এস. এম. সাইফুল ইসলাম কবির: বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের উপকূল নদী ভাঙ্গন বাংলাদেশের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিনিয়ত খবর আসছে উত্তরবঙ্গে দক্ষিণবঙ্গে নদী ভাঙ্গনের। বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলের বাগেরহাট সাতক্ষীরা খুলনা পিরোজপুর ঝালকাঠি বরিশাল বরগুনা পটুয়াখালী ভোলা চাঁদপুর লক্ষীপুর ফেনী নোয়াখালী চট্টগ্রাম কক্সবাজার এই সমস্ত জেলাগুলোতে প্রতিনিয়ত ভাঙছে নদী কমছে স্থল ভূমি। এরমধ্য অতিমাত্রায় ভাঙছে বাগেরহাট সাতক্ষীরা খুলনা পটুয়াখালী বরগুনা ভলা চাঁদপুর লক্ষীপুর ও ফেনীতে। উত্তরবঙ্গে ভাঙছে।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বাচামারা ইউনিয়নের ভারাঙ্গা এলাকায় ভারাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনটি নদী গর্ভে বিলীন : ভোলার সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের মাঝের চর এলাকায় গত ১০ দিনের ভাঙনে গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার, ভেঙে গেছে একটি বাজার, মসজিদ, ২টি মক্তব, হেফজ মাদ্রাসাসহ বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ফরিদপুর ও মাদারীপুর এই ১২ জেলা নদী ভাঙনের কবলে-সিইজিআইএস
নদী এদেশের মানুষের কাছে যেমন আশীর্বাদ, তেমনি কারো কারো জন্য আবার অভিশাপ হয়েও দেখা দেয়। নদীভাঙন নদীপাড়ের মানুষের কাছে ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ দুর্যোগ সারা বছর ধরে নানা মাত্রায় নানা গতিতে চলে। নদীভাঙনে বসতভিটা জায়গা-জমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদরাসা, কবরস্থানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের এক জরিপে বলা হয়, ভাঙনে প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। বিশেষ করে, বর্ষাকালে বিভিন্ন জেলায় নদী ভাঙন তীব্র রূপ নেয়। এ বছর দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলার ২ হাজার হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হতে পারে। নদীভাঙন এ দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে অন্য দুর্যোগের চেয়ে বেশি মাত্রায় ধ্বংস করছে। অথচ এই ভাঙন মোকাবেলায় আমাদের সরকারের কোনো প্রস্তুতি ও উদ্যোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার নদীভাঙন রোধে প্রচুর অর্থ ব্যয় করলেও তা সমন্বিত ও পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। এতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, নদীমার্তৃক এই দেশে নদীকে যতটা গুরুত্ব দেয়া দরকার তা কোন সরকারই দেয় না। এ জন্য নদী আজ শুকিয়ে মরছে, দেশ মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অন্যদিকে নদীভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। অথচ নদীভাঙন বিষয়টাকে সরকার খুব একটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বলে মনে হয় না। ভাঙন রোধে এখনো টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। এর ফলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার বিষয়ে প্রশ্নের জন্ম দেয়। নদীভাঙন রোধে সরকার প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে নদীর তীর রক্ষায় ও বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মাণে প্রচুর অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, হচ্ছে। তবে এতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে, সে অনুপাতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব এবং অনিয়ম দুর্নীতির ফলে নদী রক্ষায় যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়, সেগুলো কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে যায়। প্রতি বছরই বাঁধ ভাঙে, আবার তা মেরামত করা হয়।এ বছর বর্ষায় কেবল শুরু হয়েছে। নদ-নদীর পানি কেবল বাড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পূর্বাভাস বলছে, এ বছর দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলার ২ হাজার হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হতে পারে। এ কারণে ফসলি জমির পাশাপাশি ঘরবাড়ি হারাতে পারেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা সিইজিআইএস মূলত যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার সম্ভাব্য ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে থাকে। এবার যমুনায় ১৩টি স্থানে, গঙ্গার ৭টি ও পদ্মার ১টি স্থানে ভাঙন বেশি হতে পারে বলে তারা অনুমান করছে। সিইজিআইএসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এবার দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভাঙন বেশি হবে। জেলাগুলো হলোÑ কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। ভাঙনের কারণ হিসেবে সংস্থাটি পানির স্রোত ও নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলাকে দায়ী করেছে। মূলত পানি নেমে যাওয়ার সময় নদী তীরবর্তী যেসব এলাকার মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি থাকে, সেসব এলাকায় ভাঙন বেশি হয়। পদ্মা ও যমুনার তীরে এ ধরনের মাটি বেশি থাকায় ভাঙনও বেশি হচ্ছে।নদী ভাঙনের তথ্য নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠনো রিপোর্ট নিচে তুলে ধরা হলো।মানিকগঞ্জ থেকে শাহীন তারেক জানান, পদ্মা যমুনা কালীগঙ্গা ধলেশ্বরী ইছামতি ও গাজীখালীসহ মোট ১৪টি নদী বেষ্টিত মানিকগঞ্জ জেলা। প্রতিবছর বর্ষা শুরুর সাথে সাথে নদরী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় ভয়াবহ ভাঙন। এ বছরও চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দৌলতপুর উপজেলার বাচামারা ইউনিয়নের ভারাঙ্গা এলাকায় দেড় কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত ভারাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া জেলার বাঘুটিয়া আলিম মাদ্রসা ও চরকাটারিয়া শুকুরিয়া দাখিল মাদ্রাসাসহ নদী তীরবর্তী এলাকার ৬৪টি স্থান সবচেযয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্থানে জরুরি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভাঙনের কবলে পড়তে পারে বসতভিটা, ফসলি জমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। নদী তীরবর্তী এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বলছেন বর্ষা শুরু হলেই পানি উন্নয়ন বোর্ড তাড়াহুড়া করে কিছু জিওব্যাগ ফেলে কর্মসূচি পালন করেন। কিন্তু এসব অপরিকল্পিত জিও ব্যাগ ভাঙন রোধে তেমন কোন কাজে আসে না। জানা গেছে, হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগর, কাঞ্চনপুর, সেলিমপুর, সুতালড়ি, হাতিঘাটা, মালুচি, গোপীনাথপুর উজানপাড়া, আন্ধারমানিক, সিংগাইর উপজেলার দক্ষিণ জামশা, বালুরচর জামশা, দক্ষিণ চারিগ্রাম, বার্তা বাজার, শিবালয় উপজেলার গঙ্গাপ্রসাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তেওতা, তেওতা সমেজঘর, নেহালপুর, আরুয়া, আলোকদিয়া এলাকাও রয়েছে নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে।ফরিদপুর থেকে আনোয়ার জাহিদ জানান, বৃহত্তর ফরিদপুরের নদীভাঙনে লাখ লাখ পরিবার গৃহহীন, সরকারিভাবে সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ বিস্তর। পদ্মার পানি বাড়তেই বুকে কাঁপন উঠছে বৃহত্তর ফরিদপুরের নদীভাঙন কবলিত মানুষের মধ্যে। এখনো আতঙ্কে হাজারো পরিবার। বিগত দিনে যারা বাড়ি ঘর হারিয়েছে এখনো সরকারি রাস্তার পাশে ঝুপড়ি ঘর তুলে বৃদ্ধ বাবা-মা, বিবাহ যোগ্য মেয়ে-ছেলে, স্ত্রী নিয়ে কোনো রকমের রাত কাটাচ্ছে। ফরিদপুর সদর, সদরপুর, মধুখালি, কামারখালি আলফাডাঙ্গা, চরভদ্রদাসন ভাঙ্গা, এলাকাগুলো ভাঙন কবলিত এখনো চলছে কম-বেশি নদীভাঙন। শরীয়তপুর গোসাইরহাট, ভেদেরগঞ্জ, সুরেশ্বর কাঁচিকাটার লঞ্চঘাট এলাকায়ও চলছে কম বেশি নদীভাঙন। উল্লেখিত, উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরিবেশ বিরাজ করছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সদরপুর উপজেলার দিয়ারা নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের নুরুদ্দীন সরদার কান্দি, আব্দুল হামিদ জঙ্গির কান্দি, আলেফ সরদার কান্দি ও জব্বার শিকদার কান্দি এই গ্রামগুলো ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। আকোটের চরইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসলাম বেপারী ইনকিলাবকে বলেন, নদীভাঙন এখন আর হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো দুর্যোগ নয়, এটি একটি বার্ষিক দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আমরা বারবার জানিয়েছি। তারা এলাকা পরিদর্শনও করেছেন। আশা করছি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।বরগুনা থেকে জাহাঙ্গীর কবীর মৃধা জানান, উপকূলীয় জেলা বরগুনায় অব্যাহত নদী ভাঙনের কবলে পড়ে আতঙ্কে লক্ষাধিক মানুষ। পায়রা, বিষখালী নদী ও বলেশ্বর নদের ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। তীরবর্তী শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের দিন কাটছে ভাঙন আতঙ্কে। ইতোমধ্যেই নদ-নদীতে অসংখ্য বসত বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে। মানবেতর জীবনযাপন করছে নদী ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বরের গর্ভে বরগুনা সদরের বালিয়াতলী, তেঁতুলবাড়িয়া, বুড়িরচর, গোলবুনিয়া, রায়ের তবক, নলটোনা ও আজগরকাঠি; পাথরঘাটার কালমেঘা, জিনতলা, রুহিতা, কাকচিড়া; বামনার বামনা সদর ও রামনা; বেতাগীর পৌরসভা, সরিষামুড়ি, কালিকাবাড়ী, হোসনাবাদ ও মোকামিয়া; আমতলীর বালিয়াতলী, গুলিশাখালী, পচাকোড়ালিয়া, আরপাঙ্গাশিয়া; তালতলীর নিশানবাড়িয়া, জয়ালভাঙা, চরপাড়াসহ বেশকয়েকটি এলাকার মানচিত্র নদীভাঙনের কারণে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। বিষখালী নদীর ভাঙনে বামনা উপজেলার রামনা-ফুলঝুড়ি সড়কের বড় অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বেতাগী পৌরশহর রক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। যা শহরটিকে প্লাবনের ঝুঁকিতে ফেলেছে। নদী ভাঙনের কারণে বহু মানুষ তাদের বাড়িঘর ও সহায়-সম্বল হারাচ্ছে এবং তাদের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। নদী ভাঙনের ফলে বেড়িবাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং যেকোনো সময় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নদীভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণ এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি। ভাঙন কবলিত এলাকাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে সচেতন মহল মনে করছেন।পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, জেলার ৮৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিডর থেকে শুরু করে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৫০০ কিলোমিটার। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত ৫০০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে মাত্র ৩শ’ কিলোমিটারের। বাকি ২শ’ কিলোমিটার বাঁধেরও সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ছে। অমাবস্যা-পূর্ণিমার সময় এসব ভাঙা বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ঘরবাড়িসহ ভেসে যাচ্ছে মাছের ঘের। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগব্যবস্থা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।গাইবান্ধা থেকে আবেদুর রহমান স্বপন জানান, উজানের পানি কমতে থাকায় গাইবান্ধার তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র, নদীর তীরবর্তী এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর ফলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর, বেলকা, কাপাশিয়াসহ শ্রীপুর ইউনিয়নের পুটিমারি এলাকায় নদীভাঙ্গনের ফলে বসতবাড়ি, আবাদি জমিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। অপরদিকে পানি হ্রাস পাওয়ায় সদর উপজেলার কামারজানির কটিয়া ভিটা ও ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি, উড়িয়া ও ফজলুপুর ইউনিয়নে ভাঙন শুরু হয়েছে। এদিকে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও তিস্তা, ঘাঘট, করোতোয়া, বাঙ্গালি নদীর কয়েকটি স্থান থেকে অবৈধ ভবে বালু উত্তোলন করায় বাঁধগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান জানিয়েছেনÑ ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ার ফলে ভাঙন দেখা দিয়েছে।কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেব জানান, নদ-নদীর ভাঙনে অসহায় হয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ।
অপরদিকে কয়েকদিন আগের বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে কৃষকের ফসল। সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্ষা শুরুর আগেই ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও তিস্তার ভাঙনে বিলিন হচ্ছে উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মোল্লারহাট, রসুলপুর, কড্ডার মোড় এলাকাসহ কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী, রাজারহাট, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার বেশকিছু এলাকা। গত কয়েক দিনে এসব এলাকায় নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে শতাধিক বাড়ি-ঘর, আবাদি জমিসহ গাছপালা। ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসা কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এসব ভাঙন থেকে নদীর পাড় রক্ষা করা গেলে মানুষের সম্পদের ক্ষতি যেমন কমবে, তেমনি সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাও রক্ষা পাবে। এমন কথাই বলছেন, নদী পাড়ের মানুষজন।নোয়াখালী থেকে এহসানুল আলম খসরু জানান, নোয়াখালী জেলায় বহমান মেঘনা নদী, ছোট ফেনী নদী ও বামনীয়া নদীর অব্যাহত ভাঙনে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নোয়াখালীর জেলার উপকূলীয় উপজেলা হাতিয়া, সুবর্ণচর এবং কোম্পানীগঞ্জ। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় মেঘনা নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এতে প্রতিনিয়ত ঘর-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। নদীভাঙন রোধে দ্রুত ব্লক বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা। ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সরেজমিন গেলে স্থানীয়রা জানায়, দশকের পর দশক ধরে ভাঙছে হাতিয়ায় মেঘনা নদী।
নদীর ভাঙনে ইতোমধ্যে উপজেলার বৃহৎ এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। নদী গহ্বরে হারিয়ে গেছে বাড়ি-ঘর, ফসলের মাঠ, গাছপালা। অনেকেই বাপ-দাদার ভিটে মাটি হারিয়ে হয়েছে নিঃস্ব। নদীর করাল গ্রাসে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে রয়েছে নদী পাড়ের হাজার হাজার পরিবার। যে কোনো মুহূর্তে নদীভাঙনে হারাতে পারে মাথা গোজার একমাত্র সম্বল, এমন এমন দুঃশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে নদী পাড়ের মানুষদের। তাই নদীভাঙন রোধে হরনি, চানন্দী ও চেয়ারম্যানঘাট এলাকায় দ্রুত ব্লক বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছে এলাকাবাসী।নীলফামারী থেকে মোশফিকুর রহমান সৈকত জানান, উত্তরের জীবন রেখা আন্তর্জাতিক নদী তিস্তা। নদীর বারবার গতিপথ পরিবর্তন ও ভাঙন তিস্তপাড়ের মানুষজনকে নিঃস্ব করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না। এক সময়ের গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ সব যেন স্মৃতিপটে চলে গেছে। বর্তমান সময়ে তিস্তা নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় ভাঙন বাড়ছে। অভিযোগ তিস্তায় বাঁধ দিয়ে অবৈজ্ঞানিকভাবে সিকিমে ছয়টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করেছে। তারই জেরে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে নদী। পাহাড় থেকে বিপুল জলরাশির সঙ্গে বোল্ডার, মাটি নিয়ে এসে সমতলে ফেলছে তিস্তা। তার প্রভাব পড়ছে সমতলে। তবে তিস্তা নদীর সমতলে দুই সীমান্তে দুই দেশের বড় দুটি বাঁধ রয়েছে। একটি ভারতের গজলডোবায় ও অপরটি বাংলাদেশের ডালিয়া এলাকায় তিস্তা ব্যারাজ। উজানের তিস্তায় গতি ভিন্নপথে চলে গেলে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজের পথ ঠিক থাকবে কিনা তাও ভাবিয়ে তোলে। তিস্তার ভাঙনের ফলে গ্রাম, ভিটেমাটি, ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, কবরস্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরসহ নানা অবকাঠোমো নদীতে বিলীন হয়েছে।লক্ষ্মীপুর থেকে এস এম বাবুল (বাবর) জানান, লক্ষ্মীপুরের রামগতির মেঘনা নদীর ভাঙন বর্ষা মৌসুমে তীব্র আকার ধারণ করেছে। নদীর ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিনিয়ত ভাঙছে উপকূলীয় এলাকা। বসতবাড়ির পাশাপাশি সড়কও নদীতে বিলীন হয়ে যচ্ছে। তবে যেসব এলাকায় নদী বাঁধের কাজ চলমান রয়েছে, ওইস্থানে ভাঙনের মাত্রা অনেকটা কমেছে। সম্প্রতি অতিরিক্ত জোয়ারের ফলে নদীতে সৃষ্ট বড় বড় ঢেউয়ের ফলে রামগতি-বিবিরহাট সড়কটির কোরের বাড়ি মোড়ের পুরাতন বেড়িবাঁধের একটি অংশ নদীতে ভেঙে গেছে। সড়কটি এখন পুরোপুরি হুমকির মুখে রয়েছে। যে কোনো সময় ধসে পড়ে নদীতে বিলীনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সড়কটি ধসে পড়লে ওই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
বিশেষ করে, লক্ষ্মীপুর জেলা সদর ও রামগতি উপজেলার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এছাড়া পুরাতন বেড়িবাঁধের আশপাশের বাসিন্দারা বসতি হারানোর ভয়ে চরম উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠায় রয়েছে। ভেঙে পড়বে মানুষের ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাট ও হাটবাজার। সড়কটি ভেঙে গেলে মেঘনার পানি প্রবেশ করে আশপাশে দুইটি ইউনিয়নের কমপক্ষে চারটি গ্রামের অন্তত দুই হাজার ঘর-বাড়ি তলিয়ে যাবে মেঘনায়। স্থানীয়রা জানান, গত বছরেও সড়কটির এ অংশে ভাঙন দেখা দিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে জিও ব্যাগ দিয়ে কোনো মতে সড়কটি রক্ষা করা হয়। এ বছর জিও ব্যাগ দিয়েও আর রক্ষা করার কোনো সম্ভাবনা দেখছে না তারা। সময়মত টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করাই এখন যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি।ভোলা থেকে মোঃ জহিরুল হক জানান, মেঘনার ভাঙনে বিলিন হচ্ছে ভোলা। ভোলার নদীর ভাঙন একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোলাবাসীর জন্য। আপনারা কে বাঁচান। নদী ভাইঙ্গা আমাগোরে সব শেষ কইরা দিছে। মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে নিজের ভিটেমাটি রক্ষা করার জন্য নদীতীরে দাঁড়িয়ে এভাবেই আর্তনাদ করেছেন ভোলার থেকে বিচ্ছিন্ন কাচিয়া ইউনিয়নের মাঝের চরসহ নদীর ভাঙনের কবলিত অসহায় মানুষগুলো। সরজমিনে দেখা গেছে, ভোলা সংলগ্ন মেঘনায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন এবং ঘূর্ণিঝড় শক্তির প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল স্রোতে শস্যভা-ার খ্যাত মেঘনা নদী বেষ্টিত সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন মাঝের চর এলাকায় প্রবল ভাঙন দেখা দিয়েছে।
গত ১০ দিনের ভাঙনে গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার। ভেঙে গেছে একটি বাজার, মসজিদ, ২টি মক্তব, হেফজ মাদ্রাসাসহ বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভাঙনের তীব্রতা এতোই বৃদ্ধি পেয়েছে যে অনেক পরিবার তাদের ঘর সরিয়ে অন্যত্র নেয়ার সময়ও পাচ্ছেন না। যারা ভাঙন থেকে বসতঘর রক্ষা করতে পারেননি, তারা বসবাড়ি হারিয়ে নদী পাড়ে বসে আর্তনাদ করছেন। চোখের পলকেই মেঘনা নদীতে বাড়ি ঘর ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা। ৫নং প্রজেক্টের অর্ধেক নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে এই চরে বসবাসকারী দুই গ্রামের প্রায় ৮ হাজার মানুষের। তবে নদী ভাঙনরোধে ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয়দের মাঝে।চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মুসা মিয়া জানান, পদ্মার কোলে অবস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা নদীভাঙনের করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে তীব্র স্রোতের তোড়ে জেলার একাধিক ইউনিয়নের ও বিভিন্ন গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি ও রাস্তাঘাট। এতে করে একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে কৃষক ও সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটছে হাজারো নদী-পার্শ্ববর্তী পরিবার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় একদিকে কখনো শুকনো, আবার বর্ষায় হঠাৎ পানির চাপ বেড়ে ভয়াবহ ভাঙন তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে, জেলার শিবগঞ্জ ও সদর উপজেলার পদ্মা পাড়ের গ্রামগুলো বছরে বছরে ভাঙনের কবলে পড়ছে। প্রতি বছরে নদীতে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি ও বাসস্থান হারা হচ্ছে শত শত পরিবার। নদী ভাঙনের কারণে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে স্থানীয়রা, অন্যদিকে স্থানচ্যুতি ও মানবিক সংকট তৈরি হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে বিদ্যালয়, হাটবাজার, কবরস্থান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রতিবছর পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু সাময়িক বাঁধ নির্মাণ ও জিও ব্যাগ ফেললেও তা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। প্রয়োজন পরিকল্পিত নদীশাসন, তীর সংরক্ষণ প্রকল্প এবং ফারাক্কা সমস্যার আন্তর্জাতিক সমাধান প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।