বিদেশে দক্ষ কর্মী প্রেরণে আরো জোর দিতে হবে

সংগৃহীত ছবি

 

এ কে এম আতিকুর রহমান : গত ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি নতুন শ্রমচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ও সৌদি আরবের মানবসম্পদ মন্ত্রী এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুসারে একজন অভিবাসী কর্মীকে অনুমোদিত ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে যাত্রার আগে নথিভুক্ত চাকরির প্রস্তাব এবং কর্মচুক্তিপত্র গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। এ ছাড়া চুক্তিতে নিয়োগকারী কর্মীদের কাছ থেকে অননুমোদিত ফি না নেওয়া, কর্মীদের বেতন সরাসরি তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রদান করাসহ অন্যান্য কর্মী সুরক্ষা ব্যবস্থার বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মী রয়েছেন সৌদি আরবে (প্রায় ২৫ লাখ)। চুক্তিটিতে যেসব শর্তের উল্লেখ আছে, তা অবশ্যই অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের স্বার্থকে রক্ষা করবে। কিন্তু মূল সমস্যাটি হতে পারে ওই সব কর্মী যাঁদের মাধ্যমে চাকরি নিয়ে যাবেন, তাঁদের হাত থেকে রক্ষা করার উপায় নিয়ে। কারণ ওই জায়গাটিতেই যে কর্মী শোষণের সব উপকরণ বিদ্যমান।
শোষণের সেই ছিদ্র বন্ধ করা না গেলে চুক্তি যতই ভালো হোক, কর্মীদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না। জানি না  কর্মীদের ন্যূনতম অভিবাসন ব্যয়ের ক্ষেত্রে ওই চুক্তি কতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারবে।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি কর্মীকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে।

এই সময়কালে প্রতিবছর ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এলেও আগের বছরগুলোতে বিদেশে যাওয়া কর্মীসংখ্যার অনুপাতে এই বছরগুলোতে কম রেমিট্যান্স এসেছে। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে ওমান, বাহরাইন, লিবিয়া, ব্রুনেই, মরিশাস, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে কর্মী যাওয়া বন্ধ আছে বা সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আমাদের কর্মীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব গন্তব্যে কর্মী পাঠানোর জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশিরা বৈধ পথে যাওয়া ছাড়াও অনেকে অবৈধ পথে কোনো চাকরি না নিয়েই বিদেশে পাড়ি জমান। সচেতনতার অভাবে বা লোভে পড়ে মানবপাচারকারীদের হাত ধরে পারি দিতে গিয়ে কেউ কেউ জীবন পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন।

আমরা এভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো বাংলাদেশিদের ধরা পড়ে দেশে ফেরার অনেক ঘটনা প্রতিনিয়তই দেখছি। অন্যদিকে বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় গিয়েও অনেকে আবার নানা প্রলোভনে পড়ে অবৈধ হয়ে পড়েন। তাই বৈধ পথে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়াটাই কর্মীদের জন্য নিরাপদ। এ ছাড়া কর্মস্থল পরিবর্তন যেন সেই দেশের বিদ্যমান আইনের অনুসরণে হয় সেদিকে লক্ষ রাখাও প্রতিটি কর্মীর দায়িত্ব। অন্যথায় বৈধভাবে গেলেও অবৈধ হওয়ার কারণে জেল, জরিমানা বা দেশে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকি থাকে।
যেসব দেশে অবৈধ পথে বাংলাদেশিদের যাওয়ার আগ্রহ বেশি, সেসব দেশে অবশ্যই কর্মীদের চাহিদা রয়েছে। অবস্থাটা যদি সে রকমই হয়, তাহলে যাতে বৈধভাবে তাঁরা সেসব দেশে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাই সরকারকে নিতে হবে। আমাদের শ্রমবাজার প্রসারণের যথাযথ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। বিদ্যমান বাজার ছাড়াও নতুন বাজার খুঁজে সেখানকার চাহিদা অনুযায়ী কর্মী প্রেরণের পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সেটি করতে সক্ষম হলে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পন্থায় সেসব দেশে যাওয়ার প্রবণতা কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি ওই সব দেশের বাংলাদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

একজন কর্মী দেশে বা বিদেশে যেখানেই কর্মে নিয়োজিত থাকুন না কেন, তাঁর কর্মদক্ষতা বা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করবে তাঁর উপার্জন বা বেতন-ভাতার পরিমাণ। দেখা যায় যে একই কাজে নিয়োজিত কর্মীদের দক্ষতার কারণে তাঁদের আয় কমবেশি হয়ে থাকে। যেহেতু শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করতে হয়, তাই একজন সাধারণ কর্মীর চেয়ে প্রশিক্ষিত কর্মীর আয় তিন-চার গুণ বেশি। আসলে একজন কর্মীর দক্ষতার বিকল্প নেই। আর দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন কর্মী একজন সাধারণ কর্মীর চেয়ে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন থাকেন।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া অভিবাসী কর্মীর সংখ্যাই বেশি। এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অদক্ষ কর্মী যান বাংলাদেশ থেকে। আর এ কারণে কর্মীসংখ্যার অনুপাতে আমাদের প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। উল্লেখ্য, প্রতিবছর প্রেরিত কর্মীর সংখ্যায় ভারত আর বাংলাদেশ প্রায় সমান অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের চেয়ে পাঁচ গুণেরও বেশি রেমিট্যান্স পায়। বিগত বছরগুলোর উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের মতো ছিলেন দক্ষ কর্মী। বিভিন্ন দেশে কর্মরত আমাদের অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ও অভিবাসী কর্মীর অনুপাত থেকে প্রতীয়মান হয় যে দক্ষ বা আধাদক্ষ কর্মীর অনুপাত যেসব দেশে বেশি, সেসব দেশ থেকে প্রাপ্ত আনুপাতিক রেমিট্যান্সও বেশি।

বাংলাদেশে বিদ্যমান ভয়াবহ বেকার সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বিদেশে কর্মী প্রেরণ অত্যন্ত জরুরি। লাখ লাখ বেকার যেমন কর্মের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে, তেমনি দিন দিন বেড়েই চলছে বেকারের সংখ্যা। ২০২৩ সালে বেকারত্বের হার ছিল ৩.২, যা গত বছর বেড়ে ৪.৬-এ দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থার জন্য অনেকেই দুর্বল শ্রমবাজার এবং অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করছেন। অথচ এই বিরাট জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে এটি তখন আর বোঝা হয়ে থাকবে না, হবে এক অফুরন্ত সম্পদ। বেকারের হার কমানোর জন্য যেমন দেশে এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, তেমনি বেকারদের কাজ করার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে কাজ পেতে তাদের তেমন সমস্যা না হয়। সেটি করতে হলে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারিভাবে বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নের।

আমাদের দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে বাস্তবভিত্তিক, কর্মমুখী, উৎপাদনমুখী এবং সর্বোপরি সৃষ্টিশীল করে তুলতে হবে। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে কেউ যেন বেকার না থেকে যোগ্যতানুযায়ী কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারেন সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বেকারত্বের বোঝা জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনোক্রমেই শিক্ষার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। বরং একটি মেধাসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করাই হবে এর মূল লক্ষ্য।

একটি সুষ্ঠু ও ন্যায্য অর্থনীতিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দারিদ্র্যের হার কমাতে হবে। সরকার পরিচালনায় থাকা রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছা, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখাসহ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগপ্রবাহ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ, আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা, বিদেশে কর্মসংস্থান প্রসারণ ইত্যাদির প্রতি জোর দিতে হবে।

বাংলাদেশের জন্য কর্মীদের অভিবাসন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসনপ্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ, নিরাপদ ও অভিবাসীবান্ধব করা দরকার। তবে এই চাওয়া যতটা সহজ, স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে তা বাস্তবে পরিণত করাটা ততটা কঠিন। বিদ্যমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করে সুস্থ অভিবাসন প্রক্রিয়ার পথে বিদ্যমান বাধাগুলো চিহ্নিত করাসহ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও ফেরত আসা অভিবাসীদের দেশের অর্থনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত রাখা এবং সঠিক রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নধারাকে জোরালো করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি এসব করতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যেমন সদিচ্ছা ও দৃঢ় মনোবল থাকতে হবে, তেমনি সততা, আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতাকে মনেপ্রাণে ধারণ করতে হবে। একদিকে ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা, অন্যদিকে মানবপাচারের বীভৎস দৃশ্য আর যেন দেখতে না হয়, সেই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব ।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» পুকুরে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু

» চার কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভ, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ

» সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সরকার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে

» থাই চিকেন কারি রেসিপি

» ডায়াবেটিস নিয়ে ভ্রমণে করণীয়

» কম দামে কিনতে পারবেন এই কোম্পানির ফ্ল্যাগশিপ ফোন

» রাজধানীতে চারটি ককটেল বিস্ফোরণ

» শেখ হাসিনার রায় ঘিরে জাতীয় ঈদগাহ মাঠে বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

» সাবেক এমপি সাদেক খানের ১২ ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ

» জন্মদিনের আবহে মুগ্ধতা ছড়ালেন মিম

 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বিদেশে দক্ষ কর্মী প্রেরণে আরো জোর দিতে হবে

সংগৃহীত ছবি

 

এ কে এম আতিকুর রহমান : গত ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি নতুন শ্রমচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা ও সৌদি আরবের মানবসম্পদ মন্ত্রী এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুসারে একজন অভিবাসী কর্মীকে অনুমোদিত ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে যাত্রার আগে নথিভুক্ত চাকরির প্রস্তাব এবং কর্মচুক্তিপত্র গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। এ ছাড়া চুক্তিতে নিয়োগকারী কর্মীদের কাছ থেকে অননুমোদিত ফি না নেওয়া, কর্মীদের বেতন সরাসরি তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রদান করাসহ অন্যান্য কর্মী সুরক্ষা ব্যবস্থার বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মী রয়েছেন সৌদি আরবে (প্রায় ২৫ লাখ)। চুক্তিটিতে যেসব শর্তের উল্লেখ আছে, তা অবশ্যই অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের স্বার্থকে রক্ষা করবে। কিন্তু মূল সমস্যাটি হতে পারে ওই সব কর্মী যাঁদের মাধ্যমে চাকরি নিয়ে যাবেন, তাঁদের হাত থেকে রক্ষা করার উপায় নিয়ে। কারণ ওই জায়গাটিতেই যে কর্মী শোষণের সব উপকরণ বিদ্যমান।
শোষণের সেই ছিদ্র বন্ধ করা না গেলে চুক্তি যতই ভালো হোক, কর্মীদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না। জানি না  কর্মীদের ন্যূনতম অভিবাসন ব্যয়ের ক্ষেত্রে ওই চুক্তি কতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারবে।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি কর্মীকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে।

এই সময়কালে প্রতিবছর ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এলেও আগের বছরগুলোতে বিদেশে যাওয়া কর্মীসংখ্যার অনুপাতে এই বছরগুলোতে কম রেমিট্যান্স এসেছে। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে ওমান, বাহরাইন, লিবিয়া, ব্রুনেই, মরিশাস, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে কর্মী যাওয়া বন্ধ আছে বা সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আমাদের কর্মীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসব গন্তব্যে কর্মী পাঠানোর জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশিরা বৈধ পথে যাওয়া ছাড়াও অনেকে অবৈধ পথে কোনো চাকরি না নিয়েই বিদেশে পাড়ি জমান। সচেতনতার অভাবে বা লোভে পড়ে মানবপাচারকারীদের হাত ধরে পারি দিতে গিয়ে কেউ কেউ জীবন পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন।

আমরা এভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো বাংলাদেশিদের ধরা পড়ে দেশে ফেরার অনেক ঘটনা প্রতিনিয়তই দেখছি। অন্যদিকে বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় গিয়েও অনেকে আবার নানা প্রলোভনে পড়ে অবৈধ হয়ে পড়েন। তাই বৈধ পথে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়াটাই কর্মীদের জন্য নিরাপদ। এ ছাড়া কর্মস্থল পরিবর্তন যেন সেই দেশের বিদ্যমান আইনের অনুসরণে হয় সেদিকে লক্ষ রাখাও প্রতিটি কর্মীর দায়িত্ব। অন্যথায় বৈধভাবে গেলেও অবৈধ হওয়ার কারণে জেল, জরিমানা বা দেশে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকি থাকে।
যেসব দেশে অবৈধ পথে বাংলাদেশিদের যাওয়ার আগ্রহ বেশি, সেসব দেশে অবশ্যই কর্মীদের চাহিদা রয়েছে। অবস্থাটা যদি সে রকমই হয়, তাহলে যাতে বৈধভাবে তাঁরা সেসব দেশে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাই সরকারকে নিতে হবে। আমাদের শ্রমবাজার প্রসারণের যথাযথ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। বিদ্যমান বাজার ছাড়াও নতুন বাজার খুঁজে সেখানকার চাহিদা অনুযায়ী কর্মী প্রেরণের পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সেটি করতে সক্ষম হলে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পন্থায় সেসব দেশে যাওয়ার প্রবণতা কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি ওই সব দেশের বাংলাদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

একজন কর্মী দেশে বা বিদেশে যেখানেই কর্মে নিয়োজিত থাকুন না কেন, তাঁর কর্মদক্ষতা বা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করবে তাঁর উপার্জন বা বেতন-ভাতার পরিমাণ। দেখা যায় যে একই কাজে নিয়োজিত কর্মীদের দক্ষতার কারণে তাঁদের আয় কমবেশি হয়ে থাকে। যেহেতু শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করতে হয়, তাই একজন সাধারণ কর্মীর চেয়ে প্রশিক্ষিত কর্মীর আয় তিন-চার গুণ বেশি। আসলে একজন কর্মীর দক্ষতার বিকল্প নেই। আর দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন কর্মী একজন সাধারণ কর্মীর চেয়ে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন থাকেন।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া অভিবাসী কর্মীর সংখ্যাই বেশি। এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অদক্ষ কর্মী যান বাংলাদেশ থেকে। আর এ কারণে কর্মীসংখ্যার অনুপাতে আমাদের প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। উল্লেখ্য, প্রতিবছর প্রেরিত কর্মীর সংখ্যায় ভারত আর বাংলাদেশ প্রায় সমান অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের চেয়ে পাঁচ গুণেরও বেশি রেমিট্যান্স পায়। বিগত বছরগুলোর উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের মতো ছিলেন দক্ষ কর্মী। বিভিন্ন দেশে কর্মরত আমাদের অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ও অভিবাসী কর্মীর অনুপাত থেকে প্রতীয়মান হয় যে দক্ষ বা আধাদক্ষ কর্মীর অনুপাত যেসব দেশে বেশি, সেসব দেশ থেকে প্রাপ্ত আনুপাতিক রেমিট্যান্সও বেশি।

বাংলাদেশে বিদ্যমান ভয়াবহ বেকার সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বিদেশে কর্মী প্রেরণ অত্যন্ত জরুরি। লাখ লাখ বেকার যেমন কর্মের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে, তেমনি দিন দিন বেড়েই চলছে বেকারের সংখ্যা। ২০২৩ সালে বেকারত্বের হার ছিল ৩.২, যা গত বছর বেড়ে ৪.৬-এ দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থার জন্য অনেকেই দুর্বল শ্রমবাজার এবং অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করছেন। অথচ এই বিরাট জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে এটি তখন আর বোঝা হয়ে থাকবে না, হবে এক অফুরন্ত সম্পদ। বেকারের হার কমানোর জন্য যেমন দেশে এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, তেমনি বেকারদের কাজ করার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে কাজ পেতে তাদের তেমন সমস্যা না হয়। সেটি করতে হলে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারিভাবে বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নের।

আমাদের দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে বাস্তবভিত্তিক, কর্মমুখী, উৎপাদনমুখী এবং সর্বোপরি সৃষ্টিশীল করে তুলতে হবে। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে কেউ যেন বেকার না থেকে যোগ্যতানুযায়ী কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারেন সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বেকারত্বের বোঝা জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনোক্রমেই শিক্ষার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। বরং একটি মেধাসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করাই হবে এর মূল লক্ষ্য।

একটি সুষ্ঠু ও ন্যায্য অর্থনীতিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দারিদ্র্যের হার কমাতে হবে। সরকার পরিচালনায় থাকা রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছা, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখাসহ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগপ্রবাহ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ, আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা, বিদেশে কর্মসংস্থান প্রসারণ ইত্যাদির প্রতি জোর দিতে হবে।

বাংলাদেশের জন্য কর্মীদের অভিবাসন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসনপ্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ, নিরাপদ ও অভিবাসীবান্ধব করা দরকার। তবে এই চাওয়া যতটা সহজ, স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে তা বাস্তবে পরিণত করাটা ততটা কঠিন। বিদ্যমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করে সুস্থ অভিবাসন প্রক্রিয়ার পথে বিদ্যমান বাধাগুলো চিহ্নিত করাসহ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও ফেরত আসা অভিবাসীদের দেশের অর্থনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত রাখা এবং সঠিক রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নধারাকে জোরালো করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি এসব করতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যেমন সদিচ্ছা ও দৃঢ় মনোবল থাকতে হবে, তেমনি সততা, আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতাকে মনেপ্রাণে ধারণ করতে হবে। একদিকে ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা, অন্যদিকে মানবপাচারের বীভৎস দৃশ্য আর যেন দেখতে না হয়, সেই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব ।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com