পেনশন যেন টেনশন না হয়

ছবি : সংগৃহীত

 

প্রভাষ আমিন :এখন যেমন বিসিএস মানেই সোনার হরিণ, একসময় তেমনটা ছিল না। তবে সরকারি চাকরির একটা আলাদা কদর সব সময়ই ছিল। সরকারি চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন, হারানোও কঠিন। একবার সরকারি চাকরি হয়ে যাওয়া মানে আজীবন নিশ্চিন্ত। নিয়মিত বেতন পাওয়া যাবে, বছর বছর ইনক্রিমেন্ট হবে, বেতন বাড়বে, মহার্ঘভাতা মিলবে, টিএ/ডিএ পাওয়া যাবে, কোয়ার্টার পাওয়া যাবে, রেশন মিলবে, বড় পদে গেলে গাড়ি মিলবে, নির্ধারিত ছুটি পাওয়া যাবে; তার চেয়ে বড় কথা হলো চাকরি জীবন শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির মোটা অঙ্কের টাকা তো পাওয়া যাবেই, পাওয়া যাবে আজীবন পেনশন সুবিধাও। বেসরকারি চাকরিতে তুলনামূলকভাবে বেতন বেশি ছিল। কিন্তু চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। বসের মেজাজ খারাপ থাকলে ঝাড়ি খেতে হবে, বস পছন্দ না করলে ইনক্রিমেন্ট কম হবে, এমনকি চাকরিও চলে যেতে পারে। বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেই পেনশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে তাও নেই। অধিকাংশ বেসরকারি চাকরিজীবীকে অবসরে যেতে হয় একেবারে শূন্য হাতে। তবু অনেকে সারা জীবনের নিশ্চিন্তের সরকারি চাকরির চেয়ে তাৎক্ষণিক বাড়তি বেতনের বেসরকারি বা করপোরেট চাকরিই পছন্দ করতেন। কিন্তু দফায় দফায় বাড়তে বাড়তে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ছুঁয়ে ফেলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড়িয়েও যায়। এখন অবস্থা এমন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনও বেশি, সুযোগসুবিধাও বেশি, আজীবন পেনশনের সুবিধাও আছে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন এখন সরকারি চাকরিজীবীদের সমান, কিন্তু পেনশনের কোনো ব্যবস্থাই নেই। তবে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমেনি। উপরি আয়ের সুযোগ, ক্ষমতা সব মিলে সরকারি চাকরি হয়ে যায় সবার আরাধ্য। বিশেষ করে বিসিএস মানেই যেন সোনার হরিণ। বিয়ের বাজারে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের পেছনে ফেলে বিসিএস ক্যাডাররা শীর্ষস্থান দখল করেছেন অনেক আগেই। বিসিএসে কাস্টমসে সুযোগ পাওয়া এক তরুণ নাকি বন্ধুদের বলেছেন, তার লক্ষ্য চাকরি জীবন শেষে তার কাছে ৩০০ কোটি টাকা থাকবে। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির গল্পই এখন ডাল-ভাত। তাই হবু কাস্টমস কর্মকর্তার ৩০০ কোটি টাকার স্বপ্ন আর অবাস্তব মনে হয় না।

 

মাত্র ১৬ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর জীবন নিশ্চিন্ত, নির্ভার হলেও কোটি কোটি বেসরকারি চাকরিজীবী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশাজীবীর জীবন অনিশ্চয়তায় ঠাসা। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় প্রবল বৈষম্য। সে বৈষম্য ঘোচানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী যখন প্রথম সর্বজনীন পেনশনের কথা বলেছিলেন, আমি ভেবেছিলাম কথার কথা। নির্বাচন সামনে রেখেই হয়তো এই রাজনৈতিক স্টান্টবাজির আওয়াজ। ধারণা হিসেবে চমৎকার সন্দেহ নেই। আমার ধারণা ছিল, এই চমৎকার ও উচ্চাভিলাষী ধারণাটি বাস্তবায়িত হতে অনেক সময় লাগবে। এমনিতে আমি খুব আশাবাদী মানুষ। তার পরও আমার ধারণা ছিল সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা হয়তো একসময় চালু হবে, কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও আমার একই শঙ্কা ছিল। ১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা প্রবল গণ আন্দোলনের মাঠের কর্মী ছিলাম। কিন্তু সরকারের বিরূপ আচরণে এই বিচার বাংলার মাটিতে দেখে যেতে পারব, এমন আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা আমার সেই শঙ্কা ভেঙে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্ক ও গ্লানি মুক্ত করেছেন। শেখ হাসিনা আবারও আমাকে ভুল প্রমাণিত করলেন। উচ্চাভিলাষী মনে হলেও সবার জন্য পেনশনব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে বাংলাদেশে। এটা এক বিস্ময়কর অগ্রগতি। আমার বিবেচনায় আওয়ামী লীগ সরকারের যত উন্নয়ন কর্মকান্ড তার সবার শীর্ষে থাকবে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনা হবে বেশি। কিন্তু উপকারভোগীর সম্ভাব্য সংখ্যা বিবেচনায় এর চেয়ে বড় জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি আর কিছুই নেই। দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন। ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ, ২০৪১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৩ কোটি ১০ লাখে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দিতেই সর্বজনীন পেনশনের ভাবনা। আগে থেকে চলমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সঙ্গে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বড় পার্থক্য হলো, পেনশন কর্মসূচিতে সবার অংশগ্রহণ থাকবে। তাই এটা হবে সম্মানজনক এবং সবাই এটাকে নিজেদের কর্মসূচি মনে করবে। চলমান সামাজিক নিরাপত্তা এক ধরনের সাহায্য, আরও খারাপ করে বললে ভিক্ষা। আর সর্বজনীন পেনশন স্কিম বয়সী মানুষের মর্যাদার জীবন নিশ্চিত করবে। সত্যিকারের কল্যাণ রাষ্ট্র হওয়ার পথে বড় এক অগ্রগতি সর্বজনীন পেনশন স্কিম।

 

এমনিতে বাংলাদেশে পারিবারিক মূল্যবোধ ও বন্ধন অনেক দৃঢ়। সবাই মনে করেন, তিনি কষ্ট করে উপার্জন করবেন, সন্তান বড় করবেন। শেষ বয়সে সন্তানই তাদের দেখভাল করবেন। এটাই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। যৌথ পরিবারের ধারণাও ভেঙে যাচ্ছে আজকাল। ব্যস্ত সন্তান শেষ বয়সে বাবা-মাকে দেখার সময় বের করতে পারেন না। অনেক সন্তানের সামর্থ্য থাকে না। অনেক সন্তান দেশের বাইরে চলে যান। ফলে সারা জীবন কষ্ট করা বাবা-মাকেও শেষ বয়সে বিপাকে পড়তে হয়। সারা জীবন সচ্ছল জীবনযাপন করা মানুষটিও শেষ বয়সে অসহায় হয়ে পড়েন। তার চেয়ে বড় কথা হলো, সন্তান যত ভালো বা যত সামর্থ্যবানই হোক, শেষ বয়সেও নিজের উপার্জিত অর্থে চলার সক্ষমতা যে-কাউকে পরিবারে আরও বেশি মর্যাদাবান করবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম তাই সব বয়সের মানুষের মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার বড় ভরসা হতে পারে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে প্রাথমিকভাবে চারটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিতদের জন্য সুরক্ষা এবং বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার নিচে এমন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘সমতা’। সমতায় মাসিক চাঁদা ১ হাজার টাকা, যার অর্ধেক দেবে সরকার। অন্য প্যাকেজে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেওয়ার সুযোগ থাকছে। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত যে-কেউ এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। ৬০ বছর বয়স হওয়ার পর থেকে তিনি আজীবন পেনশন পাবেন। আর মারা গেলেই নমিনি তার ৭৫ বছর হওয়া পর্যন্ত পেনশন পাবেন। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় ৫০ পেরোনো ব্যক্তিরাও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। তবে তাকে অন্তত ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে। কেউ যদি ১৮ বছরে অন্তর্ভুক্ত হন, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ৪২ বছর চাঁদা দিতে পারবেন। ‘প্রবাস’ স্কিমে কেউ যদি সর্বোচ্চ ৪২ বছর ১০ হাজার করে চাঁদা দেন, তাহলে মেয়াদ শেষে তিনি প্রতি মাসে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা করে পাবেন। প্রগতি বা সুরক্ষায় কেউ সর্বোচ্চ ৪২ বছর ৫ হাজার টাকা করে চাঁদা দিলে মেয়াদ শেষে তিনি প্রতি মাসে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পাবেন। অফার লোভনীয় সন্দেহ নেই। প্রকল্পটি উচ্চাভিলাষী মনে হলেও এটা সরকারের জন্য বোঝা তো নয়ই, বরং আয়ের বড় সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে। কারণ আজ থেকে চালু হলেও সরকারকে কমপক্ষে ১০ বছর, সর্বোচ্চ ৪২ বছর পর টাকা শোধ শুরু হবে। আর সবাইকে একসঙ্গে টাকা ফেরত দিতে হবে না। তার মানে আগামী ১০ বছর সরকার শুধু টাকা পাবে, কিন্তু এক টাকাও ফেরত দিতে হবে না। আগামী ১০ বছরে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে যদি সরকার লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করে তাহলে কইয়ের তেলে কই ভাজার পরও বাড়তি তেল থেকে যাবে। তা ছাড়া ‘প্রবাস’ প্যাকেজে প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দেবেন। কিন্তু মেয়াদ শেষে ফেরত পাবেন টাকায়। তাই এ স্কিম সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও উৎস হতে পারে। তা ছাড়া সফলভাবে এ স্কিম চালু করতে পারলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় কমে আসবে। তবে চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়ে আছে। তাই এখন দই দেখলেও ভয় পাই, সন্দেহ করি। বাংলাদেশের আর্থিক খাতে এত অনিয়ম দেখে কেউ কেউ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের তহবিল নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই সংগৃহীত অর্থের সঠিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো লুটপাট, অনিয়ম যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে। আমার এক সহকর্মী বললেন, বাংলাদেশে সারা জীবন সরকারি চাকরি করে পেনশন পেতেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, আগের দিন পাশের টেবিলের সহকর্মীও পরদিন ঘুষ ছাড়া ফাইলে হাত দেন না। সেখানে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ৪২ বছর চাঁদা দেওয়ার পর পেনশন পেতে কয় বছর ঘুরতে হবে? এটা একটা বড় প্রশ্ন বটে। সরকার বদল হলে এ স্কিমের কী হবে, তা নিয়েও চিন্তা আছে কারও কারও।

 

সব শঙ্কা দূর করতে হলে সরকারকে পুরো প্রকল্পটি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। সুরক্ষিত আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আস্থা অর্জন করতে পারলে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহী হতে পারে। আর বিপুলসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণই এর টেকসই ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেবে। কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা অনিয়ম যেন মহৎ এ উদ্যোগ ম্লান করে না দেয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম যেন মানুষের ভরসার জায়গা হয়, ভোগান্তির নয়। পেনশন যেন কারও টেনশনের কারণ না হয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।  সূএ : বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» রেলের ভাড়া বাড়ানো অযৌক্তিক ও অমানবিক : গোলাম মোহাম্মদ কাদের

» ছয় দিন ধরে ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস

» রাজউকের প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে নতুন বিধিমালা

» ফিলিস্তিনি প্রতি বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

» যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে আমরা দায়মুক্ত হয়েছি : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

» পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতায় হয়রানি হলে সহায়তা দেবে তথ্য মন্ত্রণালয়

» নকল স্যালাইন উৎপাদনকারী একটি চক্রের ৩ সদস্য গ্রেফতার

» ভোটারবিহীন নির্বাচনে আনন্দ নেই, সৌন্দর্য্য নেই: ইসি রাশেদা

» আমি ব্রেকআপ করলাম: সুহানা খান

» লড়াইয়ের সর্বশেষ প্রস্তুতি নিন, নেতাকর্মীদের রিজভী

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

পেনশন যেন টেনশন না হয়

ছবি : সংগৃহীত

 

প্রভাষ আমিন :এখন যেমন বিসিএস মানেই সোনার হরিণ, একসময় তেমনটা ছিল না। তবে সরকারি চাকরির একটা আলাদা কদর সব সময়ই ছিল। সরকারি চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন, হারানোও কঠিন। একবার সরকারি চাকরি হয়ে যাওয়া মানে আজীবন নিশ্চিন্ত। নিয়মিত বেতন পাওয়া যাবে, বছর বছর ইনক্রিমেন্ট হবে, বেতন বাড়বে, মহার্ঘভাতা মিলবে, টিএ/ডিএ পাওয়া যাবে, কোয়ার্টার পাওয়া যাবে, রেশন মিলবে, বড় পদে গেলে গাড়ি মিলবে, নির্ধারিত ছুটি পাওয়া যাবে; তার চেয়ে বড় কথা হলো চাকরি জীবন শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির মোটা অঙ্কের টাকা তো পাওয়া যাবেই, পাওয়া যাবে আজীবন পেনশন সুবিধাও। বেসরকারি চাকরিতে তুলনামূলকভাবে বেতন বেশি ছিল। কিন্তু চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। বসের মেজাজ খারাপ থাকলে ঝাড়ি খেতে হবে, বস পছন্দ না করলে ইনক্রিমেন্ট কম হবে, এমনকি চাকরিও চলে যেতে পারে। বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেই পেনশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে তাও নেই। অধিকাংশ বেসরকারি চাকরিজীবীকে অবসরে যেতে হয় একেবারে শূন্য হাতে। তবু অনেকে সারা জীবনের নিশ্চিন্তের সরকারি চাকরির চেয়ে তাৎক্ষণিক বাড়তি বেতনের বেসরকারি বা করপোরেট চাকরিই পছন্দ করতেন। কিন্তু দফায় দফায় বাড়তে বাড়তে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ছুঁয়ে ফেলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড়িয়েও যায়। এখন অবস্থা এমন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনও বেশি, সুযোগসুবিধাও বেশি, আজীবন পেনশনের সুবিধাও আছে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন এখন সরকারি চাকরিজীবীদের সমান, কিন্তু পেনশনের কোনো ব্যবস্থাই নেই। তবে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমেনি। উপরি আয়ের সুযোগ, ক্ষমতা সব মিলে সরকারি চাকরি হয়ে যায় সবার আরাধ্য। বিশেষ করে বিসিএস মানেই যেন সোনার হরিণ। বিয়ের বাজারে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের পেছনে ফেলে বিসিএস ক্যাডাররা শীর্ষস্থান দখল করেছেন অনেক আগেই। বিসিএসে কাস্টমসে সুযোগ পাওয়া এক তরুণ নাকি বন্ধুদের বলেছেন, তার লক্ষ্য চাকরি জীবন শেষে তার কাছে ৩০০ কোটি টাকা থাকবে। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির গল্পই এখন ডাল-ভাত। তাই হবু কাস্টমস কর্মকর্তার ৩০০ কোটি টাকার স্বপ্ন আর অবাস্তব মনে হয় না।

 

মাত্র ১৬ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর জীবন নিশ্চিন্ত, নির্ভার হলেও কোটি কোটি বেসরকারি চাকরিজীবী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশাজীবীর জীবন অনিশ্চয়তায় ঠাসা। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় প্রবল বৈষম্য। সে বৈষম্য ঘোচানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী যখন প্রথম সর্বজনীন পেনশনের কথা বলেছিলেন, আমি ভেবেছিলাম কথার কথা। নির্বাচন সামনে রেখেই হয়তো এই রাজনৈতিক স্টান্টবাজির আওয়াজ। ধারণা হিসেবে চমৎকার সন্দেহ নেই। আমার ধারণা ছিল, এই চমৎকার ও উচ্চাভিলাষী ধারণাটি বাস্তবায়িত হতে অনেক সময় লাগবে। এমনিতে আমি খুব আশাবাদী মানুষ। তার পরও আমার ধারণা ছিল সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা হয়তো একসময় চালু হবে, কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারব না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও আমার একই শঙ্কা ছিল। ১৯৯২ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা প্রবল গণ আন্দোলনের মাঠের কর্মী ছিলাম। কিন্তু সরকারের বিরূপ আচরণে এই বিচার বাংলার মাটিতে দেখে যেতে পারব, এমন আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা আমার সেই শঙ্কা ভেঙে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্ক ও গ্লানি মুক্ত করেছেন। শেখ হাসিনা আবারও আমাকে ভুল প্রমাণিত করলেন। উচ্চাভিলাষী মনে হলেও সবার জন্য পেনশনব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে বাংলাদেশে। এটা এক বিস্ময়কর অগ্রগতি। আমার বিবেচনায় আওয়ামী লীগ সরকারের যত উন্নয়ন কর্মকান্ড তার সবার শীর্ষে থাকবে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনা হবে বেশি। কিন্তু উপকারভোগীর সম্ভাব্য সংখ্যা বিবেচনায় এর চেয়ে বড় জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি আর কিছুই নেই। দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন। ২০২০ সালে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ, ২০৪১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৩ কোটি ১০ লাখে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দিতেই সর্বজনীন পেনশনের ভাবনা। আগে থেকে চলমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সঙ্গে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বড় পার্থক্য হলো, পেনশন কর্মসূচিতে সবার অংশগ্রহণ থাকবে। তাই এটা হবে সম্মানজনক এবং সবাই এটাকে নিজেদের কর্মসূচি মনে করবে। চলমান সামাজিক নিরাপত্তা এক ধরনের সাহায্য, আরও খারাপ করে বললে ভিক্ষা। আর সর্বজনীন পেনশন স্কিম বয়সী মানুষের মর্যাদার জীবন নিশ্চিত করবে। সত্যিকারের কল্যাণ রাষ্ট্র হওয়ার পথে বড় এক অগ্রগতি সর্বজনীন পেনশন স্কিম।

 

এমনিতে বাংলাদেশে পারিবারিক মূল্যবোধ ও বন্ধন অনেক দৃঢ়। সবাই মনে করেন, তিনি কষ্ট করে উপার্জন করবেন, সন্তান বড় করবেন। শেষ বয়সে সন্তানই তাদের দেখভাল করবেন। এটাই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। যৌথ পরিবারের ধারণাও ভেঙে যাচ্ছে আজকাল। ব্যস্ত সন্তান শেষ বয়সে বাবা-মাকে দেখার সময় বের করতে পারেন না। অনেক সন্তানের সামর্থ্য থাকে না। অনেক সন্তান দেশের বাইরে চলে যান। ফলে সারা জীবন কষ্ট করা বাবা-মাকেও শেষ বয়সে বিপাকে পড়তে হয়। সারা জীবন সচ্ছল জীবনযাপন করা মানুষটিও শেষ বয়সে অসহায় হয়ে পড়েন। তার চেয়ে বড় কথা হলো, সন্তান যত ভালো বা যত সামর্থ্যবানই হোক, শেষ বয়সেও নিজের উপার্জিত অর্থে চলার সক্ষমতা যে-কাউকে পরিবারে আরও বেশি মর্যাদাবান করবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম তাই সব বয়সের মানুষের মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার বড় ভরসা হতে পারে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে প্রাথমিকভাবে চারটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিতদের জন্য সুরক্ষা এবং বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার নিচে এমন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘সমতা’। সমতায় মাসিক চাঁদা ১ হাজার টাকা, যার অর্ধেক দেবে সরকার। অন্য প্যাকেজে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেওয়ার সুযোগ থাকছে। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত যে-কেউ এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। ৬০ বছর বয়স হওয়ার পর থেকে তিনি আজীবন পেনশন পাবেন। আর মারা গেলেই নমিনি তার ৭৫ বছর হওয়া পর্যন্ত পেনশন পাবেন। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় ৫০ পেরোনো ব্যক্তিরাও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। তবে তাকে অন্তত ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে। কেউ যদি ১৮ বছরে অন্তর্ভুক্ত হন, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ৪২ বছর চাঁদা দিতে পারবেন। ‘প্রবাস’ স্কিমে কেউ যদি সর্বোচ্চ ৪২ বছর ১০ হাজার করে চাঁদা দেন, তাহলে মেয়াদ শেষে তিনি প্রতি মাসে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা করে পাবেন। প্রগতি বা সুরক্ষায় কেউ সর্বোচ্চ ৪২ বছর ৫ হাজার টাকা করে চাঁদা দিলে মেয়াদ শেষে তিনি প্রতি মাসে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পাবেন। অফার লোভনীয় সন্দেহ নেই। প্রকল্পটি উচ্চাভিলাষী মনে হলেও এটা সরকারের জন্য বোঝা তো নয়ই, বরং আয়ের বড় সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে। কারণ আজ থেকে চালু হলেও সরকারকে কমপক্ষে ১০ বছর, সর্বোচ্চ ৪২ বছর পর টাকা শোধ শুরু হবে। আর সবাইকে একসঙ্গে টাকা ফেরত দিতে হবে না। তার মানে আগামী ১০ বছর সরকার শুধু টাকা পাবে, কিন্তু এক টাকাও ফেরত দিতে হবে না। আগামী ১০ বছরে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে যদি সরকার লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করে তাহলে কইয়ের তেলে কই ভাজার পরও বাড়তি তেল থেকে যাবে। তা ছাড়া ‘প্রবাস’ প্যাকেজে প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দেবেন। কিন্তু মেয়াদ শেষে ফেরত পাবেন টাকায়। তাই এ স্কিম সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও উৎস হতে পারে। তা ছাড়া সফলভাবে এ স্কিম চালু করতে পারলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় কমে আসবে। তবে চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়ে আছে। তাই এখন দই দেখলেও ভয় পাই, সন্দেহ করি। বাংলাদেশের আর্থিক খাতে এত অনিয়ম দেখে কেউ কেউ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের তহবিল নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাই সংগৃহীত অর্থের সঠিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো লুটপাট, অনিয়ম যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে। আমার এক সহকর্মী বললেন, বাংলাদেশে সারা জীবন সরকারি চাকরি করে পেনশন পেতেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, আগের দিন পাশের টেবিলের সহকর্মীও পরদিন ঘুষ ছাড়া ফাইলে হাত দেন না। সেখানে বেসরকারি চাকরিজীবীদের ৪২ বছর চাঁদা দেওয়ার পর পেনশন পেতে কয় বছর ঘুরতে হবে? এটা একটা বড় প্রশ্ন বটে। সরকার বদল হলে এ স্কিমের কী হবে, তা নিয়েও চিন্তা আছে কারও কারও।

 

সব শঙ্কা দূর করতে হলে সরকারকে পুরো প্রকল্পটি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। সুরক্ষিত আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আস্থা অর্জন করতে পারলে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহী হতে পারে। আর বিপুলসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণই এর টেকসই ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেবে। কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা অনিয়ম যেন মহৎ এ উদ্যোগ ম্লান করে না দেয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম যেন মানুষের ভরসার জায়গা হয়, ভোগান্তির নয়। পেনশন যেন কারও টেনশনের কারণ না হয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।  সূএ : বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com