সংগৃহীত ছবি
কলম্বিয়ায় বেড়াতে গিয়ে বিদেশি পর্যটকরা পড়ছেন ভয়াবহ এক মাদকের ফাঁদে। ‘ডেভিল’স ব্রেথ’ নামের এই মাদক ব্যবহারে তারা হয়ে পড়ছেন ‘জম্বি’-র মতো। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অপরাধীদের ইচ্ছেমতো কাজ করে যাচ্ছেন। ডেটিং অ্যাপে প্রলোভন দেখিয়ে, পানীয়তে বিষ মিশিয়ে পর্যটকদের টার্গেট করছে অপরাধচক্র। কেউ হচ্ছেন লুটের শিকার, কেউবা খুন হয়ে ফিরছেন সুটকেসবন্দি মরদেহ হয়ে।
স্কোপোলামিন নামের এই মাদকটি বোচ্চেরো গাছের বীজ থেকে তৈরি এবং অতীতে সিআইএ একে সত্য উদ্ঘাটনের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করত।
মাত্র ১০ মিলিগ্রাম গ্রহণেই এটি মানুষকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলে এবং ‘জম্বি’র মতো অবস্থায় পড়ে। এ সময় সে অপরাধীদের নির্দেশে সহজেই কাজ করে ফেলে। সচেতনতা হারিয়ে ফেলে নিজের কাজের ওপর।
গ্যাংয়ের সদস্যরা ডেটিং অ্যাপ (যেমন টিন্ডার বা গ্রিন্ডার)-এ প্রলোভনমূলক বার্তা পাঠিয়ে পর্যটকদের ফাঁদে ফেলে। এরপর তারা পর্যটকদের নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে পানীয়, চুইংগাম বা সিগারেটের মাধ্যমে স্কোপোলামিন প্রয়োগ করে। মাদকটি রঙহীন ও গন্ধহীন, ফলে সহজে ধরা পড়ে না।
কিছু ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম সুচ ব্যবহার করেও ইনজেকশনের মাধ্যমে এটি শরীরে প্রবেশ করানো হয়—যার কোনো দাগ বা চিহ্ন থাকে না।
মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই ভুক্তভোগী হ্যালুসিনেশন, অস্থিরতা ও শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারান। এই অবস্থায় অপরাধীরা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খালি করে, গয়না লুটে নেয়, এমনকি বাড়ি থেকেও জিনিসপত্র চুরি করে পালিয়ে যায়।
বারানকুইলার বিষক্রিয়া বিশেষজ্ঞ অ্যাগুস্তিন গুয়েরেরো সালসেডো, যিনি ৪০ বছর ধরে বিষক্রিয়া চিকিৎসায় নিয়োজিত, তিনি জানান—ভুক্তভোগীরা যদি প্রতিরোধ করেন, অনেক সময় মাথায় আঘাত করে তাদের হত্যা করা হয়।
২০১৯ সালের একটি ঘটনায় নিহত হন আলেসান্দ্রো কোয়াত্তি নামে এক ৩৮ বছর বয়সী ইতালীয় বিজ্ঞানী। তিনি বেড়াতে গিয়ে সান্তা মার্তা শহর থেকে নিখোঁজ হন। পুলিশের ধারণা, গ্রিন্ডার-এ ফাঁদে পড়ে তিনি সান হোসে দেল প্যানডো এলাকায় একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে গিয়েছিলেন।
ময়নাতদন্তে দেখা যায়, মাথায় আঘাতে তার মৃত্যু হয়, পরে মরদেহ কেটে সুটকেসে ভরে শহরের বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়, মাফিয়া সংঘর্ষের নাটক সাজিয়ে তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছিল।
২০১২ সালে একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ফার্নান্দো নামে ৬৪ বছর বয়সী এক ব্রিটিশ নাগরিকের। ব্যবসায়িক সফরে বোগোটা গিয়ে এক রাতে বার থেকে হোটেলে ফেরার পর তার কাছ থেকে ১,০০০ ইউরো লুট হয়।
তিনি বলেন, “এই মাদক মানুষকে হিপনোটাইজ করে ফেলে। অপরাধীরা যা বলে তাই করতে বাধ্য হন। পরদিন অফিসে গেলে সহকর্মীরা বলেন আপনি অস্বাভাবিক ছিলেন। পরে টেস্ট করে দেখা যায় আমি ড্রাগড হয়েছিলাম।’’
স্কোপোলামিনের ঝুঁকি এতটাই বেড়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ২০২৩ সালের জুনে কলম্বিয়ায় ভ্রমণরত মার্কিন নাগরিকদের জন্য বিশেষ সতর্কতা জারি করে।
শুধু মেডেলিন শহরেই ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে বিদেশি পর্যটকদের বিরুদ্ধে চুরির হার বেড়েছে ২০০ শতাংশ।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৮ জন মার্কিন নাগরিক স্কোপোলামিনের প্রভাবে মারা যান বা হত্যার শিকার হন, বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস।
যুক্তরাজ্যেও এই মাদক ব্যবহার করে খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে ডায়ানা ক্রিস্টিয়া ও তার প্রেমিক জোয়েল ওসেই ডেটিং এপ ব্যবহার করে আইরিশ নৃত্যশিল্পী আদ্রিয়ান মারফিকে হত্যা করে। তারা পরে আরও একজনকে বিষ খাইয়ে হাসপাতালে পাঠায়। ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্রিস্টিয়াকে ১৬ বছরের কারাদণ্ড ও যাবজ্জীবন, এবং ওসেইকে কমপক্ষে ৩২ বছরের জন্য যাবজ্জীবন দেওয়া হয়।
স্কোপোলামিন কীভাবে কাজ করে
ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্ট লন্ডনের বিষবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর কামিয়ার আফারিনকিয়া বলেন, “দ্বিতীয় বর্ষের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রও বোচ্চেরো গাছ থেকে ৯০ শতাংশ বিশুদ্ধ স্কোপোলামিন তৈরি করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই মাদক স্প্রে করলেও রক্তে মিশে যেতে পারে। আঙুলে মাখানো বিজনেস কার্ড, ফলজুসে মেশানো বা গ্রেপফ্রুট জুসের মাধ্যমে প্রয়োগে এটি দ্রুত কাজ করে।”
“স্কোপোলামিন মস্তিষ্ককে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, স্মৃতিশক্তি মুছে দেয় এবং মানুষ অপরাধীর নির্দেশ মেনে চলে। এমনকি নিজের গোপন তথ্যও বলে দেয়,” বলেন তিনি।
ডা. সারাহ ককবিল, একজন অবসরপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট ও বিষবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, জানান, “এই মাদক বেশি মাত্রায় গ্রহণ করলে মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।” সূত্র: দ্যা টেলিগ্রাফ