আরেক ‘শাহেদ’-এর সন্ধান, কীভাবে শতকোটি লোপাট করলেন জিয়া

নামসর্বস্ব ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান খুলে একাধিক ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ‘ফোসান গ্রুপ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এর পেছনের কুশীলব মো. জিয়া উদ্দিন জামান নামের এক ব্যক্তি। ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রতারণায় শাহেদকে ছাড়িয়ে গেছেন এই জিয়া। আইনশৃঙখলা বাহিনী বলছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার ভয়ংকর প্রতারণার অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে গ্রেপ্তারে খুঁজছে বিভিন্ন সংস্থা।

 

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশে-বিদেশে টাইলস ও সিরামিক পণ্যের কারখানা প্রতিষ্ঠা, ব্রিক্সস কারখানা তৈরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টনার করা, ভবন তৈরির বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি, বিদেশে শ্রমিক পাঠানো, চাকরির দেওয়ার প্রলোভন ইত্যাদি নানা কায়দায় টাকা আত্মসাৎ করেছেন জিয়া।

 

এই প্রতারণার পথে জিয়ার নানা কৌশলের মধ্যে কিছু ছিল শাহেদের মতো। নিজেকে সরকারি দলের বড় বড় নেতার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিতেন জিয়া। তাদের সঙ্গে তোলা ছবি প্রচার করতেন নানা মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানের নামে গড়ে তোলা ওয়েবসাইটে ব্যবসায়িক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন, বাস্তবে যার নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঠিকানা।

 

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে জন্ম নেওয়া জিয়া দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চীনেও তার প্রতিষ্ঠান আছে বলে প্রচার করতেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক পার্টনার চেয়ে দিতেন বিজ্ঞাপন। আগ্রহী অনেকে তার প্রতারণায় ফাঁদে পড়ে হারিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

 

জিয়ার কাছে প্রতারিত বেশির ভাগই বড় বড় ব্যবসায়ী। প্রতারণার শিকার অনেকে আদালতে ও থানায় মামলা করেছেন। কিন্তু সব সময়ই নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছেন জিয়া। একেকবার প্রতারণার পর অফিস ও নিজের মোবাইল ফোন নম্বর পরিবর্তন করে আত্মগোপনে চলে যেতেন এই বহুরূপী।

 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জোট সরকারের আমলে জামায়াতের তৎকালীন এমপি আব্দুস সাত্তারের কথিত পিএস ছিলেন জিয়া উদ্দিন জামান। ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি পাড়ি জমান ওমানে। সেখান থেকে চলে যান চীনে। পরে দেশে এসে ভোল পাল্টে হয়ে যান সরকারদলীয় সমর্থক ও বড় ব্যবসায়ী।

 

সরকারি দলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে ছবি তুলে পরে সময় বুঝে এসব ছবির অপব্যবহার শুরু করেন জিয়া। আবার তার কথিত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ও ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতেন সেসব ছবি। জিয়ার এসব কর্মকাণ্ডের কারণে সহজেই তাকে বিশ্বাস করতেন সবাই। একসময় ব্যাংক ঋণের টাকা আত্মসাৎ, ওভার ইন-ভয়েসিং ও কনসোর্টিয়াম ঋণের টাকা পাচার, করবহির্ভূত সম্পদ ও বিনিয়োগ অর্জনসহ ধোঁকা দিয়ে বিভিন্ন মানুষের টাকা আত্মসাৎ তার প্রধান কাজ হয়ে ওঠে।

২০১৭ সালে মোরেলগঞ্জ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বালুর রাস্তা সংলগ্ন এলাকায় এক একর ৩৩ শতক জমি কিনে তার বেশি দখলের অভিযোগ আছে এই জিয়ার ফোসান গ্রুপের বিরুদ্ধে। তখন পলাশ শরীফ নামের একজন ভূক্তভোগী অভিযোগ করেন, ফোসান গ্রুপ যতটুকু জমি কিনেছিল তার বেশি দখলের চেষ্টা করে। এতে স্থানীয়রা বাধা দিলে ক্ষুদ্ধ্ব হয়ে ওঠেন জিয়া। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় তা সমাধান হয়।

জিয়ার যত প্রতিষ্ঠান

দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বা শিল্পপতিদের প্রতারণার উদ্দেশ্যে নিজের নামে বা বেনামে বেশ কয়েকটি নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এই জিয়া। তাছাড়া চীন, দুবাই ও ওমানে তার একাধিক সিরামিক শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জাহির করতেন। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছেন তিনি।

 

জিয়া নিজেকে নিউ জং ইউয়ান সিরামিক কোম্পানি (বিডি) লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফোসান গ্রুপের চেয়ারম্যান, ফোসান সিরামিক কোম্পানি লি.-এর চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন। এ ছাড়া মেজর চায়না লি., চায়না কনস্ট্রাকশন লি., এস কর্পোরেশন, জিয়া অটো ব্রিকস, কাশফুল টয়লেট্রিজ কোম্পানি লি, গ্রীন বায়োটেক লি., মেজর সফটটেক, ফোসান ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাজট্রিজ লি., ডাইনিং মাসকাট, হাই-টেক সিরামিক ইন্ডাজট্রিজ লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন।

এসব পরিচয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ছবি তুলে এবং ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে টার্গেট ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেন।

 

একজনকে ঠকিয়েছেন ৭৩ কোটি

নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে ব্যবসায়িক পার্টনার করার প্রলোভনে ৭৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক জিয়া। এই ঘটনায় সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করেন ওই ব্যবসায়ী।

 

নজরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি যে ব্যাংকে লেনদেন করি, সেখানেই পরিচয় হয় জিয়ার সঙ্গে। কিছু ব্যাংক অফিসারের যোগসাজশে তিনি আমার সঙ্গে পরিচিত হন। তখন আমাকে বলা হয়, তিনি (জিয়া) দুটি টাইলস ফ্যাক্টরি করছেন। তিনি অনেক বড় ব্যবসায়ী। ওমান, দুবাইতে বড় বড় ব্যবসা আছে। সেসব ওয়েবসাইট ও কাগজ দেখান। একটা টাইলস ফ্যাক্টরি বাবদ ব্যাংকের লোন ৩০০ কোটি টাকা পাস হয়েছে, কিন্তু নিতে পারছেন না। আমি বলেছিলাম, তিনি টাকা নিতে পারছেন না তাতে আমার কী?’

 

এরপর ছয় মাস চলে যায়। নজরুল ইসলামকে ব্যাংক কর্মকর্তা ভালো ব্যবসায়ী হিসেবে জানেন। এর মধ্যে তিনি তাকে প্রস্তাব করেন জিয়ার সঙ্গে পার্টনার বা চুক্তিবদ্ধ হতে।

 

নজরুল ইসরাম বলেন, ‘৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তি করে প্রথমে দিয়েছি ২০ কোটি টাকা। পরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা এক পে-অর্ডারে। জিয়া বিসিবি ব্যাংকে (বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড) ঋণখেলাপি ছিলেনর। সেই ব্যাংকে এই টাকা দেওয়া হয়। আমার নামে এক দিনে লোন পাসও হয়েছে, এক দিনে টাকা নিয়ে গেছে জিয়া।’

 

এই টাকা খোয়া যাওয়ার পর নজরুল ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এখন তিনি ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না, সুদও টানতে পারছেন না।

 

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘৬০ কোটি টাকা ছাড়াও ব্যবসা করার জন্য আরও ২৩ কোটি দিয়েছিলাম। সেই টাকাও গেছে। এরপর থেকে তার (জিয়া) সঙ্গে আর যোগযোগ করতে পারছি না। সব মোবাইল নম্বর বন্ধ করে দিয়েছে।’

 

বড় বড় রাজনীতিবিদ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জিয়ার ওঠাবসা , এমন ছবি তিনি সব সময় ফেসবুকে পোস্ট করতেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রস্তাবের পাশাপাশি এসব ছবি জিয়ার প্রতি বিশ্বাস এনেছিল নজরুলের।

জিয়ার প্রতারণার বিষয়টি যখন বুঝতে পারেন, তখন অনেক টাকা হাতছাড়া হয়ে গেছে নজরুল ইসলামে । তিনি বলেন, ‘এরপর জানতে পেরেছি শুধু আমাকে না অনেক ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে সে প্রতারণা করেছে। বিশেষ করে সোনালী ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা, টাঙ্গাইলে একটা প্রজেক্টের নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়েছে। এভাবে জিয়া ৭০০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়ে আত্মগোপনে গেছেন।

 

জিয়ার যত প্রতারণা

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নামে শ্রমিক বা ঠিকাদার নিয়োগ করলেও তাদের টাকা পরিশোধ করেননি জিয়া। তাছাড়া বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর নামে শত শত মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন তিনি।

 

জিয়া ফোসান গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে টাইলস কারখানার নাম করে বিভিন্ন ডিলারের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেন। অথচ আলোর মুখই দেখেনি প্রতিষ্ঠানটি। আবার যেসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে, তাদের টাকাও ফেরত দেওয়া হচ্ছে না।

 

এভাবে নিজের অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিয়ে মানুষের কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, জিয়ার প্রতারণার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা, যারা তাকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার কাজে সাহায্য করে আসছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, নামে-বেনামে ৯টির মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে জিয়ার। এর মধ্যে ছয়টির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঠিকানা নেই। শুধু ওয়েবসাইট আছে। এর বাইরে সবই শূন্য।

 

তার মিরপুরে একটি অফিস আছে। সেখানে অল্প কয়েকজন কাজ করেন। জিয়া তার ভুয়া প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনার কথা বলেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার আরেকটি কাজ ছিল, বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে স্বপ্ন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এমনকি সাধারণ মানুষকে দেশে ও বিদেশে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার কথাও বলেন জিয়াউদ্দিন। এভাবে বছরের পর বছর তিনি প্রতারণা করেছেন।

 

এ ছাড়া নিজেকে বিভিন্ন মন্ত্রী ও বিশিষ্টজনের শুভাকাঙ্ক্ষী পরিচয় দিয়ে সরকারি-বেসরকারি ও নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আত্মসাৎ করেন বিপুল অর্থ।

 

জানা গেছে, হাইটেক সিরামিক ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে একটি সরকারি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ১৯৬ কোটি টাকা কনসোর্টিয়াম ঋণ মঞ্জুরি নিয়ে ওভার ইন-ভয়েসের মাধ্যমে এলসি খুলে টাকা বের করে নেয জিয়ার প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করে এলসি করে ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে এই টাকা পাচার করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে জিয়াউদ্দিনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলছে

ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের মামলার অগ্রগতি জানতে চাইলে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। আর আমরা জিয়াকে খুঁজছি। এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে।’

 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপর একটি সূত্র ঢাকা টাইমসকে জানায়, মামলার পর গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়ে কাজ করছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার ভয়ংকর প্রতারণার অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে থাকলে তাকে গ্রেপ্তার হতেই হবে।

 

অপর একটি সূত্র জানায়, তার বিষয়ে দুদকে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। দ্রুতই এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করবে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।   সূএ:ঢাকাটাইমস ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঐকমত্য জরুরি : মান্না

» আরএসএফের হামলায় পালিয়েছে সুদানের এক গ্রামের ৮ হাজার পরিবার

» সাবেক এমপি মজিদ খান গ্রেফতার

» ‘দেশে যেন সহিংসতা ও হানাহানি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে’

» ‘অপারেশন ডেভিল হান্টে’ সারাদেশে আরও ৩৪৩ জন গ্রেফতার

» রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক ১৫ ফেব্রুয়ারি

» অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করুন : মাহফুজ আলম

» ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার : মির্জা ফখরুল

» ইসলামপুরে ছাত্রদলের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল

» বিঞ্জে আসছে ভিকি জাহেদের ‘নীল সুখ’

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

আরেক ‘শাহেদ’-এর সন্ধান, কীভাবে শতকোটি লোপাট করলেন জিয়া

নামসর্বস্ব ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান খুলে একাধিক ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ‘ফোসান গ্রুপ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এর পেছনের কুশীলব মো. জিয়া উদ্দিন জামান নামের এক ব্যক্তি। ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রতারণায় শাহেদকে ছাড়িয়ে গেছেন এই জিয়া। আইনশৃঙখলা বাহিনী বলছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার ভয়ংকর প্রতারণার অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে গ্রেপ্তারে খুঁজছে বিভিন্ন সংস্থা।

 

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশে-বিদেশে টাইলস ও সিরামিক পণ্যের কারখানা প্রতিষ্ঠা, ব্রিক্সস কারখানা তৈরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টনার করা, ভবন তৈরির বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি, বিদেশে শ্রমিক পাঠানো, চাকরির দেওয়ার প্রলোভন ইত্যাদি নানা কায়দায় টাকা আত্মসাৎ করেছেন জিয়া।

 

এই প্রতারণার পথে জিয়ার নানা কৌশলের মধ্যে কিছু ছিল শাহেদের মতো। নিজেকে সরকারি দলের বড় বড় নেতার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিতেন জিয়া। তাদের সঙ্গে তোলা ছবি প্রচার করতেন নানা মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানের নামে গড়ে তোলা ওয়েবসাইটে ব্যবসায়িক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন, বাস্তবে যার নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঠিকানা।

 

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে জন্ম নেওয়া জিয়া দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চীনেও তার প্রতিষ্ঠান আছে বলে প্রচার করতেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক পার্টনার চেয়ে দিতেন বিজ্ঞাপন। আগ্রহী অনেকে তার প্রতারণায় ফাঁদে পড়ে হারিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

 

জিয়ার কাছে প্রতারিত বেশির ভাগই বড় বড় ব্যবসায়ী। প্রতারণার শিকার অনেকে আদালতে ও থানায় মামলা করেছেন। কিন্তু সব সময়ই নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছেন জিয়া। একেকবার প্রতারণার পর অফিস ও নিজের মোবাইল ফোন নম্বর পরিবর্তন করে আত্মগোপনে চলে যেতেন এই বহুরূপী।

 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জোট সরকারের আমলে জামায়াতের তৎকালীন এমপি আব্দুস সাত্তারের কথিত পিএস ছিলেন জিয়া উদ্দিন জামান। ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি পাড়ি জমান ওমানে। সেখান থেকে চলে যান চীনে। পরে দেশে এসে ভোল পাল্টে হয়ে যান সরকারদলীয় সমর্থক ও বড় ব্যবসায়ী।

 

সরকারি দলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে ছবি তুলে পরে সময় বুঝে এসব ছবির অপব্যবহার শুরু করেন জিয়া। আবার তার কথিত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ও ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতেন সেসব ছবি। জিয়ার এসব কর্মকাণ্ডের কারণে সহজেই তাকে বিশ্বাস করতেন সবাই। একসময় ব্যাংক ঋণের টাকা আত্মসাৎ, ওভার ইন-ভয়েসিং ও কনসোর্টিয়াম ঋণের টাকা পাচার, করবহির্ভূত সম্পদ ও বিনিয়োগ অর্জনসহ ধোঁকা দিয়ে বিভিন্ন মানুষের টাকা আত্মসাৎ তার প্রধান কাজ হয়ে ওঠে।

২০১৭ সালে মোরেলগঞ্জ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বালুর রাস্তা সংলগ্ন এলাকায় এক একর ৩৩ শতক জমি কিনে তার বেশি দখলের অভিযোগ আছে এই জিয়ার ফোসান গ্রুপের বিরুদ্ধে। তখন পলাশ শরীফ নামের একজন ভূক্তভোগী অভিযোগ করেন, ফোসান গ্রুপ যতটুকু জমি কিনেছিল তার বেশি দখলের চেষ্টা করে। এতে স্থানীয়রা বাধা দিলে ক্ষুদ্ধ্ব হয়ে ওঠেন জিয়া। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় তা সমাধান হয়।

জিয়ার যত প্রতিষ্ঠান

দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বা শিল্পপতিদের প্রতারণার উদ্দেশ্যে নিজের নামে বা বেনামে বেশ কয়েকটি নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এই জিয়া। তাছাড়া চীন, দুবাই ও ওমানে তার একাধিক সিরামিক শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জাহির করতেন। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছেন তিনি।

 

জিয়া নিজেকে নিউ জং ইউয়ান সিরামিক কোম্পানি (বিডি) লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফোসান গ্রুপের চেয়ারম্যান, ফোসান সিরামিক কোম্পানি লি.-এর চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন। এ ছাড়া মেজর চায়না লি., চায়না কনস্ট্রাকশন লি., এস কর্পোরেশন, জিয়া অটো ব্রিকস, কাশফুল টয়লেট্রিজ কোম্পানি লি, গ্রীন বায়োটেক লি., মেজর সফটটেক, ফোসান ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাজট্রিজ লি., ডাইনিং মাসকাট, হাই-টেক সিরামিক ইন্ডাজট্রিজ লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন।

এসব পরিচয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ছবি তুলে এবং ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে টার্গেট ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেন।

 

একজনকে ঠকিয়েছেন ৭৩ কোটি

নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে ব্যবসায়িক পার্টনার করার প্রলোভনে ৭৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক জিয়া। এই ঘটনায় সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করেন ওই ব্যবসায়ী।

 

নজরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি যে ব্যাংকে লেনদেন করি, সেখানেই পরিচয় হয় জিয়ার সঙ্গে। কিছু ব্যাংক অফিসারের যোগসাজশে তিনি আমার সঙ্গে পরিচিত হন। তখন আমাকে বলা হয়, তিনি (জিয়া) দুটি টাইলস ফ্যাক্টরি করছেন। তিনি অনেক বড় ব্যবসায়ী। ওমান, দুবাইতে বড় বড় ব্যবসা আছে। সেসব ওয়েবসাইট ও কাগজ দেখান। একটা টাইলস ফ্যাক্টরি বাবদ ব্যাংকের লোন ৩০০ কোটি টাকা পাস হয়েছে, কিন্তু নিতে পারছেন না। আমি বলেছিলাম, তিনি টাকা নিতে পারছেন না তাতে আমার কী?’

 

এরপর ছয় মাস চলে যায়। নজরুল ইসলামকে ব্যাংক কর্মকর্তা ভালো ব্যবসায়ী হিসেবে জানেন। এর মধ্যে তিনি তাকে প্রস্তাব করেন জিয়ার সঙ্গে পার্টনার বা চুক্তিবদ্ধ হতে।

 

নজরুল ইসরাম বলেন, ‘৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তি করে প্রথমে দিয়েছি ২০ কোটি টাকা। পরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা এক পে-অর্ডারে। জিয়া বিসিবি ব্যাংকে (বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড) ঋণখেলাপি ছিলেনর। সেই ব্যাংকে এই টাকা দেওয়া হয়। আমার নামে এক দিনে লোন পাসও হয়েছে, এক দিনে টাকা নিয়ে গেছে জিয়া।’

 

এই টাকা খোয়া যাওয়ার পর নজরুল ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এখন তিনি ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না, সুদও টানতে পারছেন না।

 

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘৬০ কোটি টাকা ছাড়াও ব্যবসা করার জন্য আরও ২৩ কোটি দিয়েছিলাম। সেই টাকাও গেছে। এরপর থেকে তার (জিয়া) সঙ্গে আর যোগযোগ করতে পারছি না। সব মোবাইল নম্বর বন্ধ করে দিয়েছে।’

 

বড় বড় রাজনীতিবিদ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জিয়ার ওঠাবসা , এমন ছবি তিনি সব সময় ফেসবুকে পোস্ট করতেন। ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রস্তাবের পাশাপাশি এসব ছবি জিয়ার প্রতি বিশ্বাস এনেছিল নজরুলের।

জিয়ার প্রতারণার বিষয়টি যখন বুঝতে পারেন, তখন অনেক টাকা হাতছাড়া হয়ে গেছে নজরুল ইসলামে । তিনি বলেন, ‘এরপর জানতে পেরেছি শুধু আমাকে না অনেক ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে সে প্রতারণা করেছে। বিশেষ করে সোনালী ব্যাংক থেকে ৩০০ কোটি টাকা, টাঙ্গাইলে একটা প্রজেক্টের নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়েছে। এভাবে জিয়া ৭০০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়ে আত্মগোপনে গেছেন।

 

জিয়ার যত প্রতারণা

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নামে শ্রমিক বা ঠিকাদার নিয়োগ করলেও তাদের টাকা পরিশোধ করেননি জিয়া। তাছাড়া বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর নামে শত শত মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন তিনি।

 

জিয়া ফোসান গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে টাইলস কারখানার নাম করে বিভিন্ন ডিলারের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেন। অথচ আলোর মুখই দেখেনি প্রতিষ্ঠানটি। আবার যেসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে, তাদের টাকাও ফেরত দেওয়া হচ্ছে না।

 

এভাবে নিজের অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিয়ে মানুষের কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, জিয়ার প্রতারণার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা, যারা তাকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার কাজে সাহায্য করে আসছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, নামে-বেনামে ৯টির মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে জিয়ার। এর মধ্যে ছয়টির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঠিকানা নেই। শুধু ওয়েবসাইট আছে। এর বাইরে সবই শূন্য।

 

তার মিরপুরে একটি অফিস আছে। সেখানে অল্প কয়েকজন কাজ করেন। জিয়া তার ভুয়া প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনার কথা বলেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তার আরেকটি কাজ ছিল, বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে স্বপ্ন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এমনকি সাধারণ মানুষকে দেশে ও বিদেশে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার কথাও বলেন জিয়াউদ্দিন। এভাবে বছরের পর বছর তিনি প্রতারণা করেছেন।

 

এ ছাড়া নিজেকে বিভিন্ন মন্ত্রী ও বিশিষ্টজনের শুভাকাঙ্ক্ষী পরিচয় দিয়ে সরকারি-বেসরকারি ও নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আত্মসাৎ করেন বিপুল অর্থ।

 

জানা গেছে, হাইটেক সিরামিক ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে একটি সরকারি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ১৯৬ কোটি টাকা কনসোর্টিয়াম ঋণ মঞ্জুরি নিয়ে ওভার ইন-ভয়েসের মাধ্যমে এলসি খুলে টাকা বের করে নেয জিয়ার প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করে এলসি করে ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে এই টাকা পাচার করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে জিয়াউদ্দিনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা বলছে

ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের মামলার অগ্রগতি জানতে চাইলে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। আর আমরা জিয়াকে খুঁজছি। এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে।’

 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপর একটি সূত্র ঢাকা টাইমসকে জানায়, মামলার পর গোয়েন্দা বিভাগ এ বিষয়ে কাজ করছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার ভয়ংকর প্রতারণার অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে থাকলে তাকে গ্রেপ্তার হতেই হবে।

 

অপর একটি সূত্র জানায়, তার বিষয়ে দুদকে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। দ্রুতই এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করবে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।   সূএ:ঢাকাটাইমস ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com