ছবিঃ অন্তর্জাল
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ : ছোটবেলা থেকেই আমি ঘুম কাতুরে মানুষ। আমি ঐ দলের অন্তর্ভূক্ত, যারা বিছানায় যাবার পর মুহূর্ত থেকেই বাস্তব পৃথিবী থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায়। ঘুমের ভেতরে স্বপ্নও দেখে না, কারণ, স্বপ্নও এক ধরণের জাগরণ।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পগুচ্ছ’ বই থেকে আমার গল্প পড়ার সুত্রপাত। ছোটগল্প পড়ি, তবে বড় আয়তনের কোন উপন্যাস পড়ি না। কারণ, আমার পড়ার সময়কাল দিনের আলোকিত অংশে সীমাবদ্ধ। জীবনে অনেকগুলো বিখ্যাত উপন্যাস পড়া শুরু করেছিলাম। বেশীর ভাগই শেষ করতে পারিনি। তবে সাম্প্রতিক অতীতে আমি জাপানী লেখক হারুকি মুরাকামির ‘1Q84’ নামের বিশাল এক বই পড়ে শেষ করেছি। তিনখন্ডে সমাপ্ত ৯২৫ পৃষ্ঠার বই। সমান্তরাল পৃথিবীর গল্প। লুইস ক্যারলের ‘Alice in Wonderland’ অথবা বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েলের ‘1984’ উপন্যাসের পোস্টমডার্ন রুপ। যাদুবাস্তবতার গাথা।
উপন্যাসটির প্রধান দুই প্রোটাগনিস্টের একজনের নাম এওমামে (Aomame)। ২৫ বছর বয়সের যুবতী। মূলত একজন সিরিয়াল খুনী। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার প্রিয় বান্ধবীর অপমৃত্যুর স্মৃতিকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে জাপানের টোকিও শহরের বিশাল এক এক্সপ্রেসওয়ের সিঁড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ে ভিন্ন এক জগতে। এলিসের মতো। কিন্তু এই জগত এলিসের জগতের মতো মুগ্ধকর নয়। সেখানে বাস্তবের সময় 1984 সাল রুপান্তরিত হয়েছে 1Q84 নামের অনির্দিষ্ট সালে। যেখানে রাতের আকাশে দুটো চাঁদ উঠে। একটা বড় চাঁদ ও একটা ছোট চাঁদ। পাশাপাশি। আমাদের চেনা চাঁদের পাশেই আরেকটা চাঁদ …। সামঞ্জস্যহীন ও সবুজাভ। এই পৃথিবীতে আগমনের পর এওমামে’র কাছে বাস্তব পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলে যেতে থাকে।
বইটা পড়তে পড়তেই আমার মাথার ভেতরে ছোটবেলার একটা স্মৃতি তীব্রভাবে উঁকি দিয়ে গেল। একটা দূরবর্তী ও অস্পষ্ট স্মৃতি, কিন্তু খুবই ঝাঁঝালো। প্রাথমিকভাবে মনে হলো স্মৃতির মধ্য থেকে বিদায় করে দিই। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হলো গল্পের আদলে লিখে ফেলি।
গফুর চাচাদের ঘর আমাদের পেছনের বাড়িতে। তাদের বাড়ির নাম পরামানিক বাড়ি। আমার শৈশবে তিনি ছিলেন যুবক। ঝাড় কাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। গ্রামের সম্পর্কে আমি তাকে চাচা বলে ডাকি। খুবই সামাজিক ও প্রাণবন্ত মানুষ। খাওয়ার সময় ছাড়া তিনি অন্দর মহলের ঘরে অবস্থান করেন না। রাতে ঘুমান সদর বাড়ির গরুর গোয়ালের দক্ষিণ কোণায় তৈরী করা ছনের ছাউনি দেয়া একটি কক্ষে। এটাই তার পড়ার ও ঘুমানোর ঘর।
গফুর চাচারা দুই ভাই। পিতা মৃত। অনেক সম্পত্তি রেখে মারা গেছেন। পড়াশুনার পাশাপাশি গফুর চাচা ‘দস্যু বাহরাম’ ‘কুয়াশা’ ও কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের বই পড়েন। আমরা ছোটবেলায় কাছারি ঘরে ঢুকলেই দেখতে পেতাম তিনি ঘরের প্রায়ান্ধকারের ভেতরে বসে গভীর মনোযোগ সহকারে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ ‘হ্যালো সোহানা’ পড়ছেন। আমি একবার তার কাছে বইটা ধার চেয়েছিলাম পড়ার জন্যে। তিনি ক্ষেপে গিয়ে আমাকে পাঠ্য পুস্তকে মনোনিবেশ করতে বলেছিলেন। বই পাঠ শেষে তিনি একটা রঙিন ট্রাঙ্কের ভেতরে বইটাকে তালাবদ্ধ করে রাখতেন।
তখন বর্ষাকাল। চারদিক প্লাবিত। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে সোহরাব ভাইদের বাড়ি। দুই বাড়ির মধ্যে উপত্যকার মত একটা গভীর পগার। বর্ষাকালে জলমগ্ন থাকে। দুই বাড়ির ভেতরে পারাপারের জন্যে নৌকা বা কলাগাছের ভেলা ব্যবহার করতে হয়। একদিন দুপুরের পর খবর এল সোহরাব ভাইয়ের মাকে সাপে কেটেছে। সকলেই ছুটতে ছুটতে নৌকা ও ভেলায় চড়ে ঐ বাড়ীতে গেলাম। ততক্ষণে সব শেষ। সোহরাব ভাইয়ের মায়ের শরীর নীল বর্ণ ধারণ করেছে। ঠোঁটের কোণা থেকে গড়িয়ে পড়া ফেনা শুকিয়ে গেছে। পদ্ম গোখরো সাপের দংশনে তার মৃত্যু হয়েছে। মায়ের নিথর কোলের ওপরে উন্মাতালের মতো আছড়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদছে সোহরাব ভাইয়ের বোন। কিশোরী ফাতেমা।
আরও একমাস পরের কথা। শরতকাল সমাগত। বর্ষার জল নেমে যাচ্ছে। হেঁটেই দুই বাড়ির ভেতরে যাতায়াত সম্ভব। সন্ধ্যার পরেই পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে যায়। রাত দশটা মানে গভীর রাত। একদিন গভীর রাতে গফুর চাচার হৃদয় বিদারী চিৎকারে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।সবাই দৌড়ে গেলাম। পগারের এপাড় থেকে গফুর চাচা অপর পাড়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। রাত গভীর হলেও আকাশে পূর্ণ চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলোতে আমরা দেখতে পেলাম ওপাড়ের কদম গাছের ডাল থেকে ঝুলে আছে ফাতেমা।
সকালে মাদারগঞ্জ থানা থেকে পুলিশ এলো। সোহরাব ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তিনি বললেন, “গতকাল দুপুরে ফাতেমা মায়ের জন্য খুব কান্নাকাটি করেছে।” তিনি আর কিছুই জানেন না। ফাতেমার কবর হল কদম গাছ থেকে একটু দূরে। মায়ের কবরের পাশে। পার্থক্য একটাই। ফাতেমার মায়ের জানাজায় প্রবল বর্ষা ঠেলেও কয়েক গ্রামের লোকজন হাজির হয়েছিল। কিন্তু ফাতেমার কোন জানাজাই হলো না। আত্নহত্যাকারীর জানাজা হয় না। পরের জগতে তার স্থান হবে নরকে।
সপ্তাহখানেক পরের কথা। রাতে গফুর চাচা তার পড়ার ঘরের ভেতর থেকে পুনরায় চিৎকার করে উঠলেন। আমরা সকলে গিয়ে দেখি তিনি অজ্ঞান হয়ে আছেন। মাথায় জল ঢালার পর তার জ্ঞান ফিরল। জানালেন, ফাতেমা তার ঘরের চৌকাঠের উপরে শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো! সবাই বলাবলি করল যে, ফাতেমার যেহেতু জানাজা হয়নি, সেহেতু তার আত্মা সম্ভবত এখনো বাড়ী ছেড়ে চলে যায়নি। ভূত হয়ে চলাফেরা করছে। গফুর চাচাকে তাৎক্ষণিক ভাবে নির্দেশ দেয়া হল তিনি যেন আর কখনও সদর বাড়ির এই ঘরে না ঘুমান।
ফাতেমার আত্মহত্যার বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। আমি ভেবে পাইনি জীবনের অপার সম্ভাবনাকে ঠেলে ফেলে ফাতেমা কেনো আত্নহত্যার মাধ্যমে জীবনকে শেষ করে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছিলো?
“চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা – একা,
যে জীবন ফড়িঙের,দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।” – জীবনানন্দ দাশ
সূএ :ডেইলি-বাংলাদেশ