ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্রহনন আর নয়

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক:  ধর্ষণের অভিযোগে বিচারাধীন আসামিদের পক্ষে ধর্ষিতা নারীর চরিত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যাবে না বলে সাক্ষ্য আইনে পরিবর্তন আনার খবরটি আইনের শাসন এবং অপরাধ দমনে বিশ্বাসী সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। খবরটি দেখে আমার মনে পড়ল ১৯৯৮ সালের ইয়াসমিন ধর্ষণ-হত্যা মামলার কথা। রাষ্ট্রের একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে হাই কোর্টে এ মামলাটি পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। আমার সহকারী হিসেবে ছিলেন সে সময়ের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দ হায়দার আলি। হাই কোর্টেই এবং পরে আপিল বিভাগে তিন পুলিশ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল হওয়ার পর তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল।

 

তবে এ মামলার গতিপথ ছিল দুর্গম। একসময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট সহোদরা কুখ্যাত ‘চকলেট আপা’ এ মামলা বাধাগ্রস্ত করার জন্য স্বর্গ-নরক এক করে ফেলেছিলেন। এ মামলা নষ্ট করার জন্য হেন কিছু নেই যা তিনি করেননি আসামিদের এবং সে সময়ে জেলার ডিসি ও এসপিকে বাঁচানোর জন্য। ডিসি ও এসপির পরামর্শ এবং সহায়তাক্রমে চকলেট আপার সিদ্ধান্তে সারা শহরে মাইক এবং সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হলো, ইয়াসমিন একজন পতিতা। কুখ্যাত সেই ডিসি ও এসপি চকলেট আপাকে তুষ্ট করার জন্য জেলার সব সাংবাদিককে ডেকে ঘোষণা করল ইয়াসমিন পতিতা। শহরের পরিচিত কয়েকজন যৌনকর্মীকে সাক্ষী হিসেবে সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত করতে সেই কলঙ্কিত ডিসি-এসপির অসুবিধা হয়নি। চকলেট আপা, ডিসি ও এসপি কর্তৃক মামলা ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টার প্রতিবাদে জনগণ ফুঁসে উঠলে তাদের ওপর গুলি চালানো হলে সাতটি নিরীহ প্রাণ ঝরে পড়েছিল। সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা যৌনকর্মীরা ডিসি-এসপির সুরে সুর মিলিয়ে বলল, ইয়াসমিন তাদেরই এক সহযৌনকর্মী কিন্তু দিনাজপুরের কৃতীপুরুষ, বিখ্যাত মানবাধিকার নেতা, একসময়ের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুর রহিম সাহেব, যিনি মাননীয় বিচারপতি এনায়েতুর রহিম ও হুইপ ইকবালুর রহিমের পিতা, বিরামহীন প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে মামলাটি অবশেষে দিনের আলো দেখতে পেয়েছিল। মামলা চলাকালেও আসামিরা চকলেট আপা এবং ডিসি-এসপির যোগসাজশে এ মর্মে সাক্ষী হাজির করা হয়েছিল যে ইয়াসমিন একজন পতিতা। কিন্তু সব আদালতই যথার্থভাবে বলেছিল একজন যৌনকর্মীও ‘না’ বলার অধিকারী। সেদিন চকলেট আপা গংদের শত বিপত্তির মুখে আইনের শাসনের, তথা বিচার বিভাগের দৃঢ়তার জয় হয়েছিল, যে মামলাটি নিশ্চিতভাবে আমাদের বিচারিক ইতিহাসে এক মাইলফলক রায় হিসেবে চিরদিন প্রশংসিত হবে। এ মামলা আমার জীবনেও স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। সেদিন সেই ধিকৃত খালেদা সহোদরা চকলেট আপার নামও সর্বকালে কলঙ্কভরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। স্বর্ণাক্ষরে লেখা রবে অ্যাডভোকেট আবদুর রহিমের নাম। দিনাজপুর শহরে ইয়াসমিনের নামে একটি সৌধও গড়া হয়েছে। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের ধর্ষণের সংজ্ঞা হলো কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করা বিধায় সংশ্লিষ্ট নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, এ জঘন্য অপরাধের সবচেয়ে বড় উপাদান এবং এজন্য সংশ্লিষ্ট মহিলার চরিত্র কোনোক্রমেই বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। সেই অর্থে এমনকি একজন যৌনকর্মীও অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে তা-ও ধর্ষণের অপরাধ হবে, আর এ বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু নজির রয়েছে। এমনকি কোনো স্বামী স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করলে তা-ও আইনের দৃষ্টিতে ধর্ষণ, অর্থাৎ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বহু দেশের উচ্চ আদালত এ অপরাধের জন্য অনেক স্বামীকে সাজা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে ধর্ষণ মামলায় আসামির পক্ষের আইনজীবীরা ধর্ষিতা মহিলাকে তার চরিত্র সম্পর্কে এমন সব প্রশ্ন করেন যার ফলে ধর্ষিতা মহিলা আদালতে জেরার সময় দ্বিতীয়বার ধর্ষিতা হন। এসব ক্ষেত্রে আদালতের দায়িত্ব এসব প্রশ্ন করতে না দেওয়া হলেও বিজ্ঞ বিচারকরা খুব কম ক্ষেত্রেই তা করেন। এ কারণে বহু ধর্ষিতাই আদালতে সাক্ষ্য দিতে অপারগ হন। ধর্ষণ মামলায় সাজার হার অতিনিম্নমুখী হওয়ার এটি অন্যতম কারণ। যুক্তরাজ্য, এমনকি ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই আইন রয়েছে ধর্ষিতাকে তার চরিত্রের ওপর প্রশ্ন না করার। অনেক দেশেই ধর্ষিতার সাক্ষ্য প্রকাশ্য আদালতে না নিয়ে ভিডিও পদ্ধতিতে নেওয়ার বিধান রয়েছে, কেননা প্রকাশ্য আদালতে ধর্ষককে দেখলে ধর্ষিতা ভয়ে সাক্ষ্য দিতে ভীত হতে পারেন। কয়েক মাস আগে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড করার পরও ধর্ষণ চলছে। এর পেছনে যেসব কারণ রয়েছে তার অন্যতম হলো আসামিদের জামিনে মুক্তি দেওয়া। জামিনে মুক্তি পেয়ে আসামিরা ধর্ষিতা এবং অন্য সাক্ষীদের টাকার লোভ ও ভয় দেখিয়ে সাক্ষ্যদানে বিরত করে যার ফলে আর সাজা হয় না। অনেক সময় জামিনে মুক্ত হয়ে অপরাধীরা পুনরায় অপরাধটি করে।

 

এটা ঠিক যে জামিন-অযোগ্য অপরাধে জামিন দেওয়া-না দেওয়া আদালতের এখতিয়ারের ব্যাপার। কিন্তু পুলিশ দুর্বল ফরওয়ার্ডিং বা প্রতিবেদন দিলে আদালতের খুব একটা কিছু করার থাকে না। এ ছাড়া সরকার পক্ষে আইনজীবীদেরও দায়িত্ব রয়েছে শক্ত ভাষায় জামিনের বিরোধিতা করা, রিমান্ড প্রার্থনা করা। একসময় ধরা হতো শুধু ধর্ষিতার সাক্ষ্যে সাজা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু দুই দশক আগে ভারত ও বাংলাদেশের উচ্চ আদালতগুলো এ মর্মে রায় দিয়েছে যে আদালত ধর্ষিতার সাক্ষ্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করলে তার একক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করেই সাজা দেওয়া যায়। বেশ কয়েক বছর আগে বরিশালের বহুল আলোচিত স্মৃতিকণা ধর্ষণ মামলায় হাই কোর্ট এ মর্মে রায় দিয়েছিল যে ধর্ষিতার জবানবন্দি বিশ্বাসযোগ্য বিবেচিত হলে তার একক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করেই সাজা না দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। সে রায় আপিল বিভাগ নিশ্চিত করায় এটিই বর্তমানে আইন। অর্থাৎ ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণের জন্য ধর্ষিতার সাক্ষ্যের সমর্থনে কোনো অতিরিক্ত বা করাবোরেটিভ সাক্ষ্যের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ রায় সম্পর্কে নিম্ন আদালতের অনেক বিচারকই অবগত নন মনে হচ্ছে। অনেক আইনজ্ঞ এমনকি গবেষকও এটি জানেন না বলে ‘করাবোরেটিভ সাক্ষ্যের’ কথা বলেন। তা ছাড়া ডিএনএ প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে ধর্ষকের পরিচয় শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব, যার কারণে নতুন আইনে ডিএনএর নমুনা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ডিএনএ প্রযুক্তির এতটাই উন্নতি হয়েছে যে বীর্য বা রক্ত ছাড়াও অর্থাৎ এমনকি চুলের গোড়া, নখের নমুনা দিয়েও ডিএনএ প্রোফাইল বের করা যায়। অর্থাৎ ধর্ষিতার দেহের অভ্যন্তর বা কাপড় থেকে ধর্ষকের বীর্য ধুয়ে ফেলা হলেও ধর্ষিতার গায়ে বা আশপাশে ধর্ষকের চুল, নখ পাওয়া গেলে, যা সচরাচর সম্ভব, ডিএনএ পরীক্ষা করা যায়। তবে বীর্যই সর্বোত্তম এবং এ কারণেই সময় ক্ষেপণ না করে ধর্ষিতার দেহ থেকে বীর্যের নমুনা সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয়। অনেক সময় তথাকথিত সমাজপতিরা সালিশির মাধ্যমে সামান্য জরিমানা করে ধর্ষককে মুক্তি দেন। এটা শুধু বেআইনিই নয়, অপরাধও। ধর্ষণ একটি গুরুতর, আপস-অযোগ্য অপরাধ বিধায় যারা এ ধরনের সালিশ করেন তারা আইনি বিচারের পথ রুদ্ধ করে অপরাধ করেন এবং তাই তাদের বিচারে আনা অবশ্যম্ভাবী। আমি হাই কোর্টে বিচারপতি থাকাকালে এ ধরনের বহু সালিশকারীর সাজা নিশ্চিত করেছিলাম। এ ব্যাপারে ভ্রাম্যমাণ আদালতও সালিশস্থলে হানা দিয়ে তা বন্ধ করে সালিশকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষকরা অর্থ ও পেশি বলে বলীয়ান থাকায় তারা ধর্ষিতাকে সাক্ষ্য না দিতে বাধ্য করে বলে এসব সাক্ষীর জন্য সাক্ষ্য সুরক্ষা আইন যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন পুলিশের হস্তক্ষেপ। এ ব্যাপারে নিম্ন আদালতের বিচারক এবং পিপি, এপিপিদের যথাযোগ্য প্রশিক্ষণ দেওয়া আবশ্যক। সংশ্লিষ্ট সবাইকে বোঝাতে হবে ধর্ষণ খুনের চেয়ে কম বড় অপরাধ নয়, কেননা এর ফলে ধর্ষিতার মনস্তত্ত্বে যে প্রভাব পড়ে তা অনেক ক্ষেত্রে আজীবন স্থায়ী থাকে, অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। বিশেষ করে পুলিশকে এটা বুঝতে হবে, কেননা অনেক পুলিশ ধর্ষণকে তেমন কোনো অপরাধ মনে করে না। পুলিশকে আরও বোঝাতে হবে ধর্ষণের অভিযোগে কেউ মামলা না করলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী পুলিশের দায়িত্ব নিজ থেকে এজাহার করা, যে বিধান অন্য সব আমলযোগ্য অপরাধের বেলায়ও প্রযোজ্য। আমাদের আইনে কোনো আসামিকে আশ্রয় দেওয়াও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সে কারণে যেসব ব্যক্তি ধর্ষণ মামলার আসামিদের আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেয় তাদেরও বিচারের আওতায় আনা অপরিহার্য। বর্তমানে ডিএনএ পরীক্ষাগারের স্বল্পতা ঘোচানোর জন্য প্রতি জেলায় ডিএনএ পরীক্ষাগার স্থাপন করা এবং এগুলোর সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে, যার জন্য ইউএনডিপির সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। ধর্ষিতাদের আদালতে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানোর আগে যথেষ্ট মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। প্রচার-প্রচারণা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গণসচেতনতা প্রসার করারও প্রয়োজন রয়েছে। সালিশকারীরা ছাড়াও ধর্ষণ মামলায় কেউ আপসের উদ্যোগ নিলে তাকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে, কেননা একটি আপস-অযোগ্য অপরাধে আপসের চেষ্টা করাও অপরাধ। যতটা সম্ভব ধর্ষিতার পরিচয় গোপন রাখতে হবে, যে বিধান পৃথিবীর বহু দেশেই রয়েছে। সাংবাদিকদেরও দায়িত্ব ধর্ষণের অপরাধে শাস্তি দেওয়ার ঘটনাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করা, যার ফলে সবাই সাবধান হতে পারে। ধর্ষককে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ষিতাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে হবে এবং ধর্ষিতা যেন তার পরিবার ও সমাজের কাছে লাঞ্ছিত না হয়, সে উদ্দেশ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।   সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিনন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» রাশিয়া থেকে ফিরে এবার ইউক্রেন যাচ্ছেন মোদি

» আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী

» সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য খাবার আয়োজন

» আজ শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকা-মার্কেট বন্ধ

» নতুন মায়েরা সকালে এই ৫ সুপারফুড খান

» হার্ট অ্যাটাক পরবর্তী ১ থেকে ২ ঘণ্টা কেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

» বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার ক্যাভিয়ার আসলে কী?

» এশিয়া কাপ থেকে বিদায় বাংলাদেশ, ফাইনালে ভারত

» মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় স্কুলশিক্ষক নিহত

» সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসা ও আয়ের ব্যবস্থা করবে সরকার: প্রধানমন্ত্রী

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্রহনন আর নয়

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক:  ধর্ষণের অভিযোগে বিচারাধীন আসামিদের পক্ষে ধর্ষিতা নারীর চরিত্র নিয়ে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যাবে না বলে সাক্ষ্য আইনে পরিবর্তন আনার খবরটি আইনের শাসন এবং অপরাধ দমনে বিশ্বাসী সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। খবরটি দেখে আমার মনে পড়ল ১৯৯৮ সালের ইয়াসমিন ধর্ষণ-হত্যা মামলার কথা। রাষ্ট্রের একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে হাই কোর্টে এ মামলাটি পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। আমার সহকারী হিসেবে ছিলেন সে সময়ের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দ হায়দার আলি। হাই কোর্টেই এবং পরে আপিল বিভাগে তিন পুলিশ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল হওয়ার পর তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল।

 

তবে এ মামলার গতিপথ ছিল দুর্গম। একসময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট সহোদরা কুখ্যাত ‘চকলেট আপা’ এ মামলা বাধাগ্রস্ত করার জন্য স্বর্গ-নরক এক করে ফেলেছিলেন। এ মামলা নষ্ট করার জন্য হেন কিছু নেই যা তিনি করেননি আসামিদের এবং সে সময়ে জেলার ডিসি ও এসপিকে বাঁচানোর জন্য। ডিসি ও এসপির পরামর্শ এবং সহায়তাক্রমে চকলেট আপার সিদ্ধান্তে সারা শহরে মাইক এবং সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হলো, ইয়াসমিন একজন পতিতা। কুখ্যাত সেই ডিসি ও এসপি চকলেট আপাকে তুষ্ট করার জন্য জেলার সব সাংবাদিককে ডেকে ঘোষণা করল ইয়াসমিন পতিতা। শহরের পরিচিত কয়েকজন যৌনকর্মীকে সাক্ষী হিসেবে সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত করতে সেই কলঙ্কিত ডিসি-এসপির অসুবিধা হয়নি। চকলেট আপা, ডিসি ও এসপি কর্তৃক মামলা ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টার প্রতিবাদে জনগণ ফুঁসে উঠলে তাদের ওপর গুলি চালানো হলে সাতটি নিরীহ প্রাণ ঝরে পড়েছিল। সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা যৌনকর্মীরা ডিসি-এসপির সুরে সুর মিলিয়ে বলল, ইয়াসমিন তাদেরই এক সহযৌনকর্মী কিন্তু দিনাজপুরের কৃতীপুরুষ, বিখ্যাত মানবাধিকার নেতা, একসময়ের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুর রহিম সাহেব, যিনি মাননীয় বিচারপতি এনায়েতুর রহিম ও হুইপ ইকবালুর রহিমের পিতা, বিরামহীন প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে মামলাটি অবশেষে দিনের আলো দেখতে পেয়েছিল। মামলা চলাকালেও আসামিরা চকলেট আপা এবং ডিসি-এসপির যোগসাজশে এ মর্মে সাক্ষী হাজির করা হয়েছিল যে ইয়াসমিন একজন পতিতা। কিন্তু সব আদালতই যথার্থভাবে বলেছিল একজন যৌনকর্মীও ‘না’ বলার অধিকারী। সেদিন চকলেট আপা গংদের শত বিপত্তির মুখে আইনের শাসনের, তথা বিচার বিভাগের দৃঢ়তার জয় হয়েছিল, যে মামলাটি নিশ্চিতভাবে আমাদের বিচারিক ইতিহাসে এক মাইলফলক রায় হিসেবে চিরদিন প্রশংসিত হবে। এ মামলা আমার জীবনেও স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। সেদিন সেই ধিকৃত খালেদা সহোদরা চকলেট আপার নামও সর্বকালে কলঙ্কভরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। স্বর্ণাক্ষরে লেখা রবে অ্যাডভোকেট আবদুর রহিমের নাম। দিনাজপুর শহরে ইয়াসমিনের নামে একটি সৌধও গড়া হয়েছে। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের ধর্ষণের সংজ্ঞা হলো কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করা বিধায় সংশ্লিষ্ট নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, এ জঘন্য অপরাধের সবচেয়ে বড় উপাদান এবং এজন্য সংশ্লিষ্ট মহিলার চরিত্র কোনোক্রমেই বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। সেই অর্থে এমনকি একজন যৌনকর্মীও অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে তা-ও ধর্ষণের অপরাধ হবে, আর এ বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু নজির রয়েছে। এমনকি কোনো স্বামী স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করলে তা-ও আইনের দৃষ্টিতে ধর্ষণ, অর্থাৎ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বহু দেশের উচ্চ আদালত এ অপরাধের জন্য অনেক স্বামীকে সাজা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে ধর্ষণ মামলায় আসামির পক্ষের আইনজীবীরা ধর্ষিতা মহিলাকে তার চরিত্র সম্পর্কে এমন সব প্রশ্ন করেন যার ফলে ধর্ষিতা মহিলা আদালতে জেরার সময় দ্বিতীয়বার ধর্ষিতা হন। এসব ক্ষেত্রে আদালতের দায়িত্ব এসব প্রশ্ন করতে না দেওয়া হলেও বিজ্ঞ বিচারকরা খুব কম ক্ষেত্রেই তা করেন। এ কারণে বহু ধর্ষিতাই আদালতে সাক্ষ্য দিতে অপারগ হন। ধর্ষণ মামলায় সাজার হার অতিনিম্নমুখী হওয়ার এটি অন্যতম কারণ। যুক্তরাজ্য, এমনকি ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই আইন রয়েছে ধর্ষিতাকে তার চরিত্রের ওপর প্রশ্ন না করার। অনেক দেশেই ধর্ষিতার সাক্ষ্য প্রকাশ্য আদালতে না নিয়ে ভিডিও পদ্ধতিতে নেওয়ার বিধান রয়েছে, কেননা প্রকাশ্য আদালতে ধর্ষককে দেখলে ধর্ষিতা ভয়ে সাক্ষ্য দিতে ভীত হতে পারেন। কয়েক মাস আগে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড করার পরও ধর্ষণ চলছে। এর পেছনে যেসব কারণ রয়েছে তার অন্যতম হলো আসামিদের জামিনে মুক্তি দেওয়া। জামিনে মুক্তি পেয়ে আসামিরা ধর্ষিতা এবং অন্য সাক্ষীদের টাকার লোভ ও ভয় দেখিয়ে সাক্ষ্যদানে বিরত করে যার ফলে আর সাজা হয় না। অনেক সময় জামিনে মুক্ত হয়ে অপরাধীরা পুনরায় অপরাধটি করে।

 

এটা ঠিক যে জামিন-অযোগ্য অপরাধে জামিন দেওয়া-না দেওয়া আদালতের এখতিয়ারের ব্যাপার। কিন্তু পুলিশ দুর্বল ফরওয়ার্ডিং বা প্রতিবেদন দিলে আদালতের খুব একটা কিছু করার থাকে না। এ ছাড়া সরকার পক্ষে আইনজীবীদেরও দায়িত্ব রয়েছে শক্ত ভাষায় জামিনের বিরোধিতা করা, রিমান্ড প্রার্থনা করা। একসময় ধরা হতো শুধু ধর্ষিতার সাক্ষ্যে সাজা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু দুই দশক আগে ভারত ও বাংলাদেশের উচ্চ আদালতগুলো এ মর্মে রায় দিয়েছে যে আদালত ধর্ষিতার সাক্ষ্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করলে তার একক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করেই সাজা দেওয়া যায়। বেশ কয়েক বছর আগে বরিশালের বহুল আলোচিত স্মৃতিকণা ধর্ষণ মামলায় হাই কোর্ট এ মর্মে রায় দিয়েছিল যে ধর্ষিতার জবানবন্দি বিশ্বাসযোগ্য বিবেচিত হলে তার একক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করেই সাজা না দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। সে রায় আপিল বিভাগ নিশ্চিত করায় এটিই বর্তমানে আইন। অর্থাৎ ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণের জন্য ধর্ষিতার সাক্ষ্যের সমর্থনে কোনো অতিরিক্ত বা করাবোরেটিভ সাক্ষ্যের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ রায় সম্পর্কে নিম্ন আদালতের অনেক বিচারকই অবগত নন মনে হচ্ছে। অনেক আইনজ্ঞ এমনকি গবেষকও এটি জানেন না বলে ‘করাবোরেটিভ সাক্ষ্যের’ কথা বলেন। তা ছাড়া ডিএনএ প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে ধর্ষকের পরিচয় শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব, যার কারণে নতুন আইনে ডিএনএর নমুনা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ডিএনএ প্রযুক্তির এতটাই উন্নতি হয়েছে যে বীর্য বা রক্ত ছাড়াও অর্থাৎ এমনকি চুলের গোড়া, নখের নমুনা দিয়েও ডিএনএ প্রোফাইল বের করা যায়। অর্থাৎ ধর্ষিতার দেহের অভ্যন্তর বা কাপড় থেকে ধর্ষকের বীর্য ধুয়ে ফেলা হলেও ধর্ষিতার গায়ে বা আশপাশে ধর্ষকের চুল, নখ পাওয়া গেলে, যা সচরাচর সম্ভব, ডিএনএ পরীক্ষা করা যায়। তবে বীর্যই সর্বোত্তম এবং এ কারণেই সময় ক্ষেপণ না করে ধর্ষিতার দেহ থেকে বীর্যের নমুনা সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয়। অনেক সময় তথাকথিত সমাজপতিরা সালিশির মাধ্যমে সামান্য জরিমানা করে ধর্ষককে মুক্তি দেন। এটা শুধু বেআইনিই নয়, অপরাধও। ধর্ষণ একটি গুরুতর, আপস-অযোগ্য অপরাধ বিধায় যারা এ ধরনের সালিশ করেন তারা আইনি বিচারের পথ রুদ্ধ করে অপরাধ করেন এবং তাই তাদের বিচারে আনা অবশ্যম্ভাবী। আমি হাই কোর্টে বিচারপতি থাকাকালে এ ধরনের বহু সালিশকারীর সাজা নিশ্চিত করেছিলাম। এ ব্যাপারে ভ্রাম্যমাণ আদালতও সালিশস্থলে হানা দিয়ে তা বন্ধ করে সালিশকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষকরা অর্থ ও পেশি বলে বলীয়ান থাকায় তারা ধর্ষিতাকে সাক্ষ্য না দিতে বাধ্য করে বলে এসব সাক্ষীর জন্য সাক্ষ্য সুরক্ষা আইন যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন পুলিশের হস্তক্ষেপ। এ ব্যাপারে নিম্ন আদালতের বিচারক এবং পিপি, এপিপিদের যথাযোগ্য প্রশিক্ষণ দেওয়া আবশ্যক। সংশ্লিষ্ট সবাইকে বোঝাতে হবে ধর্ষণ খুনের চেয়ে কম বড় অপরাধ নয়, কেননা এর ফলে ধর্ষিতার মনস্তত্ত্বে যে প্রভাব পড়ে তা অনেক ক্ষেত্রে আজীবন স্থায়ী থাকে, অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। বিশেষ করে পুলিশকে এটা বুঝতে হবে, কেননা অনেক পুলিশ ধর্ষণকে তেমন কোনো অপরাধ মনে করে না। পুলিশকে আরও বোঝাতে হবে ধর্ষণের অভিযোগে কেউ মামলা না করলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী পুলিশের দায়িত্ব নিজ থেকে এজাহার করা, যে বিধান অন্য সব আমলযোগ্য অপরাধের বেলায়ও প্রযোজ্য। আমাদের আইনে কোনো আসামিকে আশ্রয় দেওয়াও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সে কারণে যেসব ব্যক্তি ধর্ষণ মামলার আসামিদের আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেয় তাদেরও বিচারের আওতায় আনা অপরিহার্য। বর্তমানে ডিএনএ পরীক্ষাগারের স্বল্পতা ঘোচানোর জন্য প্রতি জেলায় ডিএনএ পরীক্ষাগার স্থাপন করা এবং এগুলোর সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে, যার জন্য ইউএনডিপির সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। ধর্ষিতাদের আদালতে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানোর আগে যথেষ্ট মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। প্রচার-প্রচারণা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গণসচেতনতা প্রসার করারও প্রয়োজন রয়েছে। সালিশকারীরা ছাড়াও ধর্ষণ মামলায় কেউ আপসের উদ্যোগ নিলে তাকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে, কেননা একটি আপস-অযোগ্য অপরাধে আপসের চেষ্টা করাও অপরাধ। যতটা সম্ভব ধর্ষিতার পরিচয় গোপন রাখতে হবে, যে বিধান পৃথিবীর বহু দেশেই রয়েছে। সাংবাদিকদেরও দায়িত্ব ধর্ষণের অপরাধে শাস্তি দেওয়ার ঘটনাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করা, যার ফলে সবাই সাবধান হতে পারে। ধর্ষককে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ষিতাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে হবে এবং ধর্ষিতা যেন তার পরিবার ও সমাজের কাছে লাঞ্ছিত না হয়, সে উদ্দেশ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।   সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিনন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com