উন্নতির অন্তর্গত কান্না : ব্যবস্থার বদল চাই

ছবি সংগৃহীত

 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : একাত্তর সালটা বাংলাদেশে মেয়েদের জন্য ছিল চরম দুর্দশাপূর্ণ। পাকিস্তানি হানাদাররা হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে মেয়েদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। রাষ্ট্র তাদের লেলিয়ে দিয়েছিল। ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছিল যা ইচ্ছা তা-ই করার। তারা সেটা করেছেও।

 

রাষ্ট্রীয় সমর্থনে ক্ষমতাবান হয়ে হত্যা, অস্থাবর সম্পত্তি লুণ্ঠন এবং ধর্ষণ সমানে চালিয়েছে। এখন তো পাকিস্তান নেই, এখন তো আমরা স্বাধীন, বাঙালিই শাসন করছে বাঙালিকে। তাহলে এখন কেন মেয়েরা এভাবে নির্যাতিত হচ্ছে? পাচার হচ্ছে ভারতে, জীবিকার অন্বেষণে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে লাঞ্ছিত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে যেখানে-সেখানে, আত্মহত্যা করছে যখন-তখন, আটকা পড়ছে বাল্যবিবাহের ফাঁদে? কারণটা আমাদের অজানা নয়।

কারণ হচ্ছে পাকিস্তান বিদায় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো বিদায় হয়নি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফিরে আসার পাঁয়তারা করছে।

 

পাকিস্তানের প্রেতাত্মা এখনো আমাদের পিছু ছাড়েনি—এমন কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা মোটেই মিথ্যা কথা বলেন না। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই প্রেতাত্মাটাকে চিহ্নিত করে না। প্রেতাত্মাটা অন্য কিছু নয়, প্রেতাত্মাটা পুঁজিবাদ।

 

তাহলে উপায় কী? প্রতিবাদ? অবশ্যই। প্রতিবাদটা চলছে। বাল্যবিবাহে অসম্মত মেয়েরা কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করছে—এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিশোরী মেয়েরা বিয়ের আসর থেকে সহপাঠিনীকে উদ্ধার করছে, আমরা জানতে পাচ্ছি। খবরের কাগজেই বের হয়েছে এমন খবর যে মাগুরায় এক মা তাঁর মেয়েকে উত্ত্যক্তকারী যুবককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছেন।

 

কিন্তু তাতে তো ব্যবস্থাটা বদলায় না। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমেরিকায় বিক্ষোভ চলছে। আমেরিকার অরেগনে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে দুজন আমেরিকান নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের একজনের মা বলেছিলেন, তাঁর ছেলে বীর ছিলেন, মৃত্যুর পরেও বীর থাকবেন। মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলেছে, সে চেষ্টা চলবে, কিন্তু মনুষ্যত্ব নষ্ট হওয়ার নয়, হবেও না। তবে একলা একলা প্রতিবাদ করে যে কাজ হবে না, সেটা তো প্রমাণিত সত্য।

 

তাহলে কি পালাতে হবে? কিন্তু পালাবেন কোথায়? একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে মানুষকে পালাতে হয়েছিল, ফিরে এসে তারা দেখেছে এ কী, পাকিস্তান তো রয়েই গেছে! বদলটা শুধু নামেই। মানুষ এখনো পালাচ্ছে। ধনীরাও এরই মধ্যে বিদেশে বাড়িঘর তৈরি করেছেন, সময়মতো চলে যাবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দলীয় লোকদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে দল যদি ক্ষমতায় না থাকে, তাহলে টাকা-পয়সা নিয়ে পালানোর পথ পাওয়া যাবে না। এই সতর্কবাণীর দরকার ছিল কি? যারা পেরেছে, তারা তো তখনই ব্যবস্থা করেছে, অন্যরাও তৎপর ছিল। আর যাদের টাকা-পয়সার অভাব, দলের লোক নয়, সাধারণ মানুষ, তাদেরও একটা অংশ কিন্তু পালাচ্ছে। রিপোর্ট বলছে, নৌপথে ইউরোপে যারা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে, তাদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশিরা এখন শীর্ষস্থানে। হতভাগা এই মানুষরা অবশ্য টাকা পাচারের জন্য যায় না, টাকা উপার্জনের জন্যই যায়। কিন্তু যাচ্ছে তো। জীবন বাজি রেখে যাচ্ছে। ঝাঁপ দিচ্ছে সমুদ্রে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া থেকে মানুষ পালাবে, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী এবং উন্নতিতে পুলকিত বাংলাদেশ থেকে অত মানুষ পালাচ্ছে কেন? কারণ এখানে জীবিকার নিরাপত্তা নেই বলে; এবং মেয়েদের দুরবস্থা বলছে, এখানে নিরাপত্তা নেই জীবনেরও।

 

সিদ্ধান্তটা তো তাই অপরিহার্য। করণীয় হচ্ছে পুঁজিবাদকে বিদায় করা। কিন্তু সে কাজ তো একা কেউ করতে পারবে না, করতে গেলে কেবল হাতাশাই নয়, বিপদ বাড়বে। বিদায় করার জন্য দরকার হবে আন্দোলন এবং আন্দোলনের জন্য চাই রাজনৈতিক দল। শুধু দলেও কুলাবে না, শত্রুকে যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না হয় এবং সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করা না যায়। বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদী যুদ্ধটা শেষ হয়েছে, বাকি রয়েছে সমাজতন্ত্রের জনযুদ্ধ।

 

এই যুদ্ধটা যে সহজ হবে না, সেটা তো স্পষ্ট। জবরদস্ত পুঁজিবাদের দখলে অনেক অস্ত্র রয়েছে; খুবই শক্তিশালী একটি অস্ত্র হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়া পুঁজিবাদের নৃশংসতার খবর ছিটেফোঁটা দেয়, কিন্তু আসল খবর দেয় না; ঢেকে রাখে, বিভ্রান্ত করে এবং নানা কিসিমের রূপকথা তৈরির কারখানা চালু রাখে।

 

মিডিয়া রূপকথাকে খুব পছন্দ করে, কিন্তু রূপকথা তো নারকীয় বাস্তবতাকে অবলুপ্ত করতে পারবে না। তিন শিশুসহ এক মায়ের লাশ উদ্ধার। এই রাজধানীতেই। ধারণা করা হচ্ছে, মা নিজেই খুন করেছেন নিজের সন্তানদের, একের পর এক; তার পরে খুন করেছেন তিনি নিজেকে। মৃত মায়ের ভাই অবশ্য বলেছেন অসম্ভব, তাঁর বোন এ কাণ্ড করতে পারেন না, অন্যরাই ঘটিয়েছে; এটি একটি হত্যাকাণ্ড। যেভাবেই ঘটুক, হত্যা তো বটেই এবং তিনটি সন্তান নিয়ে মা যে চরম হতাশায় ভুগছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর স্বামীর একসময়ে ভালো আয় ছিল, প্রতারক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, মার খেয়েছেন; নিজে ব্যবসা করার চেষ্টা করেছেন, সফল হননি, সন্তানদের স্কুলের বেতন দিতে পারেন না, তাদের এমনকি ভালোমতো আহারও জোটে না; পারিবারিক বিরোধ আছে সম্পত্তি নিয়ে। কোথাও কোনো আলো ছিল না আশার। আর সব বোঝা গিয়ে চেপে বসেছিল বিপন্ন মেয়েটির ঘাড়ের ওপর। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন তিনি; এমএ পাস করেছেন, চাকরি খুঁজেছেন, পাননি। স্বামীর তবু বাইরে একটি জীবন ছিল, স্ত্রীর জীবন তিন কামরায়। জীবন তাঁর জন্য দুঃসহ এক যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

 

উন্নতির রূপকথার খবর চিৎকার করে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা এখন এমনই বিকট যে তাকে ঢেকে রাখার উপায় নেই। বাংলাদেশের মানুষের নরকবাসের আরো খবর আছে। ১. সাতক্ষীরায় দ্বিতীয় মেয়ে হওয়ায় বাবার হাতে নবজাতক খুন। ২. বরগুনায় যৌতুক না পেয়ে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যা। ৩. রৌমারীতে ক্লাসরুমে ঢুকে ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা। ৪. আড়াইহাজারে বিয়ের কথা বলে ছাত্রীকে ধর্ষণ। ৫. গাজীপুরে তিন সন্তানসহ নিখোঁজ প্রবাসীর স্ত্রী। ৬. ঢাকায় মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মায়ের সংবাদ সম্মেলন। পরের দিনের খবর : ১. রাজধানীতে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে দুজন গ্রেপ্তার। ২. শায়েস্তাগঞ্জে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে বিধবাকে পিটিয়ে হত্যা। ৩. কালিয়াকৈরে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণ। ৪. হবিগঞ্জে প্রকাশ্যে সড়কে ধর্ষণের পর পিটিয়ে হত্যা। প্রতিটি ঘটনাই ভয়াবহ। ‘উন্নতি’ অব্যাহত রয়েছে। এই উন্নতির অন্তর্গত কান্না বলছে, ব্যবস্থার বদল চাই।

 

হতাশা কাটবে না পরিবর্তনের আন্দোলন যদি জোরদার না হয়। একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ একেবারে মর্মগত। নর-নারীর সম্পর্কটা প্রাথমিক ও প্রয়োজনীয় সম্পর্কগুলোর একটি। বিয়েতে রয়েছে এই অত্যন্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কটার সামাজিক অনুমোদন। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একজন আমলা কলাম লিখেছেন পত্রিকায়। অবসরভাতা এসেছে হাতে। কিন্তু দেখছেন টাকাটা খরচ হয়ে যাবে। একটা খরচ আছে মেয়ের বিয়েতে। তাঁর স্ত্রী জানিয়েছেন মেয়েটা অনার্স দিয়েছে, এখন তো বিয়ে দিতে হয়। বিয়েতে টাকা খরচ হবে বলে ভদ্রলোক চিন্তিত। হায় তিনি জানেন না পাত্র খুঁজতে গিয়ে এবং পাত্র পাওয়ার পরে তাঁর জন্য কত প্রকারের বিপদাপদ অপেক্ষা করছে। জানতে পারলে চোখের ঘুম হারাম হয়ে যেত, যেমন বেশির ভাগ বাবারই হয়। উপযুক্ত পাত্র পাওয়া মেয়েদের জন্য আগেও কঠিন ছিল, এখন আরো কঠিন হয়েছে। বিয়ের পরে সংঘর্ষ বাধে; স্বামী তাঁর ক্ষমতা প্রকাশ করতে চান, স্ত্রী তাই নির্যাতিত হন। স্ত্রীরাও এখন আগের মতো ‘বশ্যতা’ মানতে চান না। ফলে শান্তি বিঘ্নিত হয়। আর আছে বিবাহবহির্ভূত প্রেম। এ ক্ষেত্রে পুরুষের তৎপরতাই অধিক মেয়েদের তুলনায়। কারণ পুরুষের ক্ষমতা বেশি। ক্ষমতা পেলে মেয়েরাও পিছিয়ে থাকে না, এগিয়ে আসে। পিতৃতান্ত্রিকতা কর্তা খোঁজে এবং খোঁজ পেলে কাছে টেনে নেয়। পরকীয়া অহরহ ঘটছে। এ নিয়ে খুনাখুনি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» আর কোনও স্বৈরাচারকে দেখতে চায় না দেশের মানুষ : আমান উল্লাহ

» জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে বাইপাস করলে রাজপথে যুদ্ধ হবে: মামুনুল হক

» জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রয়াত ২০ সদস্যকে স্মরণ

» প্রযুক্তির যুগে গুরুত্বপূর্ণ সঠিক তথ্যের আদানপ্রদান : উপদেষ্টা রিজওয়ানা

» জাতীয়ভাবে টাইফয়েড টিকাদান নিয়ে জরুরি ৫ প্রশ্নের উত্তর

» দেশের প্রতিটি মানুষ গাজার পাশে দাঁড়াতে আকুল: শায়খ আহমাদুল্লাহ

» দীর্ঘদিন পরে এবার সত্যিকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে: প্রেস সচিব

» সব উপদেষ্টাই তো বিদেশি নাগরিক: রুমিন ফারহানা

» বিএনপিকে চুপিসারে ক্ষমতায় আনতে চায় সরকার: রেজাউল করীম

» জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট ও সেখানে পিআর পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে: গোলাম পরওয়ার

উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা,

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

উন্নতির অন্তর্গত কান্না : ব্যবস্থার বদল চাই

ছবি সংগৃহীত

 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : একাত্তর সালটা বাংলাদেশে মেয়েদের জন্য ছিল চরম দুর্দশাপূর্ণ। পাকিস্তানি হানাদাররা হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে মেয়েদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। রাষ্ট্র তাদের লেলিয়ে দিয়েছিল। ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছিল যা ইচ্ছা তা-ই করার। তারা সেটা করেছেও।

 

রাষ্ট্রীয় সমর্থনে ক্ষমতাবান হয়ে হত্যা, অস্থাবর সম্পত্তি লুণ্ঠন এবং ধর্ষণ সমানে চালিয়েছে। এখন তো পাকিস্তান নেই, এখন তো আমরা স্বাধীন, বাঙালিই শাসন করছে বাঙালিকে। তাহলে এখন কেন মেয়েরা এভাবে নির্যাতিত হচ্ছে? পাচার হচ্ছে ভারতে, জীবিকার অন্বেষণে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে লাঞ্ছিত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে যেখানে-সেখানে, আত্মহত্যা করছে যখন-তখন, আটকা পড়ছে বাল্যবিবাহের ফাঁদে? কারণটা আমাদের অজানা নয়।

কারণ হচ্ছে পাকিস্তান বিদায় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো বিদায় হয়নি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফিরে আসার পাঁয়তারা করছে।

 

পাকিস্তানের প্রেতাত্মা এখনো আমাদের পিছু ছাড়েনি—এমন কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা মোটেই মিথ্যা কথা বলেন না। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই প্রেতাত্মাটাকে চিহ্নিত করে না। প্রেতাত্মাটা অন্য কিছু নয়, প্রেতাত্মাটা পুঁজিবাদ।

 

তাহলে উপায় কী? প্রতিবাদ? অবশ্যই। প্রতিবাদটা চলছে। বাল্যবিবাহে অসম্মত মেয়েরা কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করছে—এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিশোরী মেয়েরা বিয়ের আসর থেকে সহপাঠিনীকে উদ্ধার করছে, আমরা জানতে পাচ্ছি। খবরের কাগজেই বের হয়েছে এমন খবর যে মাগুরায় এক মা তাঁর মেয়েকে উত্ত্যক্তকারী যুবককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছেন।

 

কিন্তু তাতে তো ব্যবস্থাটা বদলায় না। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমেরিকায় বিক্ষোভ চলছে। আমেরিকার অরেগনে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে দুজন আমেরিকান নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের একজনের মা বলেছিলেন, তাঁর ছেলে বীর ছিলেন, মৃত্যুর পরেও বীর থাকবেন। মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলেছে, সে চেষ্টা চলবে, কিন্তু মনুষ্যত্ব নষ্ট হওয়ার নয়, হবেও না। তবে একলা একলা প্রতিবাদ করে যে কাজ হবে না, সেটা তো প্রমাণিত সত্য।

 

তাহলে কি পালাতে হবে? কিন্তু পালাবেন কোথায়? একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে মানুষকে পালাতে হয়েছিল, ফিরে এসে তারা দেখেছে এ কী, পাকিস্তান তো রয়েই গেছে! বদলটা শুধু নামেই। মানুষ এখনো পালাচ্ছে। ধনীরাও এরই মধ্যে বিদেশে বাড়িঘর তৈরি করেছেন, সময়মতো চলে যাবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দলীয় লোকদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে দল যদি ক্ষমতায় না থাকে, তাহলে টাকা-পয়সা নিয়ে পালানোর পথ পাওয়া যাবে না। এই সতর্কবাণীর দরকার ছিল কি? যারা পেরেছে, তারা তো তখনই ব্যবস্থা করেছে, অন্যরাও তৎপর ছিল। আর যাদের টাকা-পয়সার অভাব, দলের লোক নয়, সাধারণ মানুষ, তাদেরও একটা অংশ কিন্তু পালাচ্ছে। রিপোর্ট বলছে, নৌপথে ইউরোপে যারা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে, তাদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশিরা এখন শীর্ষস্থানে। হতভাগা এই মানুষরা অবশ্য টাকা পাচারের জন্য যায় না, টাকা উপার্জনের জন্যই যায়। কিন্তু যাচ্ছে তো। জীবন বাজি রেখে যাচ্ছে। ঝাঁপ দিচ্ছে সমুদ্রে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া থেকে মানুষ পালাবে, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী এবং উন্নতিতে পুলকিত বাংলাদেশ থেকে অত মানুষ পালাচ্ছে কেন? কারণ এখানে জীবিকার নিরাপত্তা নেই বলে; এবং মেয়েদের দুরবস্থা বলছে, এখানে নিরাপত্তা নেই জীবনেরও।

 

সিদ্ধান্তটা তো তাই অপরিহার্য। করণীয় হচ্ছে পুঁজিবাদকে বিদায় করা। কিন্তু সে কাজ তো একা কেউ করতে পারবে না, করতে গেলে কেবল হাতাশাই নয়, বিপদ বাড়বে। বিদায় করার জন্য দরকার হবে আন্দোলন এবং আন্দোলনের জন্য চাই রাজনৈতিক দল। শুধু দলেও কুলাবে না, শত্রুকে যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না হয় এবং সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করা না যায়। বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদী যুদ্ধটা শেষ হয়েছে, বাকি রয়েছে সমাজতন্ত্রের জনযুদ্ধ।

 

এই যুদ্ধটা যে সহজ হবে না, সেটা তো স্পষ্ট। জবরদস্ত পুঁজিবাদের দখলে অনেক অস্ত্র রয়েছে; খুবই শক্তিশালী একটি অস্ত্র হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়া পুঁজিবাদের নৃশংসতার খবর ছিটেফোঁটা দেয়, কিন্তু আসল খবর দেয় না; ঢেকে রাখে, বিভ্রান্ত করে এবং নানা কিসিমের রূপকথা তৈরির কারখানা চালু রাখে।

 

মিডিয়া রূপকথাকে খুব পছন্দ করে, কিন্তু রূপকথা তো নারকীয় বাস্তবতাকে অবলুপ্ত করতে পারবে না। তিন শিশুসহ এক মায়ের লাশ উদ্ধার। এই রাজধানীতেই। ধারণা করা হচ্ছে, মা নিজেই খুন করেছেন নিজের সন্তানদের, একের পর এক; তার পরে খুন করেছেন তিনি নিজেকে। মৃত মায়ের ভাই অবশ্য বলেছেন অসম্ভব, তাঁর বোন এ কাণ্ড করতে পারেন না, অন্যরাই ঘটিয়েছে; এটি একটি হত্যাকাণ্ড। যেভাবেই ঘটুক, হত্যা তো বটেই এবং তিনটি সন্তান নিয়ে মা যে চরম হতাশায় ভুগছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর স্বামীর একসময়ে ভালো আয় ছিল, প্রতারক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, মার খেয়েছেন; নিজে ব্যবসা করার চেষ্টা করেছেন, সফল হননি, সন্তানদের স্কুলের বেতন দিতে পারেন না, তাদের এমনকি ভালোমতো আহারও জোটে না; পারিবারিক বিরোধ আছে সম্পত্তি নিয়ে। কোথাও কোনো আলো ছিল না আশার। আর সব বোঝা গিয়ে চেপে বসেছিল বিপন্ন মেয়েটির ঘাড়ের ওপর। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন তিনি; এমএ পাস করেছেন, চাকরি খুঁজেছেন, পাননি। স্বামীর তবু বাইরে একটি জীবন ছিল, স্ত্রীর জীবন তিন কামরায়। জীবন তাঁর জন্য দুঃসহ এক যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

 

উন্নতির রূপকথার খবর চিৎকার করে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা এখন এমনই বিকট যে তাকে ঢেকে রাখার উপায় নেই। বাংলাদেশের মানুষের নরকবাসের আরো খবর আছে। ১. সাতক্ষীরায় দ্বিতীয় মেয়ে হওয়ায় বাবার হাতে নবজাতক খুন। ২. বরগুনায় যৌতুক না পেয়ে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যা। ৩. রৌমারীতে ক্লাসরুমে ঢুকে ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা। ৪. আড়াইহাজারে বিয়ের কথা বলে ছাত্রীকে ধর্ষণ। ৫. গাজীপুরে তিন সন্তানসহ নিখোঁজ প্রবাসীর স্ত্রী। ৬. ঢাকায় মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মায়ের সংবাদ সম্মেলন। পরের দিনের খবর : ১. রাজধানীতে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে দুজন গ্রেপ্তার। ২. শায়েস্তাগঞ্জে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে বিধবাকে পিটিয়ে হত্যা। ৩. কালিয়াকৈরে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণ। ৪. হবিগঞ্জে প্রকাশ্যে সড়কে ধর্ষণের পর পিটিয়ে হত্যা। প্রতিটি ঘটনাই ভয়াবহ। ‘উন্নতি’ অব্যাহত রয়েছে। এই উন্নতির অন্তর্গত কান্না বলছে, ব্যবস্থার বদল চাই।

 

হতাশা কাটবে না পরিবর্তনের আন্দোলন যদি জোরদার না হয়। একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ একেবারে মর্মগত। নর-নারীর সম্পর্কটা প্রাথমিক ও প্রয়োজনীয় সম্পর্কগুলোর একটি। বিয়েতে রয়েছে এই অত্যন্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কটার সামাজিক অনুমোদন। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত একজন আমলা কলাম লিখেছেন পত্রিকায়। অবসরভাতা এসেছে হাতে। কিন্তু দেখছেন টাকাটা খরচ হয়ে যাবে। একটা খরচ আছে মেয়ের বিয়েতে। তাঁর স্ত্রী জানিয়েছেন মেয়েটা অনার্স দিয়েছে, এখন তো বিয়ে দিতে হয়। বিয়েতে টাকা খরচ হবে বলে ভদ্রলোক চিন্তিত। হায় তিনি জানেন না পাত্র খুঁজতে গিয়ে এবং পাত্র পাওয়ার পরে তাঁর জন্য কত প্রকারের বিপদাপদ অপেক্ষা করছে। জানতে পারলে চোখের ঘুম হারাম হয়ে যেত, যেমন বেশির ভাগ বাবারই হয়। উপযুক্ত পাত্র পাওয়া মেয়েদের জন্য আগেও কঠিন ছিল, এখন আরো কঠিন হয়েছে। বিয়ের পরে সংঘর্ষ বাধে; স্বামী তাঁর ক্ষমতা প্রকাশ করতে চান, স্ত্রী তাই নির্যাতিত হন। স্ত্রীরাও এখন আগের মতো ‘বশ্যতা’ মানতে চান না। ফলে শান্তি বিঘ্নিত হয়। আর আছে বিবাহবহির্ভূত প্রেম। এ ক্ষেত্রে পুরুষের তৎপরতাই অধিক মেয়েদের তুলনায়। কারণ পুরুষের ক্ষমতা বেশি। ক্ষমতা পেলে মেয়েরাও পিছিয়ে থাকে না, এগিয়ে আসে। পিতৃতান্ত্রিকতা কর্তা খোঁজে এবং খোঁজ পেলে কাছে টেনে নেয়। পরকীয়া অহরহ ঘটছে। এ নিয়ে খুনাখুনি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা,

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com