শবে বরাতে হালুয়া রুটি খাওয়া কি জায়েজ?

সংগৃহীত ছবি

 

ধর্ম ডেস্ক :শবে বরাত একটি মর্যাদাপূর্ণ রাত। ১৪ শাবান দিবাগত রাত তথা ১৫ শাবানের রাতকে হাদিসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়। যা আমাদের সমাজে শবে বরাত হিসেবে পরিচিত। ‘শবে বরাত’ মূলত ফারসি শব্দ। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। এই দুই শব্দ মিলে অর্থ হয় মুক্তির রজনী। একাধিক সহিহ হাদিসে এ রাতের মর্যাদা প্রমাণিত।

 

বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)

ইসলামি শরিয়তে শবে বরাতের সঙ্গে হালুয়া রুটির সম্পর্ক নেই। নিয়মিত হালুয়া রুটি খাওয়ার অভ্যাস কারো থাকলে, তিনি শবে বরাতেও খেতে পারবেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। একইভাবে শবে বরাতের বিশেষ আমল মনে না করলে বা মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা সৃষ্টির সম্ভাবনা না থাকলে শবে বরাতে হালুয়া রুটি খাওয়া এবং মানুষকেও খাওয়ানো কোনোটাই নাজায়েজ নয়।

 

সমস্যা হলো- হালুয়া-রুটি বানানো, খাওয়া ও বিরতরণকে শবে বরাতের জরুরি বা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ আমল মনে করা। সেরকমটা করলে তা বিদআত গণ্য হবে। কেননা এধরনের কাজ শবে বরাতের বিশেষ কোনো আমল নয়।

 

এরপরও আলেমরা এ ধরনের যেকোনো বিষয় নিয়ে বাড়তি সতর্ক থাকতে বলেন, যেন পরবর্তী প্রজন্ম বড়দের দেখাদেখি কোনোকিছুকে রসমে পরিণত করতে না পারে। মূলত শয়তান উঁৎ পেতে থাকে মুসলিম সমাজে বিদআত ছড়িয়ে দিতে। প্রসিদ্ধ তাবেয়ি সুফিয়ান সাওরি (রহ) বলেন- ‘ইবলিসের নিকট নাফরমানির চেয়েও বিদআত বেশি প্রিয়। কারণ নাফরমানি থেকে তাওবা করার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু বিদআত থেকে তাওবা করার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।’ (শাতিবি, আলইতিসাম: ১/১১; ইমাম সুয়ুতি, আলআমরু বিল ইত্তিবা পৃ-১৯)

 

শবে বরাত নিয়ে কাউকে বলতে শোনা যায়, ‘শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বানালে আরশের নিচে ছায়া পাওয়া যাবে।’ অথচ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর হাদিসের সঙ্গে এর দূরতম সম্পর্ক নেই। আবার কাউকে বলতে শোনা যায়, ওহুদ যুদ্ধে নবীজির দানদান মোবারক শহীদ হওয়ায় কিছুদিন তিনি শক্ত খাবার খেতে পারেননি—সেই ঘটনার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এই দিনে ঘটা করে হালুয়া রুটি খাওয়া হয়। অথচ ওহুদ যুদ্ধ হয়েছিল শাওয়ালের ৭ তারিখে, শাবান মাসের ১৫ তারিখের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

 

সবচেয়ে বড় কথা হলো- নবীজি কিংবা সাহাবিদের যুগে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে হালুয়া রুটি খাওয়া বা প্রতিবেশিদের মাঝে বিলানোর প্রচলন ছিলো বলে হাদিসে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ১৯ শতকের শেষের দিকে এসবের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় বলে ইতিহাস বিশ্লেষকরা মনে করেন।

 

মুসল্লিদের উচিত হাদিসে এ রাতের যতটুকু ফজিলত প্রমাণিত, শুধু ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকা। নবী-সাহাবিদের যুগে প্রচলন ছিলো না—এমন কোনও রসম-রেওয়াজের পিছে না পড়ে মূল ইবাদতের দিকে মনোনিবেশ করে শবে বরাতের ফজিলত লাভ করা।

 

আসলে শবে বরাত নিয়ে এতদঞ্চলের মানুষের মধ্যে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি দুটোই রয়েছে। বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে কেউ সুন্নত অনুযায়ী ইবাদতের পরিবর্তে বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আবার কেউ শবে বরাতকে অতি সাধারণ একটি রাত ভেবে ইবাদত থেকেই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। মূলত কোনোটাই উচিত নয়।

 

আল্লাহ তাআলা আমাদের যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে হেফাজত করুন। মর্যাদাপূর্ণ রাত সুন্নত অনুযায়ী অতিবাহিত করার তাওফিক দান করুন। প্রত্যেক বিষয়ে কোরআন সুন্নাহর নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» যাত্রীবাহী বাসের চাপায় অটোচালকসহ দুজন নিহত

» আবারও রেকর্ড গড়েছে স্বর্ণের দাম

» পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার

» টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ডাবল সেঞ্চুরি

» ছেলের বন্ধুরা আমাকে ‘দিদি’ বলে ডাকে: শ্রাবন্তী

» কিছু আসনের লোভে জাতীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে কেউ পিআর চাইছে: সালাহউদ্দিন

» গাজায় গণহত্যা চলছে, দায়ী ইসরায়েল: জাতিসংঘ তদন্ত কমিশন

» বিশেষ অভিযানে মামলা ও ওয়ারেন্টভুক্ত আরও ১১২৬ জন আসামি গ্রেফতার

» ফখরুল-আব্বাসসহ ৬৭ জনকে অব্যাহতি দিলো আদালত

» জামায়াতের আন্দোলন সরকারবিরোধী না : ব্যারিস্টার ফুয়াদ

  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

শবে বরাতে হালুয়া রুটি খাওয়া কি জায়েজ?

সংগৃহীত ছবি

 

ধর্ম ডেস্ক :শবে বরাত একটি মর্যাদাপূর্ণ রাত। ১৪ শাবান দিবাগত রাত তথা ১৫ শাবানের রাতকে হাদিসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়। যা আমাদের সমাজে শবে বরাত হিসেবে পরিচিত। ‘শবে বরাত’ মূলত ফারসি শব্দ। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। এই দুই শব্দ মিলে অর্থ হয় মুক্তির রজনী। একাধিক সহিহ হাদিসে এ রাতের মর্যাদা প্রমাণিত।

 

বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)

ইসলামি শরিয়তে শবে বরাতের সঙ্গে হালুয়া রুটির সম্পর্ক নেই। নিয়মিত হালুয়া রুটি খাওয়ার অভ্যাস কারো থাকলে, তিনি শবে বরাতেও খেতে পারবেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। একইভাবে শবে বরাতের বিশেষ আমল মনে না করলে বা মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা সৃষ্টির সম্ভাবনা না থাকলে শবে বরাতে হালুয়া রুটি খাওয়া এবং মানুষকেও খাওয়ানো কোনোটাই নাজায়েজ নয়।

 

সমস্যা হলো- হালুয়া-রুটি বানানো, খাওয়া ও বিরতরণকে শবে বরাতের জরুরি বা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ আমল মনে করা। সেরকমটা করলে তা বিদআত গণ্য হবে। কেননা এধরনের কাজ শবে বরাতের বিশেষ কোনো আমল নয়।

 

এরপরও আলেমরা এ ধরনের যেকোনো বিষয় নিয়ে বাড়তি সতর্ক থাকতে বলেন, যেন পরবর্তী প্রজন্ম বড়দের দেখাদেখি কোনোকিছুকে রসমে পরিণত করতে না পারে। মূলত শয়তান উঁৎ পেতে থাকে মুসলিম সমাজে বিদআত ছড়িয়ে দিতে। প্রসিদ্ধ তাবেয়ি সুফিয়ান সাওরি (রহ) বলেন- ‘ইবলিসের নিকট নাফরমানির চেয়েও বিদআত বেশি প্রিয়। কারণ নাফরমানি থেকে তাওবা করার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু বিদআত থেকে তাওবা করার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।’ (শাতিবি, আলইতিসাম: ১/১১; ইমাম সুয়ুতি, আলআমরু বিল ইত্তিবা পৃ-১৯)

 

শবে বরাত নিয়ে কাউকে বলতে শোনা যায়, ‘শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বানালে আরশের নিচে ছায়া পাওয়া যাবে।’ অথচ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর হাদিসের সঙ্গে এর দূরতম সম্পর্ক নেই। আবার কাউকে বলতে শোনা যায়, ওহুদ যুদ্ধে নবীজির দানদান মোবারক শহীদ হওয়ায় কিছুদিন তিনি শক্ত খাবার খেতে পারেননি—সেই ঘটনার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এই দিনে ঘটা করে হালুয়া রুটি খাওয়া হয়। অথচ ওহুদ যুদ্ধ হয়েছিল শাওয়ালের ৭ তারিখে, শাবান মাসের ১৫ তারিখের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

 

সবচেয়ে বড় কথা হলো- নবীজি কিংবা সাহাবিদের যুগে শবে বরাতকে কেন্দ্র করে হালুয়া রুটি খাওয়া বা প্রতিবেশিদের মাঝে বিলানোর প্রচলন ছিলো বলে হাদিসে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ১৯ শতকের শেষের দিকে এসবের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় বলে ইতিহাস বিশ্লেষকরা মনে করেন।

 

মুসল্লিদের উচিত হাদিসে এ রাতের যতটুকু ফজিলত প্রমাণিত, শুধু ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকা। নবী-সাহাবিদের যুগে প্রচলন ছিলো না—এমন কোনও রসম-রেওয়াজের পিছে না পড়ে মূল ইবাদতের দিকে মনোনিবেশ করে শবে বরাতের ফজিলত লাভ করা।

 

আসলে শবে বরাত নিয়ে এতদঞ্চলের মানুষের মধ্যে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি দুটোই রয়েছে। বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে কেউ সুন্নত অনুযায়ী ইবাদতের পরিবর্তে বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আবার কেউ শবে বরাতকে অতি সাধারণ একটি রাত ভেবে ইবাদত থেকেই নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। মূলত কোনোটাই উচিত নয়।

 

আল্লাহ তাআলা আমাদের যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে হেফাজত করুন। মর্যাদাপূর্ণ রাত সুন্নত অনুযায়ী অতিবাহিত করার তাওফিক দান করুন। প্রত্যেক বিষয়ে কোরআন সুন্নাহর নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Design & Developed BY ThemesBazar.Com