সাজা হয় না হুন্ডি কারবারিদের

ছবি: সংগৃহীত

 

হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা যেন থামছেই না। সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো ব্যাপক নজরদারি, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, নানা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করেও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে হুন্ডিবাণিজ্য। দীর্ঘদিন ধরে অর্থ পাচার ব্যক্তিপর্যায়ে থাকলেও কয়েক বছর ধরে ভয়ংকর এ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠান। নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। হতাশার খবর হলো, কোনো কোনো মামলায় অপরাধের প্রমাণাদিসহ আদালতে চার্জশিট দিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাজার রায়ও দিয়েছেন। তবে নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড দুর্বল করে দেওয়া এসব ভয়ংকর অপরাধী।

 

দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক  বলেন, দুর্নীতিবাজরা অনেক শক্তিশালী, তবে রাষ্ট্র থেকে নয়। তারা বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করে উচ্চ আদালতে মামলা ‘স্টে’ করিয়ে রাখছেন।

 

তিনি বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় দুদক শতভাগ সফল। যদিও মামলা দায়ের করতে আমাদের কিছুটা দেরি হয়। তবে আইনের মধ্যে থেকে আমরা কাজ করেই যাব। আদালতে দুদক জিতলে দেশ জেতে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ চলবেই। দুদক দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেয় না, ভবিষ্যতেও দেবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হয় লন্ডনে। এর পরের অবস্থানে দুবাই ও মালয়েশিয়া। তবে তাদের অভিমত হলো, অর্থ পাচার প্রতিরোধ করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। প্রয়োজনে সব সংস্থার অর্থ পাচার প্রতিরোধ ইউনিটকে এক হয়ে কাজ করতে হবে, তা হলেই সফলতা আসবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ডলার সংকট সমস্যার উত্তরণের জন্য হুন্ডি বা অর্থ পাচার বন্ধে জিরো টলারেন্স বজায় রাখতে হবে। হুন্ডি বন্ধ হলেই দেশের ডলার বাজারে চলমান অস্থিরতা কাটবে। এজন্য ছোট ছোট চুনোপুঁটির চেয়ে রাঘববোয়ালদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, বিভিন্ন মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই হন্ডির কারবার চলছে দেশব্যাপী। এমএফএসের মাধ্যমে হুন্ডি কারবার করে এমন ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০২১ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। ওই ৫ হাজার এজেন্ট গত বছরের মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ২৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। সিআইডিসূত্র বলছেন, সংঘবদ্ধ হুন্ডিচক্র প্রবাসে বাংলাদেশিদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা দেশে না পাঠিয়ে এর সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। অপরাধীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজটি করে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে এবং দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপে আছে অর্থ পাচারকারী ও তাদের সহযোগীরা। তারা দেশি মুদ্রায় ওই অর্থ এমএফএস এজেন্টদের প্রদান করে। তৃতীয় গ্রুপ তথা এমএফএস এজেন্টরা বিদেশে অবস্থানকারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত এমএফএস নম্বরে দেশি মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে। এসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে। সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা  বলেন, গত বছর সেপ্টেম্বরে যে ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের সবাই এমএফএসের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতারের পর তারা জানিয়েছিলেন, গ্রেফতারের আগে মাত্র চার মাসেই ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচার করেছেন তারা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানি লন্ডারিং মামলার কাক্সিক্ষত ফল না আসার কারণ হলো, আইনি জটিলতা, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, আদালতে আসামিপক্ষের সময় ক্ষেপণ, সমন্বয়ের অভাব ও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ। তবে এ বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদরে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করা উচিত। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখা উচিত। প্রয়োজনে মানি লন্ডারিং মামলার বিচারের জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। দুদকসূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ১১৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৩টির তদন্ত চলছে। ৩২টি মামলার চার্জশিট এবং দুটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তদন্তাধীন ৮৩ মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ১১ আসামি। অনুসন্ধানাধীন রয়েছে হাজারের বেশি অভিযোগ। আদালতসূত্রের তথ্যানুযায়ী, গত ২০ বছরে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে ৭৫২টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ৩৯৭ মামলায়। ৩৫৫ মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১০ মামলায়। ঢাকার আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে এই সময়ে ৫৬টির রায় হয়েছে। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৪৪ মামলায়। মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতির বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, অর্থ পাচার মামলা প্রমাণ করা অনেক কঠিন ব্যাপার। যদিও দুদক অনেক ক্ষেত্রেই সফল। তিনি বলেন, এর প্রধান সমস্যা হচ্ছে ধরা যায়, বোঝা যায়, কিন্তু প্রমাণ করা যায় না। দুদকের অর্থ পাচার মামলায় মামলা নিষ্পত্তি এবং সাজার হার খুবই ভালো। তবে সিআইডির মামলায় সাজার হার কম। দৃশ্যমানভাবে সিআইডির দুটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। অনেক মামলা তদন্ত ও বিচার পর্যায়ে রয়েছে। খুরশীদ আলম খান বলেন, সিআইডির মামলা নিষ্পত্তির হার কম থাকার কারণ হলো, দুদকের যেমন স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউশন উইং রয়েছে, সিআইডির নিজস্ব কোনো প্রসিকিউশন নেই। আমি তাদের অনেকবার বলেছি স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউশন উইং করার জন্য। তবে এটা এখনো হয়নি। আমি মনে করি এটা খুব দ্রুতই হবে। তিনি বলেন, দুদক ও সিআইডির পাশাপাশি শুল্ক গোয়েন্দাও অর্থ পাচারের কিছু মামলা করে। তারা মূলত বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচারের মামলা করতে পারে। অনেক সময়ই দেখা যায়, আন্ডার রেট, ওভার রেট ইনভয়েসিংয়ের ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। তিনি বলেন, শুল্ক গোয়েন্দাদের এ ধরনের মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নেই। তাই অধিকাংশ সময়ই তারা বিএফআইইউ, দুদক, সিআইডির কাছে ধরনা দেয়। তাই আমি মনে করি শুল্ক গোয়েন্দার অর্থ পাচার অংশটা যদি দুদকের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায়, তাহলে মামলা নিষ্পত্তি অনেক বাড়বে। সুপ্রিম কোর্টের এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, সামগ্রিকভাবে অর্থ পাচার প্রতিরোধে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজনে সব সংস্থাকে এ বিষয়ে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তা হলেই সফলতা আসবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ  বলেন, ডলার সংকট সমস্যার সমাধানে হুন্ডি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে। তিনি বলেন, হুন্ডি ঠেকিয়ে রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে ব্যাংকগুলোর এজেন্টদের প্রবাসীদের দোরগোড়ায় গিয়ে (যেভাবে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা যায়) অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।

 

তিনি বলেন, ব্যাংকে গিয়ে প্রবাসীরা টাকা জমা দিয়ে দেশে পাঠাবেন সেটা ভেবে বসে থাকলে হবে না। কারণ হুন্ডি ব্যবসায়ীরা তো এত কিছু করে না। শুধু টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করে কত টাকা। এরপর টাকা পাঠিয়ে দেয়। মোট কথা রেমিট্যান্স সংগ্রহের সেবাটা আরও ভালো করতে হবে। প্রবাসীরা প্রপার সার্ভিস পান না। আমি নিজে দেখেছি টাকা পাঠাতে ১০০ মাইল দূর থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আসতে হয়। সপ্তাহে এক দিন ছুটি নিয়ে এভাবে টাকা পাঠাবে কেন! সৌদি আরব অনেক বিরাট জায়গা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন প্রবাসীরা। তারা কি রিয়াদ বা জেদ্দায় গিয়ে টাকা পাঠাবেন? বারবার বলা হচ্ছে রেমিট্যান্স আহরণটা সহজ করতে। রেটও আটকে রাখা হয়েছে। দরকার হলে আরও বেশি দিতে হবে রেট। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে কত দিন!

 

তিনি বলেন, কাঁচামাল, মেশিনারি আসবে না। ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। কর্মসংস্থান বন্ধ হবে। নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বরং কীভাবে ডলার বাড়ানো যায় তা চিন্তা করেন। হুন্ডিটা কমাতে পারলে বেস্ট। আর এখান থেকে যাতে টাকা না যায়, সেজন্য বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে আরও শক্তভাবে ধরতে হবে। এরপর যেন আর কোনো টাকা না যায়। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে হবে। তবে এটা মুখের কথায় হবে না। সত্যিকারের বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি ও উন্নত করতে হবে। কারণ বিদেশিরা জানেন আমাদের দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ কেমন।   সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ধমক দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত করতে চাইলে বিএনপি সহ্য করবে না : ফারুক

» পিআর ইস্যুতে যা বললেন মঈন খান

» ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণার পরিসর বাড়ানোর আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

» আসিফের অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

» দেশের স্বার্থে বন্দর ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে : নৌপরিবহন উপদেষ্টা

» বিশেষ অভিযানে মোট ১ হাজার ৩৫৩ জন গ্রেফতার

» হজ শেষে ফিরেছেন ৬০ হাজার ৫১৩ হাজি

» জামালপুরে নারী এগিয়ে চলা প্রকল্পের সভা অনুষ্ঠিত

» জিয়াউর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে  মোরেলগঞ্জে বিএনপির বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি

» ইসলামপুরে রহিম মেম্বার হত্যা সন্দেহে দুইজন আটক

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সাজা হয় না হুন্ডি কারবারিদের

ছবি: সংগৃহীত

 

হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা যেন থামছেই না। সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো ব্যাপক নজরদারি, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, নানা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করেও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে হুন্ডিবাণিজ্য। দীর্ঘদিন ধরে অর্থ পাচার ব্যক্তিপর্যায়ে থাকলেও কয়েক বছর ধরে ভয়ংকর এ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠান। নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। হতাশার খবর হলো, কোনো কোনো মামলায় অপরাধের প্রমাণাদিসহ আদালতে চার্জশিট দিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাজার রায়ও দিয়েছেন। তবে নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড দুর্বল করে দেওয়া এসব ভয়ংকর অপরাধী।

 

দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক  বলেন, দুর্নীতিবাজরা অনেক শক্তিশালী, তবে রাষ্ট্র থেকে নয়। তারা বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ করে উচ্চ আদালতে মামলা ‘স্টে’ করিয়ে রাখছেন।

 

তিনি বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় দুদক শতভাগ সফল। যদিও মামলা দায়ের করতে আমাদের কিছুটা দেরি হয়। তবে আইনের মধ্যে থেকে আমরা কাজ করেই যাব। আদালতে দুদক জিতলে দেশ জেতে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ চলবেই। দুদক দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেয় না, ভবিষ্যতেও দেবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হয় লন্ডনে। এর পরের অবস্থানে দুবাই ও মালয়েশিয়া। তবে তাদের অভিমত হলো, অর্থ পাচার প্রতিরোধ করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। প্রয়োজনে সব সংস্থার অর্থ পাচার প্রতিরোধ ইউনিটকে এক হয়ে কাজ করতে হবে, তা হলেই সফলতা আসবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ডলার সংকট সমস্যার উত্তরণের জন্য হুন্ডি বা অর্থ পাচার বন্ধে জিরো টলারেন্স বজায় রাখতে হবে। হুন্ডি বন্ধ হলেই দেশের ডলার বাজারে চলমান অস্থিরতা কাটবে। এজন্য ছোট ছোট চুনোপুঁটির চেয়ে রাঘববোয়ালদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, বিভিন্ন মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই হন্ডির কারবার চলছে দেশব্যাপী। এমএফএসের মাধ্যমে হুন্ডি কারবার করে এমন ৫ হাজারের বেশি এজেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০২১ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ৭.৮ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। ওই ৫ হাজার এজেন্ট গত বছরের মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ২৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। সিআইডিসূত্র বলছেন, সংঘবদ্ধ হুন্ডিচক্র প্রবাসে বাংলাদেশিদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা দেশে না পাঠিয়ে এর সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। অপরাধীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজটি করে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে এবং দেশ থেকে যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপে আছে অর্থ পাচারকারী ও তাদের সহযোগীরা। তারা দেশি মুদ্রায় ওই অর্থ এমএফএস এজেন্টদের প্রদান করে। তৃতীয় গ্রুপ তথা এমএফএস এজেন্টরা বিদেশে অবস্থানকারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত এমএফএস নম্বরে দেশি মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে। এসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণ চোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে। সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা  বলেন, গত বছর সেপ্টেম্বরে যে ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের সবাই এমএফএসের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতারের পর তারা জানিয়েছিলেন, গ্রেফতারের আগে মাত্র চার মাসেই ২০ কোটি ৭০ লাখ টাকা পাচার করেছেন তারা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানি লন্ডারিং মামলার কাক্সিক্ষত ফল না আসার কারণ হলো, আইনি জটিলতা, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, আদালতে আসামিপক্ষের সময় ক্ষেপণ, সমন্বয়ের অভাব ও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ। তবে এ বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদরে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করা উচিত। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখা উচিত। প্রয়োজনে মানি লন্ডারিং মামলার বিচারের জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। দুদকসূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ১১৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৩টির তদন্ত চলছে। ৩২টি মামলার চার্জশিট এবং দুটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তদন্তাধীন ৮৩ মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ১১ আসামি। অনুসন্ধানাধীন রয়েছে হাজারের বেশি অভিযোগ। আদালতসূত্রের তথ্যানুযায়ী, গত ২০ বছরে অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে ৭৫২টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ৩৯৭ মামলায়। ৩৫৫ মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে। আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১০ মামলায়। ঢাকার আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে এই সময়ে ৫৬টির রায় হয়েছে। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৪৪ মামলায়। মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতির বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, অর্থ পাচার মামলা প্রমাণ করা অনেক কঠিন ব্যাপার। যদিও দুদক অনেক ক্ষেত্রেই সফল। তিনি বলেন, এর প্রধান সমস্যা হচ্ছে ধরা যায়, বোঝা যায়, কিন্তু প্রমাণ করা যায় না। দুদকের অর্থ পাচার মামলায় মামলা নিষ্পত্তি এবং সাজার হার খুবই ভালো। তবে সিআইডির মামলায় সাজার হার কম। দৃশ্যমানভাবে সিআইডির দুটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। অনেক মামলা তদন্ত ও বিচার পর্যায়ে রয়েছে। খুরশীদ আলম খান বলেন, সিআইডির মামলা নিষ্পত্তির হার কম থাকার কারণ হলো, দুদকের যেমন স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউশন উইং রয়েছে, সিআইডির নিজস্ব কোনো প্রসিকিউশন নেই। আমি তাদের অনেকবার বলেছি স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউশন উইং করার জন্য। তবে এটা এখনো হয়নি। আমি মনে করি এটা খুব দ্রুতই হবে। তিনি বলেন, দুদক ও সিআইডির পাশাপাশি শুল্ক গোয়েন্দাও অর্থ পাচারের কিছু মামলা করে। তারা মূলত বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচারের মামলা করতে পারে। অনেক সময়ই দেখা যায়, আন্ডার রেট, ওভার রেট ইনভয়েসিংয়ের ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। তিনি বলেন, শুল্ক গোয়েন্দাদের এ ধরনের মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নেই। তাই অধিকাংশ সময়ই তারা বিএফআইইউ, দুদক, সিআইডির কাছে ধরনা দেয়। তাই আমি মনে করি শুল্ক গোয়েন্দার অর্থ পাচার অংশটা যদি দুদকের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায়, তাহলে মামলা নিষ্পত্তি অনেক বাড়বে। সুপ্রিম কোর্টের এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, সামগ্রিকভাবে অর্থ পাচার প্রতিরোধে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজনে সব সংস্থাকে এ বিষয়ে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তা হলেই সফলতা আসবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ  বলেন, ডলার সংকট সমস্যার সমাধানে হুন্ডি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে। তিনি বলেন, হুন্ডি ঠেকিয়ে রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে ব্যাংকগুলোর এজেন্টদের প্রবাসীদের দোরগোড়ায় গিয়ে (যেভাবে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা যায়) অর্থ সংগ্রহ করতে হবে।

 

তিনি বলেন, ব্যাংকে গিয়ে প্রবাসীরা টাকা জমা দিয়ে দেশে পাঠাবেন সেটা ভেবে বসে থাকলে হবে না। কারণ হুন্ডি ব্যবসায়ীরা তো এত কিছু করে না। শুধু টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করে কত টাকা। এরপর টাকা পাঠিয়ে দেয়। মোট কথা রেমিট্যান্স সংগ্রহের সেবাটা আরও ভালো করতে হবে। প্রবাসীরা প্রপার সার্ভিস পান না। আমি নিজে দেখেছি টাকা পাঠাতে ১০০ মাইল দূর থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আসতে হয়। সপ্তাহে এক দিন ছুটি নিয়ে এভাবে টাকা পাঠাবে কেন! সৌদি আরব অনেক বিরাট জায়গা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন প্রবাসীরা। তারা কি রিয়াদ বা জেদ্দায় গিয়ে টাকা পাঠাবেন? বারবার বলা হচ্ছে রেমিট্যান্স আহরণটা সহজ করতে। রেটও আটকে রাখা হয়েছে। দরকার হলে আরও বেশি দিতে হবে রেট। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে কত দিন!

 

তিনি বলেন, কাঁচামাল, মেশিনারি আসবে না। ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। কর্মসংস্থান বন্ধ হবে। নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বরং কীভাবে ডলার বাড়ানো যায় তা চিন্তা করেন। হুন্ডিটা কমাতে পারলে বেস্ট। আর এখান থেকে যাতে টাকা না যায়, সেজন্য বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে আরও শক্তভাবে ধরতে হবে। এরপর যেন আর কোনো টাকা না যায়। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে হবে। তবে এটা মুখের কথায় হবে না। সত্যিকারের বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি ও উন্নত করতে হবে। কারণ বিদেশিরা জানেন আমাদের দেশের বিনিয়োগের পরিবেশ কেমন।   সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com