এক রাতের ব্যবধানে অসহায় শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা

ছবি : সংগূূহীত

 

নঈম নিজাম :বিদেশের মাটিতে বিশ্বদরবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদ তাঁর মেয়েরাই প্রথম শুরু করেছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর সশস্র যুদ্ধ, ৩ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করা মিছিলের প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা। সেসব বিষয় নিয়ে আরেকটা অধ্যায় লিখব। খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণের দিন  মিছিল করা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা প্রতিবাদ শুরু করেন ইউরোপ ও ব্রিটেন থেকে। ভিতরের বুকভরা কষ্ট নিয়েই তাঁরা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে নামেন। দিল্লি থেকে লন্ডন গিয়ে খোকা চাচার বাসায় উঠলেন শেখ রেহানা। বড় বোনকে রেখে আসেন দিল্লি।

 

স্টকহোমে ইউরোপের বাকশাল আয়োজিত অনুষ্ঠানটি ছিল ১০ মে ১৯৭৯ সালে। ব্রিটেনসহ ইউরোপিয়ান দেশের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দেন। বিভিন্ন দেশের অনেক বিদেশি অংশ নেন। তারা শুনতে আসেন কী হয়েছিল বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করা হয়। তারা আমন্ত্রণপত্র পাঠান শেখ হাসিনার কাছে। টেলিফোনও করেন। তিনি তখনো আওয়ামী লীগের সভাপতি হননি। কঠিন সময় অতিবাহিত করছিলেন দিল্লিতে। আমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হলেন দুঃসহ জীবন অতিবাহিতকারী বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে। দিল্লি থেকে ইউরোপ যাওয়ার বিষয়টি অত সহজ ছিল না। আর্থিক সংকটের পাশাপাশি সন্তানদের রেখে যাওয়াসহ অনেক ঝামেলা ছিল। শেখ হাসিনা লন্ডনে ফোন করেন ছোট বোন শেখ রেহানাকে। বললেন এই সম্মেলনে যোগ দিতে। ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে। শেখ রেহানা যোগ দিলেন সেই অনুষ্ঠানে। শুরুতে শেখ হাসিনার লিখিত বাণী তিনি পড়ে শোনান। আবেগঘন সেই বাণীতে শেখ হাসিনা বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে। তুলে ধরেছিলেন নিষ্ঠুরতার চিত্র। এরপর পিনপতন নীরবতায় বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। দুই চোখে অশ্রুর বন্যা নিয়ে তিনি জানান, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। রেহাই দেয়নি নারী ও শিশুদের। শিশু রাসেলের কথা তুলে ধরার সময় অনেকে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ঘটনা শুনে হতবাক হন বিদেশিরাও। শেখ রেহানা জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ বিশ্ব বিবেককে অনুরোধ করেন ভয়াবহ এই হত্যার তদন্ত করতে। নারী ও শিশুদের হত্যার বিচারের দাবি তুলতে।

 

জাতির পিতাকে হত্যার পর ৩ নভেম্বর রাজধানী ঢাকাতে একটি মিছিল বের হয়েছিল। সেই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফ। মিছিলটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে খালেদ মোশাররফের সেদিন ক্ষমতা গ্রহণের কারণে। অনেকে বলছিলেন, এই মিছিল ১০ দিন আগে অথবা ১০ দিন পরে কেন হয়নি? জাসদ তখন এই মিছিল নিয়ে লিফলেট ছড়াল। তারা শুরু করল ভারতবিরোধী প্রচারণা। গর্তে লুকিয়ে থাকা ’৭১ সালের স্বাধীনতাবিরোধীরাও বেরিয়ে এসে নানামুখী প্রচারণা শুরু করল। সেনাবাহিনীর ভিতরে লিফলেট বিতরণ করল জাসদের গণবাহিনীর তাহের সমর্থক সিপাহিরা। তারা খালেদকে ভারতীয় চর হিসেবে আখ্যায়িত করে লিপ্ত হলো মিথ্যাচারে। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে মাঠে নামল কর্নেল তাহের ও জিয়া অনুসারী অফিসাররা। ক্যু করে সেনা প্রধানের দায়িত্ব নিলেও খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা কীভাবে পরিচালিত হবে তার গাইড লাইন তৈরি করতে পারলেন না। নানামুখী ষড়যন্ত্র ও নিজের দূরদর্শিতার অভাব আর সিদ্ধান্তহীনতায় তার সব কিছু বানচাল হলো। এর মধ্যে কারাগারে চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ড দেশবাসীকে হতভম্ব করল। বঙ্গবন্ধু হত্যার শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই কারা অন্তরালে নিষ্ঠুরভাবে চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান ও মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শেষ ভয়াবহতা ছিল কারা হত্যা। খন্দকার মোশতাকের নির্দেশেই কারাগারের ফটক খুলে দেওয়া হয়েছিল।

 

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে বাংলাদেশের সাহসী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নাসিম ওসমান, দীপঙ্কর তালুকদার, সুলতান মুহাম্মদ মনসুর আহমেদ, শেখ মারুফ, মানু মজুমদার, বিশ্বজিৎ নন্দীসহ অনেকে। সবচেয়ে বেশি ছিলেন ময়মনসিংহের গারো উপজাতির সদস্যরা। কাদেরিয়া বাহিনী সীমান্ত এলাকাগুলোতে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর টার্গেট ছিল ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকা প্রবেশ। সারা দেশে তাঁর অনুসারী তৈরি হয় প্রতিবাদ ও আর প্রতিরোধ যুদ্ধে। কাদের সিদ্দিকী যোগাযোগ রক্ষা করতেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে বোন বলে তিনি সম্বোধন করতেন।

এদিকে শেখ রেহানা লন্ডন যাওয়ার পর দুই বোনের মধ্যে ফোনে কথা হতো। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন পিতার হত্যার বিচার তাঁরা করবেন। তাঁরা ধীরে ধীরে মানসিকভাবে শক্তি অর্জন করতে থাকেন। যারাই যেখানে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। প্রতিবাদকারীদের চিঠি দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উৎসাহিত করতেন। শেখ রেহানা লন্ডনে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সুলতান শরিফ, সৈয়দ আশরাফসহ বিভিন্ন লেখক ও রাজনীতিবিদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতেন। ফোনে শেখ হাসিনা তাঁকে পরামর্শ দিতেন। লন্ডনে শেখ রেহানা সবার কাছে অনুরোধ করতেন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে করা মিথ্যাচারের জবাব দিতে, লিখতে ও বলতে। তখন দেশ-বিদেশে মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলা লোক ছিল সীমিত। তার মাঝে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি পত্রিকা মানুষের মাঝে সাড়া ফেলে। একটি সাপ্তাহিক খবর। আরেকটি মুক্তিবাণী। এই দুটি পত্রিকা আওয়ামী লীগের কর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় ছিল। খবর সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান অনেক সভা-সমাবেশেও যোগ দিতেন। তখনকার সব মিডিয়াতে চীনাপন্থি বাম সাংবাদিকদের দাপট ছিল। তারা মিথ্যাচার করত মুজিব পরিবারের বিরুদ্ধে। কাল্পনিক সব গল্প ছড়াত।

 

দিল্লিতে ছয় বছর ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমে ডিফেন্স কলোনিতে। তারপর পান্ডারা রোডের আরেকটি বাসায়। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা পার্ক ছিল। এই পার্কে মাঝে মাঝে তিনি হাঁটতে বের হতেন। কারও কাছে নিজেদের পরিচয় দিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণেই পরিচয় গোপন রাখা। শেখ হাসিনার নামের আগে যোগ হলো মিসেস তালুকদার। শেখ রেহানা মিস তালুকদার। আর ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াকে বলা হতো মিস্টার তালুকদার। এভাবে নাম বদলে শেখ রেহানা মন খারাপ করতেন। তারপরও সেই সময়ে তাঁদের কিছুই করার ছিল না। একটা দমবন্ধ পরিবেশ। বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা জীবনেও ভাবেননি তাদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। ১৫ আগস্টের এক দিন আগে তাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির মেয়ে। গর্ব ছিল তাঁদের পিতা একটি দেশের জাতির পিতা। মাত্র একটি রাতের ব্যবধানে সব কিছু বদলে যায়। সেই সময়ে তাঁদের জার্মানি যাওয়ার কথা ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে থাকতে। পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি জার্মানি গেলেন। পুত্র-কন্যার পাশাপাশি সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন রেহানাও। যাওয়ার সময় বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব মেয়েদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। এমনটা তিনি কখনো করেন না। তারপরও কেন সেই সময়ে কাঁদলেন সেই প্রশ্নের জবাব আজও দুই বোনের কাছে নেই। ১৩ আগস্ট ফোনে শেখ হাসিনা যখন কথা বলছিলেন, বেগম মুজিব আবারও কাঁদলেন। বললেন, তুই চলে আয়। তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। সেই কথা আর কোনো দিন বলা হলো না।

 

জার্মানি সফরই বাঁচিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে। প্রকৃতি বলে একটা কথা আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের বাঁচিয়ে রেখেছেন মানুষের কল্যাণেই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে এখন লড়ছেন তাঁর বাবার স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। গত ১৫ বছরে তিনি বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। তারপরও তিনি ভুলতে পারছেন না সেসব কঠিন দুঃসহ দিনগুলোর কথা? এখনো সেসব দিনের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা বেদনায় নীল হন। অশ্রু বিসর্জন দেন। জার্মানি তখন দুভাবে বিভক্ত ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম। ওয়াজেদ আলী মিয়াকে ঘিরেই বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের জার্মানি সফর।

 

৩০ জুলাই ১৯৭৫ সাল। পশ্চিম জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট বিমানবন্দরে পায়চারি করছেন ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া। তিনি অপেক্ষা করছেন ঢাকা থেকে আসবেন স্ত্রী শেখ হাসিনা, পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সঙ্গে আছেন বঙ্গবন্ধুর আরেক মেয়ে শেখ রেহানা। অনেকদিন সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই ওয়াজেদ মিয়ার। তিনি জার্মানিতে এসেছেন পড়তে। সেদিন বিমানবন্দরে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব আমজাদুল হক। আমজাদুল হক তাঁকে জানালেন ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ের ৪৫ মিনিট আগে এসে পৌঁছেছে। তাঁরা দ্রুত বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে যান। ততক্ষণে জার্মান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের রিসিভ করে নিয়ে এসেছেন ভিআইপি লাউঞ্জে। পিতাকে পেয়ে জয়-পুতুলের সময়টা ভালোই কাটছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের এই সদস্যদের তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান ৯ আগস্ট। খাবার টেবিলে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ছিলেন প্রাণবন্ত। তাঁরা পরামর্শ দিলেন বাচ্চাদের নিয়ে প্যারিস ও ব্র্রাসেলস ঘুরে আসতে। মিসেস চৌধুরী বললেন, ওখানে গেলে ভালো লাগবে।

 

হুমায়ূন রশীদ ফোন করলেন বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত সানাউল হককে। জানালেন, ১২ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা ব্রাসেলস যাবেন। ব্রাসেলস থেকে ১৩ আগস্ট তাঁরা ঘুরে আসেন আমস্টারডাম। ১৪ আগস্ট রাষ্ট্রদূত সানাউল হক রাতের ডিনারে ব্যাপক আয়োজন করেন। ডিনার শেষ করে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ আলী মিয়া, জয় ও পুতুলকে নিয়ে সবাই যান আরেকজন কূটনীতিক আনোয়ার শাহদাতের বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখেন আনোয়ার শাহদাতের স্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ছোটবেলার বান্ধবী। অনেকক্ষণ আড্ডা দেন তাঁরা। স্মৃতিচারণা করেন পুরনো দিনের। হইচই করেন। হাসাহাসি করেন। রাতে ফেরার পথে গাড়িতে ওঠার সময় ড. ওয়াজেদ আলীর হাতের আঙুল পিষ্ট হয় দরজা লাগানোর সময়। শেখ হাসিনা এ দুর্ঘটনায় মন খারাপ করলেন। তিনি বললেন, আজ অনেক হাসাহাসি করেছি। না জানি কপালে কী আছে। তিনি গাড়ির দরজায় হাত পিষ্ট হওয়াকে কুলক্ষণ হিসেবে দেখলেন। বললেন, বেশি হাসলে কাঁদতে হয়।

 

রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাড়িতে পৌঁছে একটু রাত করেই ঘুমালেন সবাই। সিদ্ধান্ত ছিল সকালে প্যারিস যাবেন। তারপর আবার জার্মানি। ভোর সাড়ে ৬টায় রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের ফোন বারবার বেজে ওঠে। ফোন করেছেন জার্মানি থেকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। তিনি জানান, বাংলাদেশে কিছু একটা ঘটেছে। প্যারিসে শেখ হাসিনা ও রেহানার যাওয়ার দরকার নেই। তাঁদের জার্মানি ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে তিনি অনুরোধ করেন। তিনি আরও জানান, বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই। বেগম মুজিব ও রাসেল ছাড়া সবাইকে মনে হয় হত্যা করা হয়েছে। তিনি ওয়াজেদ আলী মিয়াকে ডেকে দিতে অনুরোধ করেন। খবরটা বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের না দিতে অনুরোধ করেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। কারণ এত বড় শোকের ধাক্কা বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা সইতে পারবেন না। এদিকে মুহূর্তে বদলে গেলেন রাষ্ট্রদূত সানাউল হক। তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন বঙ্গবন্ধুর কী হয়েছে। যখন জানলেন বঙ্গবন্ধু নেই, তখন তিনি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে বললেন, আপনি আমাকে বিপদে ফেললেন কেন? এক দিন আগেও তিনি আনন্দিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের তার বাড়িতে পেয়ে। তার আচরণে বিস্মিত হন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন সানাউল হক। বঙ্গবন্ধুর আনুকূল্য না হলে তিনি রাষ্ট্রদূত হতে পারতেন না। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বুঝলেন, এক মুহূর্তও বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের সানাউল হকের বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। তিনি একটি গাড়ি চাইলেন বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের জন্য। গাড়ি দিতেও সম্মত হলেন না সানাউল হক। পরে অর্ধেক পথ হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী গাড়ি পাঠান। বাকি অর্ধেক পথ অন্য একটি সাধারণ গাড়িতে আসেন বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা, জামাতা ও নাতি-নাতনি।

 

শোকে মুহ্যমান বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা বুঝতে পারেন ঢাকায় কিছু একটা হয়েছে। ওয়াজেদ আলী মিয়া সব খুলে বলছেন না। বঙ্গবন্ধু জীবিত না মৃত তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না। একটা কিছু অনুমান করে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। কান্নাকে ধারণ করেই জয়, পুতুলকে সামাল দিচ্ছিলেন শেখ রেহানা। জার্মানি আসার আগে তাঁর প্রতি মায়ের নির্দেশ ছিল জয়, পুতুলের পাশাপাশি হাসিনাকেও দেখে রাখবি। সময় কাটছিল না। অদ্ভুত এক পরিবেশ। কোনো মতে জার্মানি পৌঁছে তাঁরা দেখলেন ড. কামাল হোসেনকে। তিনি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে জার্মানি পৌঁছেছেন। জার্মান মিডিয়া এসেছিল হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলেন না। ড. কামাল হোসেনও কিছু বললেন না।

 

এই কঠিনতম সময়ে যুগোসøাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের খবর নেন। হুমায়ূন রশীদকে তিনি জানান, বাংলাদেশের জাতির পিতার নিষ্ঠুর হত্যার কথা শুনে তিনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের খবর নেন। একটা অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি হন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। শেখ হাসিনার কাছে মাত্র ১৬ ডলার ছাড়া কোনো অর্থ নেই। জীবনের এই কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের পাশে দাঁড়ান হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। এ সময়ে চৌধুরী পরিবারের আরেক সন্তান কায়সার রশীদ চৌধুরী সতর্ক করেন ভাইকে। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ভাইয়ের কথায় পাত্তা দেননি। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের আগামী নিয়ে চিন্তিত। জার্মানিতে তখন ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ওয়াই কে পুরি। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী যোগাযোগ করেন তার সঙ্গে। আলাপ করেন ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে। পুরি পরামর্শ দেন ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতা ডি পি ধর এবং পি এন হাক্সের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তাদের ফোনে ধরতে পারলেন না চৌধুরী। তারা ছিলেন দেশের বাইরে। তিনি আবার যোগাযোগ করেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। এবার রাষ্ট্রদূত পরামর্শ দেন সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করতে।

 

একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে এভাবে ফোন করা ঠিক হবে কি না তা নিয়ে দ্বন্দ্বে ছিলেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। শেষ পর্যন্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফোন করেন মিসেস গান্ধীকে। তিনি ভেবেছিলেন ফোন ধরবেন অপারেটর। ভাগ্যক্রমে নিজেই ফোন ধরলেন ইন্দিরা গান্ধী। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা জার্মানিতে তাঁর বাসায় আছেন। মিসেস গান্ধী জানতে চান তাঁরা কেমন আছে? সব কিছু ঠিক আছে তো? জবাবে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বলেন, সব ঠিক আছে, তবে দুই বোন ভেঙে পড়েছেন। তারা ঠিকভাবে কথা বলতে পারছেন না। মিসেস গান্ধী তাদের দিল্লি পাঠানোর জন্য বললেন চৌধুরীকে।

 

১৯ আগস্ট দিল্লি থেকে নির্দেশ পান জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত। দ্রুত বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের দিল্লি পাঠানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ আসে তার কাছে। বিষয়টি সর্বোচ্চ গোপনীয়তার ভিতরে করার জন্য বলা হয়। আয়োজন চলতে থাকে। ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াকে সব কিছু জানান হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। একজন ভারতীয় কূটনীতিক আলাদা কথা বলেন ওয়াজেদ আলী মিয়ার সঙ্গে। হুমায়ূন রশীদ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন তাদের কাছে কোনো অর্থ নেই। তিনি ১ হাজার ফ্রাঙ্ক দেন ওয়াজেদ মিয়ার হাতে। তারপর বলেন, যখন যা লাগবে বলবেন। অত্যন্ত গোপনীয়তায় ২৪ আগস্ট এয়ার ইন্ডিয়াতে চড়ে দিল্লি পৌঁছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা।

 

ভারত সরকারের একজন যুগ্ম সচিব তাঁদের বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। অবশ্য বিমানবন্দরে নিয়মকানুন শেষ করতে একটু সময় বেশি লেগেছিল। টানা ভ্রমণ, বিমানবন্দরে অধিক সময় লাগাতে সবাই ভীষণ ক্লান্ত ছিলেন। এমনিতে গত ৯টা দিন তারা কীভাবে কাটিয়েছেন নিজেরাও জানেন না। গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাওয়া হয় ৫৬ রিং রোডের সেফ হাউসে। এরপর ডিফেন্স কলোনির একটি ছোট্ট বাসায়। তাঁদের বলা হয় ঘর থেকে বের না হতে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করতে। নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা থাকার কারণেই সতর্ক ছিল ভারতীয় প্রশাসন। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সাল। ভারতে অবস্থানের ১০ দিন পর সফদরজং রোডে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৫ আগস্ট কী হয়েছিল জানতে চান ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ইন্দিরা গান্ধী কিছু বলার আগেই একজন কর্মকর্তা ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের জাতির পিতাসহ তাঁর পরিবারের কেউ জীবিত নেই। সব শুনে শেখ হাসিনা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠতেই ইন্দিরা গান্ধী আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর বলেন, তোমার যা ক্ষতি হয়েছে তা কোনো দিন পূরণ হবে না। তারপরও তোমাকে ধৈর্য ধরে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তোমার ছেলেমেয়ে আছে। তারাই তোমার বাবা-মা। এই সাক্ষাতের পর ইন্ডিয়া গেটের কাছে দিল্লির পান্ডারা পার্কের সি ব্লকে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়। এ ফ্ল্যাটটি ছিল তিন বেডরুমের। খবর শোনার জন্য দেওয়া হয় একটি সাদা-কালো টেলিভিশনও। ভারতে বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা শরণার্থী হিসেবেই আশ্রয় পেয়েছিলেন। এক কঠিন দুঃসহ জীবন অতিবাহিত করছিলেন তাঁরা। ভারত সরকার ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াকে পরমাণু শক্তি বিভাগে ফেলোশিপ প্রদান করে। ইন্দিরা গান্ধী ছাড়া এ সময়ে পরিবারটির পাশে দাঁড়ান প্রণব মুখার্জি। তিনি অভিভাবকের মতোই ভূমিকা পালন করেন। দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে সাক্ষাতের এক দিনের স্মৃতিচারণা করেছেন শেখ হাসিনা আ ডটারস টেল তথ্যচিত্রে। তিনি বলেছেন, ‘সেই দিন উনি আমার মুখটা দেখে বললেন, তুমি…তুমি কিছু খেয়েছো? তুমি অমলেট খাবে? টোস্ট খাবে? চা খাবে? উনি উঠে গিয়ে অমলেট, টোস্ট আর চা নিয়ে এলেন। নিজে কাপে চা ঢেলে দিলেন। আমাকে বললেন, তুমি খাও। তোমার মুখটা একদম শুকনো। তুমি কিছু খাওনি। আসলে এই যে স্নেহটা, ভালোবাসাটা, ঘরোয়াভাবের যে ব্যবহারটা সত্যি কথা বলতে কী ওই সময়ে ওনার সামনে গিয়ে এটুকুই অনুভূতি হচ্ছিল- না, আমাদের জন্য কেউ আছে।’  জীবনের কোনো কোনো সময়ে কিছু মানুষের ছায়া, স্নেহ কখনো ভুলে থাকার নয়। শেখ রেহানা নিজেও একবার বলেছেন, ইন্দিরা গান্ধী, প্রণব মুখার্জি আর খোকা চাচা (বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই) সেই সময়ে আমাদের আগলে রেখেছেন।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন  । সূএ :বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুই-এক বছর দেখতে চাই : নুর

» চোখের সেবা সম্প্রসারণে অরবিসের সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ আগ্রহী : ইউনূস

» ভারতে বসে হাসিনা ষড়যন্ত্র করছেন : এ্যানি

» স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ২০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দে ইইউর সমর্থন চাইল বাংলাদেশ

» ধাপে ধাপে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে সরকার : হাসান আরিফ

» বিমান বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা

» অনলাইনে আয়কর পরিশোধ সহজ করতে এনবিআর-এর সাথে পার্টনারশিপ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

» বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষায় অশনি সংকেত অটোমেশন; ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা

» ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি খালেদা জিয়াকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি আলালের

» থানায় এসে কেউ যেন সেবা বঞ্চিত না হয়: ডিএমপি কমিশনার

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

এক রাতের ব্যবধানে অসহায় শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা

ছবি : সংগূূহীত

 

নঈম নিজাম :বিদেশের মাটিতে বিশ্বদরবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদ তাঁর মেয়েরাই প্রথম শুরু করেছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর সশস্র যুদ্ধ, ৩ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করা মিছিলের প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা। সেসব বিষয় নিয়ে আরেকটা অধ্যায় লিখব। খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণের দিন  মিছিল করা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা প্রতিবাদ শুরু করেন ইউরোপ ও ব্রিটেন থেকে। ভিতরের বুকভরা কষ্ট নিয়েই তাঁরা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে নামেন। দিল্লি থেকে লন্ডন গিয়ে খোকা চাচার বাসায় উঠলেন শেখ রেহানা। বড় বোনকে রেখে আসেন দিল্লি।

 

স্টকহোমে ইউরোপের বাকশাল আয়োজিত অনুষ্ঠানটি ছিল ১০ মে ১৯৭৯ সালে। ব্রিটেনসহ ইউরোপিয়ান দেশের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দেন। বিভিন্ন দেশের অনেক বিদেশি অংশ নেন। তারা শুনতে আসেন কী হয়েছিল বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করা হয়। তারা আমন্ত্রণপত্র পাঠান শেখ হাসিনার কাছে। টেলিফোনও করেন। তিনি তখনো আওয়ামী লীগের সভাপতি হননি। কঠিন সময় অতিবাহিত করছিলেন দিল্লিতে। আমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হলেন দুঃসহ জীবন অতিবাহিতকারী বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে। দিল্লি থেকে ইউরোপ যাওয়ার বিষয়টি অত সহজ ছিল না। আর্থিক সংকটের পাশাপাশি সন্তানদের রেখে যাওয়াসহ অনেক ঝামেলা ছিল। শেখ হাসিনা লন্ডনে ফোন করেন ছোট বোন শেখ রেহানাকে। বললেন এই সম্মেলনে যোগ দিতে। ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে। শেখ রেহানা যোগ দিলেন সেই অনুষ্ঠানে। শুরুতে শেখ হাসিনার লিখিত বাণী তিনি পড়ে শোনান। আবেগঘন সেই বাণীতে শেখ হাসিনা বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে। তুলে ধরেছিলেন নিষ্ঠুরতার চিত্র। এরপর পিনপতন নীরবতায় বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। দুই চোখে অশ্রুর বন্যা নিয়ে তিনি জানান, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। রেহাই দেয়নি নারী ও শিশুদের। শিশু রাসেলের কথা তুলে ধরার সময় অনেকে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ঘটনা শুনে হতবাক হন বিদেশিরাও। শেখ রেহানা জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ বিশ্ব বিবেককে অনুরোধ করেন ভয়াবহ এই হত্যার তদন্ত করতে। নারী ও শিশুদের হত্যার বিচারের দাবি তুলতে।

 

জাতির পিতাকে হত্যার পর ৩ নভেম্বর রাজধানী ঢাকাতে একটি মিছিল বের হয়েছিল। সেই মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফ। মিছিলটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে খালেদ মোশাররফের সেদিন ক্ষমতা গ্রহণের কারণে। অনেকে বলছিলেন, এই মিছিল ১০ দিন আগে অথবা ১০ দিন পরে কেন হয়নি? জাসদ তখন এই মিছিল নিয়ে লিফলেট ছড়াল। তারা শুরু করল ভারতবিরোধী প্রচারণা। গর্তে লুকিয়ে থাকা ’৭১ সালের স্বাধীনতাবিরোধীরাও বেরিয়ে এসে নানামুখী প্রচারণা শুরু করল। সেনাবাহিনীর ভিতরে লিফলেট বিতরণ করল জাসদের গণবাহিনীর তাহের সমর্থক সিপাহিরা। তারা খালেদকে ভারতীয় চর হিসেবে আখ্যায়িত করে লিপ্ত হলো মিথ্যাচারে। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে মাঠে নামল কর্নেল তাহের ও জিয়া অনুসারী অফিসাররা। ক্যু করে সেনা প্রধানের দায়িত্ব নিলেও খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা কীভাবে পরিচালিত হবে তার গাইড লাইন তৈরি করতে পারলেন না। নানামুখী ষড়যন্ত্র ও নিজের দূরদর্শিতার অভাব আর সিদ্ধান্তহীনতায় তার সব কিছু বানচাল হলো। এর মধ্যে কারাগারে চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ড দেশবাসীকে হতভম্ব করল। বঙ্গবন্ধু হত্যার শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই কারা অন্তরালে নিষ্ঠুরভাবে চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান ও মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শেষ ভয়াবহতা ছিল কারা হত্যা। খন্দকার মোশতাকের নির্দেশেই কারাগারের ফটক খুলে দেওয়া হয়েছিল।

 

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে বাংলাদেশের সাহসী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নাসিম ওসমান, দীপঙ্কর তালুকদার, সুলতান মুহাম্মদ মনসুর আহমেদ, শেখ মারুফ, মানু মজুমদার, বিশ্বজিৎ নন্দীসহ অনেকে। সবচেয়ে বেশি ছিলেন ময়মনসিংহের গারো উপজাতির সদস্যরা। কাদেরিয়া বাহিনী সীমান্ত এলাকাগুলোতে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর টার্গেট ছিল ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকা প্রবেশ। সারা দেশে তাঁর অনুসারী তৈরি হয় প্রতিবাদ ও আর প্রতিরোধ যুদ্ধে। কাদের সিদ্দিকী যোগাযোগ রক্ষা করতেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে বোন বলে তিনি সম্বোধন করতেন।

এদিকে শেখ রেহানা লন্ডন যাওয়ার পর দুই বোনের মধ্যে ফোনে কথা হতো। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন পিতার হত্যার বিচার তাঁরা করবেন। তাঁরা ধীরে ধীরে মানসিকভাবে শক্তি অর্জন করতে থাকেন। যারাই যেখানে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। প্রতিবাদকারীদের চিঠি দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উৎসাহিত করতেন। শেখ রেহানা লন্ডনে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সুলতান শরিফ, সৈয়দ আশরাফসহ বিভিন্ন লেখক ও রাজনীতিবিদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতেন। ফোনে শেখ হাসিনা তাঁকে পরামর্শ দিতেন। লন্ডনে শেখ রেহানা সবার কাছে অনুরোধ করতেন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে করা মিথ্যাচারের জবাব দিতে, লিখতে ও বলতে। তখন দেশ-বিদেশে মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলা লোক ছিল সীমিত। তার মাঝে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি পত্রিকা মানুষের মাঝে সাড়া ফেলে। একটি সাপ্তাহিক খবর। আরেকটি মুক্তিবাণী। এই দুটি পত্রিকা আওয়ামী লীগের কর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় ছিল। খবর সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান অনেক সভা-সমাবেশেও যোগ দিতেন। তখনকার সব মিডিয়াতে চীনাপন্থি বাম সাংবাদিকদের দাপট ছিল। তারা মিথ্যাচার করত মুজিব পরিবারের বিরুদ্ধে। কাল্পনিক সব গল্প ছড়াত।

 

দিল্লিতে ছয় বছর ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমে ডিফেন্স কলোনিতে। তারপর পান্ডারা রোডের আরেকটি বাসায়। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা পার্ক ছিল। এই পার্কে মাঝে মাঝে তিনি হাঁটতে বের হতেন। কারও কাছে নিজেদের পরিচয় দিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণেই পরিচয় গোপন রাখা। শেখ হাসিনার নামের আগে যোগ হলো মিসেস তালুকদার। শেখ রেহানা মিস তালুকদার। আর ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াকে বলা হতো মিস্টার তালুকদার। এভাবে নাম বদলে শেখ রেহানা মন খারাপ করতেন। তারপরও সেই সময়ে তাঁদের কিছুই করার ছিল না। একটা দমবন্ধ পরিবেশ। বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা জীবনেও ভাবেননি তাদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। ১৫ আগস্টের এক দিন আগে তাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির মেয়ে। গর্ব ছিল তাঁদের পিতা একটি দেশের জাতির পিতা। মাত্র একটি রাতের ব্যবধানে সব কিছু বদলে যায়। সেই সময়ে তাঁদের জার্মানি যাওয়ার কথা ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে থাকতে। পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি জার্মানি গেলেন। পুত্র-কন্যার পাশাপাশি সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন রেহানাও। যাওয়ার সময় বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব মেয়েদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। এমনটা তিনি কখনো করেন না। তারপরও কেন সেই সময়ে কাঁদলেন সেই প্রশ্নের জবাব আজও দুই বোনের কাছে নেই। ১৩ আগস্ট ফোনে শেখ হাসিনা যখন কথা বলছিলেন, বেগম মুজিব আবারও কাঁদলেন। বললেন, তুই চলে আয়। তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। সেই কথা আর কোনো দিন বলা হলো না।

 

জার্মানি সফরই বাঁচিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে। প্রকৃতি বলে একটা কথা আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের বাঁচিয়ে রেখেছেন মানুষের কল্যাণেই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে এখন লড়ছেন তাঁর বাবার স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। গত ১৫ বছরে তিনি বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। তারপরও তিনি ভুলতে পারছেন না সেসব কঠিন দুঃসহ দিনগুলোর কথা? এখনো সেসব দিনের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা বেদনায় নীল হন। অশ্রু বিসর্জন দেন। জার্মানি তখন দুভাবে বিভক্ত ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম। ওয়াজেদ আলী মিয়াকে ঘিরেই বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের জার্মানি সফর।

 

৩০ জুলাই ১৯৭৫ সাল। পশ্চিম জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট বিমানবন্দরে পায়চারি করছেন ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া। তিনি অপেক্ষা করছেন ঢাকা থেকে আসবেন স্ত্রী শেখ হাসিনা, পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সঙ্গে আছেন বঙ্গবন্ধুর আরেক মেয়ে শেখ রেহানা। অনেকদিন সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই ওয়াজেদ মিয়ার। তিনি জার্মানিতে এসেছেন পড়তে। সেদিন বিমানবন্দরে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন বাংলাদেশ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব আমজাদুল হক। আমজাদুল হক তাঁকে জানালেন ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ের ৪৫ মিনিট আগে এসে পৌঁছেছে। তাঁরা দ্রুত বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে যান। ততক্ষণে জার্মান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের রিসিভ করে নিয়ে এসেছেন ভিআইপি লাউঞ্জে। পিতাকে পেয়ে জয়-পুতুলের সময়টা ভালোই কাটছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের এই সদস্যদের তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান ৯ আগস্ট। খাবার টেবিলে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ছিলেন প্রাণবন্ত। তাঁরা পরামর্শ দিলেন বাচ্চাদের নিয়ে প্যারিস ও ব্র্রাসেলস ঘুরে আসতে। মিসেস চৌধুরী বললেন, ওখানে গেলে ভালো লাগবে।

 

হুমায়ূন রশীদ ফোন করলেন বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত সানাউল হককে। জানালেন, ১২ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা ব্রাসেলস যাবেন। ব্রাসেলস থেকে ১৩ আগস্ট তাঁরা ঘুরে আসেন আমস্টারডাম। ১৪ আগস্ট রাষ্ট্রদূত সানাউল হক রাতের ডিনারে ব্যাপক আয়োজন করেন। ডিনার শেষ করে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ আলী মিয়া, জয় ও পুতুলকে নিয়ে সবাই যান আরেকজন কূটনীতিক আনোয়ার শাহদাতের বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখেন আনোয়ার শাহদাতের স্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ছোটবেলার বান্ধবী। অনেকক্ষণ আড্ডা দেন তাঁরা। স্মৃতিচারণা করেন পুরনো দিনের। হইচই করেন। হাসাহাসি করেন। রাতে ফেরার পথে গাড়িতে ওঠার সময় ড. ওয়াজেদ আলীর হাতের আঙুল পিষ্ট হয় দরজা লাগানোর সময়। শেখ হাসিনা এ দুর্ঘটনায় মন খারাপ করলেন। তিনি বললেন, আজ অনেক হাসাহাসি করেছি। না জানি কপালে কী আছে। তিনি গাড়ির দরজায় হাত পিষ্ট হওয়াকে কুলক্ষণ হিসেবে দেখলেন। বললেন, বেশি হাসলে কাঁদতে হয়।

 

রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাড়িতে পৌঁছে একটু রাত করেই ঘুমালেন সবাই। সিদ্ধান্ত ছিল সকালে প্যারিস যাবেন। তারপর আবার জার্মানি। ভোর সাড়ে ৬টায় রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের ফোন বারবার বেজে ওঠে। ফোন করেছেন জার্মানি থেকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। তিনি জানান, বাংলাদেশে কিছু একটা ঘটেছে। প্যারিসে শেখ হাসিনা ও রেহানার যাওয়ার দরকার নেই। তাঁদের জার্মানি ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে তিনি অনুরোধ করেন। তিনি আরও জানান, বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই। বেগম মুজিব ও রাসেল ছাড়া সবাইকে মনে হয় হত্যা করা হয়েছে। তিনি ওয়াজেদ আলী মিয়াকে ডেকে দিতে অনুরোধ করেন। খবরটা বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের না দিতে অনুরোধ করেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। কারণ এত বড় শোকের ধাক্কা বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা সইতে পারবেন না। এদিকে মুহূর্তে বদলে গেলেন রাষ্ট্রদূত সানাউল হক। তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন বঙ্গবন্ধুর কী হয়েছে। যখন জানলেন বঙ্গবন্ধু নেই, তখন তিনি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে বললেন, আপনি আমাকে বিপদে ফেললেন কেন? এক দিন আগেও তিনি আনন্দিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের তার বাড়িতে পেয়ে। তার আচরণে বিস্মিত হন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন সানাউল হক। বঙ্গবন্ধুর আনুকূল্য না হলে তিনি রাষ্ট্রদূত হতে পারতেন না। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বুঝলেন, এক মুহূর্তও বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের সানাউল হকের বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। তিনি একটি গাড়ি চাইলেন বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের জন্য। গাড়ি দিতেও সম্মত হলেন না সানাউল হক। পরে অর্ধেক পথ হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী গাড়ি পাঠান। বাকি অর্ধেক পথ অন্য একটি সাধারণ গাড়িতে আসেন বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা, জামাতা ও নাতি-নাতনি।

 

শোকে মুহ্যমান বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা বুঝতে পারেন ঢাকায় কিছু একটা হয়েছে। ওয়াজেদ আলী মিয়া সব খুলে বলছেন না। বঙ্গবন্ধু জীবিত না মৃত তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না। একটা কিছু অনুমান করে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। কান্নাকে ধারণ করেই জয়, পুতুলকে সামাল দিচ্ছিলেন শেখ রেহানা। জার্মানি আসার আগে তাঁর প্রতি মায়ের নির্দেশ ছিল জয়, পুতুলের পাশাপাশি হাসিনাকেও দেখে রাখবি। সময় কাটছিল না। অদ্ভুত এক পরিবেশ। কোনো মতে জার্মানি পৌঁছে তাঁরা দেখলেন ড. কামাল হোসেনকে। তিনি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে জার্মানি পৌঁছেছেন। জার্মান মিডিয়া এসেছিল হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলেন না। ড. কামাল হোসেনও কিছু বললেন না।

 

এই কঠিনতম সময়ে যুগোসøাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের খবর নেন। হুমায়ূন রশীদকে তিনি জানান, বাংলাদেশের জাতির পিতার নিষ্ঠুর হত্যার কথা শুনে তিনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের খবর নেন। একটা অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি হন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। শেখ হাসিনার কাছে মাত্র ১৬ ডলার ছাড়া কোনো অর্থ নেই। জীবনের এই কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের পাশে দাঁড়ান হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। এ সময়ে চৌধুরী পরিবারের আরেক সন্তান কায়সার রশীদ চৌধুরী সতর্ক করেন ভাইকে। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ভাইয়ের কথায় পাত্তা দেননি। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের আগামী নিয়ে চিন্তিত। জার্মানিতে তখন ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ওয়াই কে পুরি। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী যোগাযোগ করেন তার সঙ্গে। আলাপ করেন ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে। পুরি পরামর্শ দেন ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতা ডি পি ধর এবং পি এন হাক্সের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তাদের ফোনে ধরতে পারলেন না চৌধুরী। তারা ছিলেন দেশের বাইরে। তিনি আবার যোগাযোগ করেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। এবার রাষ্ট্রদূত পরামর্শ দেন সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করতে।

 

একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে এভাবে ফোন করা ঠিক হবে কি না তা নিয়ে দ্বন্দ্বে ছিলেন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। শেষ পর্যন্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফোন করেন মিসেস গান্ধীকে। তিনি ভেবেছিলেন ফোন ধরবেন অপারেটর। ভাগ্যক্রমে নিজেই ফোন ধরলেন ইন্দিরা গান্ধী। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা জার্মানিতে তাঁর বাসায় আছেন। মিসেস গান্ধী জানতে চান তাঁরা কেমন আছে? সব কিছু ঠিক আছে তো? জবাবে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বলেন, সব ঠিক আছে, তবে দুই বোন ভেঙে পড়েছেন। তারা ঠিকভাবে কথা বলতে পারছেন না। মিসেস গান্ধী তাদের দিল্লি পাঠানোর জন্য বললেন চৌধুরীকে।

 

১৯ আগস্ট দিল্লি থেকে নির্দেশ পান জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত। দ্রুত বঙ্গবন্ধুর মেয়েদের দিল্লি পাঠানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশ আসে তার কাছে। বিষয়টি সর্বোচ্চ গোপনীয়তার ভিতরে করার জন্য বলা হয়। আয়োজন চলতে থাকে। ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াকে সব কিছু জানান হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। একজন ভারতীয় কূটনীতিক আলাদা কথা বলেন ওয়াজেদ আলী মিয়ার সঙ্গে। হুমায়ূন রশীদ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন তাদের কাছে কোনো অর্থ নেই। তিনি ১ হাজার ফ্রাঙ্ক দেন ওয়াজেদ মিয়ার হাতে। তারপর বলেন, যখন যা লাগবে বলবেন। অত্যন্ত গোপনীয়তায় ২৪ আগস্ট এয়ার ইন্ডিয়াতে চড়ে দিল্লি পৌঁছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা।

 

ভারত সরকারের একজন যুগ্ম সচিব তাঁদের বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। অবশ্য বিমানবন্দরে নিয়মকানুন শেষ করতে একটু সময় বেশি লেগেছিল। টানা ভ্রমণ, বিমানবন্দরে অধিক সময় লাগাতে সবাই ভীষণ ক্লান্ত ছিলেন। এমনিতে গত ৯টা দিন তারা কীভাবে কাটিয়েছেন নিজেরাও জানেন না। গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাওয়া হয় ৫৬ রিং রোডের সেফ হাউসে। এরপর ডিফেন্স কলোনির একটি ছোট্ট বাসায়। তাঁদের বলা হয় ঘর থেকে বের না হতে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করতে। নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা থাকার কারণেই সতর্ক ছিল ভারতীয় প্রশাসন। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সাল। ভারতে অবস্থানের ১০ দিন পর সফদরজং রোডে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৫ আগস্ট কী হয়েছিল জানতে চান ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ইন্দিরা গান্ধী কিছু বলার আগেই একজন কর্মকর্তা ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের জাতির পিতাসহ তাঁর পরিবারের কেউ জীবিত নেই। সব শুনে শেখ হাসিনা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠতেই ইন্দিরা গান্ধী আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর বলেন, তোমার যা ক্ষতি হয়েছে তা কোনো দিন পূরণ হবে না। তারপরও তোমাকে ধৈর্য ধরে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তোমার ছেলেমেয়ে আছে। তারাই তোমার বাবা-মা। এই সাক্ষাতের পর ইন্ডিয়া গেটের কাছে দিল্লির পান্ডারা পার্কের সি ব্লকে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়। এ ফ্ল্যাটটি ছিল তিন বেডরুমের। খবর শোনার জন্য দেওয়া হয় একটি সাদা-কালো টেলিভিশনও। ভারতে বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা শরণার্থী হিসেবেই আশ্রয় পেয়েছিলেন। এক কঠিন দুঃসহ জীবন অতিবাহিত করছিলেন তাঁরা। ভারত সরকার ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াকে পরমাণু শক্তি বিভাগে ফেলোশিপ প্রদান করে। ইন্দিরা গান্ধী ছাড়া এ সময়ে পরিবারটির পাশে দাঁড়ান প্রণব মুখার্জি। তিনি অভিভাবকের মতোই ভূমিকা পালন করেন। দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে সাক্ষাতের এক দিনের স্মৃতিচারণা করেছেন শেখ হাসিনা আ ডটারস টেল তথ্যচিত্রে। তিনি বলেছেন, ‘সেই দিন উনি আমার মুখটা দেখে বললেন, তুমি…তুমি কিছু খেয়েছো? তুমি অমলেট খাবে? টোস্ট খাবে? চা খাবে? উনি উঠে গিয়ে অমলেট, টোস্ট আর চা নিয়ে এলেন। নিজে কাপে চা ঢেলে দিলেন। আমাকে বললেন, তুমি খাও। তোমার মুখটা একদম শুকনো। তুমি কিছু খাওনি। আসলে এই যে স্নেহটা, ভালোবাসাটা, ঘরোয়াভাবের যে ব্যবহারটা সত্যি কথা বলতে কী ওই সময়ে ওনার সামনে গিয়ে এটুকুই অনুভূতি হচ্ছিল- না, আমাদের জন্য কেউ আছে।’  জীবনের কোনো কোনো সময়ে কিছু মানুষের ছায়া, স্নেহ কখনো ভুলে থাকার নয়। শেখ রেহানা নিজেও একবার বলেছেন, ইন্দিরা গান্ধী, প্রণব মুখার্জি আর খোকা চাচা (বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই) সেই সময়ে আমাদের আগলে রেখেছেন।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন  । সূএ :বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com