বিকেলটা এমনিতেই কষ্টের ছিল। চাকরিটা এবারও হয়নি। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। জানুয়ারি প্রায় শেষ, তবু ঠান্ডা কমার নাম নেই, এরমধ্যে বৃষ্টি!
বিপ্লব এক দৌড়ে একটা দোকানে আশ্রয় নিলো। চারদিক কালো হয় এসেছে। বিপ্লবের কাছে আরও বেশি কালো লাগছে।
দোকানভর্তি লোক। সবাই উসখুস করছে। এতগুলো লোক গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে, তার উপর অপেক্ষা করা ছাড়া করার কিছু নেই। কতক্ষণে বৃষ্টি থামবে কে জানে! এই ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টিতে ভেজার শখ নেই কারো।
বিপ্লব আনমনে নিজের দুর্ভাগ্যের হিসেব করছিল। মাস্টার্স পাস করেছে ৪ বছর, এরমধ্যে একটা ভালো চাকরি জোগাড় করে থিতু হতে পারেনি। তার বন্ধু-বান্ধব একেকজন কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছে! মাঝেমধ্যে রাস্তাঘাটে তাদের সাথে দেখা হলে লজ্জায় পড়তে হয়। সবাই সমবেদনা দেয়, পরামর্শ দেয়, উপদেশ দেয়, কেউ একটা ভালো চাকরি দেয় না।
বাসায় সকাল-বিকাল উঠতে-বসতে বাবা-মায়ের হুল ফোঁটানো কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, ও তাদের সৎ ছেলে! কামাইহীন একটি ছেলের চেয়ে দুর্ভাগা আর কেউ নেই এই দুনিয়ায়!
একটানা ঝুম বৃষ্টি আর কনকনে শীতল হাওয়া দোকানে জড় হওয়া লোকজনকে কেমন যেন নির্জীব করে দিয়েছে। সবাই ঝিম মেরে আছে।
এরমধ্যে হঠাৎ শান্তাকে চোখে পড়ল। কোণার দিকে লোকজনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। বিপ্লব তাকাতেই শান্তাও এদিক তাকালো। ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে বাইরে দেখলো। মুহূর্তেই আবার দৃষ্টি ওর ওপর ফেরত এলো। চিনতে পেরেছে, কারণ ওর চোখে পরিষ্কার বিস্ময় ফুটে উঠতে দেখলো বিপ্লব। পরমুহূর্তেই ওর চোখে আনন্দ দেখল। লোকজন ঠেলে শান্তা বেরিয়ে এলো। ওর হাত ধরে আছে ছোট একটি মেয়ে, বছর তিন-চারেকের হবে, মাথায় দুটো ঝুটি বাঁধা। ছোট সুন্দর ফোলাফোলা গোলাগাল চেহারা, দারুণ আদরের।
বিপ্লব যে, কেমন আছো?
শান্তার চোখে মায়াভরা দৃষ্টি। ওর স্বাস্থ্যটা বেশ ভালো হয়েছে। এখনকার মেয়েরা এটাকে মোটা বলবে, তবে বিপ্লবের মনে হলো ওকে এভাবে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। কলেজ লাইফে ও ছিল স্লিম, ফর্সা আর দারুণ স্মার্ট। ক্লাসের ছেলেরা ছাড়াও কলেজের বড় ভাই আর ছোট ভাইদের অনেকে শান্তার দারুণ ভক্ত ছিল। কিন্তু শান্তা সবাইকে ছেড়ে বিপ্লবকেই কেন চান্স দিয়েছিল এটা নিয়ে ভেবে এখনো মাঝে মাঝে ও অবাক হয়। বিপ্লব মধ্যবিত্ত ঘরের মধ্যম মানের ছাত্র। মুখচোরা, শ্যামলা, তালপাতার সেপাই টাইপ।
শান্তা স্বাস্থ্যবতী হওয়া ছাড়া একটু শ্যামলাও হয়েছে। চুলগুলো পনিটেইল করে বাঁধা, সালোয়ার-কামিজে ওকে দেখে বিপ্লব মনে মনে ভাবলো স্লিম আর ফর্সা শান্তার চেয়ে স্বাস্থ্যবান আর শ্যামলা শান্তা অনেক বেশি সুন্দর! অবশ্য বিয়ের পর সব মেয়েরই সৌন্দর্য খুলে যায়।
বিপ্লব জবাব দিলো, ভালো। তোমার কী খবর?
এই তো আছি। এটা আমার মেয়ে। তিলোত্তমা। ওর বাবার দেওয়া নাম।
খুব সুন্দর নাম। দেখতে মনে হয় ওর বাবার মতো হয়েছে।
কী বলো, সবাই তো বলে হুবহু আমার ডুপ্লিকেট! আচ্ছা যা-ই হোক, কী করছো এখন?
চাকরি খুঁজছি, আর কী করব!
বিপ্লব হালকা স্বরে বলতে চাইল, তবে গলাটা বেঈমানি করে একটা ফ্যাসফ্যাসে সুর বের হলো! না, আজ ওর এসব বলতে কোনো লজ্জা নেই, হীন্মন্যতাও নেই। ও অনেক আগেই পরাজয় মেনে নিয়েছে।
শান্তা চট করে কথা ঘোরালো, আংকেল-আন্টি ভালো আছেন? আর রুমানা আপু?
হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। আমিও ভালো আছি।
আমিও ভালো আছিতে না চাইতেই একটু মনে হয় জোর পড়ে গিয়েছিল, শান্তার চেহারাটা হঠাৎই একটু বিব্রত দেখালো। ও বলল, চলো কোথাও বসি। তোমাকে আজ কফি খাওয়াবো।
ওর সাথে সম্পর্কের দিনগুলোতেও শান্তাই সব সময় রেস্টুরেন্টের বিল দিয়েছে, ধনীর দুলালী ছিল, বিপ্লবের পেছনে ইচ্ছেমত টাকা খরচ করেছে। বিপ্লবের মুরোদ ছিল না প্রেমিকাকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট গিয়ে বিলাসিতা করে।
বিপ্লবের মুখে তেতো একটা ভাব হয়। ওর কাছে কিছু ছিল না তবু শান্তা ওকে ভালোবেসেছিল। এমনকি বাবা মা পরিবার সবকিছু ছেড়ে হলেও ওর কাছে চলে আসার জন্য পাগল হয় উঠেছিল। বিপ্লব রাজি হয়নি। বলেছিল নিজের গাড়ি বাড়ি করে সমান যোগ্যতার হয়ে তারপর শান্তার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। তখন ওর কনফিডেন্সের কোনো অভাব ছিল না। আজ মনে হয় ওর চেয়ে বড় গর্দভ দুনিয়াতে আর নেই।
সব সময় তো তুমিই খাইয়েছো, আর কত! বিপ্লব জবাব দেয়।
চলো না, অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা। চলো আজ তোমার গল্প শুনব, কেমন আছো, কী করছো।
আমার হেরে যাওয়ার গল্প শুনতে একদম উঠে পড়ে লাগলে যে!
বিপ্লবের কাটা কাটা কথায় শান্তা একটু থতমত খেয়ে যায়।
আচ্ছা তোমার গল্প নাইবা করলে, আমি আমার গল্প শুনাই, রাশেদের সাথে কীভাবে দেখা হলো, কীভাবে হঠাৎ করে বিয়ে হয় গেল।
দেখো শান্তা, তোমার স্বাস্থ্য দেখেই বোঝা যাচ্ছে দারুণ সুখে তোমার দিন কাটছে, স্বামী-সন্তান নিয়ে একেবারে গদগদ! তুমি তোমার সুখ নিয়ে ভালো থাকো, আমাকে এর মধ্যে আর টেনো না তো!
এমন কঠিন কথায় এবার শান্তার চোখের কোণে রাগের ঝিলিক দেখা যায়।
বিপ্লব তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার সব ছিল, বিদ্যা-বুদ্ধি, যোগ্যতা, কনফিডেন্স, কিন্তু তবু তুমি তোমার প্রেমিকাকে পাওনি, এমনকি এতদিনে একটা ভালো চাকরিও না। কারণটা কি জানো? তোমার জেদ! এই জেদের কারণে তোমার জীবনটা একটা ধ্বংসস্তূপে গিয়ে শেষ হবে, তুমি দেখো।
কাটা কাটা স্বরে কথাগুলো বলে শান্তা মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যায়। বৃষ্টি কখন থেমে গেছে বিপ্লব খেয়ালই করেনি!
৩০ বছর পর…
সায়েন্স ল্যাবের সামনের রাস্তায় হুলস্থূল ট্রাফিক জ্যাম, সব গাড়ি সার ধরে দাঁড়িয়ে আছে অবিচল। কতক্ষণ এভাবে নিশ্চল থাকতে হবে কেউ জানে না। পাশেই ফুটপাতে হকারেরা কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসেছে। যে কোনো কাপড় সহজেই পাওয়া যায়, যেমন সুন্দর তেমনই সস্তা। বিপ্লব সাহেব একটা সাদা শার্ট দরদাম করছিলেন। অনেকদিন নতুন শার্ট কেনা হয় না। আগের কয়টা পুরোনো হতে হতে ত্যানাত্যানা হয় গেছে। চোখের কোণ দিয়ে সামনের রাস্তায় গাড়ির সারিতে দৃষ্টি যেতেই মনে হলো কেউ যেন তারই দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখেন একটা গাঢ় নীল রঙের চকচকে কারে বসে শান্তা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এত বছর পরও ওর মধ্যে তেমন কোনো বয়সের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। শুধু সামনের দিকের চুলগুলো সাদা হয়ে আভিজাত্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সৌন্দর্যও।
শান্তার দৃষ্টিতে কোনো আগ্রহ ছিল না। ছিল না কোনো মায়াও। ছিল শুধু একরাশ সমবেদনা! সূএ:জাগোনিউজ২৪.কম