মসলিন কাপড়ের চমকপ্রদ কাহিনি

সুদূর অতীত থেকেই আমাদের এ উপমহাদেশে মসলিন কাপড়ের পরিচিতি ছিল ব্যাপক। অত্যন্ত মিহি বুননে তৈরি এক ধরনের সূতা থেকে তৈরি হতো বহুল প্রচলিত মসলিন কাপড়। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উদ্ভাবিত ব্যতিক্রমী ও সূক্ষ্ম সুতায় হাতে বোনা কাপড়টি সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই ইউরোপে রপ্তানি শুরু হয়। সুপ্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতের মসলিন কাপড়ের উদ্ভব ঘটেছে। নিচে এর মধ্যে একেবারে প্রধান প্রধান কয়েকটির বর্ণনা উপস্থাপন করা হলো—

মল-মল খাস: মল-মল খাস শব্দটি এসেছে ‘মল-বুশ খাস’ থেকে। যার দ্বারা বোঝায় বিশেষ ধরনের কাপড়। এগুলো ছিলো রাজা-বাদশাহদের খুব পছন্দের পোশাক। তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্যই মূলত এগুলো তৈরি হতো।

 

ঝুনা: ঝুনা ছিলো রেশম জাতীয় আরেক প্রকার মিহি মসলিন কাপড়। যা বিশেষ করে নর্তকীদের খুবই পছন্দনীয় ছিল। ঝুনা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে হিন্দি শব্দ ‘ঝিনা’ থেকে। যার অর্থ হলো হালকা। মাত্র ১,০০০ সুতায় (প্রতি বর্গইঞ্চিতে সমতল ও লম্বালম্বি সুতার সংখ্যা) গড়া ঝুনা ছিল একেবারে স্বচ্ছ। যার কারণে এটি রপ্তানি দ্রব্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। তারপরও গৃহবধূ ও হারেমের (অন্দরমহল) বাসিন্দাদের কাছে এটির জনপ্রিয়তা ছিল।

 

রঙ্গো: অনেকটা ঝুনার মতোই। তবে এটিকে বর্ণনা করা হয়েছে রেশম জাতীয় মসলিনের চেয়ে একটু ভিন্ন হিসেবে। সীমিতসংখ্যক সুতায় তৈরি হলেও রঙ্গোর ওজন ছিল মল-মল খাসের তুলনায় অল্প একটু বেশি।

 

আবরাওয়ান: আবরাওয়ান শব্দের অর্থটি এসেছে দুটি ফারসি শব্দ থেকে। যার দ্বারা বোঝায় পানি ও প্রবাহ। এই প্রকারের মসলিন ছিল অত্যন্ত কোমল ও হালকা। এ কারণেই প্রবাহমান পানির সাথে এর তুলনা করা হতো।

খাসা: খাসা বলতে অত্যন্ত চমৎকার ও হালকা মসলিনকে বোঝানো হয়। কাপড়টি ছিলো সমান আকৃতির এবং মজবুত বুননের জন্য বিখ্যাত। এটি তৈরিতে ১,৪০০ থেকে ২,৮০০ সুতা (প্রতি বর্গইঞ্চিতে সমতল ও লম্বালম্বি সুতার সংখ্যা) ব্যবহৃত হতো। আবুল ফজল ইবনে মুবারকের লেখা ‘আইন-ই-আকবরী’ বইয়ে খাসা মসলিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই আবুল ফজল ইবনে মুবারক মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে শাসনকার্যের বিবরণী পেশ করতেন।

 

সুবনম: সুবনম কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো সকালের শিশির বিন্দু। এটি এত চমৎকার এক মসলিন ছিল যে, ঘাসের ওপর একে বিছিয়ে শুকানো হলে শিশির বিন্দুর সাথে এর পার্থক্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। এতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা ছিলো ৭০০ থেকে ১,৪০০টি।

 

আলাবাল্লী: বুননকারীদের বর্ণনা অনুসারে, আলাবাল্লী বলতে বোঝাতো খুবই চমৎকার। এটি ছিল সূক্ষ্মভাবে বুননকৃত মসলিন। ‘সিক্যুয়েল টু দ্য পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথিয়ান সী’ গ্রন্থে আলাবাল্লীকে ‘আবোল্লাই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আলাবাল্লীতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা ছিল ১,১০০ থেকে ১,৯০০। এর ওজন অন্যান্য মসলিনের তুলনায় বেশি ছিল।

 

তানজেব: তানজেব হচ্ছে আরেকটি ফারসি শব্দ, যেটিকে ভাঙলে এর অর্থ দাঁড়ায় শরীর ও অলংকার। ৮০০ থেকে ১,৯০০ সুতার বুননের এই মসলিন ছিল হালকা ও সমান।

 

তারান্দাম: তারান্দাম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি শব্দ ‘তুরুহ’ এবং ফারসি শব্দ ‘আন্দাম’ থেকে। দুটিকে মিলিয়ে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘শরীরের জন্য একপ্রকার কাপড়’। এই নামে ইংরেজরা এটি নিজ দেশে আমদানি করেছিল এবং এটি পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলো। মসলিনটি ছিল সমান আকৃতির। এতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা ছিল ১,০০০ থেকে ২,৭০০।

 

নিয়ানসুখ: এটি প্রায়ই বলা হতো, এই বিশেষ ধরনের মসলিনের আগমন ঘটেছিল দু’চোখের তৃপ্তির জন্য। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে নিয়ানসুখ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খুবই হালকা কাপড়ের তৈরি এই মসলিন গলাবন্ধনী হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা হতো ২,২০০ থেকে ২,৭০০ এর মধ্যে।

 

বুদ্দুন-খাস: ‘বুদ্দুন’ অর্থ শরীর আর ‘খাস’ অর্থ বিশেষ। এ জাতীয় মসলিন ব্যবহার্য পোশাক তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতো। বুননটা খুব সূক্ষ্ম না হলেও এর মান ছিল বেশ উন্নত। এতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা ছিল প্রায় ২,২০০।

 

সুরবান্দ: সুরবান্দ শব্দটি গঠিত হয়েছে দুটি ফারসি শব্দের সমন্বয়ে। ‘সুর’ অর্থ মাথা এবং ‘বান্দ’ অর্থ বন্ধনী। সুরবান্দ নামক মসলিনটি মূলত মাথার আবরণ যেমন– পাগড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। প্রায় ২,১০০ সুতা প্রয়োজন হতো এটি তৈরির জন্য। ব্রিটিশ ভারতের শাসক ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এই সুরবান্দ তাদের নিজ দেশ যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করতো। ইংরেজরা মূলত স্কার্ফ হিসেবেই এটি ব্যবহার করতো।

 

কামিস: আরবি কামিস শব্দের অর্থ হলো পোশাক। কুর্তা তৈরির জন্য এ জাতীয় মসলিন ব্যবহার করা হতো। একসময় কুর্তা এত দীর্ঘ ছিল যে, তা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে দিতো। এর জন্য প্রয়োজন হতো লম্বা ও সমান কাপড়ের, যাতে সুতার সংখ্যা ছিল ১,৪০০।

 

জামদানি: বাহারি ডিজাইনে বুননকৃত মসলিন জামদানি নামেই ব্যাপকভাবে পরিচিত। ‘জাম’ শব্দটি দ্বারা বোঝাতো ফুলের গুচ্ছ এবং ‘দানি’ দ্বারা বোঝাতো পাত্র। যার মিলিত অর্থ দাঁড়ায় বিভিন্ন নকশা রাখার জন্য একটি ফুলের পাত্র। জামদানিতে ছিলো বাহারি ডিজাইনের সমাহার। বাজারে বিপুল চাহিদার কারণেই এটি ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

 

দুরিয়া: ‘ডোরাকাটা’ শব্দ থেকে উদ্ভব হয়েছে দুরিয়া নামটির, যা একটি দাগকাটা মসলিন। এটি তৈরি হতো দুই অংশ সুতা এবং তিন অংশ সিল্ক ব্যবহার করে দুই কিংবা ততোধিক বাঁকানো সূতাকে মিশিয়ে। সাধারণত দুরিয়া তৈরি করা হতো ‘ভগা’ অথবা ‘সিরঞ্জ’ নামক সুতা থেকে। পুরুষ ও মহিলা উভয়ের পোশাক তৈরির জন্যই এটি ব্যবহার করা হতো। যাতে সুতার সংখ্যা প্রয়োজন সাপেক্ষে ১,৫০০ থেকে ২,১০০ পর্যন্ত হতো।

 

চারকোণা: নামের সাথে মিল রেখেই চারকোণা ছিলো বর্গাকার ও চতুর্ভুজ আকৃতির নকশা করা মসলিন। মাপ, ওজন ও সুতার সংখ্যার দিক থেকে চারকোণা ও দুরিয়া এক রকমই ছিল। তবে দুরিয়া ছিলো দাগকাটা আর চারকোণা ছিল প্রত্যেক কোণায় নকশা করা এবং বর্গাকৃতির।

 

কালের বিবর্তনে অতীতের ঐতিহ্যবাহী মসলিন অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে ঢাকা অঞ্চলের তাঁতি বা বুননশিল্পীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ পুরোনো শিল্পটিকে একেবারে হারিয়ে যেতে দেননি। যদিও এখন মসলিন সুতা আর আগের মতো মসৃণ নেই এবং আগের সেই বাহারি ডিজাইনও নেই। তারপরও বাঙালি তাঁতিদের উৎপাদিত সীমিত ডিজাইনের চাহিদা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। এগুলোর আকর্ষণ এখনো বজায় রয়েছে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে বর্তমান যুগের মসলিনের যথেষ্ট কদর রয়েছে।

 

ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষদিকে তাঁতের নকশা করা এক ধরনের মসলিনের পুনর্জাগরণ ঘটে। যা ব্যাপকভাবে জামদানি শিল্প নামে পরিচিত। জামদানির ছিল ফুলেল ও জ্যামিতিক সব ডিজাইন। বিশ্বাস করা হতো যে এটি পার্সিয়ানদের (পারস্য বা ইরানের অধিবাসী) দ্বারা প্রভাবিত। কাপড়ের বুননে দারুণ ডিজাইনের পাশাপাশি এতে চারাগাছ ও ফুলের নকশা দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হতো এবং সেরা ডিজাইনগুলোয় থাকতো ধারালো প্রান্তের পরিবর্তে মসৃণ সব দাগ। বাহারি ডিজাইনের এই নজরকাড়া বৈচিত্র্য জামদানিকে অন্য সব মসলিন থেকে আলাদা করে তোলে।

শুরুটা ঢাকায় হলেও ক্রমান্বয়ে জামদানির প্রসার ঘটে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এবং সময়ের ক্রমবিবর্তনে এটিতে আরও বৈচিত্র্য ও নতুনত্বের যোগ হয়। এই বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব অনেকটা প্রভাবিত হয়েছে বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর দ্বারা। বর্তমান যুগে এই শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন গবেষণা, অর্থায়ন ও বিপণনভিত্তিক সংগঠন, যা একটি ইতিবাচক দিক। এখন বাংলাদেশের প্রয়োজন বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার সহায়তায় লুপ্তপ্রায় মসলিন শিল্পের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেওয়া।

লেখক: ফ্রিল্যান্স ফিচার লেখক।  সূত্র: জাগোনিউজ২৪.কম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইন্টারন্যাশনাল ডিজ্যাবিলিটি আর্ট ফেস্টিভ্যাল শুরু

» তীব্র গরমে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করলেন ইউএনও

» লালমনিরহাটে হিট স্ট্রোকে অটোচালকের মৃত্যু

» ইউএনওর ফোন নম্বর ক্লোন করে প্রার্থীদের সাথে প্রতারণার চেষ্টা

» দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করুন, আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রধানমন্ত্রী

» প্রতিক্রিয়াশীল চক্র গণতন্ত্রবিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে : পরশ

» আগামীকাল ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

» বন্দনা করা ছাড়া জাপার কোনো রাজনীতি নেই: ফিরোজ রশিদ

» বাংলাদেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে অথচ বিরোধী দল দেখে না: কাদের

» থাই পিএমও-তে প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

মসলিন কাপড়ের চমকপ্রদ কাহিনি

সুদূর অতীত থেকেই আমাদের এ উপমহাদেশে মসলিন কাপড়ের পরিচিতি ছিল ব্যাপক। অত্যন্ত মিহি বুননে তৈরি এক ধরনের সূতা থেকে তৈরি হতো বহুল প্রচলিত মসলিন কাপড়। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উদ্ভাবিত ব্যতিক্রমী ও সূক্ষ্ম সুতায় হাতে বোনা কাপড়টি সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই ইউরোপে রপ্তানি শুরু হয়। সুপ্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতের মসলিন কাপড়ের উদ্ভব ঘটেছে। নিচে এর মধ্যে একেবারে প্রধান প্রধান কয়েকটির বর্ণনা উপস্থাপন করা হলো—

মল-মল খাস: মল-মল খাস শব্দটি এসেছে ‘মল-বুশ খাস’ থেকে। যার দ্বারা বোঝায় বিশেষ ধরনের কাপড়। এগুলো ছিলো রাজা-বাদশাহদের খুব পছন্দের পোশাক। তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্যই মূলত এগুলো তৈরি হতো।

 

ঝুনা: ঝুনা ছিলো রেশম জাতীয় আরেক প্রকার মিহি মসলিন কাপড়। যা বিশেষ করে নর্তকীদের খুবই পছন্দনীয় ছিল। ঝুনা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে হিন্দি শব্দ ‘ঝিনা’ থেকে। যার অর্থ হলো হালকা। মাত্র ১,০০০ সুতায় (প্রতি বর্গইঞ্চিতে সমতল ও লম্বালম্বি সুতার সংখ্যা) গড়া ঝুনা ছিল একেবারে স্বচ্ছ। যার কারণে এটি রপ্তানি দ্রব্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। তারপরও গৃহবধূ ও হারেমের (অন্দরমহল) বাসিন্দাদের কাছে এটির জনপ্রিয়তা ছিল।

 

রঙ্গো: অনেকটা ঝুনার মতোই। তবে এটিকে বর্ণনা করা হয়েছে রেশম জাতীয় মসলিনের চেয়ে একটু ভিন্ন হিসেবে। সীমিতসংখ্যক সুতায় তৈরি হলেও রঙ্গোর ওজন ছিল মল-মল খাসের তুলনায় অল্প একটু বেশি।

 

আবরাওয়ান: আবরাওয়ান শব্দের অর্থটি এসেছে দুটি ফারসি শব্দ থেকে। যার দ্বারা বোঝায় পানি ও প্রবাহ। এই প্রকারের মসলিন ছিল অত্যন্ত কোমল ও হালকা। এ কারণেই প্রবাহমান পানির সাথে এর তুলনা করা হতো।

খাসা: খাসা বলতে অত্যন্ত চমৎকার ও হালকা মসলিনকে বোঝানো হয়। কাপড়টি ছিলো সমান আকৃতির এবং মজবুত বুননের জন্য বিখ্যাত। এটি তৈরিতে ১,৪০০ থেকে ২,৮০০ সুতা (প্রতি বর্গইঞ্চিতে সমতল ও লম্বালম্বি সুতার সংখ্যা) ব্যবহৃত হতো। আবুল ফজল ইবনে মুবারকের লেখা ‘আইন-ই-আকবরী’ বইয়ে খাসা মসলিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই আবুল ফজল ইবনে মুবারক মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে শাসনকার্যের বিবরণী পেশ করতেন।

 

সুবনম: সুবনম কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো সকালের শিশির বিন্দু। এটি এত চমৎকার এক মসলিন ছিল যে, ঘাসের ওপর একে বিছিয়ে শুকানো হলে শিশির বিন্দুর সাথে এর পার্থক্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। এতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা ছিলো ৭০০ থেকে ১,৪০০টি।

 

আলাবাল্লী: বুননকারীদের বর্ণনা অনুসারে, আলাবাল্লী বলতে বোঝাতো খুবই চমৎকার। এটি ছিল সূক্ষ্মভাবে বুননকৃত মসলিন। ‘সিক্যুয়েল টু দ্য পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথিয়ান সী’ গ্রন্থে আলাবাল্লীকে ‘আবোল্লাই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আলাবাল্লীতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা ছিল ১,১০০ থেকে ১,৯০০। এর ওজন অন্যান্য মসলিনের তুলনায় বেশি ছিল।

 

তানজেব: তানজেব হচ্ছে আরেকটি ফারসি শব্দ, যেটিকে ভাঙলে এর অর্থ দাঁড়ায় শরীর ও অলংকার। ৮০০ থেকে ১,৯০০ সুতার বুননের এই মসলিন ছিল হালকা ও সমান।

 

তারান্দাম: তারান্দাম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি শব্দ ‘তুরুহ’ এবং ফারসি শব্দ ‘আন্দাম’ থেকে। দুটিকে মিলিয়ে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘শরীরের জন্য একপ্রকার কাপড়’। এই নামে ইংরেজরা এটি নিজ দেশে আমদানি করেছিল এবং এটি পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলো। মসলিনটি ছিল সমান আকৃতির। এতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা ছিল ১,০০০ থেকে ২,৭০০।

 

নিয়ানসুখ: এটি প্রায়ই বলা হতো, এই বিশেষ ধরনের মসলিনের আগমন ঘটেছিল দু’চোখের তৃপ্তির জন্য। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে নিয়ানসুখ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খুবই হালকা কাপড়ের তৈরি এই মসলিন গলাবন্ধনী হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা হতো ২,২০০ থেকে ২,৭০০ এর মধ্যে।

 

বুদ্দুন-খাস: ‘বুদ্দুন’ অর্থ শরীর আর ‘খাস’ অর্থ বিশেষ। এ জাতীয় মসলিন ব্যবহার্য পোশাক তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতো। বুননটা খুব সূক্ষ্ম না হলেও এর মান ছিল বেশ উন্নত। এতে ব্যবহৃত সুতার সংখ্যা ছিল প্রায় ২,২০০।

 

সুরবান্দ: সুরবান্দ শব্দটি গঠিত হয়েছে দুটি ফারসি শব্দের সমন্বয়ে। ‘সুর’ অর্থ মাথা এবং ‘বান্দ’ অর্থ বন্ধনী। সুরবান্দ নামক মসলিনটি মূলত মাথার আবরণ যেমন– পাগড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। প্রায় ২,১০০ সুতা প্রয়োজন হতো এটি তৈরির জন্য। ব্রিটিশ ভারতের শাসক ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এই সুরবান্দ তাদের নিজ দেশ যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করতো। ইংরেজরা মূলত স্কার্ফ হিসেবেই এটি ব্যবহার করতো।

 

কামিস: আরবি কামিস শব্দের অর্থ হলো পোশাক। কুর্তা তৈরির জন্য এ জাতীয় মসলিন ব্যবহার করা হতো। একসময় কুর্তা এত দীর্ঘ ছিল যে, তা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে দিতো। এর জন্য প্রয়োজন হতো লম্বা ও সমান কাপড়ের, যাতে সুতার সংখ্যা ছিল ১,৪০০।

 

জামদানি: বাহারি ডিজাইনে বুননকৃত মসলিন জামদানি নামেই ব্যাপকভাবে পরিচিত। ‘জাম’ শব্দটি দ্বারা বোঝাতো ফুলের গুচ্ছ এবং ‘দানি’ দ্বারা বোঝাতো পাত্র। যার মিলিত অর্থ দাঁড়ায় বিভিন্ন নকশা রাখার জন্য একটি ফুলের পাত্র। জামদানিতে ছিলো বাহারি ডিজাইনের সমাহার। বাজারে বিপুল চাহিদার কারণেই এটি ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

 

দুরিয়া: ‘ডোরাকাটা’ শব্দ থেকে উদ্ভব হয়েছে দুরিয়া নামটির, যা একটি দাগকাটা মসলিন। এটি তৈরি হতো দুই অংশ সুতা এবং তিন অংশ সিল্ক ব্যবহার করে দুই কিংবা ততোধিক বাঁকানো সূতাকে মিশিয়ে। সাধারণত দুরিয়া তৈরি করা হতো ‘ভগা’ অথবা ‘সিরঞ্জ’ নামক সুতা থেকে। পুরুষ ও মহিলা উভয়ের পোশাক তৈরির জন্যই এটি ব্যবহার করা হতো। যাতে সুতার সংখ্যা প্রয়োজন সাপেক্ষে ১,৫০০ থেকে ২,১০০ পর্যন্ত হতো।

 

চারকোণা: নামের সাথে মিল রেখেই চারকোণা ছিলো বর্গাকার ও চতুর্ভুজ আকৃতির নকশা করা মসলিন। মাপ, ওজন ও সুতার সংখ্যার দিক থেকে চারকোণা ও দুরিয়া এক রকমই ছিল। তবে দুরিয়া ছিলো দাগকাটা আর চারকোণা ছিল প্রত্যেক কোণায় নকশা করা এবং বর্গাকৃতির।

 

কালের বিবর্তনে অতীতের ঐতিহ্যবাহী মসলিন অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে ঢাকা অঞ্চলের তাঁতি বা বুননশিল্পীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ পুরোনো শিল্পটিকে একেবারে হারিয়ে যেতে দেননি। যদিও এখন মসলিন সুতা আর আগের মতো মসৃণ নেই এবং আগের সেই বাহারি ডিজাইনও নেই। তারপরও বাঙালি তাঁতিদের উৎপাদিত সীমিত ডিজাইনের চাহিদা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। এগুলোর আকর্ষণ এখনো বজায় রয়েছে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে বর্তমান যুগের মসলিনের যথেষ্ট কদর রয়েছে।

 

ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষদিকে তাঁতের নকশা করা এক ধরনের মসলিনের পুনর্জাগরণ ঘটে। যা ব্যাপকভাবে জামদানি শিল্প নামে পরিচিত। জামদানির ছিল ফুলেল ও জ্যামিতিক সব ডিজাইন। বিশ্বাস করা হতো যে এটি পার্সিয়ানদের (পারস্য বা ইরানের অধিবাসী) দ্বারা প্রভাবিত। কাপড়ের বুননে দারুণ ডিজাইনের পাশাপাশি এতে চারাগাছ ও ফুলের নকশা দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হতো এবং সেরা ডিজাইনগুলোয় থাকতো ধারালো প্রান্তের পরিবর্তে মসৃণ সব দাগ। বাহারি ডিজাইনের এই নজরকাড়া বৈচিত্র্য জামদানিকে অন্য সব মসলিন থেকে আলাদা করে তোলে।

শুরুটা ঢাকায় হলেও ক্রমান্বয়ে জামদানির প্রসার ঘটে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এবং সময়ের ক্রমবিবর্তনে এটিতে আরও বৈচিত্র্য ও নতুনত্বের যোগ হয়। এই বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব অনেকটা প্রভাবিত হয়েছে বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর দ্বারা। বর্তমান যুগে এই শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন গবেষণা, অর্থায়ন ও বিপণনভিত্তিক সংগঠন, যা একটি ইতিবাচক দিক। এখন বাংলাদেশের প্রয়োজন বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার সহায়তায় লুপ্তপ্রায় মসলিন শিল্পের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেওয়া।

লেখক: ফ্রিল্যান্স ফিচার লেখক।  সূত্র: জাগোনিউজ২৪.কম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com