বাড়ছে বৈষম্য ও দারিদ্র্য

সংগৃহীত ছবি

 

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন প্রতিবেদন, ২০২৫’-এ বাংলাদেশের দারিদ্র্যপ্রবণতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতি কিভাবে বিস্তার লাভ করছে এবং সমাজকে প্রভাবিত করছে, তার উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। চার বছর ধরেই বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, যা এ বছর শেষের দিকে ২১.২ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

বর্তমানে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তিন কোটি ৬০ লাখ। আরো ছয় কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থান করছে, যারা সামান্য অভিঘাতেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং কর্মসংস্থানের অভাব। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ২০ লাখ কম কর্মসংস্থান হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার মান সাংঘাতিকভাবে নিম্নমুখী হয়েছে। একই সঙ্গে কর্মোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে একজন শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে গিয়ে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। যাঁরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন, তাঁরা কার্যত অহমিকাপূর্ণ বেকারে পরিণত হচ্ছেন। কারিগরি প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবে কর্মসংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে মাঝ পর্যায়ের দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

দারিদ্র্যের নানা রূপ রয়েছে। অনেকেই কর্মসংস্থান হারিয়ে পরিবার চালানোর জন্য ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছেন। সার্বিকভাবে উৎপাদনশীল সেক্টরকে গতিশীল করার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য উৎপাদনশীল খাতে গতি বৃিদ্ধর কোনো বিকল্প নেই। দেশে ব্যাপক হারে কলকারখানা স্থাপিত হলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের উৎপাদন খাত মন্থর হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নানা সামাজিক অস্থিতিশীলতার কারণে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধান্বিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.২৯ শতাংশ। এটি বিগত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রেও মন্দা লক্ষ করা যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, একটি পরিবারের আর্থিক দুর্দশা রোধ করতে হলে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আগেকার দিনে একটি পরিবারের একজন মাত্র সদস্যের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে পুরো পরিবার তার উপার্জনের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। এখন আর্থিক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পরিবারের একজন সদস্যের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে অন্যদের টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পরিবারের একাধিক সদস্যের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

যেসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে, সেখানেও উপযুক্ত মজুরি বা বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক পরিবারই নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে যেসব সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে দরিদ্র পরিবারের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই বিত্তবান পরিবারগুলো সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা ভোগ করছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ৩৫ শতাংশ সুবিধাভোগী হচ্ছে বিত্তবান পরিবার। মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, তারা কর্মমুখী জনপদ বা অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টন করা সম্ভব হয়নি। ফলে উন্নয়নের সুফল সামান্য কিছু বিত্তবান পরিবারের হাতে চলে গেছে। এতে ধনী-দরিদ্রের মাঝে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধান আরো বেড়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মানুষের মাঝে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষা দেওয়া। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শীর্ষক পোস্টারের কথা নিশ্চয় অনেকেরই মনে থাকার কথা। সেই পোস্টারে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে আমরা ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। এখন ২২ হাজার পরিবারের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে বিদ্যমান আয়বৈষম্য ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে দেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয় শহর থেকে গ্রামে। ফলে বিত্তবান ও বিত্তহীনের মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে দ্রুতগতিতে। আওয়ামী লীগ দুর্নীতিতে কতটা সিদ্ধহস্ত, তা বিগত ১৬ বছরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকারের জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। ফলে তারা দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তাহলে যাঁরা একটু ওপরের পর্যায়ে ছিলেন, তাঁরা কী পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন, তা সহজেই বোধগম্য। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে বিগত সরকারের আমলে নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা বিস্ময়কর। দেশের বাইরে একজন প্রতিমন্ত্রীর তিন শতাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। মন্ত্রীরা দেশের বাইরে বাড়ি ও ফ্ল্যাট ক্রয় করলেও দেশে বাস্তুচ্যুৎ মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালের পর থেকে প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে ধনীরা। ফলে দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। বাংলাদেশে সম্পদের অভাব নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের সুবর্ণ সময়ে অবস্থান করছে। প্রায় ২০ বছর ধরে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বয়স যখন ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ কর্মক্ষম সীমার মাঝে থাকে, সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে অনুকূল বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একবারই সৃষ্টি হয়। আবার কারো কারো মতে, হাজার বছরে একবার এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়।

যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে না, তারা উন্নয়নের শিখরে উঠতে পারে না। চীনে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেছে। তারা এর সুযোগ পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে জাপান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা থেকে দূরে সরে আসার কারণে তার উন্নয়নের গতি কিছুটা হলেও মন্থর হয়ে পড়েছে। জাপান ৪৪ বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। চীন সম্প্রতি জাপানের সেই অবস্থানকে অতিক্রম করে বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এরই মধ্যে বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। অর্থাৎ আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ হারাতে চলেছি।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন এবং বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে উৎপাদিত সম্পদের সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবার মাঝে বণ্টনের ব্যবস্থাকরণে ব্যর্থতা। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাঁরাই মনে করেন দেশটি তাঁদের নিজস্ব সম্পত্তি। অর্জিত সুফল ভোগ করার জন্য তাঁরাই একমাত্র দাবিদার।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ এক নতুন যুগে পদার্পণ করেছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার মাধ্যমে দেশে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবদরদি সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। ভবিষ্যতে যাঁরা সরকার গঠন করবেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে জনগণ যদি বিরূপ হয়, তাহলে মহাশক্তিধর সরকারও ব্যর্থ হতে পারে।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এটি বলা যায় যে অন্তর্বর্তী সরকার দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য দূরীকরণের তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তাই ভবিষ্যতে যাঁরা সরকার গঠন করবেন, তাঁদের দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য নিরসনের ইস্যুটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন হবে দ্রুত একটি গণমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, যার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে দারিদ্র্য হ্রাস পেতে পারে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।

সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» তবে কি গোপনেই বিয়ে সারলেন অভিনেত্রী সামান্থা?

» ছিনতাই চক্রের দুই সদস্য গ্রেপ্তার

» প্লাস্টিক ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনকে অভিযান চালাতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

» ডিআরইউর সভাপতি আবু সালেহ আকন, সম্পাদক মাইনুল হাসান

» নির্বাচিত সরকার যারা চায় না, তারেক রহমান তাদের জন্য বড় বাধা

» মানিকগঞ্জের জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে আগুন

» শেখ হাসিনা-রেহানা-টিউলিপ যেখানেই থাকুন বিচারে বাধা নেই: আদালত

» ‘অপপ্রচারকারী ভুঁইফোড় পেজের বিরুদ্ধে মামলা করব’: ভিপি সাদিক কায়েম

» শ্রীলঙ্কায় ঘূর্ণিঝড় ডিটওয়াহর ক্ষয়ক্ষতিতে প্রধান উপদেষ্টার শোক

» বিএনপিতে যোগ দিয়ে যা বললেন রেজা কিবরিয়া

 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বাড়ছে বৈষম্য ও দারিদ্র্য

সংগৃহীত ছবি

 

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন প্রতিবেদন, ২০২৫’-এ বাংলাদেশের দারিদ্র্যপ্রবণতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতি কিভাবে বিস্তার লাভ করছে এবং সমাজকে প্রভাবিত করছে, তার উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। চার বছর ধরেই বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটেছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, যা এ বছর শেষের দিকে ২১.২ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

বর্তমানে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তিন কোটি ৬০ লাখ। আরো ছয় কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থান করছে, যারা সামান্য অভিঘাতেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং কর্মসংস্থানের অভাব। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ২০ লাখ কম কর্মসংস্থান হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার মান সাংঘাতিকভাবে নিম্নমুখী হয়েছে। একই সঙ্গে কর্মোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে একজন শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে গিয়ে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। যাঁরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন, তাঁরা কার্যত অহমিকাপূর্ণ বেকারে পরিণত হচ্ছেন। কারিগরি প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবে কর্মসংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে মাঝ পর্যায়ের দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।

দারিদ্র্যের নানা রূপ রয়েছে। অনেকেই কর্মসংস্থান হারিয়ে পরিবার চালানোর জন্য ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছেন। সার্বিকভাবে উৎপাদনশীল সেক্টরকে গতিশীল করার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য উৎপাদনশীল খাতে গতি বৃিদ্ধর কোনো বিকল্প নেই। দেশে ব্যাপক হারে কলকারখানা স্থাপিত হলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের উৎপাদন খাত মন্থর হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নানা সামাজিক অস্থিতিশীলতার কারণে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধান্বিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬.২৯ শতাংশ। এটি বিগত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রেও মন্দা লক্ষ করা যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, একটি পরিবারের আর্থিক দুর্দশা রোধ করতে হলে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আগেকার দিনে একটি পরিবারের একজন মাত্র সদস্যের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে পুরো পরিবার তার উপার্জনের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। এখন আর্থিক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পরিবারের একজন সদস্যের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে অন্যদের টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পরিবারের একাধিক সদস্যের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

যেসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে, সেখানেও উপযুক্ত মজুরি বা বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক পরিবারই নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিগত সরকারের আমলে যেসব সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে দরিদ্র পরিবারের পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই বিত্তবান পরিবারগুলো সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা ভোগ করছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ৩৫ শতাংশ সুবিধাভোগী হচ্ছে বিত্তবান পরিবার। মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, তারা কর্মমুখী জনপদ বা অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টন করা সম্ভব হয়নি। ফলে উন্নয়নের সুফল সামান্য কিছু বিত্তবান পরিবারের হাতে চলে গেছে। এতে ধনী-দরিদ্রের মাঝে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধান আরো বেড়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মানুষের মাঝে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষা দেওয়া। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শীর্ষক পোস্টারের কথা নিশ্চয় অনেকেরই মনে থাকার কথা। সেই পোস্টারে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে আমরা ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। এখন ২২ হাজার পরিবারের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে বিদ্যমান আয়বৈষম্য ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে দেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হয় শহর থেকে গ্রামে। ফলে বিত্তবান ও বিত্তহীনের মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে দ্রুতগতিতে। আওয়ামী লীগ দুর্নীতিতে কতটা সিদ্ধহস্ত, তা বিগত ১৬ বছরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকারের জনগণের কাছে কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। ফলে তারা দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। তাহলে যাঁরা একটু ওপরের পর্যায়ে ছিলেন, তাঁরা কী পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন, তা সহজেই বোধগম্য। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে বিগত সরকারের আমলে নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা বিস্ময়কর। দেশের বাইরে একজন প্রতিমন্ত্রীর তিন শতাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। মন্ত্রীরা দেশের বাইরে বাড়ি ও ফ্ল্যাট ক্রয় করলেও দেশে বাস্তুচ্যুৎ মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালের পর থেকে প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে ধনীরা। ফলে দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। বাংলাদেশে সম্পদের অভাব নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের সুবর্ণ সময়ে অবস্থান করছে। প্রায় ২০ বছর ধরে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বয়স যখন ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ কর্মক্ষম সীমার মাঝে থাকে, সেই অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে অনুকূল বলে বিবেচনা করা হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একবারই সৃষ্টি হয়। আবার কারো কারো মতে, হাজার বছরে একবার এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়।

যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে না, তারা উন্নয়নের শিখরে উঠতে পারে না। চীনে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেছে। তারা এর সুযোগ পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে জাপান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা থেকে দূরে সরে আসার কারণে তার উন্নয়নের গতি কিছুটা হলেও মন্থর হয়ে পড়েছে। জাপান ৪৪ বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। চীন সম্প্রতি জাপানের সেই অবস্থানকে অতিক্রম করে বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এরই মধ্যে বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। অর্থাৎ আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ হারাতে চলেছি।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন এবং বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে উৎপাদিত সম্পদের সুফল ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবার মাঝে বণ্টনের ব্যবস্থাকরণে ব্যর্থতা। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাঁরাই মনে করেন দেশটি তাঁদের নিজস্ব সম্পত্তি। অর্জিত সুফল ভোগ করার জন্য তাঁরাই একমাত্র দাবিদার।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ এক নতুন যুগে পদার্পণ করেছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার মাধ্যমে দেশে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবদরদি সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। ভবিষ্যতে যাঁরা সরকার গঠন করবেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে জনগণ যদি বিরূপ হয়, তাহলে মহাশক্তিধর সরকারও ব্যর্থ হতে পারে।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এটি বলা যায় যে অন্তর্বর্তী সরকার দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য দূরীকরণের তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তাই ভবিষ্যতে যাঁরা সরকার গঠন করবেন, তাঁদের দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য নিরসনের ইস্যুটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন হবে দ্রুত একটি গণমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, যার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে দারিদ্র্য হ্রাস পেতে পারে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।

সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



 

সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,

ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,

নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন: ই-মেইল : [email protected],

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com