প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট সহজে সহ্য করার মতো নয়। তারপরও মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়জনকে ছাড়া বাঁচতে শিখে যায়। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মৃত্যুর পর কবর দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এই কারণে মুসলিমরা কেউ মারা যাওয়ার পর তাকে কবর দেন। অনেকেই আবার সেই কবর পাকা করেন। অন্যদিকে, এমন অনেকেই আছেন যারা নির্দিষ্ট স্থান নিয়ে শুধু মাত্র নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের কবর সেখানে দেন এবং সেই কবরগুলো পাকা করে রাখেন।
কেউ কেউ আবার ওলি-আউলিয়ার মাজার স্থাপন, তাদের কবরের পাশে মসজিদ নির্মাণকে পুণ্যের কাজ মনে করে থাকেন। অথচ কবর পাকা করার কোনো রীতি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর আদর্শে নেই। সাহাবায়ে কেরামও কখনো ও কোনোদিন কবর পাকা করেননি।
তবে কবর চিহ্নিত করা যায়; নবী কারিম (সা.)-এর যুগে কবরের বুক বরাবর স্থানটি উটের কুজের মতো সামান্য উঁচু করে দেওয়া হতো। মাথার দিকে একটি পাথর কবরটি চেনার জন্য রাখা হতো।
কবর পাকা করা ইসলাম কী বলে?
নবী করিম (সা.) কবর পাকা করতে নিষেধ করেছেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) কবরে চুনকাম করতে, কবরের ওপর গৃহ নির্মাণ করতে এবং কবরের ওপর বসতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৯৭০)
অন্য হাদিসে আবুল হাইয়াজ আসাদী হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘একবার হজরত আলী (রা.) আমাকে বলেন, আমি কি তোমাকে সেই কাজে পাঠাব না, যে কাজে রাসুল (সা.) আমাকে পাঠিয়েছিলেন? ওই কাজ এই যে, কোনো মূর্তি দেখলে তা নষ্ট করে ফেলবে, আর কোনো উঁচু কবর দেখলে তা সমান করে দেবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৯৬৯)
বুজুর্গদের কবরগুলো পাকা করা কি জায়েজ?
প্রশ্ন হলো, অনেক সময় দেখা যায় পূর্ববর্তী বুজুর্গদের (পীর/আউলিয়া) কবরগুলো প্রায় সবই পাকা করা। হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ (রহ.)-এর আমলেও অনেক আলেমের কবর পাকা হয়েছে। এছাড়া হজরত শাহজালাল (রহ.), হজরত মইনুদ্দিন চিশতি (রহ.) সহ অনেক পীর আউলিয়ার কবর পাকা। এর উত্তরে বলব, প্রথমে আমরা হাদিসের মাধ্যমে জেনেছি যে নবীজি (সা.) কবর পাকা করতে নিষেধ করেছেন। সাহাবাদেরও এর বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল। তাছাড়া ফিকহের ইমামরাও কবর পাকা করার কোনো অনুমতি দেননি।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কবর পাকা করতে নিষেধ করেছেন। ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) কর্তৃক সঙ্কলিত কিতাবুল আসারে উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা (কবরকে) চুনকাম করা, পাকা করা, অথবা তার নিকটে মসজিদ নির্মাণ করা, ঝান্ডা টানানো, কোনো কিছু লেখা মাকরুহ মনে করি। এবং আমরা কবরকে ইট দিয়ে পাকা করা, কবরে প্রবেশ করাকে মাকরুহ মনে করি। তবে কবরে পানি ছিটিয়ে দেওয়াতে কোনো সমস্যা নেই।’ (কিতাবুল আসার লিমুহাম্মদ : ২/১৯১)
এছাড়াও প্রখ্যাত ফিকাহবিদ ও হাদিস-গবেষকগণও কবরকে পাকা করাকে মাকরুহ উল্লেখ করেছেন। (মাজমাউল বিহার লি- আল্লামা তাহের : ৩/২২৬; ফাতাওয়ায়ে শামি : ২/২৩৬; ফাতহুল বারি লি-ইবনে হাজার আসকালানি : ৩/৫৫৯)
যেখানে পরিষ্কার ভাষায় হাদিসে ইরশাদ রয়েছে, গ্রহণযোগ্য ফুকাহায়ে কেরামরা যুগে যুগে মাকরুহ বলেছেন। সুতরাং কোনো বড় ব্যক্তির কবর পাকা থাকলেই সে কাজ জায়েজ হয়ে যাবে না। তাছাড়া যেসব মনীষীর কবরকে পাকা করা হয়েছে, তারা নিজেরা কি কখনও তাদের পূববর্তী কোনো বুজুর্গের কবরকে পাকা করেছেন? কিংবা তারা কি তাদের কবরকে পাকা করতে নির্দেশ দিয়েছেন?
ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার ভক্ত ও মুরিদ বা পরবর্তী ব্যক্তিরা কোনো কাজ করলেই— সেটি ওই বুজুর্গের কাজ বলে সাব্যস্ত হয় না। সুতরাং হাদিসের দ্বারা এবং ফুকাহায়ে কেরামের মতামত দ্বারা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত যে, কবরকে পাকা করা অনুচিত ও নাজায়েজ।
কবরের ওপর গম্বুজ নির্মাণ করার বিধান
কবর পাকা করা ও কবরের ওপর গম্বুজ তৈরি করা সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ইমামরা হারাম হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন। ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, ‘কবর খনন করতে যে মাটি কবর থেকে বের করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি দেওয়া আমরা সঠিক মনে করি না। আমরা কবর পাকা করা ও লেপ দেওয়াকে মাকরুহ মনে করি। নবী করিম (সা.) কবর চতুষ্কোণ বানাতে ও পাকা করতে নিষেধ করেছেন। এটাই আমাদের মাজহাব। আর এটাই ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর অভিমত। ’ (কিতাবুল আসার, পৃষ্ঠা ৯৬)
আল্লামা ইবনে আবেদিন শামি (রহ.) বলেন, ‘(কবরে) বিল্ডিং নির্মাণ বিষয়ে এমন কাউকে দেখিনি, যিনি এর বৈধতা দিয়েছেন। ’ (ফাতাওয়ায়ে শামি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৩৭, নতুন সংস্করণ, মিসর)
কাজি সানাউল্লাহ পানিপথি (রহ.) লিখেছেন, ‘আর ওলি-আউলিয়ার কবরের ওপর উঁচু উঁচু বিল্ডিং নির্মাণ করা, বাতি জ্বালানো এবং এজাতীয় আরো যা করা হয়, সবই হারাম।’ (মা-লা-বুদ্দা মিনহু, পৃষ্ঠা : ৮৪)
কবরের ওপর মসজিদ নির্মাণ করা
আর কবরের ওপর মসজিদ নির্মাণ করা দুটি শর্তে বৈধ। এক. যদি ওই কবরস্থান আর কবর দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত না হয়। দুই. কবরস্থানে দাফনকৃত লাশ মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে থাকে। যদি উল্লিখিত উভয় শর্ত পাওয়া যায়, তাহলে ওই স্থানে মসজিদ নির্মাণ বৈধ। যদিও তা অনুচিত। (উমদাতুল কারি : ৩/৪৩৫)
কিন্তু যদি এই দুই শর্তের একটি শর্তও না পাওয়া যায়, তাহলে ওই স্থানে মসজিদ নির্মাণ বৈধ নয়। শর্ত না মেনে এমন জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করা হলে ওই মসজিদে নামাজ পড়া মাকরুহে তাহরিমি। আর বিধানের দিক থেকে মাকরুহে তাহরিমি হারামের নিকটবর্তী। (রদ্দুল মুহতার : ৩/১৫৪; তাতারখানিয়া : ২/১৮২) সূএ:ডেইলি বাংলাদেশ ডটকম