আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমের সুরা হুজরাতের একটি আয়াতে তিনটি কাজকে হারাম করেছেন। যা সামাজিক রীতি-নীতি ও মানুষের পারস্পরিক অধিকারের সঙ্গে জড়িত। বিষয়গুলো হলো- গিবত করা, কারো দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানো এবং ধারণা করা। এগুলো ইসলামে নিষিদ্ধ কাজ। এর পরিণামও খুবই ভয়াবহ। আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি ৩টি সম্পর্কে আয়াত নাজিল করেছেন এভাবে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا کَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ وَّ لَا تَجَسَّسُوۡا وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا ؕ اَیُحِبُّ اَحَدُکُمۡ اَنۡ یَّاۡکُلَ لَحۡمَ اَخِیۡهِ مَیۡتًا فَکَرِهۡتُمُوۡهُ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ تَوَّابٌ رَّحِیۡمٌ
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা বহুবিধ ধারণা হতে দূরে থাক; কারণ কোনো কোনো ধারণা পাপ আর তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা (গীবত) করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো এটাকে ঘৃণ্যই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা আল-হুজুরাত : আয়াত ১২)
এই আয়াতে মহান প্রভু মানুষের পারস্পরিক হক ও সামাজিক রীতি-নীতি ব্যক্ত করেছেন। এতে তিনটি বিষয়কে হারাম করেছেন। এক. ধারণা; দুই. কোন গোপন দোষ সন্ধান করা এবং তিন. গীবত ; কোন ব্যক্তি সম্পর্কে এমন কথা বলা যা সে শুনলে সে নিজেকে অসহনীয় মনে করতো বা নিজের মনে কষ্ট পেতো।
এ তিনটি বিষয়ের মধ্যে মানুষের দোষ খুঁজে বেড়ানো সবচেয়ে মারাত্মক ঘৃণ্য অপরাধ। এ তিনটি বিষয়ের প্রথমটি হচ্ছে-
> ধারণা
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কারও আল্লাহর প্রতি সু-ধারণা পোষণ করা ছাড়া মৃত্যুবরণ করা উচিত নয়।’ (মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
২. অন্য হাদিসে এসেছে ‘আমি আমার বান্দার সাথে তেমনি ব্যবহার করি, যেমন সে আমার সম্বন্ধে ধারণা রাখে। এখন সে আমার প্রতি যা ইচ্ছা ধারণা রাখুক।’ (মুসনাদে আহমাদ)
এ থেকে জানা যায় যে, আল্লাহর প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করা ফরজ এবং কু-ধারণা পোষণ করা হারাম। এমনিভাবে যেসব মুসলিম বাহ্যিক অবস্থার দিক দিয়ে সৎকর্মপরায়ণ দৃষ্টিগোচর হয়, তাদের সম্পর্কে প্রমাণ ছাড়া খারাপ মন্তব্য করাও হারাম। হাদিসে এসেছে-
৩. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কেননা ধারণা মিথ্যা কথার নামান্তর।’ (বুখারি, মুসলিম)
> দোষ খুঁজে বেড়ানো
এ আয়াতে দ্বিতীয় নিষিদ্ধ বিষয় হচ্ছে, কারও দোষ খুঁজে বেড়ানো। এর দ্বারা নানান ধরনের ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হয়। এ কারণে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর খুতবায় দোষ অন্বেষণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন-
১. ‘হে লোক সকল! যারা মুখে ঈমান এনেছো কিন্তু এখনো ঈমান তোমাদের অন্তরে প্ৰবেশ করেনি, তোমরা মুসলিমদের গোপনীয় বিষয় খুঁজে বেড়াবে না। যে ব্যক্তি মুসলিমদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটির অন্বেষণে লেগে যাবেন। আর আল্লাহ যার ত্রুটি খুঁজে বেড়াবেন তাকে তার ঘরের মধ্যে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন।’ (আবু দাউদ)
২. হজরত মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি নিজে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘তুমি যদি মানুষের গোপনীয় বিষয় জানার জন্য পেছনে লাগো। তাদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে কিংবা অন্তত বিপর্যয়ের দ্বার প্রান্তে পৌছে দেবে।’ (আবু দাউদ)
৩. অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুসলিমদের গিবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা যে ব্যক্তি মুসলিমদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আল্লাহ যার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে নিজ ঘরেও লাঞ্ছিত করে দেন।’ (আবু দাউদ)
মনে রাখতে হবে
৪. গোপন দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান না করার এ নির্দেশ শুধু ব্যক্তির জন্যই নয়, বরং ইসলামি সরকারের জন্যও এটি দিকনির্দেশনা। এ ক্ষেত্রে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা শিক্ষণীয়। তাহলো-
‘একবার রাতের বেলা তিনি (হজরত ওমর) এক ব্যক্তির কণ্ঠ শুনতে পেলেন। সে গান গাইতেছিল। তাঁর সন্দেহ হলো। তিনি তার সঙ্গী আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, এ ঘরটি কার? বলা হলো- এটা রবিআ ইবন উমাইয়া ইবন খালফ এর ঘর। তারা এখন শরাব খাচ্ছে। আপনার কি অভিমত?
এরপর হজরত আব্দুর রাহমান ইবন আওফ বললেন, আমার অভিমত হচ্ছে যে, আমরা আল্লাহ যা নিষেধ করেছে তা-ই করে ফেলছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের তা করতে নিষেধ করে বলেছেন- ‘তোমরা গোপন বিষয়ে অন্বেষণ করো না।’ (সুরা আল-হুজুরাত : আয়াত ১২) তখন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ফিরে আসলেন এবং তাকে ছেড়ে গেলেন।’ (মুসতাদরাকে হাকেম, মুসান্নাফে আব্দির রাজ্জাক)
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, খুঁজে খুঁজে মানুষের গোপন দোষ-ত্রুটি বের করা এবং তারপর তাদের পাকড়াও করা শুধু ব্যক্তির জন্যই নয়, ইসলামি রাষ্ট্র প্রধান বা দায়িত্বশীলদের জন্যও বৈধ নয়।
৫. এ হাদিসে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘শাসকরা যখন সন্দেহের বশে মানুষের দোষ অনুসন্ধান করতে শুরু করে তখন তাদের চরিত্র নষ্ট করে দেয়।’ (আবু দাউদ)
> গিবত করা
আয়াতে নিষিদ্ধ তৃতীয় বিষয় হচ্ছে ‘গিবত’। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে কারো এমন কথা বলা- যা শুনলে সে অপছন্দ করবে। প্রশ্ন হলো, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সত্যিই থেকে থাকে তাহলে আপনার মত কি? তিনি বললেন, ‘তুমি যা বলছো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলেই তো তুমি তার ‘গিবত’ করলে। আর তা যদি না থাকে তাহলে ‘অপবাদ’ আরোপ করলে।’ (মুসলিম, আবু দাউদ তিরমিজি)
আয়াতে তিনটি বিষয়ের মধ্যে গিবতের নিষিদ্ধতাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমনকি এটিকে মৃত মুসলিম ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমতুল্য প্রকাশ করে এর নিষিদ্ধতা ও নীচতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নবিজী মিরাজের রাতের হাদিসে বলেন, ‘তারপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল, আমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছ দিয়ে গেলাম যাদের নখ ছিল তামার। তারা তাদের মুখমণ্ডল ও দেহের মাংস আচড়াচ্ছিল। আমি জিবরিল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, ‘এরা তাদের ভাইয়ের গীবত করত এবং তাদের ইজ্জতহানি করতো।’ (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ)
আয়াতে উল্লেখিত তিনটি বিষয়ই মানুষের জন্য নিষিদ্ধ। যা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। ধারণা করে মিথ্যাচার ও পাপের কাজে নিজেকে না জড়ানো। কারো কোনো গোপন দোষ-ত্রুটি পেলে বদনাম করা থেকে বিরত থাকা। যদি কারো কোনো গোপন দোষ-ত্রুটি কেউ জেনে ফেলে তবে তা গোপন করা। মানুষের সামনে না বলা। কিংবা কারো দোষ না খোঁজা। গিবতের মতো মারাত্মক ও ভয়াবহ নিষিদ্ধ কাজে না জড়ানো।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনুল কারিমের এ আয়াতের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। উল্লেখিত তিনটি বিষয়ের ব্যাপারে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করার তাওফিক দান করুন। আমিন। সূএ:জাগোনিউজ২৪.কম