চাকরিজীবী বা বেতনভুক্ত কর্মচারীর জন্য দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে নির্ধারিত ফি এর চেয়ে অতিরিক্ত কিছু গ্রাহকের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া জায়েজ নেই। ইসলামে এটি ঘুষের অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে এ বিষয়ে কঠিন সতর্কতা রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে একজন কর্মচারী কিছু মাল এনে বলল, এটা আপনাদের (সরকারি) মাল, আর এটা আমাকে দেওয়া হাদিয়া। রাসুলুল্লাহ (স.) এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, সে তার বাবা-মার ঘরে বসে থাকল না কেন, তখন সে দেখতে পেত- তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি-না? (সহিহ বুখারি: ২৪২৫)
ওই কর্মচারীর কথা শোনার পর নবীজি (স.) ভাষণে বলেন, যার হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্তার কসম, সাদকার মাল থেকে সামান্য পরিমানও যে আত্মসাৎ করবে, সে তা কাঁধে করে কেয়ামতের দিন হাজির হবে। সে মাল যদি উট হয় তাহলে তা তার আওয়াজে, আর যদি গাভী হয় তাহলে হাম্বা হাম্বা রবে আর বকরি হলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ রবে (আওয়াজ করতে থাকবে)। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর দু’হাত এতটুকু উত্তোলন করলেন যে, আমরা তাঁর উভয় বগলের শুভ্রতা দেখতে পেলাম। তিনি তিনবার বললেন, হে আল্লাহ আমি কি পৌঁছে দিয়েছি; হে আল্লাহ আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? (সহিহ বুখারি: ২৪২৫)
তাই বকশিশ চাওয়া যাবে না। যদি চাওয়া ছাড়া এমনিতে সার্ভিসে খুশি হয়ে কেউ কিছু হাদিয়া দেয়, তাহলে সেটা গ্রহণ জায়েজ, তা-ও গ্রহণ না করাটাই উত্তম। অন্যদিকে চাওয়া বা চাওয়ার পরিবেশ তৈরি করে পাওয়া পুরোটাই ঘুষের হুকুমে নাজায়েজ হবে। আবু হুররাহ আর রক্কাশি (রহ) তাঁর চাচা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, কারো মাল তার মনোতুষ্টি ছাড়া গ্রহণ করা কারো জন্য হালাল নয়। (মুসনাদে আবু ইয়ালা মুসিলি: ১৫৭০, দারা কুতনি: ২৮৮৬, সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি: ১১৫৪৫, শুয়াবুল ঈমান লিলবায়হাকি: ৫৪৯২, মেশকাত: ২৯৪৬)
আমরা জানি, ঘুষ দেওয়া-নেওয়া সর্বসম্মতিক্রমে হারাম বা নিষিদ্ধ। কিন্তু বকশিশ কোন পর্যায়ের হলে ঘুষ হয়ে যায়, তা অনেকে জানেন না। তাই দেখা যায়, বেতনভুক্ত হয়েও বাড়তি অর্থ গ্রহণ করা, একইভাবে সুবিধা আদায়ের জন্য উৎকোচ দেওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। অথচ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)
নবীজি (স.) বলেছেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামি।’ (মু’জামুল আউসাত: ২০২৬) হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায়, সে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আগমন করবে যে তার মুখমণ্ডলে এক টুকরা গোশতও থাকবে না। ’ (বুখারি: ১৪৭৪)
ঘুষগ্রহণের ফলে ইবাদত, দোয়া কবুল হয় না। একবার রাসুল (স.)-এর কাছে একটি আয়াত তেলাওয়াত করা হলো, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ করো।’ তখন সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন আমার দোয়া কবুল হয়। রাসুল (স.) বলেন, হে সাআদ, তোমার পানাহারকে হালাল করো, তবেই তোমার দোয়া কবুল হবে। (আল মুজামুল আউসাত: ৬৪৯৫)
রাষ্ট্র জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স বসিয়ে টাকা আদায় করে জনগণেরই খেদমত করার জন্য বেতন দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে। এসব বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর ওয়াজিব হলো, যে কাজের জন্য তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে, সে কাজ করে দেওয়া। এর বিনিময়ে জনগণের কাছ থেকে বাড়তি কিছু গ্রহণ করার অধিকার তার নেই। ওই বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি তাদের নিজ নিজ এলাকায় জনগণের কাছ থেকে উপহার নেয়, জনগণের বাড়িতে দাওয়াত খায়, জনগণের কাছ থেকে কোনো হাদিয়া, তোহফা গ্রহণ করে বা তাদের ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর জন্য মিষ্টি বা নাশতা খাবার গ্রহণ করে, তবে তার সবই ঘুষ হবে। হারাম হবে। আমানতের খেয়ানত হবে। গুনাহে কবিরা হবে।’ (বেহেশতি জেওর-পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০৮)
নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে দেহের গোশত হারাম উপার্জনে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম ধন-সম্পদে গঠিত ও লালিত পালিত দেহের জন্য জাহান্নামই উপযোগী। (মেশকাত: ২৭৭২; আহমদ: ১৪৪১, শুয়াবুল ঈমান: ৮৯৭২)
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হারাম অর্থ উপার্জন থেকে রক্ষা করুন। হাদিয়ার নামে ঘুষ নেওয়া-দেওয়া থেকে আমাদের হেফাজত করুন। আমিন। সূএ:ঢাকা মেইল ডটকম