সৈয়দ বোরহান কবীর: আপনার সামনে যদি কেউ টাকার ঝুড়ি নিয়ে আসে আপনি কী করবেন? সপ্তাহজুড়ে এ প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিভিন্ন জনকে প্রশ্নটা করলাম। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম সহধর্মিণীকে। কোনো চিন্তাভাবনা না করে সরাসরি জানিয়ে দিলেন ‘জীবনেও নেব না’। একজন সফল ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি চায়ের কাপে আলতো চুমুক দিয়ে মৃদু হাসলেন।
বললেন, ‘পৃথিবীতে কেউ কোনো কারণ ছাড়া টাকার ঝুড়ি দেবে না। কেউ যদি টাকার ঝুড়ি সামনে নিয়ে আসে বুঝতে হবে তার বড় কোনো মতলব আছে। প্রথমে তার মতলব বোঝার চেষ্টা করব তারপর টাকার বস্তা তাকে ফিরিয়ে দেব।’ আমার গ্রামের এক আত্মীয় মাঝেমধ্যেই ফোন করেন। খোঁজখবর নেন। আমার মাথায় যখন এ টাকার ঝুড়ি প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে তখন তিনি এক বিকালে ফোন করলেন। কুশলাদি জিজ্ঞেসের আগেই তাকে আচমকা প্রশ্নটা করলাম। তিনি আকস্মিকভাবে আর্তনাদ করে উঠলেন। বললেন, ‘না বাবা! জমি আমি বেচব না। আমার গ্রামে যারা জমি কেনে তারা এমন টাকার ঝোলা নিয়ে ঘোরে।’ আমার তো আক্কেলগুড়ুম! একজন রাজনৈতিক নেতা বন্ধুর মতো। প্রায়ই তার সঙ্গে দেশের রাজনীতির আবহাওয়া নিয়ে আড্ডা হয়। তাকে একই প্রশ্ন করলাম। তিনি জিবে কামড় নিয়ে বললেন, ‘ভাই! এবার মনোনয়ন বাণিজ্য হবে না। নমিনেশন এবার নেত্রী নিজে দেবেন। টাকার বস্তা কেন ট্রাকভর্তি টাকা দিলেও লাভ হবে না।’ আমি বিরক্ত এবং আশ্চর্য হলাম। বললাম টাকার সঙ্গে মনোনয়নের সম্পর্ক কী? এবার তিনি আমাকে ভেংচি কেটে বললেন, ‘এত কিছু লেখেন এটা বোঝেন না! নমিনেশন পাওয়ার চেষ্টা ছাড়া কেউ কাউকে টাকার ঝুড়ি দেয়?’ একজন রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি রীতিমতো আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘কন কী স্যার! ফাঁসাইয়া দিব। পুলিশ বাইন্দা নিয়া যাইব।’ একজন মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি যেন ভূত দেখলেন। বললেন, ‘ভাই! ভুলেও এসব কথা বলবেন না। দেয়ালেরও কান আছে।’ যে কজনের সঙ্গে কথা বললাম তারা কেউ আচমকা এভাবে টাকার ঝুড়ি নিতে রাজি নন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে টাকার ঝুড়ির আড়ালে আসলে স্বার্থ হাসিলের ফাঁদ আছে। সবাই ভাবনা ছাড়াই ঝটপট উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। তাহলে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এত ভাবনা কেন? ভরা মজলিসে কেন তিনি জানতে চাইলেন সামনে টাকার ঝুড়ি, তিনি কী করবেন? কেন সবকিছু বাদ দিয়ে টাকার ঝুড়িতেই মন্ত্রীর চোখ গেল? ঘটনাটি শনিবারের। সেদিন জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল নিরাপত্তা সম্মেলন। তিন দিনব্যাপী ওই সম্মেলনে শনিবার রাতে প্যানেল আলোচনার বিষয় ছিল ‘ইন্দো-প্যাসিফিকে আঞ্চলিক ব্যবস্থা ও নিরাপত্তায় বড় পরিবর্তন’। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের এশিয়া প্যাসিফিক-বিষয়ক সিনিয়র ফেলনিন কিউক অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ইউরোপ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতাবিষয়ক সাবকমিটির চেয়ারপারসন জিনি শাহিন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর, অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরিস পেইন ও জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হায়াশি ইয়োশিমাখা। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন প্যানেলের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন। ইংরেজিতে করা এ প্রশ্নের বাংলা অনুবাদ করলে এ রকম দাঁড়ায়- ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ভালো করছে। দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাও বেড়ে গেছে। তারা আরও উন্নত জীবন এবং সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামো চায়। কিন্তু বাংলাদেশের যথেষ্ট টাকা ও প্রযুক্তি নেই।’ অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা এবং ঋণের জন্য জাপান ও ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আরও তহবিল প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক তারা অনেক জটিলতা নিয়ে আসে এবং এটি গ্রহণ করা আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে যায়।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিকল্প হিসেবে টাকার ঝুড়ি নিয়ে এগিয়ে এসেছে চীন। তারা আগ্রাসী ও সাশ্রয়ী প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। এখন বিষয় হলো আমরা কী করব।’
কূটনীতি সম্পর্কে প্রয়াত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এক মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘একজন কূটনীতিকের একটি শব্দ একটি আগ্নেয়াস্ত্রের সমান। তাই প্রতিটি শব্দ চয়নের উদ্দেশ্য এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করেই উচ্চারণ করতে হবে।’ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য হেনরি কিসিঞ্জারের মতবাদ বিশ্বাস করেন না। তিনি সবকিছু বলেন, খুললাম খুললাম। কূটনীতির ভাষা-পরিভাষার বদলে তিনি তাঁর নিজস্ব স্টাইল চালু করেছেন। একবার তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো’। ড. মোমেনের বক্তব্য শুনে ক্ষমতাসীন দলেরই কেউ কেউ লজ্জায় মুখ লুকালেন। কেউ জিব কাটলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে কিছুদিন বেশ ট্রল হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাল না তখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন এটা নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঢং। এরপর গণতন্ত্র সম্মেলনে দাওয়াত না পাওয়ার এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিলেন। জানালেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোকেই গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন, সে দেশের প্রধান কূটনীতিক। তার প্রতিটি শব্দের মূল্য অপরিসীম। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শব্দকে মূল্যহীন করেছেন। কিসিঞ্জারের ভাষ্য অনুযায়ী একজন কূটনীতিকের একটি শব্দ যদি আগ্নেয়াস্ত্রের মতো হয় তাহলে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মতো। একবার নয়, বারবার তিনি এ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেই চলেছেন। এতে দেশের কি আদৌ কল্যাণ হচ্ছে?
চীন এখন বিশে^ অর্থনৈতিক পরাশক্তি। এ শক্তির আড়ালে তার রাজনৈতিক অভিপ্রায় ইদানীং প্রায়ই প্রকাশিত হয়। দেশে দেশে চীনা বিনিয়োগ এখন বিশ্ববাস্তবতা। চীন যে টাকার ঝুড়ি নিয়ে ঘুরছে এ কোনো নতুন তথ্য নয়। বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় চীন যে অবদান রাখছে তা-ও কোনো গবেষণার বিষয় নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চীনের আগ্রাসী ও সাশ্রয়ী প্রস্তাব আমরা কতটা নেব। আমার কি সামনে টাকা আছে, এজন্য খুশিতে বাকবাকুম করে যথেচ্ছ খরচ করব, ঋণের ভারে দেশকে জর্জরিত করব? নাকি টেকসই উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করব? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের কূটনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে একটি বাক্যে সন্নিবেশিত করেছেন- ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ যখনই এ চিন্তার ব্যতিক্রম হয়েছে তখনই বাংলাদেশ পথভ্রষ্ট হয়েছে। সস্তা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য জিয়ার ‘ভারতবিদ্বেষ’ নীতিতে বাংলাদেশের লাভ হয়নি। বরং ভারতবিদ্বেষের আড়ালে এ দেশে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আবাদ হয়েছে। জিয়ার পথ ধরে এরশাদও বাংলাদেশে জনগণের জন্য সুখবর আনতে পারেননি। বেগম জিয়ার শাসনামলে ভুল বিদেশনীতি বিশে^ বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা লাগিয়েছিল। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থানে বাংলাদেশের জনগণকে সন্দেহের খাতায় নাম লিখিয়েছিল। যে জায়গা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটিয়েছেন শেখ হাসিনা। গত ১৩ বছরে বিশে^ বাংলাদেশ আলাদা এক মর্যাদার আসন পেয়েছে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট-ধারীদের এখন আর অন্য চোখে দেখা হয় না। বাংলাদেশ একাধারে চীন ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে এগিয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রেখেও ফিলিস্তিন প্রশ্নে সোচ্চার থেকেছে। মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশে^ মানবিকতার নতুন বিজ্ঞাপন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু গত দুই বছরে বাংলাদেশের কূটনীতি যেন দিগ্ভ্রষ্ট। আমরা যেন লক্ষ্যচ্যুত। আর সে কারণেই টাকার ঝুড়ি বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লোভাতুর প্রশ্ন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন জ্ঞানীগুণী মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই জানেন চীনের টাকার ঝুড়ির লোভ কখনো কখনো কোনো দেশের জন্য ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় আনতে পারে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক স্যাম পার্কার ও গ্যাবরিয়েল শেফিটন লিখেছেন, ‘গত এক দশকে চীন এমন সব দেশকে শত সহস্র কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে যে দেশগুলোর তা পরিশোধের সামর্থ্য নেই।’ ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘যেসব দেশ বিপুল অঙ্কের চীনা ঋণ নিয়েছে চীন সেসব দেশের ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে।’ যেমন ধরা যাক শ্রীলঙ্কার কথা। ঋণ শোধে অক্ষমতার কারণে শ্রীলঙ্কা সরকার হ্যামবানটোটা পোর্ট ৯৯ বছরের জন্য চীনকে ইজারা দিতে বাধ্য হয়েছে। শ্রীলঙ্কা এখন দেউলিয়াপ্রায়। বাংলাদেশ রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ধার দিয়েছে। চীনের টাকার ঝুড়ির লোভে মালদ্বীপও এখন ধুঁকছে। ২০১৭ সালে জিবুতির ঋণের বোঝা তার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতভাগের কাছাকাছি পৌঁছায়। এর ফলে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেশটিতে চীনা নৌঘাঁটি স্থাপনের সম্মতি দেয় সে দেশের সরকার। এ রকম বহু উদাহরণ আছে। কাজেই আমাদের উন্নয়ন কৌশলে চীনমুখী আগ্রাসী ঝোঁক কতটা মঙ্গলজনক তা ভাবার সময় এসেছে। চীন যখন টাকার বস্তা নিয়ে এগিয়ে আসে বুঝতে হবে এর পেছনে নিশ্চয়ই চীনের স্বার্থ জড়িয়ে আছে এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বার্থ আমাদের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না তা পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা করাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ। বাংলাদেশের উন্নয়ন দরকার। কিন্তু দেশের স্বার্থ বিকিয়ে নয়। বাংলাদেশের অবকাঠামো দরকার। কিন্তু তা আত্মমর্যাদা বিকিয়ে নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় দেশের স্বার্থ অগ্রাধিকার দেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে গ্যাস বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই একাধিক বক্তৃতায় এ তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। শেখ হাসিনা এও বলেছিলেন, ‘গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হইনি বলেই নির্বাচনে জিততে পারিনি।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে দেশের স্বার্থ প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এতে সাময়িকভাবে তিনি হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তিনিই উজ্জ্বল হয়েছেন। উদ্ভাসিত হয়েছেন। যে প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বার্থ প্রাধান্য দেন সবার ওপরে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে এ রকম প্রশ্ন করেন কীভাবে? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের মন্তব্যটি বিচক্ষণ, বুদ্ধিদীপ্ত ও বাস্তবসম্মত। তিনি বলেছেন, ‘কোন দেশ কার কাছ থেকে বিনিয়োগ নেবে তা দেশের স্বার্থেই বিবেচনা করা উচিত। শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ গ্রহণকারী দেশ কী পাচ্ছে তা জেনে শুনেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ আমি জানি না ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দার্শনিক উপদেশের পর ড. মোমেনের টাকার ঝুড়ির মোহভঙ্গ হয়েছে কি না। নাকি তিনি জড়বাদী চার্বাক দর্শনে বিশ্বাসী। চার্বাক দর্শন বলে, ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’। অর্থাৎ ‘ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচ সুখে বাঁচ’। কিন্তু ঋণের পরিণাম যে ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের জন্যও ভয়ংকর পরিণতি বয়ে আনতে পারে তার উদাহরণ চারপাশে তাকালেই দেখা যায়। ব্যক্তির ঋণের বোঝা বইতে হয় তার উত্তরাধিকারদের। রাষ্ট্রের ঋণের বোঝা বইতে হয় জনগণকে, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। আমাদের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা, অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি সবই দরকার। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে আমরা যেন ঋণের ফাঁদে না পড়ি। যেমন পড়েছে পাকিস্তান। ২০২০-২১ সালে ঋণ গ্রহণে নতুন রেকর্ড গড়েছে পাকিস্তানের ইমরান খান সরকার। পাকিস্তানের ওপর এখন ৮৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণের বোঝা। এক অর্থবছরেই (২০২০-২১) ইমরান খান সরকার ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। ২০১৮ সালে পাকিস্তানি মুদ্রার বিপরীতে ডলার ছিল ১২৩ টাকা ডিসেম্বরে তা হয়েছে ১৭৭ টাকা। অর্থনীতিতে দেউলিয়া প্রায় পাকিস্তান এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্য গড়তে মরিয়া। ’৭১-এর ক্ষত ভুলিয়ে দিতে ইমরান খানের কত না আয়োজন। আমাদেরও মনে রাখতে হবে উন্নয়নের রঙিন স্বপ্ন পূরণে আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন দেউলিয়া না হয়ে যায়। ঋণ করে অট্টালিকা বানানোর চিন্তা কখনই জাতির পিতার রাষ্ট্রদর্শনে ছিল না। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল এক সোনার বাংলা বিনির্মাণ করতে। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আমাদের যদি কেউ কিনতে চান ভুল হবে। কেউ যদি সাহায্যের নামে আমাদের দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তবে ভুল হবে। আমরা শোষিত মানুষ। বহু ত্যাগ করেছি। বহু রক্ত দিয়েছি। দরকার হয় আরও দেব। কিন্তু আত্মসম্মান বিক্রি করে আমরা কারও কাছে সাহায্য চাই না।’ তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মিউনিখের বক্তব্য জাতির পিতার রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা বেড়ে গেছে এজন্য সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের টাকার বস্তার জন্য হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এমন ভাবনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। বরং আমরা আমাদের সম্পদগুলো বিকশিত করব, সব ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াব, রপ্তানি বাড়াব, তা দিয়ে উন্নত হব- এটাই স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের কথা না হয় বাদই দিলাম। একজন মানুষ আয়-উপার্জনে উন্নতি করছেন। তার আকাক্সক্ষা হলো বিলাসবহুল বাড়ি বানাবেন, দামি গাড়িতে চড়বেন, ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়াবেন। এজন্য তিনি কী করবেন? আরও কষ্ট করে উপার্জন বাড়াবেন, অপচয়ের খাতগুলো বন্ধ করবেন নাকি ঋণ করবেন? একজন ব্যক্তির জন্য যেমন এ প্রশ্নের উত্তর জরুরি, তেমনি রাষ্ট্রের জন্যও এ প্রশ্নের উত্তর জরুরি।
একজন ব্যক্তির যেমন একটি নীতি ও আদর্শ থাকে। নিজের বিলাসিতা বা উন্নত জীবনের জন্য তিনি যদি নীতি ও আদর্শ বিলিয়ে দেন তাহলে তার আর মর্যাদা থাকে না। তেমনি একটি রাষ্ট্রও কিছু মৌলিক নীতি ও আদর্শের ওপর দাঁড়ায়। সে আদর্শ ও নীতি বিসর্জন দিলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
বাংলাদেশ গত এক যুগে যেমন বিস্ময়কর উন্নতি করেছে, তেমনি অনেক দেশের ঈর্ষার কারণও হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রায় বিশে^র সব দেশ খুশি এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া বিশে^ এখন স্নায়ুযুদ্ধের নতুন মেরুকরণ চলছে। নতুন করে বিভক্তি এবং উত্তাপের আঁচ আজ টের পাওয়া যায়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের উন্নয়ন টেকসই করতে টালমাটাল বৈশি^ক রাজনীতিতে আমাদের অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে। আমরা যেন কোনো শিবিরের ব্র্যাকেটবন্দি না হই। কোনো দেশের ‘একান্ত বাধ্যগত’ না হই তা বিবেচনায় রাখতে হবে। উন্নয়নের অংশীদার হয়ে কোনো দেশ যেন নব্য কাবুলিওয়ালা হয়ে আমাদের ঘাড়ে না চাপে সেটাই এখন কূটনীতির চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নের বেপরোয়া উন্মাদনা যেন আমাদের আত্মমর্যাদা কেড়ে না নেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে সবার আগে। টাকার বস্তা দেখলেই আমরা যেন খুশিতে আত্মহারা না হই, বরং বস্তার পেছনের উদ্দেশ্যের অবয়বটা বোঝার চেষ্টা করি।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
Email : [email protected] সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন