বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা

একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালীদের উপর অতর্কিত  চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করতে থাকে। এমতাবস্থায় ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।

 

সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খন্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঘোষণা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২৫ মার্চ মধ্য রাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি যা তৎকালিন ইপিআর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মূল্যবান দলিলটি সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।

 

২০১৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের সংবিধানের উপক্রমণিকায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বাংলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসভায় এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইবার ডাক দেন এবং ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।

 

উপক্রমণিকায় আরও বলা হয়েছে, রক্তপাতহীন স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদের সহিত ঢাকায় আলোচনায় বসেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রিতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালীদের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।’

 

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু স্বকন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এমন তথ্য নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এরকম একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মি ঢাকা রেডিও’র দখল নিলেও, গোপন তিনটি ট্রান্সমিটার আগে থেকে প্রস্তুত রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেগুলোতে টেলিফোনে নিজের ঘোষণা রেকর্ড করান তিনি। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা করেন। নিবন্ধে আরো বলা হয়, চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার অন্তত ১৮ ঘন্টা আগে গোপন রেডিও মনিটর করে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ প্রকাশ করে বিশ্ব গণমাধ্যম।

 

লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্ব পালনকারী সিদ্দিক সালিক-এর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত একটি বিবরণের সত্যতা পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসাবে পাক সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর মুহূর্ত নিয়ে তিনি ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেন “এভাবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল। যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও’র সরকারি তরঙ্গের (ওয়েব লেংনথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কন্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।

 

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস-এ ওই ঘোষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঘোষণায় বলা হয়, এই-ই হয়তো আপনাদের জন্য আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি- যে যেখানেই খাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন এবং হাতে যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান- যতদিন না দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লার বৈঠকের বিবরণ থেকেও বঙ্গবন্ধুর স্বকন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার পরিকল্পনার কথা ধারণা করা যায়।

 

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের সাথে যেমন আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তেমনি সাথে সাথে তিনি কতকগুলো ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ওর্য়াকও করে যাচ্ছিলেন। ৭ মার্চের পর তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাকে তার কাছে ডেকে পাঠান। তিনি তার সাথে বৈঠক করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারা এ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। বৈঠকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমেদও উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীনতার দলিল ৮ম খন্ডের ২২ থেকে ২৩ পৃষ্ঠায় এ বৈঠকের কথা উল্লেখ আছে। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু নুরুল উল্লাকে একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করে দেয়ার কথা বলেন। ঐ ট্রান্সমিটারে তিনি শেষবারের মত ভাষণ দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন।

 

বঙ্গবন্ধু বলেন, নুরুল উল্লা আমাকে ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে হবে।আমি যাবার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। তুমি আমায় কথা দাও, যেভাবেই হোক একটা ট্রান্সমিটার আমার জন্য তৈরি রাখবে। আমি শেষবারের ভাষণ দিয়ে যাব। ড. মোহাম্মদ হান্নান এ ব্যাপারে তার ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকের পর নুরুল উল্লা সঙ্গে সঙ্গে এসে বার্তাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিক্ষকদের বলেন। শুরু হয়ে যায় স্বাধীন বাংলার প্রথম রেডিও ট্রান্সমিটার তৈরির কাজ। বিভাগীয় প্রধান ড. জহুরুল হকসহ প্রায় সকল শিক্ষক ৯ দিন কাজ করার পর একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করেন। এর সম্প্রচার ক্ষমতা বা শক্তি ছিল প্রায় বাংলাদেশব্যাপী। শর্ট ওয়েভে এর শব্দ ধরা যেতো।

 

অন্যদিকে আব্দুল কুদ্দুস মাখন তার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৯৭০ সালেই বঙ্গবন্ধু আখাউড়া শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি লালমিয়া ও গঙ্গাসাগরের রফিককে একটি রেডিও স্টেশন স্থাপন বিষয়ে যাবতীয় খুটিনাটি বিষয়ে খোঁজ-খবর করার জন্য ভারতে পাঠিয়ে ছিলেন। তাদের মিশনের প্রাক কাজকর্ম স্বাধীন বাংলার প্রথম বেতার কেন্দ্র স্থাপনে সহায়ক হয়েছিল। ২৬ মার্চ ১৯ সংখ্যার একটি নিবন্ধে ড. ফিরোজ মাহমুদ বলেন, ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু করে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর পর্যন্ত দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে একাধিক রেডিওতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্র পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেলেও, বঙ্গবন্ধু গোপন তিনটি রেডিও ট্রান্সমিটার তিন জায়গায় প্রস্তুত রেখেছিলেন। পিলখানার এক সুবেদারের কাছে তাঁর একটি প্রি-রেকর্ডেড ভাষণ ছিল। যেটির কোড ‘বলদা গার্ডেন।

 

ক্র্যাক ডাউনের খবর জেনে সেটি প্রচারের লক্ষ্যে ওই সুবেদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে দ্বিতীয় ট্রান্সমিটারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সেখানে টেলিফোনের মাধ্যমে নতুন করে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করান বঙ্গবন্ধু। একটু পরেই তা প্রচার করা হয়। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের তিন সাংবাদিকের কাছে এ তথ্য জানিয়েছিলেন বলে জানান ফিরোজ মাহমুদ। বস্তুত লড়াইয়ের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করে যৌক্তিক সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙ্গালীকে মুক্ত করার ঐতিহাসিক ঘোষণার লিখিত রূপ (কালুর ঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রচারিত) ইতিহাসে থাকার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর স্বকন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণার কথাও জানা যাচ্ছে।সূত্র-বাসস।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বন্দনা করা ছাড়া জাপার কোনো রাজনীতি নেই: ফিরোজ রশিদ

» বাংলাদেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে অথচ বিরোধী দল দেখে না: কাদের

» থাই পিএমও-তে প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা

» দ্রুতগামী ট্রাকের ধাক্কায় অজ্ঞাত বৃদ্ধার মৃত্যু

» আজকের খেলা

» অধিকার আদায়ে শেরে বাংলার অবদান কখনোই ভুলবার নয়: ফখরুল

» বিশেষ অভিযান চালিয়ে মাদকবিরোধী অভিযানে বিক্রি ও সেবনের অপরাধে ৩৯ জন গ্রেপ্তার

» সরবরাহ থাকলেও কমছে না সবজির দাম, অস্বস্তি মাছ-মাংসের বাজারে

» ভারী বৃষ্টিপাতের পর তানজানিয়ায় বন্যা-ভূমিধস, নিহত অন্তত ১৫৫

» ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুরু

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা

একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালীদের উপর অতর্কিত  চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করতে থাকে। এমতাবস্থায় ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।

 

সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খন্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ঘোষণা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২৫ মার্চ মধ্য রাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি যা তৎকালিন ইপিআর এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মূল্যবান দলিলটি সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এভাবে ‘ইহাই হয়তো আমাদের শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও। শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ, ১৯৭১।

 

২০১৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের সংবিধানের উপক্রমণিকায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বাংলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসভায় এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইবার ডাক দেন এবং ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।

 

উপক্রমণিকায় আরও বলা হয়েছে, রক্তপাতহীন স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং রাজনৈতিক নেতাদের সহিত ঢাকায় আলোচনায় বসেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রিতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালীদের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।’

 

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু স্বকন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এমন তথ্য নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এরকম একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মি ঢাকা রেডিও’র দখল নিলেও, গোপন তিনটি ট্রান্সমিটার আগে থেকে প্রস্তুত রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেগুলোতে টেলিফোনে নিজের ঘোষণা রেকর্ড করান তিনি। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা করেন। নিবন্ধে আরো বলা হয়, চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার অন্তত ১৮ ঘন্টা আগে গোপন রেডিও মনিটর করে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ প্রকাশ করে বিশ্ব গণমাধ্যম।

 

লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্ব পালনকারী সিদ্দিক সালিক-এর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত একটি বিবরণের সত্যতা পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসাবে পাক সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর মুহূর্ত নিয়ে তিনি ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেন “এভাবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল। যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও’র সরকারি তরঙ্গের (ওয়েব লেংনথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কন্ঠের বাণী মনে হলো আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন।

 

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস-এ ওই ঘোষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঘোষণায় বলা হয়, এই-ই হয়তো আপনাদের জন্য আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি- যে যেখানেই খাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন এবং হাতে যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান- যতদিন না দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লার বৈঠকের বিবরণ থেকেও বঙ্গবন্ধুর স্বকন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার পরিকল্পনার কথা ধারণা করা যায়।

 

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের সাথে যেমন আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তেমনি সাথে সাথে তিনি কতকগুলো ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ওর্য়াকও করে যাচ্ছিলেন। ৭ মার্চের পর তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাকে তার কাছে ডেকে পাঠান। তিনি তার সাথে বৈঠক করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারা এ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। বৈঠকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমেদও উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীনতার দলিল ৮ম খন্ডের ২২ থেকে ২৩ পৃষ্ঠায় এ বৈঠকের কথা উল্লেখ আছে। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু নুরুল উল্লাকে একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করে দেয়ার কথা বলেন। ঐ ট্রান্সমিটারে তিনি শেষবারের মত ভাষণ দেয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন।

 

বঙ্গবন্ধু বলেন, নুরুল উল্লা আমাকে ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে হবে।আমি যাবার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। তুমি আমায় কথা দাও, যেভাবেই হোক একটা ট্রান্সমিটার আমার জন্য তৈরি রাখবে। আমি শেষবারের ভাষণ দিয়ে যাব। ড. মোহাম্মদ হান্নান এ ব্যাপারে তার ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেন, বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকের পর নুরুল উল্লা সঙ্গে সঙ্গে এসে বার্তাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিক্ষকদের বলেন। শুরু হয়ে যায় স্বাধীন বাংলার প্রথম রেডিও ট্রান্সমিটার তৈরির কাজ। বিভাগীয় প্রধান ড. জহুরুল হকসহ প্রায় সকল শিক্ষক ৯ দিন কাজ করার পর একটি ট্রান্সমিটার তৈরি করেন। এর সম্প্রচার ক্ষমতা বা শক্তি ছিল প্রায় বাংলাদেশব্যাপী। শর্ট ওয়েভে এর শব্দ ধরা যেতো।

 

অন্যদিকে আব্দুল কুদ্দুস মাখন তার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৯৭০ সালেই বঙ্গবন্ধু আখাউড়া শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি লালমিয়া ও গঙ্গাসাগরের রফিককে একটি রেডিও স্টেশন স্থাপন বিষয়ে যাবতীয় খুটিনাটি বিষয়ে খোঁজ-খবর করার জন্য ভারতে পাঠিয়ে ছিলেন। তাদের মিশনের প্রাক কাজকর্ম স্বাধীন বাংলার প্রথম বেতার কেন্দ্র স্থাপনে সহায়ক হয়েছিল। ২৬ মার্চ ১৯ সংখ্যার একটি নিবন্ধে ড. ফিরোজ মাহমুদ বলেন, ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু করে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর পর্যন্ত দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে একাধিক রেডিওতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্র পাকিস্তানিদের দখলে চলে গেলেও, বঙ্গবন্ধু গোপন তিনটি রেডিও ট্রান্সমিটার তিন জায়গায় প্রস্তুত রেখেছিলেন। পিলখানার এক সুবেদারের কাছে তাঁর একটি প্রি-রেকর্ডেড ভাষণ ছিল। যেটির কোড ‘বলদা গার্ডেন।

 

ক্র্যাক ডাউনের খবর জেনে সেটি প্রচারের লক্ষ্যে ওই সুবেদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে দ্বিতীয় ট্রান্সমিটারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। সেখানে টেলিফোনের মাধ্যমে নতুন করে স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করান বঙ্গবন্ধু। একটু পরেই তা প্রচার করা হয়। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের তিন সাংবাদিকের কাছে এ তথ্য জানিয়েছিলেন বলে জানান ফিরোজ মাহমুদ। বস্তুত লড়াইয়ের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করে যৌক্তিক সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙ্গালীকে মুক্ত করার ঐতিহাসিক ঘোষণার লিখিত রূপ (কালুর ঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রচারিত) ইতিহাসে থাকার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর স্বকন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণার কথাও জানা যাচ্ছে।সূত্র-বাসস।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com