ছবি: সংগৃহীত
হাসান মাহাদি
কথায় আছে, ‘ভরা কলসি বাজে না।’ তাহলে কি দুঃখ ভরা হৃদয়ের আর্তনাদ ইহজাগতিক কোনো কান শুনতে পায় না?
আমি হাঁটছি অনবরত। পুরান ঢাকার কয়েকশ বছরের পুরোনো অলিগলি দিয়ে আমার দেহটাকে নিয়ে আমার পা দুটো চলছে। আমার মন আর আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। সে ছুটছে বাতাসের গতিতে। যেন জাগতিক চেতনার বাইরে গিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেছে মহাজাগতিক কোনো ভাবনায়। আমি শুধু সেই ভাবনাগুলো প্রলাপের মতো বকে যাচ্ছি। কোনো চর্মচক্ষু দেখামাত্রই আফসোস করবে, ‘আহা! এই অল্প বয়সেই মনে হয় মাথাটা গেছে।
আদতে শব্দের সাধনা করতে করতে হেঁটে চলেছেন এক সাধক পুরুষ। এই শব্দ বাংলা ব্যাকরণের রূপতত্ত্বের আলোচনা নয়। এ শব্দ তরল, কঠিন বা বায়বীয় মাধ্যম দিয়ে সঞ্চারিত যান্ত্রিক কোনো তরঙ্গ নয়। যা আমাদের শ্রবণের অনুভূতি দেয়। এ শব্দ মজলুমের, যা জালেমের কান কখনো শোনে না। এ শব্দ শীতের রাতে ফুটপাতে পরে থাকা হাড্ডিসার দেহটার, যা চলন্ত পথিকের বড়লোকি উষ্ণতায় পৌঁছায় না।
এ শব্দ জগন্নাথের সেই ছেলেটার, যার বন্ধুরা জানে না সে মেসে মিলের টাকা কমাতে দুটো শিঙাড়া খেয়েই দুপুরটা কাটিয়ে দিয়েছে। টিউশনির বেতনের টাকাটা বাঁচিয়ে টাকাটা বাড়িতে পাঠাতে হবে।
এ শব্দ সব হারানো সেই লোকটার, যে ঋণের বোঝা সমেত মাথাটা ট্রেনের নিচে দিয়েছিল। ট্রেনের ঝনঝন শব্দে তার মৃত্যুকালীন কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের আর্তনাদের শব্দটাও শোনা যায়নি।
এ শব্দ মধ্যবিত্তের, যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নিজের ব্যক্তিত্ব ও অস্তিত্ব টিকেয়ে রাখতে সংগ্রাম করে যায়।
এ শব্দ টাকায় গড়াগড়ি খাওয়া এই ধনী মানুষটার, যে টাকা দিয়েও সুখ কিনতে পারেনি।
এ শব্দ সেই তরুণটার, যে এলোমেলো চুলে নিজের স্বপ্ন নিয়ে হেঁটে যায়। হয়তো মাঝে মাঝে কোনো ব্যথিত মানুষের চিৎকার শোনা যায়। মানুষের কাছে হাত পাতা ভিক্ষুকটার সুর করে ভিক্ষা চাওয়াটা শোনা যায়।
‘আমাদের দাবি মানতে হবে’, ‘ধর্ষকের বিচার চাই’ স্লোগানগুলোই শোনা যায়। গুম হয়ে যাওয়া স্বজনের খোঁজে মানববন্ধন বা সংবাদ সম্মেলনে শুধু লিখিত বক্তব্যগুলো শোনা যায়।
বিনা দোষে কারাগারে থাকা সন্তানের জামিনের জন্য বাবা-মায়ের আকুতির ভাষাগুলো শোনা যায়। কমলাপুরে গুলি খেয়ে মরে যাওয়া মেয়েটার বাবা যখন বলে, ‘কার কাছে বিচার চাইব?’ শুধু এই বক্তব্যটাই পত্রিকায় ছাপা হয়।
এগুলো সবই আওয়াজ, স্রেফ আওয়াজ। কখনো কখনো শব্দদূষণ। জাগতিক চামড়া শুধু সেই আওয়াজগুলো শুনতে পায়। শব্দ শোনার সময় কারো নেই। সবাই ছোটে আপন গতিতে। স্বার্থের সীসায় গভীর শব্দযন্ত্র নষ্ট হয়ে গেছে। যতক্ষণ না নিজের সঙ্গে ঘটে যায়; ততক্ষণ পর্যন্ত শুধু আওয়াজ শোনা যায়।
আমি এতক্ষণ কল্পনায় হেঁটেছিলাম। আসলে আমি ক্লাসরুমে বসে আছি। প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কোর্সের লেকচার চলছে। মাইক্রোফোনে কেউ একজন কথা বলছেন শুধু এই আওয়াজটুকুই কানে আসছে। হঠাৎ ডাক আসে, ‘লাস্ট বেঞ্চ, স্ট্যান্ড আপ। হোয়াট ইজ সট অ্যানালাইসিস?’ আমার দিব্য ধ্যান ভঙ্গ হয়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। কারণ সট অ্যানালাইসিস টপিকের একটা শব্দও আমি শুনিনি।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। সূএ : জাগোনিউজ২৪.কম