প্রধানমন্ত্রী আদালত অবমাননা করতে পারেন না

ছবি: সংগৃহীত

 

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক :এটা কারো অজানা থাকার কথা নয় যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চাইলেও এমন একটি ফৌজদারি মামলার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারেন না, যে মামলার বাদী সরকার নয় এবং যে মামলা আপস অযোগ্য। এমনকি আপসযোগ্য মামলা বাদী তুলে ফেলতে চাইলেও শেষ ইচ্ছাটি আদালতের। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ এবং ৪০২ ধারা এবং সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমা করার যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটি শুধু দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য প্রযোজ্য। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় পাবলিক প্রসিকিউটরদের মামলা তুলে নেওয়ার যে কথা বলা আছে, সেখানেও আদালতের ইচ্ছাই মুখ্য।

 

এ ছাড়া সেই বিধান শ্রম আদালতে প্রযোজ্য নয়। বিষয়টি হিলারি ক্লিনটনের অজানা থাকার কথা নয়। হিলারি ক্লিনটন বহু বছর যুক্তরাষ্ট্রে সেক্রেটারি অব স্টেট পদে কাজ করেছেন। তাঁর এটাও অজানা থাকার কথা নয় যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের সংবিধানেও রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ।

 

যথা—প্রশাসন, বিচার এবং আইন প্রণয়ন অঙ্গ। একটির থেকে অন্যটি আলাদা এবং স্বতন্ত্র, কারো ওপরই কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার অর্থ, প্রশাসন অঙ্গের প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা নেই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলতি মামলাগুলো থামিয়ে দেওয়ার। হিলারি ক্লিনটন যদি এগুলো না জেনে থাকেন, তাহলে বলতে হবে সেটি তাঁর নেহাত অজ্ঞতা।

 

তবে তিনি এত অজ্ঞ, সেটা বিশ্বাস করা দুষ্কর। সে অর্থে বলতে হয়, হিলারি ক্লিনটনের উদ্যোগ এবং প্রভাবে ১৬০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ, তার পেছনে অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচনের কয়েক মাস আগে চিঠিটি পাঠানোর কারণে সেই সন্দেহ আরো বেশি ঘনীভূত হচ্ছে।

 

প্রধানমন্ত্রী আদালত অবমাননা করতে পারেন না২০০৬ সালেও মূলত হিলারি ক্লিনটনের ইচ্ছানুযায়ী চেষ্টা করা হয়েছিল ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় বসানোর। সেই অভিলাষ বিফল হওয়ায় হিলারি ক্লিনটন নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন বলে যাঁরা মনে করছেন তাঁদের সন্দেহ অমূলক নয়।

 

তাঁরা জানেন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলতি মামলা বন্ধ করার ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেই। তার পরও তাঁরা চিঠিটি লিখেছেন একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ড. ইউনূসকে সামনে আনার জন্য। এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, যে ১৬০ ব্যক্তি চিঠিটিতে দস্তখত করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাসংক্রান্ত কিছুই জানেন না। তাঁর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ রয়েছে, মামলার বাদী কারা, কী সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলাগুলো করা হয়েছে, তাঁরা এসব না জেনে নেহাত হিলারি ক্লিনটনের ইচ্ছায় প্রভাবিত হয়েই চিঠিতে দস্তখত করেছেন, এমনটি ভাবার পেছনে শক্ত যুক্তি রয়েছে। মামলা সম্পর্কে তাঁদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা ন্যূনতম জবাবও দিতে পারবেন না বলেই সবার বিশ্বাস। শ্রম আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর বাদী সরকার নয়। ড. ইউনূসেরই কয়েকজন কর্মচারী বাদী হয়ে মামলাগুলো করেছেন এই অভিযোগ এনে যে ড. ইউনূস শ্রমিকদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ড. ইউনূস দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়েছিলেন, তাঁরা সব তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করেই মামলা চলবে মর্মে আদেশ দিয়েছেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যদি ড. ইউনূসের মামলায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টাও করেন, তাহলেও তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবমাননার দায়ে দায়ী হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।

 

ড. ইউনূসের আইনজীবী মহামান্য হাইকোর্টে যে এফিডেভিট জমা দিয়েছেন, তা থেকে ড. ইউনূস কর্তৃক দুর্নীতির কিছু স্বীকৃতির অবিশ্বাস্য চিত্র ফুটে উঠেছে। এফিডেভিটে বলা হয়েছে, শুধু শ্রম আদালতের জন্য নিযুক্ত আইনজীবীকেই ড. ইউনূস ফি বাবদ প্রদান করেছেন ১৬ কোটি টাকা, যে কথা শুনে স্বয়ং মাননীয় বিচারপতিও বিস্মিত হয়েছিলেন। পৃথিবীতে হেন কোনো দেশ নেই যেখানে এত বিশাল অঙ্কের ফি দেওয়া হয়। সে অর্থে সেখানে রয়েছে দুর্নীতির দুর্গন্ধ। এ ছাড়া ১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে মামলা দায়েরকারী শ্রমিক নেতা এবং তাঁদের আইনজীবীদের। এসব থেকে বোঝা যায় মামলাগুলো বন্ধ করার জন্য ড. ইউনূস সম্ভাব্য সবই করেছেন। শ্রম আদালত তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন গ্রহণ করেন।

 

হিলারির সঙ্গে একটি স্বার্থান্বেষী দেশি চক্রও যে কাজ করছে, তা এখন পরিষ্কার। তারা শুধু ড. ইউনূসের পক্ষে বক্তব্য দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এ ধরনেরও একটি উদ্ভট কথা প্রচারে ব্যস্ত হয়েছে যে জাতিসংঘ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে তদন্ত করবে। একটি দেশের কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে মামলাসংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করার কোনো এখতিয়ারই জাতিসংঘের নেই। জাতিসংঘ সনদের একটি মৌলিক কথা হচ্ছে, সমতার ভিত্তিতে সব সদস্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। তা ছাড়া এ ধরনের কোনো উদ্যোগ শুধু নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদই নিতে পারে, জাতিসংঘের মহাসচিব বা কোনো কর্মকর্তার পক্ষেই এ ধরনের কিছু করার সুযোগ নেই।

 

বাংলাদেশের কর কর্তৃপক্ষকে প্রতারিত করার প্রচেষ্টা করে ড. ইউনূস হাতেনাতেই ধরা পড়েছেন। তাঁর মতো একজন অতি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির অজানা থাকার কথা নয় যে সেই সব ট্রাস্টই কর মওকুফ দাবি করতে পারে যেগুলো দাতব্য ট্রাস্ট। যে ট্রাস্টের বেনিফিশিয়ারি ট্রাস্ট স্রষ্টা নিজে, সে ট্রাস্ট কর মুক্তি পেতে পারে না। অবশেষে ড. ইউনূস জল ঘোলা করে সেই জলই পান করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যখন সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে বিশাল অঙ্কের কর পরিশোধের আদেশ দিলেন। যে ব্যক্তি জনহিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নিজেকে জাহির করেন, কর মুক্তি পাওয়ার জন্য তাঁর পক্ষে কর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতারণা নিশ্চয়ই শোভা পায় না।

 

হিলারি গং যদি ভেবে থাকেন উঁচু মর্যাদার লোকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যায় না, তাহলে তাঁদের নিজ দেশেই যে এক সাবেক প্রেসিডেন্টের বিচার হচ্ছে তা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। কয়েক বছর আগে তাঁর দেশেই ধর্ষণের অভিযোগে বিচার হয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রধান ডোমিনিক স্ট্রস কাহানের, যিনি একসময় ফরাসি অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ডোমিনিক কাহান বিচার এড়ানোর জন্য প্যারিসগামী বিমানে উঠেও রেহাই পাননি, নিউ ইয়র্ক পুলিশ তাঁকে বিমান থেকে নামিয়ে এনেছিল। বিচার চলছে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজির, ফাঁসি হয়েছে পাকিস্তানের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর, বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজি, রয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ দুনিয়াভরা আরো অনেকে। বেশ কিছু নোবেল বিজয়ীরও বিচার হয়েছে বা হচ্ছে, যাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন অং সান সু চি, যাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত তদন্ত শুরু করেছেন। ফিলিপাইনের নোবেলজয়ী মারিয়া রেসার ছয় বছর কারাদণ্ড হয়েছিল, যদিও সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট পরে তাঁকে খালাস দিয়েছেন। বেলারুশের নোবেল বিজয়ী এলেস বিয়ালিয়াটস্কিকে সে দেশের আদালত ১০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন। এমনকি যে একাডেমি নোবেল পুরস্কার প্রদান করে থাকে, সেই একাডেমিরই এক সদস্য, জিন ক্লোড আরনন্ডকেও সুইডিশ আদালত দুই বছর জেল দিয়েছেন ধর্ষণের অভিযোগে।

 

হিলারি গং উল্লিখিত চিঠির মাধ্যমে আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূল্যবান তত্ত্বকেই ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের উচিত কালবিলম্ব না করে চিঠিটি তুলে নেওয়া। চাইলে তাঁরা বাংলাদেশে এসে ড. ইউনূসের আইনজীবীর ফাইলে রক্ষিত কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে পারেন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তি রয়েছে কি না। এগুলো গোপন দলিল নয় এবং তাঁদের বাংলাদেশে আসতেও কেউ বাধা দেবে না। তাঁদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উচিত আইনের শাসনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে না দিয়ে বরং তা বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করা, আর সে জন্যই তাঁদের উচিত ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করা। মনে রাখতে হবে, আইনের শাসনের একটি বড় তত্ত্ব হচ্ছে এই যে আইনের চোখে সবাই সমান। অপরাধ করলে সবাইকেই বিচারের সম্মুখীন করা আইনের শাসনের একটি বড় মন্ত্র। সেখানে ছোট-বড় ভেদাভেদ করার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুই-এক বছর দেখতে চাই : নুর

» চোখের সেবা সম্প্রসারণে অরবিসের সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ আগ্রহী : ইউনূস

» ভারতে বসে হাসিনা ষড়যন্ত্র করছেন : এ্যানি

» স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ২০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দে ইইউর সমর্থন চাইল বাংলাদেশ

» ধাপে ধাপে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে সরকার : হাসান আরিফ

» বিমান বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা

» অনলাইনে আয়কর পরিশোধ সহজ করতে এনবিআর-এর সাথে পার্টনারশিপ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

» বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষায় অশনি সংকেত অটোমেশন; ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা

» ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি খালেদা জিয়াকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি আলালের

» থানায় এসে কেউ যেন সেবা বঞ্চিত না হয়: ডিএমপি কমিশনার

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

প্রধানমন্ত্রী আদালত অবমাননা করতে পারেন না

ছবি: সংগৃহীত

 

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক :এটা কারো অজানা থাকার কথা নয় যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চাইলেও এমন একটি ফৌজদারি মামলার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারেন না, যে মামলার বাদী সরকার নয় এবং যে মামলা আপস অযোগ্য। এমনকি আপসযোগ্য মামলা বাদী তুলে ফেলতে চাইলেও শেষ ইচ্ছাটি আদালতের। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ এবং ৪০২ ধারা এবং সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমা করার যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটি শুধু দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য প্রযোজ্য। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় পাবলিক প্রসিকিউটরদের মামলা তুলে নেওয়ার যে কথা বলা আছে, সেখানেও আদালতের ইচ্ছাই মুখ্য।

 

এ ছাড়া সেই বিধান শ্রম আদালতে প্রযোজ্য নয়। বিষয়টি হিলারি ক্লিনটনের অজানা থাকার কথা নয়। হিলারি ক্লিনটন বহু বছর যুক্তরাষ্ট্রে সেক্রেটারি অব স্টেট পদে কাজ করেছেন। তাঁর এটাও অজানা থাকার কথা নয় যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের সংবিধানেও রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ।

 

যথা—প্রশাসন, বিচার এবং আইন প্রণয়ন অঙ্গ। একটির থেকে অন্যটি আলাদা এবং স্বতন্ত্র, কারো ওপরই কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার অর্থ, প্রশাসন অঙ্গের প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা নেই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলতি মামলাগুলো থামিয়ে দেওয়ার। হিলারি ক্লিনটন যদি এগুলো না জেনে থাকেন, তাহলে বলতে হবে সেটি তাঁর নেহাত অজ্ঞতা।

 

তবে তিনি এত অজ্ঞ, সেটা বিশ্বাস করা দুষ্কর। সে অর্থে বলতে হয়, হিলারি ক্লিনটনের উদ্যোগ এবং প্রভাবে ১৬০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ, তার পেছনে অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচনের কয়েক মাস আগে চিঠিটি পাঠানোর কারণে সেই সন্দেহ আরো বেশি ঘনীভূত হচ্ছে।

 

প্রধানমন্ত্রী আদালত অবমাননা করতে পারেন না২০০৬ সালেও মূলত হিলারি ক্লিনটনের ইচ্ছানুযায়ী চেষ্টা করা হয়েছিল ড. ইউনূসকে ক্ষমতায় বসানোর। সেই অভিলাষ বিফল হওয়ায় হিলারি ক্লিনটন নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন বলে যাঁরা মনে করছেন তাঁদের সন্দেহ অমূলক নয়।

 

তাঁরা জানেন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলতি মামলা বন্ধ করার ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেই। তার পরও তাঁরা চিঠিটি লিখেছেন একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ড. ইউনূসকে সামনে আনার জন্য। এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, যে ১৬০ ব্যক্তি চিঠিটিতে দস্তখত করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাসংক্রান্ত কিছুই জানেন না। তাঁর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ রয়েছে, মামলার বাদী কারা, কী সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলাগুলো করা হয়েছে, তাঁরা এসব না জেনে নেহাত হিলারি ক্লিনটনের ইচ্ছায় প্রভাবিত হয়েই চিঠিতে দস্তখত করেছেন, এমনটি ভাবার পেছনে শক্ত যুক্তি রয়েছে। মামলা সম্পর্কে তাঁদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা ন্যূনতম জবাবও দিতে পারবেন না বলেই সবার বিশ্বাস। শ্রম আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর বাদী সরকার নয়। ড. ইউনূসেরই কয়েকজন কর্মচারী বাদী হয়ে মামলাগুলো করেছেন এই অভিযোগ এনে যে ড. ইউনূস শ্রমিকদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ড. ইউনূস দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়েছিলেন, তাঁরা সব তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করেই মামলা চলবে মর্মে আদেশ দিয়েছেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যদি ড. ইউনূসের মামলায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টাও করেন, তাহলেও তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবমাননার দায়ে দায়ী হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।

 

ড. ইউনূসের আইনজীবী মহামান্য হাইকোর্টে যে এফিডেভিট জমা দিয়েছেন, তা থেকে ড. ইউনূস কর্তৃক দুর্নীতির কিছু স্বীকৃতির অবিশ্বাস্য চিত্র ফুটে উঠেছে। এফিডেভিটে বলা হয়েছে, শুধু শ্রম আদালতের জন্য নিযুক্ত আইনজীবীকেই ড. ইউনূস ফি বাবদ প্রদান করেছেন ১৬ কোটি টাকা, যে কথা শুনে স্বয়ং মাননীয় বিচারপতিও বিস্মিত হয়েছিলেন। পৃথিবীতে হেন কোনো দেশ নেই যেখানে এত বিশাল অঙ্কের ফি দেওয়া হয়। সে অর্থে সেখানে রয়েছে দুর্নীতির দুর্গন্ধ। এ ছাড়া ১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে মামলা দায়েরকারী শ্রমিক নেতা এবং তাঁদের আইনজীবীদের। এসব থেকে বোঝা যায় মামলাগুলো বন্ধ করার জন্য ড. ইউনূস সম্ভাব্য সবই করেছেন। শ্রম আদালত তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন গ্রহণ করেন।

 

হিলারির সঙ্গে একটি স্বার্থান্বেষী দেশি চক্রও যে কাজ করছে, তা এখন পরিষ্কার। তারা শুধু ড. ইউনূসের পক্ষে বক্তব্য দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এ ধরনেরও একটি উদ্ভট কথা প্রচারে ব্যস্ত হয়েছে যে জাতিসংঘ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে তদন্ত করবে। একটি দেশের কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে মামলাসংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত করার কোনো এখতিয়ারই জাতিসংঘের নেই। জাতিসংঘ সনদের একটি মৌলিক কথা হচ্ছে, সমতার ভিত্তিতে সব সদস্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। তা ছাড়া এ ধরনের কোনো উদ্যোগ শুধু নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদই নিতে পারে, জাতিসংঘের মহাসচিব বা কোনো কর্মকর্তার পক্ষেই এ ধরনের কিছু করার সুযোগ নেই।

 

বাংলাদেশের কর কর্তৃপক্ষকে প্রতারিত করার প্রচেষ্টা করে ড. ইউনূস হাতেনাতেই ধরা পড়েছেন। তাঁর মতো একজন অতি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির অজানা থাকার কথা নয় যে সেই সব ট্রাস্টই কর মওকুফ দাবি করতে পারে যেগুলো দাতব্য ট্রাস্ট। যে ট্রাস্টের বেনিফিশিয়ারি ট্রাস্ট স্রষ্টা নিজে, সে ট্রাস্ট কর মুক্তি পেতে পারে না। অবশেষে ড. ইউনূস জল ঘোলা করে সেই জলই পান করতে বাধ্য হয়েছিলেন, যখন সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে বিশাল অঙ্কের কর পরিশোধের আদেশ দিলেন। যে ব্যক্তি জনহিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নিজেকে জাহির করেন, কর মুক্তি পাওয়ার জন্য তাঁর পক্ষে কর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রতারণা নিশ্চয়ই শোভা পায় না।

 

হিলারি গং যদি ভেবে থাকেন উঁচু মর্যাদার লোকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যায় না, তাহলে তাঁদের নিজ দেশেই যে এক সাবেক প্রেসিডেন্টের বিচার হচ্ছে তা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। কয়েক বছর আগে তাঁর দেশেই ধর্ষণের অভিযোগে বিচার হয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রধান ডোমিনিক স্ট্রস কাহানের, যিনি একসময় ফরাসি অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ডোমিনিক কাহান বিচার এড়ানোর জন্য প্যারিসগামী বিমানে উঠেও রেহাই পাননি, নিউ ইয়র্ক পুলিশ তাঁকে বিমান থেকে নামিয়ে এনেছিল। বিচার চলছে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজির, ফাঁসি হয়েছে পাকিস্তানের আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর, বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাই সারকোজি, রয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ দুনিয়াভরা আরো অনেকে। বেশ কিছু নোবেল বিজয়ীরও বিচার হয়েছে বা হচ্ছে, যাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন অং সান সু চি, যাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত তদন্ত শুরু করেছেন। ফিলিপাইনের নোবেলজয়ী মারিয়া রেসার ছয় বছর কারাদণ্ড হয়েছিল, যদিও সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট পরে তাঁকে খালাস দিয়েছেন। বেলারুশের নোবেল বিজয়ী এলেস বিয়ালিয়াটস্কিকে সে দেশের আদালত ১০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন। এমনকি যে একাডেমি নোবেল পুরস্কার প্রদান করে থাকে, সেই একাডেমিরই এক সদস্য, জিন ক্লোড আরনন্ডকেও সুইডিশ আদালত দুই বছর জেল দিয়েছেন ধর্ষণের অভিযোগে।

 

হিলারি গং উল্লিখিত চিঠির মাধ্যমে আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূল্যবান তত্ত্বকেই ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের উচিত কালবিলম্ব না করে চিঠিটি তুলে নেওয়া। চাইলে তাঁরা বাংলাদেশে এসে ড. ইউনূসের আইনজীবীর ফাইলে রক্ষিত কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে পারেন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তি রয়েছে কি না। এগুলো গোপন দলিল নয় এবং তাঁদের বাংলাদেশে আসতেও কেউ বাধা দেবে না। তাঁদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উচিত আইনের শাসনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে না দিয়ে বরং তা বাঁচিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করা, আর সে জন্যই তাঁদের উচিত ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করা। মনে রাখতে হবে, আইনের শাসনের একটি বড় তত্ত্ব হচ্ছে এই যে আইনের চোখে সবাই সমান। অপরাধ করলে সবাইকেই বিচারের সম্মুখীন করা আইনের শাসনের একটি বড় মন্ত্র। সেখানে ছোট-বড় ভেদাভেদ করার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com