সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক:
হন্তদন্ত হয়ে ইউনিয়ন পরিষদে প্রবেশ করে ইন্দ্রজিৎ দত্ত।
‘আমনে অগো বিচার করেন দাদা, আমনে অগো বিচার করেন।’
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ইউপি চেয়ারম্যান মতি মিয়ার উদ্দেশে কথাগুলো বলে ইন্দ্রজিৎ। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় মতি মিয়া।
ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে একটি জরুরি মিটিংয়ে বক্তব্য দিচ্ছিল মতি মিয়া। উপস্থিত নেতা-কর্মীরাও হতবাক। অবিরাম কেঁদে চলেছে ইন্দ্রজিৎ। দু’হাতে মাটি চাপড়াচ্ছে আর বিলাপ করছে।
‘অরা আমার কলিজা ছিদ্র কইরা দিছে চেয়ারম্যান সাব।’
আর বলতে পারে না। বাকরুদ্ধ হয়ে আসে। নেতা-কর্মীরা একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। মতি মিয়ার জরুরি বক্তব্য অসমাপ্ত থেকে যায়। ইন্দ্রজিৎকে উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়। হঠাৎ করে কোনো কথা বের হয় না তার মুখ থেকে। নেতারা হুট করে বলতেও পারে না। ভেবে-চিন্তে তারপর বলতে হয়। বিচারের জন্য ইন্দ্রজিৎকে আশ্বস্তও করে না। শুধু বলে।
‘কী অইছে? আগে খুইলা কবি তো। না-কি মাইয়া মাইনষের মতো ফ্যাচ-ফ্যাচ কইরা কানবি?’
ইন্দ্রজিৎ উঠে দাঁড়ায়। উপস্থিত নেতা-কর্মীদের মুখের দিকে তাকায়। সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। তিনটি মুখের উপর চোখ পড়তেই ক্ষোভে তার চোখে রক্ত জমে যায়। মুখ তিনটি নিমিষেই শুকিয়ে আমসির মতো হয়ে যায়। তিনটি ঢোক গেলার শব্দ শোনা যায়। দুহাতে চোখ দুটি মুছে নেয় ইন্দ্রজিৎ। রাগে-ক্ষোভে ঠোঁট দুটি ফুলে ফুলে ওঠে। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কোন কথা বলে না।
‘কী কইবা, তাড়াতাড়ি কও। সময় নষ্ট করার সময় নাই।’
উপস্থিত কর্মীদের মধ্য থেকে বলে ওঠে একজন। ইন্দ্রজিতের চক্ষু স্থির হয় তার ওপর। বিক্ষুব্ধ দৃষ্টি আছড়ে পড়ে তার মুখের ওপর। লোকটি মাথা নিচু করে ফেলে। নীরবতায় কেটে যায় কিছুটা সময়।
‘কী আর কইমু? জোর যার মুল্লুক তার।’ নীরবতা ভাঙে ইন্দ্রজিৎ।
‘তা তো বুঝলাম। কী অইছে খুইলা কঅ।’ বলল মতি মিয়া।
‘ক্ষমতার দাপটে আপনেরা আর কত অত্যাচার করবেন?’ মতি মিয়ার চিন্তামগ্ন মুখের ওপর জটিল এক প্রশ্ন ছুড়ে মারে ইন্দ্রজিৎ।
ইন্দ্রজিতের এমন প্রশ্নে খেই হারিয়ে ফেলে মতি মিয়া। কিছু বলার উৎস খুঁজে পায় না। অবনত মস্তকে বসে থাকে। টেবিলে রাখা কাচের গ্লাসটা ডান হাতে নিয়ে ঘোরাতে থাকে।
তিন যুবকের উদ্বিগ্ন তিন জোড়া চোখ নিমিলিত হয়। তবে আশ্বস্ততার ক্ষীণ আভা ছড়িয়ে পড়ে চোখে-মুখে। নেতা থাকতে কোনো ভয় নেই। ক্ষমতায় তাদের চেয়ারম্যান। বিরোধী পক্ষের হলে না হয় থানা পুলিশের ভয় ছিল। এমন কোন থানা নেই যে, তাদের আটকে রাখে। সাক্ষী দেওয়ার মতো কে আছে এ তল্লাটে? একটা মেয়ের মুখের কথায় অনেক বড় সাজা হতে পারে না। যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। চাড়ালের আবার ইজ্জত! যতসব ফেরাউনের দল।
ইন্দ্রজিৎ কাতর চোখে তাকায় মতি মিয়ার দিকে। মতি মিয়া চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে তাকে। নালিশটা উত্থাপন করার ইঙ্গিত দেয়। বিজ্ঞ বিচারকের মতো নড়েচড়ে আরামপ্রদ গদিতে হেলান দিয়ে বসে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইন্দ্রজিৎ। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুবিন্দু মুছতে মুছতে বলতে থাকে, ‘বেশ কয়দিন আগে থেইকা ছগির আমার মাইয়া জয়শ্রীর লগে প্রেম করতে চায়। জয়শ্রী রাজি অয় নাই। তহোন ছগির অরে ধর্ম ছাড়ার জন্য চাপ দেয়। জয়শ্রী তাতেও কান দেয় নাই। শ্যাষে ও গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দেয়। তারপরও জয়শ্রী অরে তোয়াক্কা করে না। কেন করবো? মোরা এই দ্যাশের নাগরিক। আমাগো পূর্বপুরুষরাও এই দ্যাশের লেইগা রক্ত দিছে। আর হের লেইগাই সব শ্যাষে এইডাই আমাগো লাইগা কাল অইয়া দাঁড়াইছে।’
ক্ষণিকের জন্য থামে ইন্দ্রজিৎ।
‘প্রেম করতে চাইছে, তাতে দোষের কী? প্রেম-ভালোবাসা জাত-ধর্ম মানে না-কি?’ ভিড়ের মধ্য থেকে কথাটি বলে এক অর্ধশিক্ষিত যুবক। ইন্দ্রজিতের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় তার ওপর। যুবকের চোখে উপচে পড়ে অত্যুজ্জ্বল প্রেমাগ্নি।
হো হো শব্দে হেসে ওঠে সবাই। কপট একটি রাগ দেখিয়ে সবাইকে ধমক দেয় মতি মিয়া।
‘এই ব্যাটারা, হাসো কেন? লজ্জা-শরমের মাথা খাইছো?’
উপস্থিত জনতা ছিদ্র হওয়া বেলুনের মতো চুপসে যায়। কিছুক্ষণ নীরব থাকে ইউনিয়ন পরিষদ অফিস।
নীরবতা ভাঙল ইন্দ্রজিৎ।
‘আমার কতা শ্যাষ অয় নাই। প্রেম করতে চাইয়াই ক্ষ্যান্ত অয় নাই ছগির।’
ইন্দ্রজিতের কথাটি শেষ হয় না। তাকে থামিয়ে দেয় মতি মিয়া।
‘সত্য না-কি মিয়ারা? এত কিছু ঘটল অথচ আমি এর কিছুই জানলাম না।’ কপাল কুচকে কথাটি বলে মতি মিয়া।
‘এতদিন কাউরে জানাই নাই। এইডাই তো আমাগো অপরাধ।’ বলল ইন্দ্রজিৎ।
কারো মুখে কোন কথা নেই। ইন্দ্রজিৎ বলতে থাকে তার অসমাপ্ত কথাগুলো
‘তাগো ভাব-ভঙ্গিতে জয়শ্রী আস্তে আস্তে ভয় পাইতে থাকে। গতকাইল সে তার মামা বাড়ি হিজলগ্রামের দিকে রওনা দেয়। বদনখালী পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় পৌঁছায়। পথের মাঝখানে ছগির, রমিজ আর কাশেম ওর পথ আটকায়। আমার ছোট পোলার হাত-পা বাইন্ধা একটা গাছের লগে আটকায়া রাহে। জয়শ্রীরে নিয়া যায় গভীর জঙ্গলে।’
আর বলতে পারে না ইন্দ্রজিৎ। হু-হু করে কেঁঁদে ওঠে। উপস্থিত জনতার চোখে-মুখে একটা অপরাধবোধ ছায়া ফেলে। এতটা বাড়াবাড়ি উচিত হয়নি।
মতি মিয়ার মুখের ওপর কে যেন কালি মেখে দিলো। তার মুখটা ক্ষণিকেই বিবর্ণ হয়ে গেল। ছগির, রমিজ ও কাশেমের দৃষ্টি পায়ের বৃদ্ধাঙুলির দিকে নিবদ্ধ হয়। কী জানি কী হয়? চকিতে একবার মুখ তুলে তাকায় মতি মিয়ার দিকে। মতি মিয়ার রক্তবর্ণ চোখ দুটি দেখে খুব ঘাবড়ে যায় ওরা তিনজন।
এর সঠিক বিচার কী হতে পারে? তা-ও স্থির করতে পারে না মতি মিয়া। সমাজে তার মাথা হেট হয়ে যাবে। শত হলেও ওরা তারই একনিষ্ঠ কর্মী। এদিকে মেয়েটির হারানো ইজ্জতই বা কী করে ফেরত দেবে সে। এ নিয়ে আবার সাম্প্রদায়িক চাপও আসতে পারে। তাই এর একটা বিচার তো করতেই হবে।
উপস্থিত কর্মীদের ভেতর থেকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে তিনটি দানব। হুমড়ি খেয়ে পড়ে ইন্দ্রজিতের পায়ের ওপর। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় ইন্দ্রজিৎ। হঠাৎ ছিটকে সড়ে যায় ওদের কাছ থেকে।
‘এত বড় সর্বনাশ কইরা পা ধইরা মাপ চাইলেই বুঝি সব শ্যাষ?’ ঘৃণামিশ্রিত কণ্ঠে কথাটি বলে ইন্দ্রজিৎ।
মতি মিয়ার নির্দেশে উঠে দাঁড়ায় ওরা তিনজন।
রাগত চোখে তাকায় মতি মিয়া। ইন্দ্রজিৎ নির্বিকার। নীরব দর্শকের মতো তাকিয়ে থাকে সবার দিকে।
‘তোরা আমার মান-সম্মান সব ধুলায় মিশায়া দিলি। তোগোরে কাইট্টা কুটি কুচি কইরা গাঙে ভাসায়া দিলেও সঠিক বিচার অয় না।’ মতি মিয়ার কথায় থরথর করে কাঁপতে থাকে ওরা তিনজন।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মতি মিয়া একটা রায় দেয়। প্রত্যেকে দশ হাজার টাকা করে জরিমানা দেবে জয়শ্রীকে। সাথে দশবার করে কানে ধরে উঠ-বস করবে। রায়টা দিয়ে যেন স্বস্তি লাভ করে মতি মিয়া। রায় শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ইন্দ্রজিৎ। মানুষের ইজ্জতের মূল্য কি ত্রিশ হাজার টাকা? মনে মনে ভাবে ইন্দ্রজিৎ।
সবার উদ্দেশে মতি মিয়া বলে, ‘উপস্থিত সবাইকে জানায়া দেই, গ্রামের আর কেউ যেন এই খবর জানতে না পারে। সবাই কইবেন, ভরদুপুরে জঙ্গলের ভেতর দিয়া যাওনের সময় জ্বিন-ভূতে আছড় করছে জয়শ্রীরে। তাই অর মতিভ্রম অইছে। কী ইন্দ্রজিৎ, ঠিক কইছি না?’
সবাই বলল, ‘তা-ই হইবো চেয়ারম্যান সাব। তা-ই হইবো।’
হতভম্বের মতো এদিক-সেদিক তাকায় ইন্দ্রজিৎ। দশবার কান ধরে উঠ-বস করে ওরা তিনজন। ত্রিশ হাজার টাকা ইন্দ্রজিতের হাতের মুঠোয় পুড়ে দেয় মতি মিয়া।
সবাই চলে যেতে দুশ্চিন্তার রেখা মতি মিয়ার ঘামে ভেজা কপালে অঙ্কিত হতে থাকে। চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। যদি ক্ষমতা বদল হয়; তবে এসব ঘটনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। হঠাৎ চিন্তাযুক্ত মুখের ভাবখানা বদলে যায় তার। খুশির ঝিলিক ফুটে ওঠে চোখে-মুখে। কেননা পুনরায় চেয়ারম্যান হওয়ার সব বন্দোবস্ত এখন পাকাপোক্ত। তাকে হটানোর মতো শক্তিশালী কোন লোক বা প্রার্থী এখন আর এলাকায় নেই।
টলতে টলতে পথ চলে ইন্দ্রজিৎ। এই মুখে কীভাবে বাড়ি পৌঁছবে সে। কীভাবে দাঁড়াবে মেয়ের সামনে? বাড়ি যাবে, না-কি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে? ভাবতে পারছে না। পৃথিবীতে ন্যায়বিচার বলে কিছু নেই। এ জনপদ ইন্দ্রজিতের নয়। বিচারের নামে এমন প্রহসন কোন বাবা সহ্য করতে পারে না।
ভাবতে ভাবতে বাড়ির খুব কাছে চলে আসে ইন্দ্রজিৎ। বাড়ির দিকে তাকাতেই আঁতকে ওঠে। এত মানুষ কেন উঠানে? ঘরে ইন্দ্রজিতের স্ত্রী জয়া দত্তের বিলাপ শোনা যায়। ছোট ছেলে অনুপ দত্তের হাতে ভাঙা একখানা দা। সে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। উপস্থিত লোকজন তাকে ধরে রেখেছে।
উঠানে কাপড়ে ঢাকা একটি নিথর মানবদেহ। ইন্দ্রজিতের বুঝতে বাকি নেই। ন্যায়বিচার সে পেয়ে গেছে। উপস্থিত কেউ সান্ত্বনা জানানোর সাহস পেল না। সবার চোখে-মুখে অপরাধবোধ। কেউ কেউ মুখে মুখে খিস্তি ছাড়ছে, ‘শালা জানোয়ারের বাচ্চারা। কচি একটা মাইয়ারে খাবলায়া খাবলায়া খাইছে।’
অধিক শোকে পাথর হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল ইন্দ্রজিৎ। একদিন জয়া বলেছিল ইন্দ্রজিৎকে, ‘চলো, আমরা ইন্ডিয়া চইলা যাই। পোলা-মাইয়া বড় অইতাছে। এইহানে মোগো দেহার কেউ নাই।’ জয়ার সেই কথাগুলো ইন্দ্রজিতের কানে বাজতে থাকে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ইন্দ্রজিৎ। হাঁটু গেড়ে বসে জয়শ্রীর মাথার কাছে। আস্তে আস্তে মুখের কাপড়টা সরায়। সতেজ মুখখানা কেমন নীলবর্ণ হয়ে আছে। গলায় ফাঁসের দাগটা কেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
জয়শ্রীর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা বলতে পারে না ইন্দ্রজিৎ। মতি মিয়ার দেওয়া ত্রিশ হাজার টাকা রাখে জয়শ্রীর মুখের ওপর। নীরবে অশ্রু ঝরে দু’গণ্ড বেয়ে। ইন্দ্রজিতের চোখের জলে সিক্ত হয় অপরাজেয় জয়শ্রীর মুখখানি। সূএ:জাগো নিউজ