আইনমন্ত্রীর সঙ্গে উপদেষ্টার ফোনালাপ ফাঁস করল কে?

সৈয়দ বোরহান কবীর: তাঁরা দুজনই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, অন্যজন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এ দুই বিশিষ্ট এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একটি ফোনালাপ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ৩ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের এ ফোনালাপে গোপন কিছু নেই, ভয়ংকর কোনো তথ্যও নেই। আইনমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, একটি ইনোসেন্ট ফোনালাপকে অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সাংবাদিকতায় বলা হয় অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। ফোনালাপ নিয়ে যেভাবে মিথ্যাচার ও মনগড়া অপপ্রচারের ঝুলি সাজানো হয়েছে তা বিস্ময়কর। আমি এ ফোনালাপটি কয়েকবার শুনেছি। আমার মনে হয় না এ আলাপে মহাগুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাঁস হয়েছে। দুজনের ব্যক্তিগত নীরস, নিরীহ আলাপ। এ ফোনালাপে রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর, জনগুরুত্বসম্পন্ন, রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো গোপন তথ্যও নেই। তাই এ ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদে কিছু হাসিল করা যাবে না, তা নিশ্চিত। এটা দিয়ে সাময়িকভাবে কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে। যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে নিরন্তর অপপ্রচারে লিপ্ত তাঁরা কিছুটা আত্মপ্রসাদ লাভ করবেন। তবে এ ফোনালাপ ফাঁস রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার এক ভয়ংকর দিক উন্মোচন করেছে। এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো ঘটনা। সরকারের এ রকম দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতা কারা রেকর্ড করল? ফোনালাপ রেকর্ড সম্পর্কে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা যে তথ্য দিলেন তার সারমর্ম এ রকম- মোটামুটি চার ধরনের ঘটনা এ ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। প্রথমত, ফোনালাপটি একেবারে বানোয়াট হতে পারে। এখন ‘ভয়েস ক্লোনিং’ সফটওয়্যার পাড়ায় মহল্লায় পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে যে কারও কণ্ঠস্বর হুবহু, অবিকল নকল করা যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতারক চক্র এ ভয়েস ক্লোনিং ব্যবহার করে অপকর্ম করছে। এ রকম খবর দেশের গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত হয়। কিছুদিন আগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদও ডয়েচে ভেলেতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভয়েস ক্লোনিং প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের দণ্ডিত লন্ডনে পলাতক এক ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথন ফাঁস হওয়া প্রসঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধান ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তির কথা বলেন। জেনারেল আজিজ সরাসরি বলেন, তিনি ওইরকম আলাপচারিতা করেননি। তাঁর কণ্ঠস্বর প্রযুক্তির মাধ্যমে নকল করা হয়েছে। ওই দণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে ফোনালাপের যে অডিওটি ফাঁস হয়েছে তা তাঁর নয়। আইনমন্ত্রী ও উপদেষ্টার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তা নয়। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান দুজনের কেউই ফোনালাপটি তাঁদের নয় এমন দাবি করেননি। কাজেই ফাঁস হওয়া ফোনালাপটি যে ‘ভয়েস ক্লোনিং’ নয় তা সন্দেহাতীত। দ্বিতীয় যে ঘটনা ঘটতে পারে তা হলো, আলাপকারী দুই পক্ষের মধ্যে যে কোনো এক পক্ষ সহজেই ফোনালাপ রেকর্ড করতে পারে। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা এখন ব্যাপকভাবে ঘটছে। প্রতিপক্ষকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য ফোন করে তা রেকর্ড করার এক কুৎসিত সংস্কৃতি এখন চালু হয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যাপকের সঙ্গে একজন অভিভাবকের টেলিআলাপ ফাঁস হয়েছিল কিছুদিন আগে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছুদিন হইচই হলো। পরে জানা গেল অধ্যক্ষকে ফাঁসানোর জন্য অন্য প্রান্তের মানুষটি আলাপচারিতা রেকর্ড করেছিলেন। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে এমপি নিক্সন চৌধুরীর আলাপ রেকর্ড করেছিলেন দুই পক্ষের একজন। বরখাস্ত হওয়া গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে ফাঁসানোর জন্য তাঁকে ফোন করে তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করেছিলেন তাঁর দলেরই এক কর্মী। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর এ নোংরা খেলা এখন সারা দেশে ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এটি ক্রমে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেদিন আইনমন্ত্রী বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রাষ্ট্রের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লিখিত অনুমতি ছাড়া ফোনে আড়ি পাততে পারে না। বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন আছে। এ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সংস্থাও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ফোনে আড়ি পাততে পারে না। তাহলে যে যেমন খুশি ফোন রেকর্ড করছে তার প্রতিকার কী? আইনমন্ত্রী বিবিসি বাংলাকে বললেন, এ রকম অভিযোগ কম আসে। কম আসুক বেশি আসুক তা বড় বিষয় নয়। একজন আরেকজনকে ফাঁসানোর জন্য যে ফোন রেকর্ড করেন তা অন্যায় বা শাস্তিযোগ্য অপরাধ কি না অবিলম্বে স্পষ্ট হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে এখনই সরকারের পদক্ষেপ জরুরি। না হলে কদিন পর ছেলে বাবাকে ফোন করে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করবে এবং তা রেকর্ড করবে। প্রেমিক প্রেমিকাকে ফাঁসানোর জন্য (অথবা প্রেমিকা প্রেমিককে) ফোনের একান্ত অন্তরঙ্গ কথাবার্তা রেকর্ড করবে। এভাবে এমন একসময় আসবে যখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করবে না। কেউ কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলতেও ভয় পাবে। আমরা অবশ্য এখন সে রকম সময়ের কাছাকাছি চলে এসেছি। তবে আইনমন্ত্রী ও সালমান এফ রহমানের কথোপকথন এ প্রক্রিয়ায় রেকর্ড এবং ফাঁস হয়নি, তা হলফ করেই বলা যায়। দুজনই সম্মানিত ব্যক্তি। দুজনের মধ্যে কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্বও টেলিআলাপে প্রকাশিত হয়নি। কাজেই তাঁদের দুজনের কেউই অন্যজনের আলাপ রেকর্ড করেননি তা বুঝতে গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই।

 

তৃতীয় যে ঘটনা ঘটতে পারে তা হলো- এ রকম অডিও রেকর্ড করার সক্ষমতা যাঁদের আছে তাঁরা যদি এটি রেকর্ড করেন। মাঝেমধ্যেই ফোনে আড়ি পাতার নানা কাহিনি শুনি। উঁচুতলার লোকজন এখন মোবাইলে সাধারণ কল করেন না বললেই চলে। হোয়াটসআপ, ভাইবার, টেলিগ্রাম, সিগন্যাল ইত্যাদি নানা অ্যাপের মাধ্যমে এখন লোকজন কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কখনো শুনি এটা এখন নিরাপদ নয়, ওটা ব্যবহার কর। সরকার মুখে যা-ই বলুক, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ফোনে আড়ি পাতা হয়। বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে আলাপ সাম্প্রতিক সময়ে ফাঁস হয়েছে। বিএনপি নেত্রী নিপুণ রায়চৌধুরী এক কর্মীকে গাড়ি পোড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিএনপির আরেক নেতা আমীর খসরুর সঙ্গে এক কর্মীর নাশকতাবিষয়ক আলাপও ফাঁস হয়ে যায়। হেফাজতের সাবেক নেতা মামুনুলের সঙ্গে তাঁর প্রথম স্ত্রীর কথোপকথনও মুহূর্তে ফাঁস হয়ে গণমাধ্যমে চলে আসে। এসব টেলিআলাপ ফাঁস নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কেউ জিজ্ঞেস করেনি এটা কারা করল। এসব টেলিআলাপ ফাঁসের ঘটনা প্রমাণ করে আড়ি পাতার ব্যবস্থা আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে তা করা যায়। কিন্তু যে দুজনের টেলিআলাপ ফাঁস হয়েছে তাঁরা দুজনই বিশিষ্ট ব্যক্তি। উভয়েই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। যাঁরা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নিপুণ রায়চৌধুরী কিংবা মামুনুল হকের ফোনে আড়ি পেতেছেন, তাঁদের কেউ কি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোনেও আড়ি পাতছেন? সরকারের ভিতরেই কি ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে সরকারের শত্রু, রাষ্ট্রের শত্রু? এরা সরকারকে চাপে ফেলতে, অস্বস্তিতে ফেলতে তৎপর। যে কোনো সময় এদের লুকিয়ে রাখা হিংস্র নখ বেরিয়ে আসবে। এ প্রশ্নগুলো মনের ভিতর এলো সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। মনে হচ্ছে সরকারের ভিতরেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর। তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা শুরু করেছে। বিশেষ করে যখন নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে। কিছুদিন আগে চিত্রনায়িকা পরীমণিকে নিয়ে সারা দেশে হুলুস্থুল হয়ে গেল। এ সময় এক তরুণ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে পরীমণির অন্তরঙ্গ এক ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি ছড়ানো হলো সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেখানে বসে কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধী লাগাতার অপপ্রচার করছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ করা এক ব্যক্তির কাছে ওই ভিডিও ক্লিপটি কে পাঠাল? সে প্রশ্নের কোনো উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি দেখলাম পুলিশ বাহিনী এবং এর প্রধানকে নিয়ে কুৎসিত অপপ্রচার। এ অপপ্রচারের উৎস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আদেশ। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আদেশটিকে ‘অনবধানতাবশত সৃষ্ট ভাষাগত বিভ্রাটপ্রসূত’ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এটি শুধুই ভাষাগত বিভ্রাট নাকি এর পেছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র আছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব এ রকম একটি ভুল বিভ্রান্তিমূলক আদেশ জারি করেন কীভাবে? এটি নিছক ভুল না এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে? কিছুদিন ধরেই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইমেজ নষ্টের পরিকল্পিত কিছু ঘটনা দৃশ্যমান। এসব করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল নষ্টের জন্য। গত বছর ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি আলোচিত হয়। সেখানে একজন সদস্য প্রশ্ন করেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাস কী করেছিল?’ পরপরই জাতিসংঘে র‌্যাবকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে নিষিদ্ধ করার লিখিত দাবি উত্থাপন করে ১২টি মানবাধিকার সংগঠন। এর পরই এলো চাদর-বালিশ কেনার সাজানো নাটক। সব কি তাহলে একই সূত্রে গাঁথা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাঁরা যে পদে আছেন তাঁরা কি পরীক্ষিত? তাঁদের সবাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত? আওয়ামী লীগ সংগঠনেই শুধু অনুপ্রবেশকারী জামায়াত-বিএনপি ঠাঁই নেয়নি। প্রশাসনেও রং বদল করে অনেক জামায়াত-যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগ হয়েছে। তাঁরা যে রাষ্ট্রের গোপন তথ্য বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন না তার গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারে? তাই সরকারের ভিতর থেকে কেউ আইনমন্ত্রী ও উপদেষ্টার টেলিআলাপ ফাঁস করল কি না খতিয়ে দেখা দরকার। আইনমন্ত্রী এ রকম সম্ভাবনার শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। আমি আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে আস্থা রাখতে চাই। বিশ্বাস করতে চাই সরকারের ভিতর থেকে এ কাণ্ডটি ঘটেনি। কিন্তু একটি নির্মোহ তদন্তের মাধ্যমে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ ঘটনাটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বড় প্রশ্ন হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। এ ফোনালাপ ফাঁস প্রমাণ করে সামনে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। 

চতুর্থ যে ঘটনাটি ঘটতে পারে তা হলো বাইরের কেউ আড়ি পাততে পারে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশ থেকে, শত্রুপক্ষ অপপ্রচারকারী, ষড়যন্ত্রকারীরা সহজেই আড়ি পাততে পারে। কিছুদিন ধরে ইসরায়েলের আড়ি পাতা যন্ত্র ‘পেগাসাস স্পাইওয়ার’ নিয়ে সারা বিশে^ তোলপাড় চলছে। বিশে^র বড় বড় সব নেতার ফোনে এ যন্ত্র প্রয়োগ করার কথা ফাঁস হচ্ছে। বিশ্বের কোন কোন দেশ ‘পেগাসাস স্পাইওয়ার’ কিনেছে তা নিয়েও চলছে নানা বিতর্ক। জানা গেছে, বাংলাদেশ এটি কেনেনি। ক্রেতার তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। পেগাসাস এমন এক স্পাইওয়ার যা দিয়ে খুব সহজেই যে কোনো ফোনে আড়ি পাতা যায়। ধরা যাক, আপনার ফোনের যাবতীয় তথ্য, কথোপকথনের ওপর কেউ নজরদারি করতে চাইল। তাকে কিছু করতে হবে না। শুধু আপনার ফোনে একটি মেসেস পাঠালেই হলো। আপনি মেসেজ বা খুদে বার্তাটি দেখলেন। ব্যস, পেগাসাস জীবাণু ঢুকে গেল আপনার ফোনে। আপনার ফোনের সব তথ্য চলে গেল অন্যের হাতে। আপনি বলতেই পারেন আমি সব মেসেজ দেখি না। অপরিচিত মেসেজ তো নয়ই। তাতে কী, আপনাকে ফোন করা হলো, কোনো বিদেশি নম্বর থেকে। বিদেশি নম্বর দেখে আপনি আগ্রহী হয়ে ধরলেন। ব্যস, আপনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার তালা খুলে গেল। এভাবে যে কোনো ব্যক্তির গোপনীয়তার দরজা ভাঙা এখন খুবই সহজ। বাংলাদেশ পেগাসাস না কিনলে কী হবে যাঁরা বিদেশে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, তাঁরা তো পেগাসাস স্পাইওয়ার কিনতেই পারেন। কিংবা অন্য কোনো আড়ি পাতা যন্ত্র, যা দিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সব তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমার এ ধরনের আশঙ্কার পেছনে কারণ আছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে এ রকম আড়ি পাতা যন্ত্র বসানো হয়েছিল হাওয়া ভবনে। তাই এখন এর চেয়েও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হবে না তা কে হলফ করে বলবে। এঁরা যদি লবিস্ট নিয়োগ করে কোটি টাকা খরচ করতে পারেন, যদি তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচারের জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ করতে পারেন তাহলে এ রকম আড়ি পাতা যন্ত্র কিনতে না পারার কোনো কারণ নেই। আমরা জানি লন্ডনে বসে যাঁরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন তাঁদের টাকার অভাব নেই। এ সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য তাঁরা সবকিছু করতে পারেন। আমি লক্ষ্য করছি, এ সরকারের কিছু কিছু ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের আত্মম্ভরিতা ভর করছে। অনেকে অতি আত্মবিশ্বাসী। এক ধরনের উপেক্ষার সংস্কৃতি দানা বেঁধেছে সরকারের মধ্যে। অনেকেই সারাক্ষণ আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। বাংলাদেশকে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাল না, তখন দেখলাম এ ঘটনাকে পাত্তাই দিলেন না কতিপয় করিৎকর্মা মন্ত্রী। বললেন, এটা নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেন নতুন ঢং। আবার অজুহাত দাঁড় করালেন চট করে। গণতন্ত্রে দুর্বল দেশগুলোকেই নাকি এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল, তখন অনেকেই একে পাত্তা না দেওয়ার ভাব করলেন। কি অদ্ভুত। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এক মন্ত্রী বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে। কমিটির বাইরে প্রতিমন্ত্রী বললেন, বাংলাদেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো চাপ নেই। মালয়েশিয়ায় আটক হলেন জেলহত্যার আসামি খায়রুজ্জামান। তাকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে বলা হলো। এখন সংবাদে জানলাম তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যে কোনো ঘটনা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার এ প্রবণতা আত্মঘাতী ও ভয়ংকর। আইনমন্ত্রী এবং উপদেষ্টার ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনাটিও উপেক্ষার জালে বন্দি হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন, এ ঘটনার তদন্ত হবে। রাষ্ট্রের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এ ঘটনার প্রকৃত, সত্যনিষ্ঠ তদন্ত প্রয়োজন। কারণ দেশের বাইরে বসে কেউ যদি এ কাজ করেন তাহলে তা গুরুতর ভাবনার বিষয় বটে। কারণ বাংলাদেশের শত্রুরা দুর্বল নয়। তারা ক্রমে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এ সত্য মেনে নিয়েই প্রস্তুতি নিতে হবে সরকারকে। না হলে অডিও ফাঁসের মেলা বসবে নির্বাচনের আগে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।    সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Email : [email protected]

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসির লালবাগ উপশাখা উদ্বোধন

» পাঁচবিবিতে বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

» বৃষ্টি কামনায় বায়তুল মোকাররমে ইসতিসকার নামাজ আদায়

» মেটার স্মার্ট সানগ্লাসে দিয়ে করা যাবে ভিডিও কল

» গরমে ট্রাফিক পুলিশ কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে?

» জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরু থেকে কেন খেলবেন না, জানালেন সাকিব

» পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলের চালক নিহত

» বাস-ইজিবাইকের মুখোমুখি সংর্ঘষে ইজিবাইক চালক নিহত,আহত ৩

» বিএনপি নেতারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ক্ষমতায় আসতে মরিয়া: কাদের

» শেরে বাংলার মৃত্যুবার্ষিকীতে আ.লীগের কর্মসূচি

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

আইনমন্ত্রীর সঙ্গে উপদেষ্টার ফোনালাপ ফাঁস করল কে?

সৈয়দ বোরহান কবীর: তাঁরা দুজনই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একজন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, অন্যজন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এ দুই বিশিষ্ট এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একটি ফোনালাপ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ৩ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের এ ফোনালাপে গোপন কিছু নেই, ভয়ংকর কোনো তথ্যও নেই। আইনমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, একটি ইনোসেন্ট ফোনালাপকে অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সাংবাদিকতায় বলা হয় অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। ফোনালাপ নিয়ে যেভাবে মিথ্যাচার ও মনগড়া অপপ্রচারের ঝুলি সাজানো হয়েছে তা বিস্ময়কর। আমি এ ফোনালাপটি কয়েকবার শুনেছি। আমার মনে হয় না এ আলাপে মহাগুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাঁস হয়েছে। দুজনের ব্যক্তিগত নীরস, নিরীহ আলাপ। এ ফোনালাপে রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর, জনগুরুত্বসম্পন্ন, রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো গোপন তথ্যও নেই। তাই এ ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদে কিছু হাসিল করা যাবে না, তা নিশ্চিত। এটা দিয়ে সাময়িকভাবে কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে। যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে নিরন্তর অপপ্রচারে লিপ্ত তাঁরা কিছুটা আত্মপ্রসাদ লাভ করবেন। তবে এ ফোনালাপ ফাঁস রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার এক ভয়ংকর দিক উন্মোচন করেছে। এটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো ঘটনা। সরকারের এ রকম দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতা কারা রেকর্ড করল? ফোনালাপ রেকর্ড সম্পর্কে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা যে তথ্য দিলেন তার সারমর্ম এ রকম- মোটামুটি চার ধরনের ঘটনা এ ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। প্রথমত, ফোনালাপটি একেবারে বানোয়াট হতে পারে। এখন ‘ভয়েস ক্লোনিং’ সফটওয়্যার পাড়ায় মহল্লায় পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে যে কারও কণ্ঠস্বর হুবহু, অবিকল নকল করা যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতারক চক্র এ ভয়েস ক্লোনিং ব্যবহার করে অপকর্ম করছে। এ রকম খবর দেশের গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত হয়। কিছুদিন আগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদও ডয়েচে ভেলেতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভয়েস ক্লোনিং প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশের দণ্ডিত লন্ডনে পলাতক এক ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথন ফাঁস হওয়া প্রসঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধান ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তির কথা বলেন। জেনারেল আজিজ সরাসরি বলেন, তিনি ওইরকম আলাপচারিতা করেননি। তাঁর কণ্ঠস্বর প্রযুক্তির মাধ্যমে নকল করা হয়েছে। ওই দণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে ফোনালাপের যে অডিওটি ফাঁস হয়েছে তা তাঁর নয়। আইনমন্ত্রী ও উপদেষ্টার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তা নয়। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান দুজনের কেউই ফোনালাপটি তাঁদের নয় এমন দাবি করেননি। কাজেই ফাঁস হওয়া ফোনালাপটি যে ‘ভয়েস ক্লোনিং’ নয় তা সন্দেহাতীত। দ্বিতীয় যে ঘটনা ঘটতে পারে তা হলো, আলাপকারী দুই পক্ষের মধ্যে যে কোনো এক পক্ষ সহজেই ফোনালাপ রেকর্ড করতে পারে। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা এখন ব্যাপকভাবে ঘটছে। প্রতিপক্ষকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য ফোন করে তা রেকর্ড করার এক কুৎসিত সংস্কৃতি এখন চালু হয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যাপকের সঙ্গে একজন অভিভাবকের টেলিআলাপ ফাঁস হয়েছিল কিছুদিন আগে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছুদিন হইচই হলো। পরে জানা গেল অধ্যক্ষকে ফাঁসানোর জন্য অন্য প্রান্তের মানুষটি আলাপচারিতা রেকর্ড করেছিলেন। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে এমপি নিক্সন চৌধুরীর আলাপ রেকর্ড করেছিলেন দুই পক্ষের একজন। বরখাস্ত হওয়া গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে ফাঁসানোর জন্য তাঁকে ফোন করে তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করেছিলেন তাঁর দলেরই এক কর্মী। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর এ নোংরা খেলা এখন সারা দেশে ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এটি ক্রমে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেদিন আইনমন্ত্রী বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রাষ্ট্রের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লিখিত অনুমতি ছাড়া ফোনে আড়ি পাততে পারে না। বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন আছে। এ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সংস্থাও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ফোনে আড়ি পাততে পারে না। তাহলে যে যেমন খুশি ফোন রেকর্ড করছে তার প্রতিকার কী? আইনমন্ত্রী বিবিসি বাংলাকে বললেন, এ রকম অভিযোগ কম আসে। কম আসুক বেশি আসুক তা বড় বিষয় নয়। একজন আরেকজনকে ফাঁসানোর জন্য যে ফোন রেকর্ড করেন তা অন্যায় বা শাস্তিযোগ্য অপরাধ কি না অবিলম্বে স্পষ্ট হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে এখনই সরকারের পদক্ষেপ জরুরি। না হলে কদিন পর ছেলে বাবাকে ফোন করে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করবে এবং তা রেকর্ড করবে। প্রেমিক প্রেমিকাকে ফাঁসানোর জন্য (অথবা প্রেমিকা প্রেমিককে) ফোনের একান্ত অন্তরঙ্গ কথাবার্তা রেকর্ড করবে। এভাবে এমন একসময় আসবে যখন কেউ কাউকে বিশ্বাস করবে না। কেউ কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলতেও ভয় পাবে। আমরা অবশ্য এখন সে রকম সময়ের কাছাকাছি চলে এসেছি। তবে আইনমন্ত্রী ও সালমান এফ রহমানের কথোপকথন এ প্রক্রিয়ায় রেকর্ড এবং ফাঁস হয়নি, তা হলফ করেই বলা যায়। দুজনই সম্মানিত ব্যক্তি। দুজনের মধ্যে কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্বও টেলিআলাপে প্রকাশিত হয়নি। কাজেই তাঁদের দুজনের কেউই অন্যজনের আলাপ রেকর্ড করেননি তা বুঝতে গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই।

 

তৃতীয় যে ঘটনা ঘটতে পারে তা হলো- এ রকম অডিও রেকর্ড করার সক্ষমতা যাঁদের আছে তাঁরা যদি এটি রেকর্ড করেন। মাঝেমধ্যেই ফোনে আড়ি পাতার নানা কাহিনি শুনি। উঁচুতলার লোকজন এখন মোবাইলে সাধারণ কল করেন না বললেই চলে। হোয়াটসআপ, ভাইবার, টেলিগ্রাম, সিগন্যাল ইত্যাদি নানা অ্যাপের মাধ্যমে এখন লোকজন কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কখনো শুনি এটা এখন নিরাপদ নয়, ওটা ব্যবহার কর। সরকার মুখে যা-ই বলুক, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ফোনে আড়ি পাতা হয়। বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে আলাপ সাম্প্রতিক সময়ে ফাঁস হয়েছে। বিএনপি নেত্রী নিপুণ রায়চৌধুরী এক কর্মীকে গাড়ি পোড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিএনপির আরেক নেতা আমীর খসরুর সঙ্গে এক কর্মীর নাশকতাবিষয়ক আলাপও ফাঁস হয়ে যায়। হেফাজতের সাবেক নেতা মামুনুলের সঙ্গে তাঁর প্রথম স্ত্রীর কথোপকথনও মুহূর্তে ফাঁস হয়ে গণমাধ্যমে চলে আসে। এসব টেলিআলাপ ফাঁস নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। কেউ জিজ্ঞেস করেনি এটা কারা করল। এসব টেলিআলাপ ফাঁসের ঘটনা প্রমাণ করে আড়ি পাতার ব্যবস্থা আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে তা করা যায়। কিন্তু যে দুজনের টেলিআলাপ ফাঁস হয়েছে তাঁরা দুজনই বিশিষ্ট ব্যক্তি। উভয়েই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। যাঁরা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নিপুণ রায়চৌধুরী কিংবা মামুনুল হকের ফোনে আড়ি পেতেছেন, তাঁদের কেউ কি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোনেও আড়ি পাতছেন? সরকারের ভিতরেই কি ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে সরকারের শত্রু, রাষ্ট্রের শত্রু? এরা সরকারকে চাপে ফেলতে, অস্বস্তিতে ফেলতে তৎপর। যে কোনো সময় এদের লুকিয়ে রাখা হিংস্র নখ বেরিয়ে আসবে। এ প্রশ্নগুলো মনের ভিতর এলো সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। মনে হচ্ছে সরকারের ভিতরেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর। তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা শুরু করেছে। বিশেষ করে যখন নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসছে। কিছুদিন আগে চিত্রনায়িকা পরীমণিকে নিয়ে সারা দেশে হুলুস্থুল হয়ে গেল। এ সময় এক তরুণ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে পরীমণির অন্তরঙ্গ এক ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি ছড়ানো হলো সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেখানে বসে কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধী লাগাতার অপপ্রচার করছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ করা এক ব্যক্তির কাছে ওই ভিডিও ক্লিপটি কে পাঠাল? সে প্রশ্নের কোনো উত্তর আজও পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি দেখলাম পুলিশ বাহিনী এবং এর প্রধানকে নিয়ে কুৎসিত অপপ্রচার। এ অপপ্রচারের উৎস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আদেশ। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আদেশটিকে ‘অনবধানতাবশত সৃষ্ট ভাষাগত বিভ্রাটপ্রসূত’ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এটি শুধুই ভাষাগত বিভ্রাট নাকি এর পেছনে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র আছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব এ রকম একটি ভুল বিভ্রান্তিমূলক আদেশ জারি করেন কীভাবে? এটি নিছক ভুল না এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে? কিছুদিন ধরেই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইমেজ নষ্টের পরিকল্পিত কিছু ঘটনা দৃশ্যমান। এসব করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল নষ্টের জন্য। গত বছর ১০ ডিসেম্বর র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি আলোচিত হয়। সেখানে একজন সদস্য প্রশ্ন করেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাস কী করেছিল?’ পরপরই জাতিসংঘে র‌্যাবকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে নিষিদ্ধ করার লিখিত দাবি উত্থাপন করে ১২টি মানবাধিকার সংগঠন। এর পরই এলো চাদর-বালিশ কেনার সাজানো নাটক। সব কি তাহলে একই সূত্রে গাঁথা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাঁরা যে পদে আছেন তাঁরা কি পরীক্ষিত? তাঁদের সবাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত? আওয়ামী লীগ সংগঠনেই শুধু অনুপ্রবেশকারী জামায়াত-বিএনপি ঠাঁই নেয়নি। প্রশাসনেও রং বদল করে অনেক জামায়াত-যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগ হয়েছে। তাঁরা যে রাষ্ট্রের গোপন তথ্য বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন না তার গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারে? তাই সরকারের ভিতর থেকে কেউ আইনমন্ত্রী ও উপদেষ্টার টেলিআলাপ ফাঁস করল কি না খতিয়ে দেখা দরকার। আইনমন্ত্রী এ রকম সম্ভাবনার শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। আমি আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে আস্থা রাখতে চাই। বিশ্বাস করতে চাই সরকারের ভিতর থেকে এ কাণ্ডটি ঘটেনি। কিন্তু একটি নির্মোহ তদন্তের মাধ্যমে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ ঘটনাটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বড় প্রশ্ন হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। এ ফোনালাপ ফাঁস প্রমাণ করে সামনে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। 

চতুর্থ যে ঘটনাটি ঘটতে পারে তা হলো বাইরের কেউ আড়ি পাততে পারে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশ থেকে, শত্রুপক্ষ অপপ্রচারকারী, ষড়যন্ত্রকারীরা সহজেই আড়ি পাততে পারে। কিছুদিন ধরে ইসরায়েলের আড়ি পাতা যন্ত্র ‘পেগাসাস স্পাইওয়ার’ নিয়ে সারা বিশে^ তোলপাড় চলছে। বিশে^র বড় বড় সব নেতার ফোনে এ যন্ত্র প্রয়োগ করার কথা ফাঁস হচ্ছে। বিশ্বের কোন কোন দেশ ‘পেগাসাস স্পাইওয়ার’ কিনেছে তা নিয়েও চলছে নানা বিতর্ক। জানা গেছে, বাংলাদেশ এটি কেনেনি। ক্রেতার তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। পেগাসাস এমন এক স্পাইওয়ার যা দিয়ে খুব সহজেই যে কোনো ফোনে আড়ি পাতা যায়। ধরা যাক, আপনার ফোনের যাবতীয় তথ্য, কথোপকথনের ওপর কেউ নজরদারি করতে চাইল। তাকে কিছু করতে হবে না। শুধু আপনার ফোনে একটি মেসেস পাঠালেই হলো। আপনি মেসেজ বা খুদে বার্তাটি দেখলেন। ব্যস, পেগাসাস জীবাণু ঢুকে গেল আপনার ফোনে। আপনার ফোনের সব তথ্য চলে গেল অন্যের হাতে। আপনি বলতেই পারেন আমি সব মেসেজ দেখি না। অপরিচিত মেসেজ তো নয়ই। তাতে কী, আপনাকে ফোন করা হলো, কোনো বিদেশি নম্বর থেকে। বিদেশি নম্বর দেখে আপনি আগ্রহী হয়ে ধরলেন। ব্যস, আপনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার তালা খুলে গেল। এভাবে যে কোনো ব্যক্তির গোপনীয়তার দরজা ভাঙা এখন খুবই সহজ। বাংলাদেশ পেগাসাস না কিনলে কী হবে যাঁরা বিদেশে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, তাঁরা তো পেগাসাস স্পাইওয়ার কিনতেই পারেন। কিংবা অন্য কোনো আড়ি পাতা যন্ত্র, যা দিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সব তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমার এ ধরনের আশঙ্কার পেছনে কারণ আছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে এ রকম আড়ি পাতা যন্ত্র বসানো হয়েছিল হাওয়া ভবনে। তাই এখন এর চেয়েও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হবে না তা কে হলফ করে বলবে। এঁরা যদি লবিস্ট নিয়োগ করে কোটি টাকা খরচ করতে পারেন, যদি তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচারের জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ করতে পারেন তাহলে এ রকম আড়ি পাতা যন্ত্র কিনতে না পারার কোনো কারণ নেই। আমরা জানি লন্ডনে বসে যাঁরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন তাঁদের টাকার অভাব নেই। এ সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য তাঁরা সবকিছু করতে পারেন। আমি লক্ষ্য করছি, এ সরকারের কিছু কিছু ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের আত্মম্ভরিতা ভর করছে। অনেকে অতি আত্মবিশ্বাসী। এক ধরনের উপেক্ষার সংস্কৃতি দানা বেঁধেছে সরকারের মধ্যে। অনেকেই সারাক্ষণ আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। বাংলাদেশকে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাল না, তখন দেখলাম এ ঘটনাকে পাত্তাই দিলেন না কতিপয় করিৎকর্মা মন্ত্রী। বললেন, এটা নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেন নতুন ঢং। আবার অজুহাত দাঁড় করালেন চট করে। গণতন্ত্রে দুর্বল দেশগুলোকেই নাকি এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল, তখন অনেকেই একে পাত্তা না দেওয়ার ভাব করলেন। কি অদ্ভুত। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এক মন্ত্রী বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে। কমিটির বাইরে প্রতিমন্ত্রী বললেন, বাংলাদেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো চাপ নেই। মালয়েশিয়ায় আটক হলেন জেলহত্যার আসামি খায়রুজ্জামান। তাকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে বলা হলো। এখন সংবাদে জানলাম তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যে কোনো ঘটনা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার এ প্রবণতা আত্মঘাতী ও ভয়ংকর। আইনমন্ত্রী এবং উপদেষ্টার ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনাটিও উপেক্ষার জালে বন্দি হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন, এ ঘটনার তদন্ত হবে। রাষ্ট্রের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এ ঘটনার প্রকৃত, সত্যনিষ্ঠ তদন্ত প্রয়োজন। কারণ দেশের বাইরে বসে কেউ যদি এ কাজ করেন তাহলে তা গুরুতর ভাবনার বিষয় বটে। কারণ বাংলাদেশের শত্রুরা দুর্বল নয়। তারা ক্রমে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এ সত্য মেনে নিয়েই প্রস্তুতি নিতে হবে সরকারকে। না হলে অডিও ফাঁসের মেলা বসবে নির্বাচনের আগে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।    সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Email : [email protected]

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com