সংগৃহীত ছবি
মোস্তফা কামাল :বরবাদের পথে জুলাই ঐক্য। সেই ঐক্যের অংশীজনদের অনৈক্য স্পষ্ট। তাঁরা কে কাকে কী বলছেন, কী করছেন, তার বিস্ময়কর নমুনা অস্পষ্ট নয়। পরস্পরের বিরুদ্ধে হেন বাজে কথা নেই, যা বলতে ছাড়ছেন। তার কিছু কিছু লেখার অযোগ্য। শুনতে অসহ্য। তাঁদের এ ভেদাভেদের সুযোগে আইন-শৃঙ্খলার ক্রমাবনতি ও মববাজির বিস্তার ঘটছে।
জুলাই ঐক্য নষ্ট হলে কপালে খারাবি আছে- সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রাজনৈতিক দলগুলোকে মেসেজটি দিয়ে রেখেছিলেন মাস চারেক আগে গত ফেব্রুয়ারিতেই। তা-ও ইনিয়ে-বিনিয়ে নয়, একদম নরমে-গরমে ক্লিয়ার অ্যান্ড লাউডে। কম কথার মানুষ ওয়াকার সেদিন পরিমাণে একটু বেশিই বলেছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ সেনা দিবসে ‘রাওয়া’ আয়োজিত স্মরণসভায় তাঁর সেই বক্তব্য ঘটনা, সময় ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। সেখানে তিনি সতর্ক-সাবধান-হুঁশিয়ারি যে ভাষাতেই হোক, সময়োচিত দশ কথার কয়েকটি বলতে ছাড়েননি।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা বলেছেন। নির্বাচনের কথাও বলেছেন। নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, তা-ও জানিয়েছেন। তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে চায়ের দোকানেও আলোচনার ঝড় ওঠে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের মুখের ভাষার সঙ্গে সেদিন শরীরের ভাষায়ও ছিল বেশ স্পষ্টতা।
বক্তব্যে কয়েকবার ‘সতর্ক’ শব্দের ব্যবহার করেছেন। খোলাসা করে বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের দিকে ধাবিত হচ্ছি।’ বক্তব্যের আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘আমার উপদেশ গ্রহণ করলে আপনারা লাভবান হবেন, এটা আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি।’
নিজেদের মধ্যে কোনো সমস্যা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, নইলে নিজের ক্ষতি হবে। তখন যেন তাঁকে দোষারোপ করা না হয়, তা আগাম বলে দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় : নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি, হানাহানি বাদ দিয়ে একসাথে ইউনাইটেড হয়ে কাজ করতে হবে। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলবেন সতর্ক করা হয়নি!
সতর্কতা-সাবধানতা, হুমকি বা হুঁশিয়ারি- যে যেভাবেই নেন, জেনারেল ওয়াকার কথার বাকি রাখেননি। তাঁর ওই কঠিন উচ্চারণের মাঝে সময়ের ব্যবধানে এখন কারো কারো মধ্যে বোধহীনতার লক্ষণ। আগে সংস্কার না নির্বাচন, আগে জাতীয় না স্থানীয় নির্বাচন, সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনসহ নানা কথামালা ও তত্ত্ব আওড়ানোর হিড়িকের মাঝে এখন জাতীয় ঐক্য নিয়ে চলছে তামাশাও। সেই সঙ্গে চরিত্রহননের প্রবণতা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার শাসনের পতনের দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পরও সেনাপ্রধান বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁর সেই বক্তব্যেই জানা গিয়েছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয় এবং সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে। সেদিনের বক্তব্যে ভঙ্গি ও ভাষা এমন ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকারের ৯-১০ মাস, রাজনৈতিক দলগুলোর অযাচিত কাজকর্ম, জুলাই বিপ্লবী ছাত্রনেতাদের বাচন-বচনসহ কিছু কারণে জনমনে এক ধরনের অস্বস্তি চলছে। এর মধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনীকে আরো দুই মাস মাঠে রাখার প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। তারা যৌথ বাহিনীর শরিক হয়ে কাজ করছে। শুরু হয়েছে কম্বিং অপারেশনও। ডেভিল হান্ট অভিযান তো চলছেই। মব ভায়োলেন্স বরদাশত না করার কড়া হুঁশিয়ারিও জারি রয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন সঙ্গিন সময়েই রাজনৈতিক অনৈক্য। জুলাই ঐক্যে হেরফের। মহলবিশেষ খুব আশায় ছিল সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি আর থাকছে না। আর মাঠেও থাকবে না। এবার ঠিকই তাদের তুলে নেওয়া হবে। এমন আশায় গুড়ে বালি পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে। তবে রাজনৈতিক অনৈক্যে গণ্ডগোল আরো পাখা মেলার সমূহ বাতাবরণ দেখা যাচ্ছে এবং তা জনগণকে মর্মাহত করছে। ঘুরছে নানা শঙ্কা। সেই ক্ষেত্রে এখনো ভরসার জায়গায় সেনাবাহিনী।
বিচারিক ক্ষমতার সুবাদে অনিবার্য প্রয়োজনে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনীকে প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। অপরাধীদের সরাসরি গ্রেপ্তার করা যাবে। ছাড়াও যাবে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে পুলিশকে নির্দেশও দিতে পারবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশন্ড সেনা কর্মকর্তারা। বেআইনি সভা-সমাবেশ নিজেরা ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারবে, এই কাজে বেসামরিক বাহিনীকেও ব্যবহার করতে পারবে সেনাবাহিনী। এ ছাড়া স্থানীয় উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আদেশ জারি করতে পারবে, আটক করতে পারবে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেও।
এমন এখতিয়ার দেওয়ার পরও বাস্তবে সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার তেমন এক্সেস করছে না, কোথাও বাড়তি বল প্রয়োগেও যাচ্ছে না বলে অনেকের ধারণা। এর নেপথ্যে একদিকে সেনাবাহিনীর পেশাদারি, আরেক দিকে বাস্তবতাবোধ। জনতার পালস উপলব্ধি। কিছু ক্ষেত্রে অন্য দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে মেলানো যাবে না। আরোপিত বা চাপিয়ে দেওয়া নয়, জনতার সঙ্গে সেতুবন্ধ দিয়েই এ দেশে সেনাবাহিনীর জন্ম। আর কোথাও সেনা-জনতার কেমিস্ট্রি বলবৎ থাকলে বাহিনীটির মেজাজ-বৈশিষ্ট্য অন্য রকম হওয়াই স্বাভাবিক।
চব্বিশের গণ-আন্দোলন সেখানে আরেকটি মাত্রা যোগ করেছে। সেনাবাহিনী শেষতক আর শুধুই বাহিনী থাকেনি; জনতার অংশ হয়ে গেছে। একাত্তরে এই মন্ত্রের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম। বাহিনীটির জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠার মূল রহস্য সেখানেই। ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’ মন্ত্রটি সেনা সদস্যদের মনে আপনাআপনিই বাজে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি তাঁরা ছুটে যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন সেবামূলক ও উন্নয়নকাজে। সমতল-পাহাড়-জল-জঙ্গল সবখানেই। তা প্রাকৃতিক বা মানবিক দুর্বিপাকে, বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণকাজেও, পুনর্বাসনেও। সেনাবাহিনীর কর্মপ্রক্রিয়া ও শৃঙ্খলার ধরন এমনই।
দেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে সেনাবাহিনী। পাহাড়ে সেনাবাহিনী আছে বলে পাহাড়ের মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে। পাহাড়ে সেনাবাহিনী আছে বলে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের দেশের একটা অংশ হয়ে আছে। সেখানে শুধু নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না; পাহাড়িদের সেবাও দেয়। দুর্গম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দরিদ্র, অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে সহায়তা, বই ও শিক্ষাসামগ্রীও দেয়। আন্তর্জাতিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের আত্মত্যাগ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারির মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্মান ও গৌরব। ওইসব দেশে মানুষকে শিক্ষাদান, কৃষিকাজ শেখানোর মতো কাজেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রেকর্ড তৈরি করছে।
দেশে রাজনৈতিক একটি দুষ্টচক্রের কাছে সেনাবাহিনী তাই মারাত্মক নাপছন্দের। সেনাবাহিনী কখন মাঠ থেকে সরবে, সেই অপেক্ষা তাদের। কোন অনিবার্য পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেসি সক্ষমতা দিয়ে এখনো সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখা হয়েছে, তা দুর্বোধ্য নয়। তারা আছে বলেই সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে রক্ষা। জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেওয়া, মিল-কারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলো রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ সেনাবাহিনী যেভাবে করে যাচ্ছে, তা বিবেকবানরা উপলব্ধি করছেন মর্মে মর্মে।
প্রথাগতভাবে উপরোক্ত কাজগুলো পুলিশের। কিন্তু ক্ষতবিক্ষত, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া পুলিশকে কাজে ফেরানো এখনো কঠিন কাজ। অন্যান্য বাহিনী একটু একটু করে পেশাদার হয়ে উঠছে। তাদের স্বাভাবিক করে তুলতে বাড়তি শ্রম দিতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। এর সঙ্গে এখন আরো বাড়তি কাজ করতে হচ্ছে নিয়মিত কাজের মতো। এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় নিরাপত্তা, ভূ-আঞ্চলিক নানা চ্যালেঞ্জসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিদের সুচিন্তিত পরামর্শের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যেতে ঐক্য ধরে না রাখলে পরিণতি সম্পর্কে সেনাপ্রধানের আগাম বার্তা ও আহ্বানের কত ওজন, তা যাঁর যাঁর জায়গা থেকে উপলব্ধির বিষয়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন ।
সূএ: বাংংলাদেশ প্রতিদিন