কিয়েভে রক্তক্ষয়ী লড়াই

রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণের তৃতীয় দিনে ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকায় রুশ বাহিনীকে বাধা দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের সেনারা। রাজধানী কিয়েভ ঘিরে চলছে রক্তক্ষয়ী লড়াই। দুই পক্ষেই কয়েকশ সেনা নিহত হওয়ার দাবি করা হয়েছে। ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবর্ষণের মুখে দেশটির বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মাটির নিচের বাঙ্কার ও ভূগর্ভস্থ মেট্রো স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ইউক্রেন ত্যাগ করেছে দেড় লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিক।

 

আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাগুলোর খবর অনুসারে, গত শনিবার স্থানীয় সময় ভোরে ইউক্রেনের রাজধানীর অনেক বাসিন্দাই যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট কিয়েভের আবাসিক ভবনে আঘাত হানে। সিএনএন জানিয়েছে, ভিডিও ও বিভিন্ন ছবিতে ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ১০ তলারও ওপরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন দেখা গেছে, বাইরের দেয়ালগুলো পুরোপুরি ধসে গেছে। তবে ওই ভবনে হামলার কারণ ও হতাহতের বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক করে ফেসবুকে বলে, আমাদের শহরের রাস্তাগুলোতে লড়াই চলছে। শহরের বাসিন্দাদের শান্ত থাকার, ঘরের ভিতরে লুকিয়ে থাকার ও আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিমান হামলার সাইরেন শুনতে পেলে দ্রুত নিকটবর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়ার পরামর্শও দেয় ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, কিয়েভের ওপর গোলা হামলার শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে শহরের কেন্দ্র থেকে কয়েক মাইল দূর পর্যন্ত শব্দ পেয়েছেন তারা। কিয়েভ ইন্ডিপেনডেন্ট বলছে, শহরের চিড়িয়াখানার কাছে এবং শুলিয়াভকা শহরের আশেপাশে ৫০টিরও বেশি বিস্ফোরণ এবং ভারী মেশিনগানে গোলাগুলি হয়েছে। ফক্স নিউজের সংবাদদাতা ট্রে ইংস্ট বলেছেন, কিয়েভ একাধিক দিক থেকে আক্রমণের শিকার হয়েছে। ইউক্রেনীয় স্টেট স্পেশাল সার্ভিসের মতে, রাজধানীর ট্রয়েসচিনা এলাকার সিএইচপি-৬ পাওয়ার স্টেশনের কাছে তীব্র লড়াই চলছে। এ হামলার মাধ্যমে পুরো শহরটিকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে। কিয়েভের পেরেমোহি এভিনিউতে গাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ভাসিলকিভের একটি বিমান ঘাঁটির কাছে তীব্র লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ান প্যারাট্রুপাররা কিয়েভের ওপর হামলা চালানোর জন্য এই ঘাঁটিকে তাদের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করবে।

 

এর আগে, গতকাল ভোররাত ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত কিয়েভে ও এর আশপাশে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ভোরের আগে গুলির শব্দ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সবকিছু শান্ত ছিল। ভোররাতে যে শব্দগুলো শোনা গেছে তার মধ্যে একটি রুশ ট্যাঙ্ক ধ্বংস হওয়ার শব্দও ছিল বলে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী দাবি করেছে। শনিবার সকালে কিয়েভ থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ভাসিলকিভ শহরের মেয়র জানান, শহরটিতে তীব্র লড়াইয়ের পর ইউক্রেনীয় পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিক্টর লিয়াশকোর জানিয়েছেন, রাশিয়ার হামলার কারণে তিন শিশুসহ মোট ১৯৮ জন ইউক্রেনীয় নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১১৫ জন, যাদের মধ্যে ৩৩ জন শিশু।

 

গতকালও ইউক্রেনের রিজার্ভ সেনা ও বেসামরিকদের মধ্যে হাজার হাজার অস্ত্র বিরতণ করা হয়েছে। টেলিভিশনে মলোটোভ ককটেল বানানোর প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হচ্ছে। দেশটির পার্লামেন্ট সদস্যরাও জানিয়েছেন, তারা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে বন্দুক তুলে নিয়ে গুলি ছোড়ার অভ্যাস করছেন।

 

শুক্রবার রাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তার প্রশাসনের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে কিয়েভের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেশ রক্ষার প্রত্যয় জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখানে আমরা সবাই আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করছি। পরে সেনাদের পোশাক পরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের যুদ্ধের ময়দানে ঘোরাফেরার করার ছবিও দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। জেলেনস্কির এই ভিডিও এবং ছবি এসেছে তার দেশ ছেড়ে পালানোর গুজবের পর।

 

দুই দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর কিয়েভের বহু বাসিন্দা শহরটি ছেড়ে পালিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছেন। বৃহস্পতিবার রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই বাসিন্দারা শহর ছাড়তে শুরু করেন। পোল্যান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রায় ১ লাখ ইউক্রেনীয় পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন।  জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুযায়ী শুধু পোল্যান্ড নয়, মলদোভাসহ অন্যান্য রাষ্ট্র দিয়েও ইউক্রেন ত্যাগ করছেন নাগরিকরা।

 

এদিকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে রুশ সংবাদমাধ্যম ইন্টারফ্যাক্স ও স্পুটনিক জানিয়েছে, রুশ সেনারা ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপোরিঝিঝিয়ায় মেলিটোপল শহর দখল করেছে। মেলিটোপল হলো ইউক্রেনের মূল বন্দর মারিউপোলের কাছে একটি মাঝারি আকারের শহর। যেখানে অন্তত দেড় লাখ মানুষ বাস করেন। অন্যদিকে, ইউক্রেন সেনাবাহিনীর একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা গেছে, তাদের সেনারা রুশ হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। কিয়েভের একটি সেনা ইউনিট শহরের প্রধান সিটি এভিনিউ থেকে রাশিয়ান বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে বলে  দিয়েছে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর দাবি, তারা কৃষ্ণ সাগরের শহর মাইকোলাইভে থেকে রাশিয়ানদের সফলভাবে সরিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কিয়েভে সেনা ঘাঁটিতে হামলা ঠেকিয়েছে।

 

রুশ সেনাবাহী উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার দাবি ইউক্রেনের : কিয়েভের কাছে রুশ সেনাবাহী একটি উড়োজাহাজ গুলি করে ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ইউক্রেনের এসইউ-২৭ যুদ্ধবিমান শনিবার স্থানীয় সময় ০০:৩০ দিকে (জিএমটি ২২:৩০) রাশিয়ার সেনা বহনকারী আইএল-৭৬ এমডি আটকে দিয়েছে। রুশ উড়োজাহাজটি তখন কিয়েভ অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামানোর চেষ্টা করছিল। উড়োজাহাজটির উৎপাদনকারীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ওই উড়োজাহাজে ১৬৭ জনের বেশি সেনা এবং ছয় থেকে সাতজন ক্রু ছিলেন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ দাবির সত্যতা বিবিসি যাচাই করতে পারেনি। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

 

রাষ্ট্রকে রক্ষা করার অঙ্গীকার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের : ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি টুইটারে নিজের একটি সেলফি ভিডিও পোস্ট করে বলেছেন, ‘অনলাইনে প্রচুর মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে যে, আমি আমাদের সেনাবাহিনীকে অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি এবং সেখান থেকে তাদের সরিয়ে নিচ্ছি। আমি এখানে আছি। আমরা আমাদের অস্ত্র রাখব না। আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে রক্ষা করব।’ জেলেনস্কিকে ইউক্রেন থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ওয়াশিংটন প্রস্তাব করলেও সেটা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো খবর প্রকাশ করেছে। জেলেনস্কি এর জবাবে বলেছেন, ‘এখানে লড়াই চলছে। আমার গোলাবারুদ দরকার, কোথাও সরে যাওয়ার নয়। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের সশস্ত্র বাহিনী বিষয়ক মন্ত্রী জেমস হেপি বলেছেন, যুক্তরাজ্য এবং আরও ২৫টি দেশ ইউক্রেনকে মানবিক সহায়তা ও অস্ত্র সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।

 

রুশ সেনাদের ব্যারাকে ফেরার আহ্বান জাতিসংঘ মহাসচিবের : জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রুশ সেনাদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শান্তিকে আরেকটি সুযোগ দেওয়া উচিত। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পরপরই তিনি এ মন্তব্য করেন। এ বৈঠকেই ইউক্রেনে আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে একটি খসড়া প্রস্তাবে ভেটো দেয় রাশিয়া। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতার কারণে এই খসড়া প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। নিরাপত্তা পরিষদের ১১ সদস্য দেশ ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। চীন, ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ভোটদান থেকে বিরত থাকে।

নিষেধাজ্ঞার প্রতিশোধে বিদেশিদের তহবিল বাজেয়াপ্ত করবে রাশিয়া : রাশিয়ায় থাকা বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তহবিল বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছে মস্কো। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও তার ঘনিষ্ঠদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা আরোপের একদিনের মাথায় এ ঘোষণা এলো। শনিবার রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ রুশ সরকারের নতুন এ সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাকে উদ্ধৃত করে রুশ সংবাদমাধ্যম আরআইএ জানিয়েছে, রাশিয়ায় বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তহবিল জব্দ করে রুশ নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ জব্দের জবাব দেবে মস্কো। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য ‘অবান্ধব অঞ্চলে’ নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর সম্পদের জাতীয়করণের বিষয়টি নাকচ করছে না মস্কো।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বন্দনা করা ছাড়া জাপার কোনো রাজনীতি নেই: ফিরোজ রশিদ

» বাংলাদেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে অথচ বিরোধী দল দেখে না: কাদের

» থাই পিএমও-তে প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা

» দ্রুতগামী ট্রাকের ধাক্কায় অজ্ঞাত বৃদ্ধার মৃত্যু

» আজকের খেলা

» অধিকার আদায়ে শেরে বাংলার অবদান কখনোই ভুলবার নয়: ফখরুল

» বিশেষ অভিযান চালিয়ে মাদকবিরোধী অভিযানে বিক্রি ও সেবনের অপরাধে ৩৯ জন গ্রেপ্তার

» সরবরাহ থাকলেও কমছে না সবজির দাম, অস্বস্তি মাছ-মাংসের বাজারে

» ভারী বৃষ্টিপাতের পর তানজানিয়ায় বন্যা-ভূমিধস, নিহত অন্তত ১৫৫

» ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুরু

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

কিয়েভে রক্তক্ষয়ী লড়াই

রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণের তৃতীয় দিনে ইউক্রেনের বিভিন্ন এলাকায় রুশ বাহিনীকে বাধা দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের সেনারা। রাজধানী কিয়েভ ঘিরে চলছে রক্তক্ষয়ী লড়াই। দুই পক্ষেই কয়েকশ সেনা নিহত হওয়ার দাবি করা হয়েছে। ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবর্ষণের মুখে দেশটির বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মাটির নিচের বাঙ্কার ও ভূগর্ভস্থ মেট্রো স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ইউক্রেন ত্যাগ করেছে দেড় লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিক।

 

আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাগুলোর খবর অনুসারে, গত শনিবার স্থানীয় সময় ভোরে ইউক্রেনের রাজধানীর অনেক বাসিন্দাই যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট কিয়েভের আবাসিক ভবনে আঘাত হানে। সিএনএন জানিয়েছে, ভিডিও ও বিভিন্ন ছবিতে ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ১০ তলারও ওপরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন দেখা গেছে, বাইরের দেয়ালগুলো পুরোপুরি ধসে গেছে। তবে ওই ভবনে হামলার কারণ ও হতাহতের বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক করে ফেসবুকে বলে, আমাদের শহরের রাস্তাগুলোতে লড়াই চলছে। শহরের বাসিন্দাদের শান্ত থাকার, ঘরের ভিতরে লুকিয়ে থাকার ও আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিমান হামলার সাইরেন শুনতে পেলে দ্রুত নিকটবর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যাওয়ার পরামর্শও দেয় ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

 

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, কিয়েভের ওপর গোলা হামলার শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে শহরের কেন্দ্র থেকে কয়েক মাইল দূর পর্যন্ত শব্দ পেয়েছেন তারা। কিয়েভ ইন্ডিপেনডেন্ট বলছে, শহরের চিড়িয়াখানার কাছে এবং শুলিয়াভকা শহরের আশেপাশে ৫০টিরও বেশি বিস্ফোরণ এবং ভারী মেশিনগানে গোলাগুলি হয়েছে। ফক্স নিউজের সংবাদদাতা ট্রে ইংস্ট বলেছেন, কিয়েভ একাধিক দিক থেকে আক্রমণের শিকার হয়েছে। ইউক্রেনীয় স্টেট স্পেশাল সার্ভিসের মতে, রাজধানীর ট্রয়েসচিনা এলাকার সিএইচপি-৬ পাওয়ার স্টেশনের কাছে তীব্র লড়াই চলছে। এ হামলার মাধ্যমে পুরো শহরটিকে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে। কিয়েভের পেরেমোহি এভিনিউতে গাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ভাসিলকিভের একটি বিমান ঘাঁটির কাছে তীব্র লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ান প্যারাট্রুপাররা কিয়েভের ওপর হামলা চালানোর জন্য এই ঘাঁটিকে তাদের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করবে।

 

এর আগে, গতকাল ভোররাত ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত কিয়েভে ও এর আশপাশে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ভোরের আগে গুলির শব্দ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সবকিছু শান্ত ছিল। ভোররাতে যে শব্দগুলো শোনা গেছে তার মধ্যে একটি রুশ ট্যাঙ্ক ধ্বংস হওয়ার শব্দও ছিল বলে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী দাবি করেছে। শনিবার সকালে কিয়েভ থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ভাসিলকিভ শহরের মেয়র জানান, শহরটিতে তীব্র লড়াইয়ের পর ইউক্রেনীয় পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিক্টর লিয়াশকোর জানিয়েছেন, রাশিয়ার হামলার কারণে তিন শিশুসহ মোট ১৯৮ জন ইউক্রেনীয় নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১১৫ জন, যাদের মধ্যে ৩৩ জন শিশু।

 

গতকালও ইউক্রেনের রিজার্ভ সেনা ও বেসামরিকদের মধ্যে হাজার হাজার অস্ত্র বিরতণ করা হয়েছে। টেলিভিশনে মলোটোভ ককটেল বানানোর প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হচ্ছে। দেশটির পার্লামেন্ট সদস্যরাও জানিয়েছেন, তারা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে বন্দুক তুলে নিয়ে গুলি ছোড়ার অভ্যাস করছেন।

 

শুক্রবার রাতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তার প্রশাসনের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের নিয়ে কিয়েভের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেশ রক্ষার প্রত্যয় জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এখানে আমরা সবাই আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করছি। পরে সেনাদের পোশাক পরে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের যুদ্ধের ময়দানে ঘোরাফেরার করার ছবিও দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। জেলেনস্কির এই ভিডিও এবং ছবি এসেছে তার দেশ ছেড়ে পালানোর গুজবের পর।

 

দুই দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর কিয়েভের বহু বাসিন্দা শহরটি ছেড়ে পালিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছেন। বৃহস্পতিবার রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই বাসিন্দারা শহর ছাড়তে শুরু করেন। পোল্যান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রায় ১ লাখ ইউক্রেনীয় পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন।  জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুযায়ী শুধু পোল্যান্ড নয়, মলদোভাসহ অন্যান্য রাষ্ট্র দিয়েও ইউক্রেন ত্যাগ করছেন নাগরিকরা।

 

এদিকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে রুশ সংবাদমাধ্যম ইন্টারফ্যাক্স ও স্পুটনিক জানিয়েছে, রুশ সেনারা ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপোরিঝিঝিয়ায় মেলিটোপল শহর দখল করেছে। মেলিটোপল হলো ইউক্রেনের মূল বন্দর মারিউপোলের কাছে একটি মাঝারি আকারের শহর। যেখানে অন্তত দেড় লাখ মানুষ বাস করেন। অন্যদিকে, ইউক্রেন সেনাবাহিনীর একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা গেছে, তাদের সেনারা রুশ হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। কিয়েভের একটি সেনা ইউনিট শহরের প্রধান সিটি এভিনিউ থেকে রাশিয়ান বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে বলে  দিয়েছে। ইউক্রেনীয় বাহিনীর দাবি, তারা কৃষ্ণ সাগরের শহর মাইকোলাইভে থেকে রাশিয়ানদের সফলভাবে সরিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কিয়েভে সেনা ঘাঁটিতে হামলা ঠেকিয়েছে।

 

রুশ সেনাবাহী উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার দাবি ইউক্রেনের : কিয়েভের কাছে রুশ সেনাবাহী একটি উড়োজাহাজ গুলি করে ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ইউক্রেনের এসইউ-২৭ যুদ্ধবিমান শনিবার স্থানীয় সময় ০০:৩০ দিকে (জিএমটি ২২:৩০) রাশিয়ার সেনা বহনকারী আইএল-৭৬ এমডি আটকে দিয়েছে। রুশ উড়োজাহাজটি তখন কিয়েভ অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামানোর চেষ্টা করছিল। উড়োজাহাজটির উৎপাদনকারীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ওই উড়োজাহাজে ১৬৭ জনের বেশি সেনা এবং ছয় থেকে সাতজন ক্রু ছিলেন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ দাবির সত্যতা বিবিসি যাচাই করতে পারেনি। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

 

রাষ্ট্রকে রক্ষা করার অঙ্গীকার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের : ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি টুইটারে নিজের একটি সেলফি ভিডিও পোস্ট করে বলেছেন, ‘অনলাইনে প্রচুর মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে যে, আমি আমাদের সেনাবাহিনীকে অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি এবং সেখান থেকে তাদের সরিয়ে নিচ্ছি। আমি এখানে আছি। আমরা আমাদের অস্ত্র রাখব না। আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে রক্ষা করব।’ জেলেনস্কিকে ইউক্রেন থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ওয়াশিংটন প্রস্তাব করলেও সেটা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো খবর প্রকাশ করেছে। জেলেনস্কি এর জবাবে বলেছেন, ‘এখানে লড়াই চলছে। আমার গোলাবারুদ দরকার, কোথাও সরে যাওয়ার নয়। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের সশস্ত্র বাহিনী বিষয়ক মন্ত্রী জেমস হেপি বলেছেন, যুক্তরাজ্য এবং আরও ২৫টি দেশ ইউক্রেনকে মানবিক সহায়তা ও অস্ত্র সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।

 

রুশ সেনাদের ব্যারাকে ফেরার আহ্বান জাতিসংঘ মহাসচিবের : জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রুশ সেনাদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শান্তিকে আরেকটি সুযোগ দেওয়া উচিত। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পরপরই তিনি এ মন্তব্য করেন। এ বৈঠকেই ইউক্রেনে আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে একটি খসড়া প্রস্তাবে ভেটো দেয় রাশিয়া। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতার কারণে এই খসড়া প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। নিরাপত্তা পরিষদের ১১ সদস্য দেশ ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। চীন, ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ভোটদান থেকে বিরত থাকে।

নিষেধাজ্ঞার প্রতিশোধে বিদেশিদের তহবিল বাজেয়াপ্ত করবে রাশিয়া : রাশিয়ায় থাকা বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তহবিল বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছে মস্কো। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও তার ঘনিষ্ঠদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা আরোপের একদিনের মাথায় এ ঘোষণা এলো। শনিবার রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ রুশ সরকারের নতুন এ সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তাকে উদ্ধৃত করে রুশ সংবাদমাধ্যম আরআইএ জানিয়েছে, রাশিয়ায় বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তহবিল জব্দ করে রুশ নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ জব্দের জবাব দেবে মস্কো। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য ‘অবান্ধব অঞ্চলে’ নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর সম্পদের জাতীয়করণের বিষয়টি নাকচ করছে না মস্কো।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com