ঘুষদাতা ও গ্রহীতা যে শাস্তি ভোগ করবে

ছবি:সংগৃহীত

 

ইসলামে ঘুষ দেওয়া ও গ্রহণ করা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম বা নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে, রাসুল (স.) ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই লানত করেছেন। (তিরমিজি: ১৩৩৬; ইবনে মাজাহ: ২৩১৩)

 

ঘুষ খাওয়ার পরিণতি কঠিন ও ভয়ঙ্কর। নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে দেহের গোশত হারাম উপার্জনে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম ধন-সম্পদে গঠিত ও লালিত পালিত দেহের জন্য জাহান্নামই উপযোগী। (মেশকাত: ২৭৭২; আহমদ: ১৪৪১, শুয়াবুল ঈমান: ৮৯৭২) অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে ওঠে, তার জন্য দোজখের আগুনই উত্তম।’ (তিরমিজি: ৬১৪)

 

ঘুষ জঘন্য পাপ। ইরশাদ হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি এক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) সুদ জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে, তাতে তার পাপ ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও অনেক বেশী হয়।’ (আহমদ, মেশকাত: ২৮২৫, সনদ সহিহ)

তবে, হাদিয়া ঘুষ নয়। ইসলামে হাদিয়া জায়েজ। হাদিয়া হলো সম্পর্কোন্নয়নের হাতিয়ার। এতে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, ঘুষ ভালোবাসা নষ্ট করে। ঘুষ ও হাদিয়ার মধ্যে পার্থক্য হলো- হাদিয়ায় আর্থিক কোনো লাভের উদ্দেশ্য থাকে না, কিন্তু ঘুষে আর্থিক লাভের আশা থাকে।

 

বর্তমান সমাজে সুদে জড়িত কেউই ঘুষকে ঘুষ বলতে চায় না। বরং তারা এটিকে অফিস খরচ, বকশিশ, চা-মিষ্টির জন্য হাদিয়া—এসব নামে অভিহিত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নাম বদল করে তারা এ অপরাধকে কিছুটা হালকাভাবে দেখতে চায়। এজন্যই হয়ত ওমর বিন আব্দুল আজি (রহ) বলেছিলেন, كانة الهدية فى زمن رسول الله هدية، واليوم رشوة. ‘রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগে হাদিয়া ছিল; আর এখন তা ঘুষ।’ (বুখারি, ‘হেবা ও তার ফজিলত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৭)

 

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে একজন কর্মচারী কিছু মাল এনে বলল, এটা আপনাদের (সরকারি) মাল, আর এটা আমাকে দেওয়া হাদিয়া। রাসুলুল্লাহ (স.) এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, সে তার বাবা-মার ঘরে বসে থাকল না কেন, তখন সে দেখতে পেত- তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি-না? (বুখারি: ২৫৯৭ ‘হেবা ও তার ফজিলত’ অধ্যায়)

ওই কর্মচারীর কথা শোনার পর ভাষণে নবীজি (স.) বলেন, ..‘আল্লাহর কসম, তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো জিনিস অনধিকার গ্রহণ করবে, সে কেয়ামতের দিন তা নিজ ঘাড়ে বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করবে। অতএব আমি যেন অবশ্যই চিনতে না পারি যে, তোমাদের মধ্য হতে কেউ নিজ ঘাড়ে চিঁহি আওয়াজবিশিষ্ট উট, অথবা হাম্বা রববিশিষ্ট গাই, অথবা মে মে রববিশিষ্ট ছাগল বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করেছে।’ আবু হুমাইদ (র.) বলেন, অতঃপর নবী (স.) উভয় হাতকে (মোনাজাতের সময়) উপর দিকে এতটা তুললেন যে, তাঁর উভয় বগলের শুভ্রতা দেখা গেলো। অতঃপর তিনবার বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিলাম?’ (মুত্তাফাকুন আলাইহ)

 

‘নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে আল্লাহর সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কেয়ামতের দিন তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম’। (বুখারি, মেশকাত: ৩৯৯৫, ‘কর্মচারীদের বেতন নেওয়া ও উপঢৌকন গ্রহণ করা’ অনুচ্ছেদ: ৩৭৪৬)

 

ঘুষ খাওয়া ইহুদিদের বৈশিষ্ট্য। ইহুদিরা সুদ ও ঘুষের সঙ্গে বেশি জড়িত। তাদের প্রসঙ্গে কোরআনে এসেছে, ‘তারা (ইহুদিরা) মিথ্যা শ্রবণে অধিক আগ্রহী এবং অবৈধ অর্থ (ঘুষ) গ্রহণে অত্যন্ত আসক্ত।’ (সুরা মায়েদা: ৪২) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে নবী, আপনি (আহলে কিতাবদের) অনেককেই দেখবেন দোজখে সীমা লঙ্ঘনে ও অবৈধ সম্পদ (ঘুষ) গ্রহণে তৎপর। তারা যা করে, নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট।’ (সুরা মায়েদা: ৬২)

 

ঘুষ বড় ধরণের পাপ হলেও মানুষ এই অবৈধ কাজে দিন দিন জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমান সমাজে তো ঘুষ মহামারীতে রূপ নিয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তাদের অনেককেই তুমি দেখবে পাপে, সীমালঙ্ঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে তৎপর; তারা যা করে নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট।’ (সুরা মায়েদা: ৬২)

 

অন্য আরেকটি আয়াতে ঘুষ নিষেধের ব্যাপারে আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)

 

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের তাফসির বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন, এই আয়াত এমন ব্যক্তির ব্যাপারে যার কাছে কারও পাওনা থাকে, কিন্তু পাওনাদারের নিকট প্রমাণ না থাকে, এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সে আদালত বা বিচারকের মাধ্যমে নিজের ব্যাপারে ফয়সালা করিয়ে নেয়। এমনিভাবে অন্যের হক জোর-জবরদস্তি করে নিয়ে নেয়। আদালতের ফয়সালা জুলুম এবং হারামকে জায়েজ এবং হালাল করতে পারে না। এই জালেম আল্লাহ তাআলার কাছে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ১/৫২১)

 

মুফতি শফি (রহ.) উল্লেখিত আয়াতের তাফসিরে হালাল-হারামের কারণগুলো স্পষ্ট করতে গিয়ে লেখেন, ‘ইসলামি শরিয়তে যতগুলো লেনদেন বাতিল, ফাসেদ ও গুনাহ বিবেচিত হয়, সবগুলোর কারণ এটাই যে, কোথাও ধোঁকার আশ্রয় নেওয়া হয়, কোথাও অজানা বস্তু, অজানা কাজের বিনিময় হয়, কোথাও কারও হক লুণ্ঠন হয়, কোথাও কাউকে ক্ষতি করা হয়, কোথাও অবৈধ হস্তক্ষেপ করা হয়। সুদ, জুয়া এগুলো হারাম হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ কিন্তু এটাই যে, সেগুলো সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে গুটিকয়েক মানুষ আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়, আর পুরো সমাজ এতে দেউলিয়া হয়। এ ধরনের লেনদেন উভয়ের সন্তুষ্টিতে হলেও হালাল হবে না। কারণ সেটি পুরো জাতির বিপরীতে একটি অপরাধ প্রবণতা। উল্লিখিত আয়াতটি এ সব অবৈধ বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। (মারেফুল কোরআন: ১/৪৫৯)

 

কারো ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে কিছু দেওয়াকে ঘুষ বলা হয়। কখনো আবার কোনো মধ্যস্থতাকারীকে ব্যবহার করে চুক্তির মাধ্যমেও নেওয়া হয়। কেউ আবার এটিকে নিজের অধিকার ভেবে সরাসরি চেয়েও বসে। পার্থক্য হলো, কারো চাওয়ার ধরণ ভিক্ষুকের মতো হয়, আবার কেউ মাস্তানদের মতো মানুষকে জিম্মি করেও তা আদায় করে থাকে। কেউ আবার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের গুণগান গাওয়াসহ বিভিন্ন উপায়ে ঘুষ নিয়ে থাকে। কেউ কেউ পরিচিত মুখ দেখলে ঘুষ চাইতে পারে না, তাই ওই বেচারার কাজও শেষ পর্যন্ত হয় না। এসব পরিস্থিতির মূলে থাকে কিছু হারাম অর্থ। অথচ রাসুল (স.) সাবধান করেছেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামি।’ (মু’জামুল আউসাত: ২০২৬)

 

ঘুষখোররা এতটাই নীচ ও জঘন্য হয় যে, তারা রাষ্ট্রের মুচি, মেথরের কাছ থেকে ঘুষ নিতে পর্যন্ত লজ্জা বোধ করে না। তাদের টেবিলে জনগণের ফাইল যেন ভিক্ষার থালা হয়ে পড়ে থাকে। যতক্ষণ সেই থালায় ঘুষের টাকা পড়বে না, ততক্ষণ সেই ফাইলের কার্যক্রমও চলবে না। পবিত্র হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায়, সে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আগমন করবে যে তার মুখমণ্ডলে এক টুকরা গোশতও থাকবে না।’ (বুখারি: ১৪৭৪)

 

ঘুষগ্রহণের ফলে ইবাদত, দোয়া কবুল হয় না। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, একবার রাসুল (স.)-এর কাছে একটি আয়াত তেলাওয়াত করা হলো, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ করো। ’ তখন সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন আমার দোয়া কবুল হয়। রাসুল (স.) বলেন, হে সাআদ, তোমার পানাহারকে হালাল করো, তবেই তোমার দোয়া কবুল হবে। (আল মুজামুল আউসাত: ৬৪৯৫)

 

রাষ্ট্র জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স বসিয়ে টাকা আদায় করে জনগণেরই খেদমত করার জন্য বেতন দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে। এসব বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর ওয়াজিব হলো, যে কাজের জন্য তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে, সে কাজ তাকে করে দেওয়া। এর বিনিময়ে উপরি কিছু গ্রহণ করতে পারবে না। ওই বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি তাদের নিজ নিজ এলাকায় জনগণের কাছ থেকে উপহার নেয়, জনগণের বাড়িতে দাওয়াত খায়, জনগণের কাছ থেকে কোনো হাদিয়া, তোহফা গ্রহণ করে বা তাদের ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর জন্য মিষ্টি বা নাশতা খাবার গ্রহণ করে, তবে তার সবই ঘুষ হবে। হারাম হবে। আমানতের খেয়ানত হবে। গোনাহে কবিরা হবে।’ (বেহেশতি জেওর-পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০৮)

 

মহান আল্লাহ সবাইকে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজদের কবল থেকে রক্ষা করুন। হাদিয়ার নামে ঘুষ দেওয়া থেকেও বিরত রাখুন। আমিন।

সূএ: ঢাকা মেইল ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান তারেক রহমানের

» সরকারি চাকরি ফিরে পাচ্ছেন ডা. জুবাইদা রহমান

» জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি দায়িত্ব পালন করবেন এটিএম মা’ছুম

» পাকিস্তানকে ভয় পায় ভারত: ইলিয়াস

» ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা, পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ আইজিপির

» আপাতত গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াবে না সরকার: উপদেষ্টা ফাওজুল কবির

» ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ: প্রেস সচিব

» র‍্যাব অফিসে এএসপি পলাশের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার, পাশে চিরকুট

» লক্ষ্মীপুরে বিআরটিএ বাড়তি টাকা আদায়ের সত্যতা পেয়েছে দুদক

» সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে প্রাইম ব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষর

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ঘুষদাতা ও গ্রহীতা যে শাস্তি ভোগ করবে

ছবি:সংগৃহীত

 

ইসলামে ঘুষ দেওয়া ও গ্রহণ করা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম বা নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে, রাসুল (স.) ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই লানত করেছেন। (তিরমিজি: ১৩৩৬; ইবনে মাজাহ: ২৩১৩)

 

ঘুষ খাওয়ার পরিণতি কঠিন ও ভয়ঙ্কর। নবীজি (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে দেহের গোশত হারাম উপার্জনে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম ধন-সম্পদে গঠিত ও লালিত পালিত দেহের জন্য জাহান্নামই উপযোগী। (মেশকাত: ২৭৭২; আহমদ: ১৪৪১, শুয়াবুল ঈমান: ৮৯৭২) অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে ওঠে, তার জন্য দোজখের আগুনই উত্তম।’ (তিরমিজি: ৬১৪)

 

ঘুষ জঘন্য পাপ। ইরশাদ হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি এক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) সুদ জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে, তাতে তার পাপ ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও অনেক বেশী হয়।’ (আহমদ, মেশকাত: ২৮২৫, সনদ সহিহ)

তবে, হাদিয়া ঘুষ নয়। ইসলামে হাদিয়া জায়েজ। হাদিয়া হলো সম্পর্কোন্নয়নের হাতিয়ার। এতে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, ঘুষ ভালোবাসা নষ্ট করে। ঘুষ ও হাদিয়ার মধ্যে পার্থক্য হলো- হাদিয়ায় আর্থিক কোনো লাভের উদ্দেশ্য থাকে না, কিন্তু ঘুষে আর্থিক লাভের আশা থাকে।

 

বর্তমান সমাজে সুদে জড়িত কেউই ঘুষকে ঘুষ বলতে চায় না। বরং তারা এটিকে অফিস খরচ, বকশিশ, চা-মিষ্টির জন্য হাদিয়া—এসব নামে অভিহিত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নাম বদল করে তারা এ অপরাধকে কিছুটা হালকাভাবে দেখতে চায়। এজন্যই হয়ত ওমর বিন আব্দুল আজি (রহ) বলেছিলেন, كانة الهدية فى زمن رسول الله هدية، واليوم رشوة. ‘রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগে হাদিয়া ছিল; আর এখন তা ঘুষ।’ (বুখারি, ‘হেবা ও তার ফজিলত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৭)

 

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে একজন কর্মচারী কিছু মাল এনে বলল, এটা আপনাদের (সরকারি) মাল, আর এটা আমাকে দেওয়া হাদিয়া। রাসুলুল্লাহ (স.) এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, সে তার বাবা-মার ঘরে বসে থাকল না কেন, তখন সে দেখতে পেত- তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি-না? (বুখারি: ২৫৯৭ ‘হেবা ও তার ফজিলত’ অধ্যায়)

ওই কর্মচারীর কথা শোনার পর ভাষণে নবীজি (স.) বলেন, ..‘আল্লাহর কসম, তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো জিনিস অনধিকার গ্রহণ করবে, সে কেয়ামতের দিন তা নিজ ঘাড়ে বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করবে। অতএব আমি যেন অবশ্যই চিনতে না পারি যে, তোমাদের মধ্য হতে কেউ নিজ ঘাড়ে চিঁহি আওয়াজবিশিষ্ট উট, অথবা হাম্বা রববিশিষ্ট গাই, অথবা মে মে রববিশিষ্ট ছাগল বহন করা অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করেছে।’ আবু হুমাইদ (র.) বলেন, অতঃপর নবী (স.) উভয় হাতকে (মোনাজাতের সময়) উপর দিকে এতটা তুললেন যে, তাঁর উভয় বগলের শুভ্রতা দেখা গেলো। অতঃপর তিনবার বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কি পৌঁছে দিলাম?’ (মুত্তাফাকুন আলাইহ)

 

‘নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে আল্লাহর সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কেয়ামতের দিন তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম’। (বুখারি, মেশকাত: ৩৯৯৫, ‘কর্মচারীদের বেতন নেওয়া ও উপঢৌকন গ্রহণ করা’ অনুচ্ছেদ: ৩৭৪৬)

 

ঘুষ খাওয়া ইহুদিদের বৈশিষ্ট্য। ইহুদিরা সুদ ও ঘুষের সঙ্গে বেশি জড়িত। তাদের প্রসঙ্গে কোরআনে এসেছে, ‘তারা (ইহুদিরা) মিথ্যা শ্রবণে অধিক আগ্রহী এবং অবৈধ অর্থ (ঘুষ) গ্রহণে অত্যন্ত আসক্ত।’ (সুরা মায়েদা: ৪২) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে নবী, আপনি (আহলে কিতাবদের) অনেককেই দেখবেন দোজখে সীমা লঙ্ঘনে ও অবৈধ সম্পদ (ঘুষ) গ্রহণে তৎপর। তারা যা করে, নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট।’ (সুরা মায়েদা: ৬২)

 

ঘুষ বড় ধরণের পাপ হলেও মানুষ এই অবৈধ কাজে দিন দিন জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমান সমাজে তো ঘুষ মহামারীতে রূপ নিয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তাদের অনেককেই তুমি দেখবে পাপে, সীমালঙ্ঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে তৎপর; তারা যা করে নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট।’ (সুরা মায়েদা: ৬২)

 

অন্য আরেকটি আয়াতে ঘুষ নিষেধের ব্যাপারে আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-বুঝে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে বিচারককে উৎকোচ দিও না।’ (সুরা বাকারা: ১৮৮)

 

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের তাফসির বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন, এই আয়াত এমন ব্যক্তির ব্যাপারে যার কাছে কারও পাওনা থাকে, কিন্তু পাওনাদারের নিকট প্রমাণ না থাকে, এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সে আদালত বা বিচারকের মাধ্যমে নিজের ব্যাপারে ফয়সালা করিয়ে নেয়। এমনিভাবে অন্যের হক জোর-জবরদস্তি করে নিয়ে নেয়। আদালতের ফয়সালা জুলুম এবং হারামকে জায়েজ এবং হালাল করতে পারে না। এই জালেম আল্লাহ তাআলার কাছে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির: ১/৫২১)

 

মুফতি শফি (রহ.) উল্লেখিত আয়াতের তাফসিরে হালাল-হারামের কারণগুলো স্পষ্ট করতে গিয়ে লেখেন, ‘ইসলামি শরিয়তে যতগুলো লেনদেন বাতিল, ফাসেদ ও গুনাহ বিবেচিত হয়, সবগুলোর কারণ এটাই যে, কোথাও ধোঁকার আশ্রয় নেওয়া হয়, কোথাও অজানা বস্তু, অজানা কাজের বিনিময় হয়, কোথাও কারও হক লুণ্ঠন হয়, কোথাও কাউকে ক্ষতি করা হয়, কোথাও অবৈধ হস্তক্ষেপ করা হয়। সুদ, জুয়া এগুলো হারাম হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ কিন্তু এটাই যে, সেগুলো সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে গুটিকয়েক মানুষ আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়, আর পুরো সমাজ এতে দেউলিয়া হয়। এ ধরনের লেনদেন উভয়ের সন্তুষ্টিতে হলেও হালাল হবে না। কারণ সেটি পুরো জাতির বিপরীতে একটি অপরাধ প্রবণতা। উল্লিখিত আয়াতটি এ সব অবৈধ বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। (মারেফুল কোরআন: ১/৪৫৯)

 

কারো ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে কিছু দেওয়াকে ঘুষ বলা হয়। কখনো আবার কোনো মধ্যস্থতাকারীকে ব্যবহার করে চুক্তির মাধ্যমেও নেওয়া হয়। কেউ আবার এটিকে নিজের অধিকার ভেবে সরাসরি চেয়েও বসে। পার্থক্য হলো, কারো চাওয়ার ধরণ ভিক্ষুকের মতো হয়, আবার কেউ মাস্তানদের মতো মানুষকে জিম্মি করেও তা আদায় করে থাকে। কেউ আবার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের গুণগান গাওয়াসহ বিভিন্ন উপায়ে ঘুষ নিয়ে থাকে। কেউ কেউ পরিচিত মুখ দেখলে ঘুষ চাইতে পারে না, তাই ওই বেচারার কাজও শেষ পর্যন্ত হয় না। এসব পরিস্থিতির মূলে থাকে কিছু হারাম অর্থ। অথচ রাসুল (স.) সাবধান করেছেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামি।’ (মু’জামুল আউসাত: ২০২৬)

 

ঘুষখোররা এতটাই নীচ ও জঘন্য হয় যে, তারা রাষ্ট্রের মুচি, মেথরের কাছ থেকে ঘুষ নিতে পর্যন্ত লজ্জা বোধ করে না। তাদের টেবিলে জনগণের ফাইল যেন ভিক্ষার থালা হয়ে পড়ে থাকে। যতক্ষণ সেই থালায় ঘুষের টাকা পড়বে না, ততক্ষণ সেই ফাইলের কার্যক্রমও চলবে না। পবিত্র হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায়, সে কেয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আগমন করবে যে তার মুখমণ্ডলে এক টুকরা গোশতও থাকবে না।’ (বুখারি: ১৪৭৪)

 

ঘুষগ্রহণের ফলে ইবাদত, দোয়া কবুল হয় না। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, একবার রাসুল (স.)-এর কাছে একটি আয়াত তেলাওয়াত করা হলো, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ করো। ’ তখন সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন আমার দোয়া কবুল হয়। রাসুল (স.) বলেন, হে সাআদ, তোমার পানাহারকে হালাল করো, তবেই তোমার দোয়া কবুল হবে। (আল মুজামুল আউসাত: ৬৪৯৫)

 

রাষ্ট্র জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স বসিয়ে টাকা আদায় করে জনগণেরই খেদমত করার জন্য বেতন দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে। এসব বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর ওয়াজিব হলো, যে কাজের জন্য তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে, সে কাজ তাকে করে দেওয়া। এর বিনিময়ে উপরি কিছু গ্রহণ করতে পারবে না। ওই বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি তাদের নিজ নিজ এলাকায় জনগণের কাছ থেকে উপহার নেয়, জনগণের বাড়িতে দাওয়াত খায়, জনগণের কাছ থেকে কোনো হাদিয়া, তোহফা গ্রহণ করে বা তাদের ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর জন্য মিষ্টি বা নাশতা খাবার গ্রহণ করে, তবে তার সবই ঘুষ হবে। হারাম হবে। আমানতের খেয়ানত হবে। গোনাহে কবিরা হবে।’ (বেহেশতি জেওর-পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪০৮)

 

মহান আল্লাহ সবাইকে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজদের কবল থেকে রক্ষা করুন। হাদিয়ার নামে ঘুষ দেওয়া থেকেও বিরত রাখুন। আমিন।

সূএ: ঢাকা মেইল ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com