একমাত্র সন্তান এমিলি! সে আজ আর আমার কাছে নেই! কিন্তু মাদাম সিমন চক্রে বসলে আমি আমার ছোট্ট বাচ্চাটাকে দেখতে পাই। তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। হয়ত সম্ভব হলে আমি তাকে স্পর্শও করতে পারি।’
‘সাবধান’, আঁতকে ওঠে রাউল। ‘মাদাম একস, ভুলেও এধরনের চিন্তা করবেন না। ভুলেও আপনি তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না।সাঙ্ঘাতিক বিপদ হতে পারে।’
‘আমার বিপদ হবে?’ জানতে চাইলে একস।
‘না মাদাম, বিপদের সম্ভাবনা মিডিয়মের।’ রাউল বলে, ‘প্রেত চক্রে বিদেহী আত্মার দেহধারণের সময় যা ঘটে থাকে, বিজ্ঞান তার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছে। খুঁটিনাটি বা জটিলতার মধ্যে না গিয়ে আমি আপনাকে সহজভাবে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। আপনি কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন।’
‘বলুন। আমি শুনছি।’
‘কোনও বিদেহী আত্মা যদি স্থুলদেহ ধারণ করতে চায় তবে মিডিয়মের দেহ থেকে তাকে দেহধারণের উপাদান গ্রহণ করতে হয়। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, প্রেতচক্র চলাকালীন মিডিয়মের মুখ থেকে সূক্ষ্ম ধোঁয়ার মতো বাষ্প বের হয়। এই বাষ্পই ধীরেধীরে ঘনীভূত হয়ে প্রেতাত্মার নিখুঁত দেহের সৃষ্টি করে। মিডিয়মের দেহ থেকে যে সূক্ষ্ম বাষ্প বেরিয়ে আসে, তাকে বলে এক্টোপাজম। যাঁরা প্রেততত্ব নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা বলেন যে এই এক্টোপাজম মিডিয়মেরই দেহের অতিসূক্ষ বস্তুকণা। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ওজনের সাহায্যে এ জিনিসটা প্রমাণ করা যাবে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও বিপদের সম্ভাবনা আছে। কারণ দেহধারী প্রেতাত্মাকে স্পর্শ করলেই মিডিয়মের দেহে অসহ্য যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। রূপধারী প্রেতাত্মাকে স্পর্শ করলে মিডিয়মের ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে। এমনকি এক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটাও বিচিত্র নয়।’
রাউলের কথাগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনছিলেন মাদাম একস। ‘বুঝতেই পারছেন, মিডিয়মের গুরুত্ব কোথায়।’ রাউল বলে যায় ‘মিডিয়মের সাহায্য ছাড়া বিদেহী আত্মা দেহধারণ করতে পারে না। মিডিয়ম হলো ইহলোক আর পরলোকের মধ্যে সংযোগের সেতু। যে কোনও লোক মিডিয়ম হতে পারে না। কারণ সবার মধ্যে মিডিয়ম হবার দুর্লভ গুণগুলো থাকে না। দু একজনের মধ্যেই এ দুর্লভ ক্ষমতার স্ফুরণ হয়।’
‘আশ্চর্য! কি আশ্চর্য’, বলে উঠলেন মাদাম একস। ‘ আচ্ছা মঁশিয়ে রাউল, ‘এমন দিন কি আসবে না যখন এই দেহধারণের ব্যাপারটা উন্নতির এমন স্তর পৌঁছবে যে দেহধারী আত্মা মিডিয়মের দেহ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারবে?’
‘এ হওয়ার নয়, মাদাম’, চমকে ওঠলো রাউল, ‘এটা তো ঈশ্বরের তৈরি করা নিয়ম ভাঙার পরিকল্পনা। এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। এই বিশ^ সংসার একটা সূতোয় বাঁধা ঘুড়ির মতো। সুতোর এক জায়গায় কেটে দিলে ঘুড়ি আর নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।
‘আমি আজকের কথা বলছি না, আজেকের দিনটাই তো শেষ কথা নয়।’ গমগম কণ্ঠে মাদাম একস ‘আজকে যা অসম্ভব, আগামী দিনে তাই-ই সম্ভব হয়ে উঠতে পারে। তাই না?’
ঘরে ঢুকল সিমন। ক্লান্ত এবং বিবর্ণ লাগছে। মনের ভেতর ঝড় বয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে। তবুও শেষপর্যন্ত সে যে অনেকটা সামলে উঠেছে, বেশ বোঝা যায়। এগিয়ে এসে মাদাম একসের সঙ্গে করমর্দন করল। এই হাত মেলাবার সময় ও যে শিউরে উঠল, তা নজর এড়াল না রাউলের। মাদাম একস বললেন, ‘শুনে দুঃখিত হলাম যে আপনার শরীর ভাল নেই’।
ফ্যাকাশে হাসি হাসলো সিমন, ‘ওটা নিয়ে আপনি ভাববেন না”, ।
‘আজকে কাজ করতে পারবেন তো?’ জিজ্ঞেস করলেন মাদাম একস। ‘মানে, চক্রে বসতে পারবেন তো?’
‘নিশ্চয়ই পারব’, সিমন রুক্ষ্ম কণ্ঠে জবাব দিলো। ওর গলা শুনে রাউল তো বটেই, মাদাম একস পর্যন্ত চমকে উঠলেন।
‘যে জন্য এসেছেন, সে কাজটা ঠিকমতো করা নিয়েই তো কথা।’ বললো সিমন, ‘কার শরীর ভালো। কার শরীর খারাপ। ওসব নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে।’
সিমন আর দেরি করলো না। ঢুকে পড়ল ছোট কুঠুরিটার মধ্যে। বললো, ‘আর দেরি করে লাভ কি, শুরু করা যাক তাহলে’।
বড় হাতলওয়ালা ইজিচেয়ারটায় সে। রাউলের ভেতর আচমকা আলোড়ন তৈরি হলো। আতঙ্ক ভর করেছে তার ভেতর। ‘সিমন বাদ দাও। আজকে তোমার শরীরটা ভাল নেই, সিমন। আজ প্রেতচক্র বন্ধ থাক। আশা করি, মাদাম একস কিছু মনে করবেন না।’
‘এ কেমন কথা মঁশিয়ে!’ ক্রুদ্ধস্বরে মাদাম একস বললেন।
‘ঠিকই বলছি আমি’। দৃঢ়তার সঙ্গে বলল রাউল, ‘শরীর খারাপ হতেই পারে কারো। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রেতচক্রে না বসাই ভাল’।
‘মঁশিয়ে, এতে কথার বরখেলাপ হবে।’ মাদাম একসের কন্ঠ থেকে একইসঙ্গে ঝরে পড়ল ক্রোধ আর ঘৃণা। ‘মাদাম সিমন কথা দিয়েছিলেন যে, আজ আমার জন্য শেষবারের মতো উনি চক্রে বসবেন।’
‘সরি মাদাম, আমি কথা দিয়েছি। সেই কথার খেলাপ হবে না।’ ঠান্ডা গলায় বলল সিমন।
‘গুড, এই তো একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের মতো কথা বলেছেন’ আশ^স্ত হলেন মাদাম একস।
রাউলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ধীর কন্ঠে সিমন বলল, ‘রাউল এখন আর পিছিয়ে আসা যাবে না। আমাকে তো আগে অভয় দিয়েছো, এখন তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? ভয় পেয়ো না। আমি তো শেষবারের মতো প্রেতচক্রে বসছি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! এই শেষবারের মতো আমার কষ্ট পাওয়া। আর কখনো এই কষ্ট সহ্য করতে হবে না। এই শেষ, এবারই শেষ।’
ঘরের কালো পর্দাটা সিমোনের ইঙ্গিতে টেনে দিল রাউল। তারপর জানলার পর্দাগুলো টেনে দিতেই আধো আলো আধো ছায়ার পরিবেশ সৃষ্টি হলো ছোট কুঠুরিখানার মধ্যে। মাদাম একসকে একখানা চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করে রাউল অন্য চেয়ারখানায় বসল। ‘আমায় মাপ করবেন মঁশিয়ে’। ইতস্তত করে মাদাম একস বললেন, ‘আমি আপনার বা মাদাম সিমোনের সততাকে অবিশ্বাস করছি না। জানি আপনারা দুজনেই অত্যন্ত সৎ। আর এই প্রেতচক্রের মধ্যেও কোনও জালিয়াতি নেই। কিন্তু তবুও আমি নিঃসন্দেহ হবার জন্য এই জিনিসটা সঙ্গে করে এনেছি।।
নিজের হাত ব্যাগ থেকে নাইলনের একটা সরু অথচ শক্ত দড়ি বের করলেন বিশাল দেহী ভদ্রমহিলা। ‘মাদাম একস!’ রাউল চিৎকার করে উঠল, ‘আপনি তো অপমান করছেন। এটা অপমান, ভীষণ অপমান!’
অদ্ভুত ঠান্ডা গলায় মাদাম একস বললেন, ‘মঁশিয়ে এ হলো নিছক সাবধানতা। একজন ক্লায়েন্ট হিসেব নিশ্চয়ই আমার সাবধনতা অবলম্বনের অধিকার আছে।
‘আপনি আমাদের দুজনকেই অপমান করছেন’, উত্তেজতভাবে বলল রাউল। ” ‘এ হলো অপমান… মারাত্মক অপমান।’
‘মঁশিয়ে রাউল, আপনার আপত্তির কারণ তো আমি বুঝতে পারছি না,’ বিদ্রুপের সুরে মাদাম একস বললেন, ‘তাহলে কি ধরে নেব, আপনারা অসাধু। আপনাদের চক্রে যদি কোনও জালিয়াতি না থাকে তাহলে আপত্তি করছেন কেন? আপনাদের মধ্যে যদি কোনও ছলনা না থাকে তবে ভয় পাওয়ার তো কারণ নেই।
রাউলের মুখ ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গেল। মাদাম একসের দিকে তাকিয়ে অবজ্ঞার হাসি হেসে বলল, ‘আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন মাদাম একস, এ ব্যাপারে আমাদের কারোরই ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। প্রশ্নই নেই ভয় পাওয়ার। বেশ তো, যদি আমার হাত পা দড়ি দিয়ে বাঁধলে খুশি হন, তো বাঁধুন।’
এভাবে কথা বলার পর মাদাম একস শান্ত হবেন, ভেবেছিল রাউল। তার ভাবনাটা যে একেবারেই ভুল তা বোঝা গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
‘ধন্যবাদ মঁশিয়ে’, মাদাম একসের কষ্ঠ অদ্ভুত সুরেলা হয়ে ওঠলো। তারপর দড়িটা হাতে নিয়ে হাতে এগিয়ে গেলেন রাউলের দিকে।
‘না, না রাউল’, পর্দার পেছন থেকে সিমনের তীব্র তীক্ষè কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘মাদাম একসের এই অপমানকর প্রস্তাব কিছুতেই রাজি হয়ো না।’
‘আপনাদের জালিয়াতি ধরা পড়ে যাবে, এই ভয় পাচ্ছেন নাকি? মাদাম একসের মুখ ব্যঙ্গের হাসি।
রাউল চিৎকার করে উঠে বলল, ‘সিমন, এই মহিলা ভাবছেন আমরা তাঁকে ঠকাতে যাচ্ছি। আমরা জালিয়াত – জোচ্চোর।’ কান্নার শব্দ শুনলো রাউল। সিমন কাঁদছে।
গম্ভীর কন্ঠে মাদাম একস বললেন, আমাকে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হতে হবে।
মাদাম একস রাউল হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধলেন।
‘বাঁধার কাজে আপনি খুব ওস্তাদ’, বিদ্রুপ করে বলল রাউল। ‘ কেমন, এবার খুশি হয়েছেন তো?’
মাদাম একসের মুখে রহস্যময় হাসি। তিনি কোনও উত্তরই দিলেন না। ঘরের দেয়ালগুলি ভাল করে পরীক্ষা করলেন। হলঘরে যাবার দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা নিজের কাছে রাখলেন। তারপর এসে বসলেন চেয়ারে। এবার ভয়ংকর অদ্ভূত কণ্ঠে আদেশের ভঙ্গিতে বললেন, ‘প্রেতচক্র শুরু হোক’।
নিরবে কেটে গেল কিছুটা সময়। পর্দার পেছনের কুঠুরিতে সিমোনের নিশ্বাস প্রশ^াসের শব্দ ক্রমেই ভারী হয়ে উঠতে লাগল। একসময় সে শব্দ প্রবল হয়ে উঠল। তারপর সে শব্দ থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধ। এরপর শোনা গেলে অবর্ণনীয় চাপা আর্তনাদ।
খানিকক্ষণে পরেই পাখির ডানার শব্দ, ঘোড়ার খুড়ের আওয়াজ। আবার কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধতা জগত-সংসারের নয়। কবরের সঙ্গেই শুধু এর তুলনা চলে।
আচমকা ঘরের ভেতর ঝুমঝুমি বেজে ওঠলো। এরপর স্রোতের শব্দ। হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা টকটকে লাল গোলাপটা লাফ দিয়ে শূণ্যে ভাসলো। কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি যেন ফুলটা ছিড়ে পাপড়িগুলো সারাঘরে ছিটিয়ে দিল। পাপড়ির রঙ পাল্টে কালো হয়ে গেছে। খনখন গলায় অন্যভুবনের অশরীরী কিছু পৃথিবীকে অবজ্ঞা করে খনে খনে গলায় হেসে ওঠলো। ঘরের তাপমাত্রা নেমে এলো শূন্যের কাছাকাছি।
সরাত করের কুঠুরির ভারী পর্দাটা সরে গেল। মিডিয়ম সিমন এরই মধ্যে চেতনা হারিয়েছে। চেয়ার থেকে তার দেহটা কয়েক ইঞ্চি উপরে ভাসছে। তার মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর। কেঁপে ওঠলো হাতপা বেধে রাখ রাউল, শিউরে ওঠে জোরে শ^াস টানলেন মাদাম একস।
মিডিয়ম সিমনের মুখ বেরিয়ে আসছে হালকা কুয়াশা। একটা সরু সাদা ফিতের মতো কুয়াশা বের হয়ে এসে ক্রমশ ঘণ হতো থাকলো। কুয়াশা ধীরে ধীরে রঙ পাল্টাচ্ছে। রূপান্তরিত হয়েছে বস্তুকণায়। কণাগুলোর মধ্যে একটা আলোড়ন উঠেছে। জমাট বাঁধছে কণাগুলো। একটি আকৃতি নিচ্ছে , ছোট একটা শিশুর আকৃতি। একটা বাচ্চা মেয়ের আকৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
মাদাম একস আবেগে কেঁপে ওঠলেন।
‘আমার মেয়ে, আমার ছোট্ট এমিলি, আমার বাচ্চা। ওই তো তাকে দেখতে পাচ্ছি আমার সামনে।’ তার ফিসফিসানো সাপের কন্ঠ প্রতিধ্বনি তুলছে।
সামনের আকৃতিটা ক্রমশই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাউল সেদিকে। এমন নিখুঁত দেহধারণ এর আগে কখনো হয়নি। ঠিক যেন রক্তমাংসে গড়া একটি জীবন্ত শিশু।
‘মা, মামণি’, শিশুর কচি কণ্ঠ শোনা গেলো কুঠুরিতে। ‘তুমি কোথায়? তোমাকে আমি দেখি না কেন?
‘ওরে আমার সোনা, আমার এমিলি। এই যে এই যে আমি।’ বলতে বলতে উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন মাদাম একস।
‘মাদাম খুব সাবধান, অত উত্তেজিত হবেন না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।’ রাউল চেঁচিয়ে উঠে সতর্ক করল।
ওদিকে বাচ্চা মেয়েটি মায়ে দিকে দু’খানি ছোট হাত সামনে বাড়িয়ে দিল। এমিলি বলছে, মা তোমাকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না। মা , মামণি আমার…।
‘ওহ এমিলি, আমার মেয়ে। আমার ছোট্ট মা,’ হাত বাড়িয়ে বলে এমিলির দিকে এক পা এগিয়ে গেলেন মাদাম একস। উত্তেজিতভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি।
রাউল ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘এটা কি করছেন মাদাম? বসুন, বসে পড়ুন। নিয়ন্ত্রণ করুন নিজেকে। নইলে মিডিয়মের…’।
মাদাম একসের কানে রাউলে কণ্ঠ পৌছালো বলে মনে হলো না। তিনি বিলাপের মতো বলছেন, ‘ওরে আমার এমিলি রে। আমার একমাত্র সন্তান। এমিলি ছাড়া আমার আর কেউ নাই। আমি ওকে একটু ধরবো। আমি ওকে একটু কোলে নেব।
আরও এক পা সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন মাদাম একস। ‘আল্লাহর কসম লাগে, আপনি থামুন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। চেয়ারে বসে পড়–ন। নয়তো, খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে।’
ভীষণ ভয় কাঁপছে রাউল। হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। বাঁধনমুক্তির চেষ্টা করে দেখলো নাইলনের দড়ি চামড়ার ভেতরে দেবে যাচ্ছে। কয়েক জায়গা থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাতে। কিন্তু হায়, বৃথা সব চেষ্টা
‘আমার বাচ্চা! আমি ওকে ধরবই। আমি ওকে কোলে নেবই। কেউ আমায় ঠেকাতে পারবে না।’ ‘নাহ, আপনি এটা করতে পারেন না। মিডিয়মের কথাটা আপনি ভুলে যাচ্ছেন। আপনাকে আমি বলছি, আপনি বসে পড়ুন। আর একটি পা-ও এগোবেন না। দয়া করে বসে পড়ুন। বসে পড়ুন দয়া করে। দয়া করে তার দিকটা ভাবুন।’
মাদাম একসের চোখে মুখে অদ্ভুত আনন্দ আর উন্মাদনা। রাউলের কথা শোনার মতো অবস্থায় তিনি নেই। ছোট্টা বাচ্চাটা মায়ের বাড়ানো হাতকে উপেক্ষা করতে পারছে না। কুঠুরি থেকে এমিলি দুই কদম সামনে এসে দাঁড়ালো।
অপার্থিব শিশুটির দিকে এগিয়ে গেল মাদাম একস। হাত বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করলেন।
দূরে কোথাও গর্জে ওঠলো বাজ। ঘরের পাশে কেঁদে ওঠলো শকুন ছানা। মিডিয়ম সিমনের মুখ থেকে বেরিয়ে এল এক তীব্র আর্তনাদ। অসহ্য যন্ত্রণায় যেন তির তির করে মিডিয়ম।
‘হায় ঈশ্বর! এসব কি হচ্ছে। সহ্য করা যায় না, মিডিয়মের যন্ত্রণা.. রক্ষা করো প্রভু। সিমনকে রক্ষা করো।’ প্রার্থনা ছাড়া তার এখন আর কিচ্ছু করার নাই।
খনখনে গলায় হেসে ওঠলেন মাদাম একস, দানবীতে রূপন্তারিত হয়েছেন তিনি। বললেন, ‘মঁশিয়ে রাউল, আপনার মিডিয়মের জন্য আমার একটুও মাথাব্যথা নেই। আমি কেবল আমার হারানো মেয়েকে ফিরে পেতে চাই। মৃতের রাজ্য থেকে আমার এমিলি সোনা আবার ফিরে এসেছে আমারই কাছে। ও তো মরে যায়নি… ও বেঁচে আছে। আমার সোনা আমার কোলে আয়।
চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করেও রাউল পারলো না। সীমাহীন আতঙ্কে ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে একটি শব্দও বেরোলনা তার । মাদাম একস যেন এখন সেই আদিম যুগের সেই ভয়ঙ্কর দানবী। সভ্যতার সব রীতিনীতি পায়ে দলে মেতে ওঠেছেন নিজেকে। নিজের অন্ধ আবেগেই মত্ত তিনি। বাইরে তখন ঝড় ওঠেছে। দমকা হাওয়া শো শো মধ্যে পরলোক থেকে ওঠা আসা শিশু এমিলির কচিকণ্ঠ শোনা গেল, মা, মামণি!”
‘ও আমার সোনাও আমার মণি.. কে বলে তুই মরে গেছিস!.আয়, আমার কোলে আয়…’।
উন্মাদের মা আলিঙ্গনে জড়িয়ে জীবনের অন্যপাড়ে চলে যাওয়া আদরের শিশুটিকে। দমকা হওয়া একযোগে আছড়ে পড়ে কার্ডনেটের সতেরো নম্বর বাড়ির চতুর্থ তালার এ ঘরটিতে। ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি। কালো কুঠুরি থেকে ভেসে আসে একসঙ্গে কয়েকশ জন্তুর গোঙানির আওয়াজ।
মাদাম একস কোলে তুলে নিলেন শিশুটিকে। সঙ্গে সঙ্গে পর্দার ওপাশ থেকে ভেসে আসে রক্তহীম করা অসহ্য যন্ত্রণার এক তীব্র আর্তনাদ।
ঘোর লাগা দৃষ্টিতে রাউল দেখলো, কুয়াশা গড়া শিশুটিকে কোলে নিয়ে মাদাম একস বন্য হাতির মতো দ্রুত চলে গেলেন তার পাশ দিয়ে। তালা খুলবার শব্দ শোনা গেল। এরপর সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।নিচে নেমে গেলেন মাদাম একস।
বাইরের ঝড়বাদল থেমে গেছে। কালো কুঠুরি থেকে তখনও ভেসে আসা আর্তনাদ একটু একটু করে ভোতা হচ্ছে। একটু পরেই আর্তনাদ রুপান্তরিত হলো বিভৎস ঘড়ঘড় শব্দে। একসময় ধপাস করে পতনের শব্দ হলো। তারপর সব চুপ, একদম নিস্তব্ধ নিশ্চুপ।
উন্মাদের মতো রাউল তার বেঁধে রাখা হাতপা খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নাইলনের দড়ি চামড়া বসে যাচ্ছে, রক্ত ঝড়ছে। কোনো কিছুই ভ্রুক্ষেপ করছে না। উন্মত্ত প্রচেষ্টার কাছে একসময় হার মানলো মাদাম একসের কঠিন বাঁধন। বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো রাউল। এলিস ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকে চিৎকার করে উঠল, ‘মাদাম! মাদাম!
রাউলের গলা চিরে একবার শুধু বেরিয়ে এলো তার হবু স্ত্রীর নাম, ‘সিমন’।
কালোপর্দাটা একটানে সরিয়ে কুঠুরি ঢুকতে গিয়েও রাউল থমকে দাঁড়ালো। বৃদ্ধা পরিচারিকাও তার পাশে এসে দাঁঁড়িয়েছে। উদভ্রান্তের মতো এলিস বলে ওঠলো, ‘হা ঈশ্বর! রক্ত, এত রক্ত! পুরো কুঠুরি যে রক্তে ভিজে লালে লা হয়ে গেছে।’
রাউল স্তম্ভিত, নির্বাক। ফরাসী বৃদ্ধাটা চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, আমি জানতাম এরকম অশুভ একটা কিছু ঘটতে চলেছে। সেটা আজই ঘটলো, আর শেষ পর্যন্ত আমার মাদামকে প্রাণ দিতে হলো।
এখনও নীরব রাউল। পাথরের মুর্তি হয়ে গেছে। লাল রক্তে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ছোট্ট নিথর দেহটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।এতোক্ষণে মাদামের প্রাণহীন দেহটা এলিসের নজরে এলো। অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠ থেকে। রাউলকে ধাক্কা দিয়ে সে বললো, ‘মঁশিয়ে, এসব কি দেখছি? কিভাবে কি হলো! মাদাম এতটুকু হয়ে গেলেন কি করে? তাঁর দেহটা যে অর্ধেকেরও বেশি ছোট হয়ে গেছে। এ কি করে হল? বলুন, মঁশিয়ে.. আপনাকে বলতেই হবে।’
এলিসের ধাক্কায় সম্বিত ফিরে পেল রাউল। এবার হাও মাও কেঁদে ফেললো সে।
‘জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না।’ রাউলের কণ্ঠে বিলাপ, হে ঈশ^র, এ আমি কি করলাম। পরলোকের শিশুটিকে জগতে ডেকে আনতে বলে সিমনকেই মৃত্যুর দেশে পাঠিয়ে দিলাম। এলিস কিভাবে কি হলো, আমার কাছে জানতে চেয়ো না কিছু। কিচ্ছু জানি না আমি। খালি জানি, সিমন নেই।’…
`ওহ, আমার সিমন’! সূএ: পূর্বপশ্চিম ডটকম