নিভে যাওয়া সন্ধ্যাপ্রদীপ ও টি এন সেশানের ভোট

নঈম নিজাম: বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে প্রথম দেখা ইতালি বিমানবন্দরে। কলকাতার তপন রায় পরিচয় করে দেন। সময়টা ২০০১ সাল। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা ইতালি, জার্মানি, লন্ডনে তিনটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান তিনটি আয়োজন করা হয় এটিএনের ইউরোপ যাত্রা উপলক্ষে। বাপ্পি লাহিড়ী এ অনুষ্ঠানগুলোয় যোগ দেন গান করতে। প্রথম পরিচয়ে কুমিল্লার লোক জেনে বললেন, ‘আমিও কুমিল্লার মানুষ। আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি কুমিল্লায়। এ কারণে কুমিল্লার লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আপন মনে হয়।’ বললাম শচীন দেববর্মণও কুমিল্লার। শচীনকর্তার পড়াশোনা ও সংগীতের যাত্রা কুমিল্লা থেকে। কবি নজরুল আর শচীন দেব একসঙ্গে কুমিল্লায় সুরের ঝঙ্কার তুলতেন। তিনি বললেন, ‘জানি আমি। এ কারণে কুমিল্লা নিয়ে গর্ব করি।’ পুরো সফরকালে বাপ্পি লাহিড়ী আমাদের মাতিয়ে রাখেন। ভীষণ আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। এরপর ঢাকা ও কলকাতায় অনেকবার দেখা হয়েছে। তিনি প্রাণখোলা মানুষ ছিলেন। গান করতেন দরাজ গলায়। কলকাতায় যাত্রা হলেও তিনি মুম্বাই জয় করেন। তিনি গেয়েছেন- দিনক্ষণ দেখে প্রেম হয় না, ভালোবাসা হঠাৎ হয়…/চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারই… শেষ ট্রামে দুইজনাতে…। তিনি যেমন গেয়েছিলেন বাংলা গান, তেমনি গেয়েছেন আই অ্যাম এ ডিসকো ড্যান্সার…। বাপ্পি লাহিড়ী চলে গেলেন। আর ফিরে আসবেন না।

 

শুধু বাপ্পি নন, স্বল্প সময়ে আমরা তিনজন সংগীত ব্যক্তিত্বকে হারালাম। এ উপমহাদেশের কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর প্রয়াণের রেশ না কাটতেই বাংলা গানের সম্রাজ্ঞী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বিদায় নিলেন। লতা হিন্দি সংগীতে তুলনাহীন। তিনি গেয়েছেন- আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও…/আকাশ প্রদীপ জ্বলে…/আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন…। লতা আর কিশোর কুমারের কিছু অসাধারণ গান রয়েছে একসঙ্গে। বাংলা গানে আমার চোখে সন্ধ্যার অবস্থান অনেক উচ্চতায়। সলিল চৌধুরী ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা গানগুলো গেয়ে তিনি একটা সময়কে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। সলিল ও গৌরীর কিছু গান সন্ধ্যার কণ্ঠে এখনো অম্লান। সে যুগে সেই সময়ে চলচ্চিত্রে সুচিত্রার বেশির ভাগ জনপ্রিয় ছবির গানের প্লেব্যাক করেছেন সন্ধ্যা। এখনো সন্ধ্যার গানগুলো আমাদের আপ্লুত করে। নিজের অজান্তে আমরা গুনগুন করি- মধু মালতি ডাকে আয়, ফুল ফাগুনের এ খেলায়…,/চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে জীবনে তোমায় যদি পেলাম না/কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে, আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে…/হয়তো কিছুই নাহি পাব তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাব…যদি ওগো কাঁদে মোর ভীরু ভালোবাসা, জানি তুমি বুঝিবে না…/ এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার। আঃ কী সুরেলা কণ্ঠ। এমন কণ্ঠ আমরা কি আর কোনো দিন শুনব? আর কোনো দিন পাব সন্ধ্যা মুখার্জিকে?

মৃত্যু মানে একজন মানুষের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া। না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া। আর কোনো দিন প্রিয়জনদের  কাছে ফিরে না আসা। জীবিত মানুষটি বুঝতে পারেন না আগামীকাল কী হবে। সন্ধ্যা মুখার্জি আর কোনো দিন   ফিরবেন না। সন্ধ্যা গান দিয়ে অমরত্ব নিয়েছেন। লতা ও বাপ্পি লাহিড়ীর বিষয়েও একই কথা বলব। বাংলা সংগীতের নতুন মাত্রার যাত্রা পঞ্চাশের দশকে। সেই রাজত্ব টানা অব্যাহত ছিল ষাট, সত্তর ও আশির দশকে। তারপর অনেক কিছু আমাদের হারিয়ে গেছে। সংগীতও এর বাইরে নয়। এ কথা সত্যি, সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। কিন্তু বাংলা সংগীতের জনপ্রিয় গানগুলো কখনো হারাবে না। কিংবদন্তি লতা, গীতশ্রী সন্ধ্যা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

 

 

মানুষের জীবন এক বহতা নদী। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে ধারণ করেই আমাদের চলতে হয়। চলতে হবে। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের নির্বাচনী সার্চ কমিটির বৈঠকে। বের হওয়ার পর সাংবাদিক সহকর্মীরা জানতে চান কী কথা বলেছি কমিটির সামনে। স্পষ্টবাদী মানুষ। কথা বলায় কৌশলী নই। যা মনে আসে বলে ফেলি। যা অনেক সময় নেতিবাচক হয়ে আসে। এ যুগে হিপোক্রেসি না করলে চলে না। হিপোক্রেট আর চাটুকারদের একটা যুগ চলছে। বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা একটা কঠিন সময় পার করছে। হুদা কমিশনের অপরিসীম ব্যর্থতা আজকের অবস্থা তৈরি করেছে। হুদা কমিশন ভোটকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করেনি সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। এখন কাউকে সবকিছু স্বাভাবিক করতেও একটা সময় লাগবে। যে কোনো কমিশন চাইলেও সব স্বাভাবিক করতে পারবে না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে দক্ষ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তার প্রয়োজন। যিনি সাহসী হবেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করে ন্যায়নিষ্ঠার পথে হাঁটবেন। যার বলিষ্ঠতা থাকবে ভারতের নির্বাচনব্যবস্থার আধুনিক সংস্কারক টি এন সেশানের মতো। আমরা কি কখনো একজন টি এন সেশান পাব ভোটের মাঠে?

 

টি এন সেশান ছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য থাকাকালে একদিন তাঁর দিল্লির প্যান্ডেরা রোডের বাড়িতে আসেন চন্দ্র শেখর সরকারের একজন মন্ত্রী। সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর। চন্দ্র শেখর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ভোট নিয়ে একদিন তিনি কথা বলছিলেন তাঁর মন্ত্রী সুব্রামনিয়াম স্বামীর সঙ্গে। নতুন সিইসি কাকে করবেন আলোচনা করতেই স্বামীজি বললেন, হার্ভার্ডে আমার এক ছাত্র ছিল, বয়সে আমার বড়, স্পষ্টবাদী কর্মকর্তা, তাকে করা যায়। আমার এই ছাত্র এখন প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য। হার্ভার্ডে পড়ার সময় তার বাসায় ভারতীয় খাবার খেতে মাঝেমধ্যে যেতাম। চলাফেরায় কাউকে তোয়াক্কা করেন না। চুপচাপ থাকেন। বেশি শোডাউনে নেই। চন্দ্র শেখর বললেন, তাকে প্রস্তাব দিয়ে দেখুন নির্বাচন পরিচালনা করতে সম্মত আছেন কি না।

 

টি এন সেশানের বাড়িতে গেলেন স্বামীজি। জানালেন সিইসি করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের কথা। টি এন সেশান প্রথম সম্মত হলেন না। বললেন, একটা নীতির বাইরে যেতে পারব না। আমার কাজ রাজনীতিবিদরা ভালো চোখে দেখবেন না। স্বামীজি বললেন, শুরু করুন। সমস্যা হবে না। ভারতে এখন আপনার মতো একজন উচ্চমাত্রার সিইসি দরকার। রাজীব গান্ধী তখন বিরোধী দলের নেতা। সে নির্বাচন রাজীব গান্ধীর আবার ক্ষমতায় আসার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রাজীব গান্ধী শুনলেন একজন কট্টর আমলাকে সিইসি করা হয়েছে। তিনি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। কারণ কংগ্রেস তখন নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কঠোর অবস্থানে। টি এন সেশান দায়িত্ব নিলেন। প্রক্রিয়া শুরু করলেন জাতীয় নির্বাচনের। বললেন, আমি এখন থেকে ভারত সরকারের অংশ নই। শুরুতে ভোট করতে গিয়ে প্রশাসনিক সমন্বয় করতে থাকলেন কঠোরভাবে। একবার যুগ্মসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো ত্রিপুরার ভোটের। সেই কর্মকর্তা ত্রিপুরা না গিয়ে চলে গেলেন বিদেশ সফরে। এর জবাবে টি এন সেশান তার ফাইল তলব করলেন। তাতে লিখলেন, এই কর্মকর্তাকে এখনই চাকরিচ্যুত করা উচিত। এমন দায়িত্বহীন কর্মকর্তার কোনো অধিকার নেই প্রশাসনে থাকার। তবে আমি তাকে এখনই চাকরিচ্যুতি করতে বলছি না। তার আগামী পদোন্নতি ফাইলে মতামত ব্যক্ত করছি। এ মতামতে পদোন্নতি আটকে যায় সেই কর্মকর্তার।

 

টি এন সেশানকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন ভারতীয় সাংবাদিক কে গোবিন্দন কুট্টি। বইটির নাম ‘সেশান অ্যান ইন্টিমেন্ট স্টোরি’। এ বইতে বিশাল উচ্চতার একজন সেশানকে দেখতে পাই। যিনি নিজের দায়িত্ব পালনে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করতেন না। কোনো সমালোচনার জবাবে থাকতেন নিশ্চুপ। ব্যক্তিগতভাবে কারও প্রতি বিরূপ অবস্থান দেখাতেন না। কিন্তু নিজের দায়িত্বের প্রতি ছিলেন অবিচল। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে লড়েছেন। কিন্তু সে লড়াইটা ছিল জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি কাউকে ছাড় দেননি। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল সবাইকে তটস্থ করে রাখতেন। অনেক   মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৯৩ সালের ২ আগস্ট সেশান ১৭ পৃষ্ঠার একটি নির্দেশ জারি করেন। এতে লেখা ছিল- ‘যত দিন না নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সরকার মান্যতায় নিচ্ছে তত দিন দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ তাঁর এ বক্তব্যে ঝড় বয়ে যায় ভারতে।

 

প্রণব মুখার্জি তখন মন্ত্রী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের একটি উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁর সংসদে ফেরার কথা। এ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে প্রণব মুখার্জিকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হবে। টি এন সেশানের কাছে অনুরোধ এলো উপনির্বাচনটি নির্দিষ্ট তারিখে করতে। টি এন সেশান কারও কথা শুনলেন না। তিনি নির্ধারিত তারিখে ভোট করলেন না। বারবার তারিখ বদলে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছিল প্রণব মুখার্জিকে। আরেকটি ভোট নিয়ে জ্যোতি বসুর অনুরোধও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এতে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়েছিলেন জ্যোতি বসুর মতো ভদ্রলোকও। জ্যোতি বাবু রাগ করে তখন বলেছিলেন, ‘সেশান পাগলা কুত্তার মতো আচরণ করছেন।’ ভারতীয় রাজনীতিকে তিনি উথালপাথাল করে দিয়েছিলেন। লালু প্রসাদ যাদবের বিহারের নির্বাচনের তারিখ বারবার বদল করেছেন। বিহার ও নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে ভোটের লেভেল প্লেয়িং মাঠ তৈরি করতেই ভোটের তারিখ বদল করা হয়। মোদি প্রকাশ্য বক্তব্য রাখেন টি এন সেশানের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেননি। হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে লড়াইটা অনেক দূর গিয়েছিল। যার সমাপনী মোটেও ইতিবাচক ছিল না।

 

টি এন সেশান তাঁর মেয়াদে ভারতে নির্বাচনব্যবস্থার অনেক কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। সংশোধন করেছিলেন অনেক কিছু। আইনের সংশোধনগুলো বদলে দিয়েছিল সার্বিক কাঠামো। কাজটা এভাবেই করতে হয়। কাজ করতে গেলে গালি শুনতে হবে। সমালোচনা হবে। না করলে কেউ কিছু বলবে না। এভাবে সবাই পারে না। কেউ কেউ পারে। টি এন সেশান পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই তিনি ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন। এখন শুধু ভারত নয়, এ উপমহাদেশে তাঁকে উদাহরণ হিসেবে আনা হয়। টি এন সেশানের এ সাফল্যে বিচার বিভাগেরও বড় একটা অবদান ছিল। রাজনীতিবিদরা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যেতেন আদালতে। হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগে রায় আসত নির্বাচন কমিশনের পক্ষে। একবার রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে তখনকার ক্ষমতাসীনরা দুজন ইসি পাঠান টি এন সেশানের বিরুদ্ধে। এ দুজনের একজন ছিলেন তখনকার কৃষি সচিব।   আরেকজন আরেকটি মন্ত্রণালয়ের। তাদের নাম ছিল এম এস গিল ও কৃষ্ণমূর্তি। একবার বিদেশ সফরের সময় এ দুজনের কারও ওপরই তিনি দায়িত্ব দিয়ে যানটি। একজন উপনির্বাচন কমিশনারের কাছে দায়িত্ব দেন।

 

জানি একজন টি এন সেশান কোনো দিন পাবে না বাংলাদেশ। প্রত্যাশাও করি না। কিন্তু বাস্তবতা আড়াল করা যায় না। একটি গ্রহণযোগ্য সর্বজনীন অংশগ্রহণের নির্বাচন দরকার। কীভাবে সে নির্বাচন হবে ভাবতে হবে। বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে প্রয়াত কর্নেল (অব.) আকবর হোসেনের সংসদে প্রদত্ত একটি বক্তব্য মনে পড়ছে। ২০০৬ সালে সংসদে তিনি সরকারি দলের একজন মন্ত্রী হিসেবে বক্তব্য দেন। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তাঁর আগে বক্তব্য দিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম। আকবর হোসেন কুমিল্লা সদরের এমপি ছিলেন। তিনি একটু আলাদা ধাঁচের রাজনীতিবিদ ছিলেন। বিএনপি থেকে ভোট করলেও তিনি কুমিল্লার সংখ্যালঘুদের ভোট পেতেন। আকবর হোসেন সংসদে বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার! তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন তোফায়েল সাহেব, শেখ সেলিম সাহেব ও আওয়ামী লীগকে দিয়ে দিন। আমাকে শুধু ওসি আর টিএনও দেবেন। তাদের ওপর অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি ডিসি এসপিও না। এ দুজনকে নিয়ে আমি ভোট করব। তখন ফল আমার দিকে এলে অভিযোগ করতে পারবেন না।’ আকবর হোসেনের এ বক্তব্য বাস্তবতার নিরিখে দেওয়া। আমাদের প্রশাসনব্যবস্থার ওপরই ভোটের অনেক কিছু নির্ভর করে। প্রশাসন চাইলে যা খুশি তা করতে পারে।

 

প্রশাসনের অতি উৎসাহ আমাদের গত নির্বাচনের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বলা যায় সর্বনাশ করেছে। হুদা কমিশনের ব্যর্থ অবস্থানের কারণে সব প্রশাসন ছিল লাগামহীন। তারা কারও নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তারা ভুলে গিয়েছিল এ দেশটা স্বাধীন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা। ভোটের অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন শেখ হাসিনার দীর্ঘ সময়ের অর্জন। এ অতি উৎসাহের দরকার ছিল না। নিরপেক্ষ ভোট হলে গত নির্বাচনে শেখ হাসিনা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসত। তবে জাতীয় পার্টির পরিবর্তে প্রধান বিরোধী দলের আসনে আমরা বিএনপিকে দেখতাম। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের নেতা হতেন। এতে কী সমস্যা হতো আমার জানা নেই। তবে লাভ হতো। আজ দেশ-বিদেশে আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন খাতে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেত না। আওয়ামী লীগ এখনো এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ ঠিকানা। শেখ হাসিনা মানুষের আস্থার প্রতীক। এ অবস্থান কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশ আগামীতে হোঁচট খাবে। এগিয়ে চলা ব্যাহত হবে।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।  সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম করলে কঠোর ব্যবস্থা: পরিবেশ উপদেষ্টা

» চিন্ময় দাসকে গ্রেফতারের বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ

» ‘শ্রম অধিকার চর্চার দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা জরুরি’

» জুলাই বিপ্লব ইতিহাসের ইতিবাচক পরিবর্তন : শফিকুর রহমান

» মিরপুর থানার ৩ নং বিট পুলিশ নিয়ে আলোচনা সভা

» রিমান্ড শেষে কারাগারে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম

» শালিস করা নিয়ে ইউপি সদস্যেল ওপর হামলার চেষ্টার অভিযোগ অস্ত্র সহ তিনজন আটক

» শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কঠোর হতে চায় না সরকার: উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম

» চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর

» জনগণ প্রত্যাশা মতো গণমাধ্যমের সহায়তা পাচ্ছি না: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

নিভে যাওয়া সন্ধ্যাপ্রদীপ ও টি এন সেশানের ভোট

নঈম নিজাম: বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে প্রথম দেখা ইতালি বিমানবন্দরে। কলকাতার তপন রায় পরিচয় করে দেন। সময়টা ২০০১ সাল। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা ইতালি, জার্মানি, লন্ডনে তিনটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান তিনটি আয়োজন করা হয় এটিএনের ইউরোপ যাত্রা উপলক্ষে। বাপ্পি লাহিড়ী এ অনুষ্ঠানগুলোয় যোগ দেন গান করতে। প্রথম পরিচয়ে কুমিল্লার লোক জেনে বললেন, ‘আমিও কুমিল্লার মানুষ। আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি কুমিল্লায়। এ কারণে কুমিল্লার লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আপন মনে হয়।’ বললাম শচীন দেববর্মণও কুমিল্লার। শচীনকর্তার পড়াশোনা ও সংগীতের যাত্রা কুমিল্লা থেকে। কবি নজরুল আর শচীন দেব একসঙ্গে কুমিল্লায় সুরের ঝঙ্কার তুলতেন। তিনি বললেন, ‘জানি আমি। এ কারণে কুমিল্লা নিয়ে গর্ব করি।’ পুরো সফরকালে বাপ্পি লাহিড়ী আমাদের মাতিয়ে রাখেন। ভীষণ আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। এরপর ঢাকা ও কলকাতায় অনেকবার দেখা হয়েছে। তিনি প্রাণখোলা মানুষ ছিলেন। গান করতেন দরাজ গলায়। কলকাতায় যাত্রা হলেও তিনি মুম্বাই জয় করেন। তিনি গেয়েছেন- দিনক্ষণ দেখে প্রেম হয় না, ভালোবাসা হঠাৎ হয়…/চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারই… শেষ ট্রামে দুইজনাতে…। তিনি যেমন গেয়েছিলেন বাংলা গান, তেমনি গেয়েছেন আই অ্যাম এ ডিসকো ড্যান্সার…। বাপ্পি লাহিড়ী চলে গেলেন। আর ফিরে আসবেন না।

 

শুধু বাপ্পি নন, স্বল্প সময়ে আমরা তিনজন সংগীত ব্যক্তিত্বকে হারালাম। এ উপমহাদেশের কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকর প্রয়াণের রেশ না কাটতেই বাংলা গানের সম্রাজ্ঞী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বিদায় নিলেন। লতা হিন্দি সংগীতে তুলনাহীন। তিনি গেয়েছেন- আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও…/আকাশ প্রদীপ জ্বলে…/আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন…। লতা আর কিশোর কুমারের কিছু অসাধারণ গান রয়েছে একসঙ্গে। বাংলা গানে আমার চোখে সন্ধ্যার অবস্থান অনেক উচ্চতায়। সলিল চৌধুরী ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা গানগুলো গেয়ে তিনি একটা সময়কে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। সলিল ও গৌরীর কিছু গান সন্ধ্যার কণ্ঠে এখনো অম্লান। সে যুগে সেই সময়ে চলচ্চিত্রে সুচিত্রার বেশির ভাগ জনপ্রিয় ছবির গানের প্লেব্যাক করেছেন সন্ধ্যা। এখনো সন্ধ্যার গানগুলো আমাদের আপ্লুত করে। নিজের অজান্তে আমরা গুনগুন করি- মধু মালতি ডাকে আয়, ফুল ফাগুনের এ খেলায়…,/চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে জীবনে তোমায় যদি পেলাম না/কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে, আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে…/হয়তো কিছুই নাহি পাব তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাব…যদি ওগো কাঁদে মোর ভীরু ভালোবাসা, জানি তুমি বুঝিবে না…/ এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার। আঃ কী সুরেলা কণ্ঠ। এমন কণ্ঠ আমরা কি আর কোনো দিন শুনব? আর কোনো দিন পাব সন্ধ্যা মুখার্জিকে?

মৃত্যু মানে একজন মানুষের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া। না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া। আর কোনো দিন প্রিয়জনদের  কাছে ফিরে না আসা। জীবিত মানুষটি বুঝতে পারেন না আগামীকাল কী হবে। সন্ধ্যা মুখার্জি আর কোনো দিন   ফিরবেন না। সন্ধ্যা গান দিয়ে অমরত্ব নিয়েছেন। লতা ও বাপ্পি লাহিড়ীর বিষয়েও একই কথা বলব। বাংলা সংগীতের নতুন মাত্রার যাত্রা পঞ্চাশের দশকে। সেই রাজত্ব টানা অব্যাহত ছিল ষাট, সত্তর ও আশির দশকে। তারপর অনেক কিছু আমাদের হারিয়ে গেছে। সংগীতও এর বাইরে নয়। এ কথা সত্যি, সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। কিন্তু বাংলা সংগীতের জনপ্রিয় গানগুলো কখনো হারাবে না। কিংবদন্তি লতা, গীতশ্রী সন্ধ্যা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

 

 

মানুষের জীবন এক বহতা নদী। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে ধারণ করেই আমাদের চলতে হয়। চলতে হবে। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের নির্বাচনী সার্চ কমিটির বৈঠকে। বের হওয়ার পর সাংবাদিক সহকর্মীরা জানতে চান কী কথা বলেছি কমিটির সামনে। স্পষ্টবাদী মানুষ। কথা বলায় কৌশলী নই। যা মনে আসে বলে ফেলি। যা অনেক সময় নেতিবাচক হয়ে আসে। এ যুগে হিপোক্রেসি না করলে চলে না। হিপোক্রেট আর চাটুকারদের একটা যুগ চলছে। বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা একটা কঠিন সময় পার করছে। হুদা কমিশনের অপরিসীম ব্যর্থতা আজকের অবস্থা তৈরি করেছে। হুদা কমিশন ভোটকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করেনি সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। এখন কাউকে সবকিছু স্বাভাবিক করতেও একটা সময় লাগবে। যে কোনো কমিশন চাইলেও সব স্বাভাবিক করতে পারবে না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে দক্ষ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তার প্রয়োজন। যিনি সাহসী হবেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করে ন্যায়নিষ্ঠার পথে হাঁটবেন। যার বলিষ্ঠতা থাকবে ভারতের নির্বাচনব্যবস্থার আধুনিক সংস্কারক টি এন সেশানের মতো। আমরা কি কখনো একজন টি এন সেশান পাব ভোটের মাঠে?

 

টি এন সেশান ছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য থাকাকালে একদিন তাঁর দিল্লির প্যান্ডেরা রোডের বাড়িতে আসেন চন্দ্র শেখর সরকারের একজন মন্ত্রী। সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর। চন্দ্র শেখর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ভোট নিয়ে একদিন তিনি কথা বলছিলেন তাঁর মন্ত্রী সুব্রামনিয়াম স্বামীর সঙ্গে। নতুন সিইসি কাকে করবেন আলোচনা করতেই স্বামীজি বললেন, হার্ভার্ডে আমার এক ছাত্র ছিল, বয়সে আমার বড়, স্পষ্টবাদী কর্মকর্তা, তাকে করা যায়। আমার এই ছাত্র এখন প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য। হার্ভার্ডে পড়ার সময় তার বাসায় ভারতীয় খাবার খেতে মাঝেমধ্যে যেতাম। চলাফেরায় কাউকে তোয়াক্কা করেন না। চুপচাপ থাকেন। বেশি শোডাউনে নেই। চন্দ্র শেখর বললেন, তাকে প্রস্তাব দিয়ে দেখুন নির্বাচন পরিচালনা করতে সম্মত আছেন কি না।

 

টি এন সেশানের বাড়িতে গেলেন স্বামীজি। জানালেন সিইসি করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহের কথা। টি এন সেশান প্রথম সম্মত হলেন না। বললেন, একটা নীতির বাইরে যেতে পারব না। আমার কাজ রাজনীতিবিদরা ভালো চোখে দেখবেন না। স্বামীজি বললেন, শুরু করুন। সমস্যা হবে না। ভারতে এখন আপনার মতো একজন উচ্চমাত্রার সিইসি দরকার। রাজীব গান্ধী তখন বিরোধী দলের নেতা। সে নির্বাচন রাজীব গান্ধীর আবার ক্ষমতায় আসার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রাজীব গান্ধী শুনলেন একজন কট্টর আমলাকে সিইসি করা হয়েছে। তিনি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। কারণ কংগ্রেস তখন নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কঠোর অবস্থানে। টি এন সেশান দায়িত্ব নিলেন। প্রক্রিয়া শুরু করলেন জাতীয় নির্বাচনের। বললেন, আমি এখন থেকে ভারত সরকারের অংশ নই। শুরুতে ভোট করতে গিয়ে প্রশাসনিক সমন্বয় করতে থাকলেন কঠোরভাবে। একবার যুগ্মসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো ত্রিপুরার ভোটের। সেই কর্মকর্তা ত্রিপুরা না গিয়ে চলে গেলেন বিদেশ সফরে। এর জবাবে টি এন সেশান তার ফাইল তলব করলেন। তাতে লিখলেন, এই কর্মকর্তাকে এখনই চাকরিচ্যুত করা উচিত। এমন দায়িত্বহীন কর্মকর্তার কোনো অধিকার নেই প্রশাসনে থাকার। তবে আমি তাকে এখনই চাকরিচ্যুতি করতে বলছি না। তার আগামী পদোন্নতি ফাইলে মতামত ব্যক্ত করছি। এ মতামতে পদোন্নতি আটকে যায় সেই কর্মকর্তার।

 

টি এন সেশানকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন ভারতীয় সাংবাদিক কে গোবিন্দন কুট্টি। বইটির নাম ‘সেশান অ্যান ইন্টিমেন্ট স্টোরি’। এ বইতে বিশাল উচ্চতার একজন সেশানকে দেখতে পাই। যিনি নিজের দায়িত্ব পালনে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করতেন না। কোনো সমালোচনার জবাবে থাকতেন নিশ্চুপ। ব্যক্তিগতভাবে কারও প্রতি বিরূপ অবস্থান দেখাতেন না। কিন্তু নিজের দায়িত্বের প্রতি ছিলেন অবিচল। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে লড়েছেন। কিন্তু সে লড়াইটা ছিল জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি কাউকে ছাড় দেননি। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল সবাইকে তটস্থ করে রাখতেন। অনেক   মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৯৩ সালের ২ আগস্ট সেশান ১৭ পৃষ্ঠার একটি নির্দেশ জারি করেন। এতে লেখা ছিল- ‘যত দিন না নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সরকার মান্যতায় নিচ্ছে তত দিন দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ তাঁর এ বক্তব্যে ঝড় বয়ে যায় ভারতে।

 

প্রণব মুখার্জি তখন মন্ত্রী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের একটি উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁর সংসদে ফেরার কথা। এ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে প্রণব মুখার্জিকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হবে। টি এন সেশানের কাছে অনুরোধ এলো উপনির্বাচনটি নির্দিষ্ট তারিখে করতে। টি এন সেশান কারও কথা শুনলেন না। তিনি নির্ধারিত তারিখে ভোট করলেন না। বারবার তারিখ বদলে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছিল প্রণব মুখার্জিকে। আরেকটি ভোট নিয়ে জ্যোতি বসুর অনুরোধও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এতে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়েছিলেন জ্যোতি বসুর মতো ভদ্রলোকও। জ্যোতি বাবু রাগ করে তখন বলেছিলেন, ‘সেশান পাগলা কুত্তার মতো আচরণ করছেন।’ ভারতীয় রাজনীতিকে তিনি উথালপাথাল করে দিয়েছিলেন। লালু প্রসাদ যাদবের বিহারের নির্বাচনের তারিখ বারবার বদল করেছেন। বিহার ও নরেন্দ্র মোদির গুজরাটে ভোটের লেভেল প্লেয়িং মাঠ তৈরি করতেই ভোটের তারিখ বদল করা হয়। মোদি প্রকাশ্য বক্তব্য রাখেন টি এন সেশানের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেননি। হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে লড়াইটা অনেক দূর গিয়েছিল। যার সমাপনী মোটেও ইতিবাচক ছিল না।

 

টি এন সেশান তাঁর মেয়াদে ভারতে নির্বাচনব্যবস্থার অনেক কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। সংশোধন করেছিলেন অনেক কিছু। আইনের সংশোধনগুলো বদলে দিয়েছিল সার্বিক কাঠামো। কাজটা এভাবেই করতে হয়। কাজ করতে গেলে গালি শুনতে হবে। সমালোচনা হবে। না করলে কেউ কিছু বলবে না। এভাবে সবাই পারে না। কেউ কেউ পারে। টি এন সেশান পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই তিনি ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন। এখন শুধু ভারত নয়, এ উপমহাদেশে তাঁকে উদাহরণ হিসেবে আনা হয়। টি এন সেশানের এ সাফল্যে বিচার বিভাগেরও বড় একটা অবদান ছিল। রাজনীতিবিদরা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যেতেন আদালতে। হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগে রায় আসত নির্বাচন কমিশনের পক্ষে। একবার রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে তখনকার ক্ষমতাসীনরা দুজন ইসি পাঠান টি এন সেশানের বিরুদ্ধে। এ দুজনের একজন ছিলেন তখনকার কৃষি সচিব।   আরেকজন আরেকটি মন্ত্রণালয়ের। তাদের নাম ছিল এম এস গিল ও কৃষ্ণমূর্তি। একবার বিদেশ সফরের সময় এ দুজনের কারও ওপরই তিনি দায়িত্ব দিয়ে যানটি। একজন উপনির্বাচন কমিশনারের কাছে দায়িত্ব দেন।

 

জানি একজন টি এন সেশান কোনো দিন পাবে না বাংলাদেশ। প্রত্যাশাও করি না। কিন্তু বাস্তবতা আড়াল করা যায় না। একটি গ্রহণযোগ্য সর্বজনীন অংশগ্রহণের নির্বাচন দরকার। কীভাবে সে নির্বাচন হবে ভাবতে হবে। বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে প্রয়াত কর্নেল (অব.) আকবর হোসেনের সংসদে প্রদত্ত একটি বক্তব্য মনে পড়ছে। ২০০৬ সালে সংসদে তিনি সরকারি দলের একজন মন্ত্রী হিসেবে বক্তব্য দেন। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তাঁর আগে বক্তব্য দিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম। আকবর হোসেন কুমিল্লা সদরের এমপি ছিলেন। তিনি একটু আলাদা ধাঁচের রাজনীতিবিদ ছিলেন। বিএনপি থেকে ভোট করলেও তিনি কুমিল্লার সংখ্যালঘুদের ভোট পেতেন। আকবর হোসেন সংসদে বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার! তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন তোফায়েল সাহেব, শেখ সেলিম সাহেব ও আওয়ামী লীগকে দিয়ে দিন। আমাকে শুধু ওসি আর টিএনও দেবেন। তাদের ওপর অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি ডিসি এসপিও না। এ দুজনকে নিয়ে আমি ভোট করব। তখন ফল আমার দিকে এলে অভিযোগ করতে পারবেন না।’ আকবর হোসেনের এ বক্তব্য বাস্তবতার নিরিখে দেওয়া। আমাদের প্রশাসনব্যবস্থার ওপরই ভোটের অনেক কিছু নির্ভর করে। প্রশাসন চাইলে যা খুশি তা করতে পারে।

 

প্রশাসনের অতি উৎসাহ আমাদের গত নির্বাচনের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বলা যায় সর্বনাশ করেছে। হুদা কমিশনের ব্যর্থ অবস্থানের কারণে সব প্রশাসন ছিল লাগামহীন। তারা কারও নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তারা ভুলে গিয়েছিল এ দেশটা স্বাধীন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা। ভোটের অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন শেখ হাসিনার দীর্ঘ সময়ের অর্জন। এ অতি উৎসাহের দরকার ছিল না। নিরপেক্ষ ভোট হলে গত নির্বাচনে শেখ হাসিনা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসত। তবে জাতীয় পার্টির পরিবর্তে প্রধান বিরোধী দলের আসনে আমরা বিএনপিকে দেখতাম। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের নেতা হতেন। এতে কী সমস্যা হতো আমার জানা নেই। তবে লাভ হতো। আজ দেশ-বিদেশে আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন খাতে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেত না। আওয়ামী লীগ এখনো এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ ঠিকানা। শেখ হাসিনা মানুষের আস্থার প্রতীক। এ অবস্থান কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশ আগামীতে হোঁচট খাবে। এগিয়ে চলা ব্যাহত হবে।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।  সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com