সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত : কথাটা পুরনো হলেও চার দশক পরে আবার ঘুরে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। কথাটা বলেছিলেন, কলকাতায় চার দশক আগে এক জনসভায় তৎকালীন সিপিএম নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার এক শ বারো’। তিনি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, তখন কনস্টেবলদের মাইনে ছিল ১১২ টাকা। চার-পাঁচ দশক পরে সেই কথাটাই পশ্চিমবঙ্গে চালু হয়েছে। মাঝে যে চালু হয়নি তা নয়। ১৯৭২-৭৭ সালে সিদ্ধার্থ রায়ের রাজত্বে ছাত্র-যুবরা আন্দোলন করলে ধরেই বিনা কারণে পুলিশ প্রচ- মারধর করত। আর গত ১২ বছরে সরকারি হিসাব পাওয়া কঠিন হলেও প্রতিদিন টিভি খুললেই দেখা যায়, পুলিশ অতৃণমূল সমস্ত রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের কোনো কারণ না দেখিয়ে শুধু মারছেই না, কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের জন্য জেলেও পুরে দিচ্ছে। সম্প্রতি তৃণমূলের স্লোগান হলো ‘দিদির রক্ষাকবচ’। এ নামে একটি কর্মসূচি নিয়েছে রাজ্যের শাসক দল। এ প্রকল্পের কাজ দেখার জন্য তৃণমূলের সমাজবিরোধীসহ বিধায়ক সাংসদদের গ্রামগঞ্জে পাঠানো হচ্ছে। দিদির দূতরা গ্রামে গেলেই সাধারণ মানুষ নানা অভাব -অভিযোগ নিয়ে ঘিরে ধরছে। গ্রামবাসী তাদের অভাব-অভিযোগ জানাতে গেলেই পুলিশ মারধর শুরু করে দেয়। এগুলো টিভির পর্দায় দেখা যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখা যায় যারা অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন, তাদেরই পুলিশ গ্রেফতার করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে- এগুলো দিদির রক্ষাকবচ নাকি পুলিশকে দিয়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের? শত শত ঘটনার মধ্যে মাত্র দু-একটি উল্লেখ করছি। কলকাতা থেকে ৪০ কিমি দূরে সীমান্তের নিকটবর্তী গ্রামে ঢুকে তাদের অভাব-অভিযোগ জানতে চাইলে গ্রামবাসী তাদের ঘিরে ধরে। একটি তরতাজা যুবক মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা অনেক কিছু দিয়েছেন বলছেন, কিন্তু আমরা তো কিছুই পাইনি। কেন তিনি মন্ত্রীকে এ প্রশ্ন করেছেন, এই বলে ওই ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তৃণমূলের এক দুষ্কৃতকারী। টিভির পর্দায় দেখা গেল, ওই যুবককে এলোপাতাড়ি চর-থাপ্পড় মারা হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। পরদিন রাতেই পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে আনে। তার অপরাধ, সে কেন প্রশ্ন করেছিল আর মন্ত্রীর সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করেছিল। তাকে থানায় নিয়ে এসে পেটানোও হয়। দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও চমৎকার। জলপাইগুড়ি হাসপাতালে একজন বৃদ্ধা মারা যান। তার স্বামী ও ছেলে তৃণমূল অ্যাম্বুলেন্স সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেন অ্যাম্বুলেন্সে করে দেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য। তৃণমূলের ইউনিয়ন নেতারা দেড় মাইল যেতে ৩ হাজার টাকা দাবি করেন। মৃতের আত্মীয়রা বলেন, আমরা গরিব। আমরা ৩ হাজার টাকা দিতে পারব না। খবর পেয়ে ওই এলাকার মানবাধিকার সংগঠনের জনৈক নেতা ঘটনাস্থলে এসে ওই নেতাদের বলেন, ওদের তো টাকা নেই। এই পথ যেতে ভাড়া লাগে ১ হাজার টাকা। তোমরা ৩ হাজার টাকা কেন চাইছ? তিনি অনেক মিটমাটের চেষ্টা করলেও সফল হননি। কিন্তু কেন তিনি মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন, সেই অভিযোগে সেই রাতেই তাকে গ্রেফতার করে গারদে পোরা হয়। চার দিন তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখার পর মামলা করে; অবশেষে তাকে মুক্ত করা হয়। জজসাহেব রায় দিতে গিয়ে বলেন, এমন অমানবিক ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায় এখন প্রশাসন চালায় পুলিশের আইসি বা ওসিরা। প্রতিদিন জেলা থেকে খবর আসে তারা জেলা শাসক বা এমপির কথা শুনতে চান না। এদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কে এই অভিষেক? তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এবং মমতা ব্যানার্জির ভ্রাতুষ্পুত্র। তার কথাই পশ্চিমবঙ্গের শেষ কথা। জেলায় জেলায় এখন মজুদ হচ্ছে বোমা। এই এত বোমা কোথা থেকে আসছে, সে ব্যাপারে পুলিশ সব জেনেও বলছে জানি না। আর টিভির পর্দায় সাফাই গাইছেন তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক কুনাল ঘোষ। কুনাল সারদা মামলায় সাড়ে তিন বছর জেলে ছিলেন, বর্তমানে জামিনে আছেন। অন্যদিকে বিজেপির মুখপাত্র পুলিশের বিভিন্ন কীর্তিকলাপের ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে পুলিশের বাড়াবাড়ির চিত্র তুলে ধরেন। কয়েক দিন আগে আসানসোলে শীতবস্ত্র বিলির সময় পদপিষ্ট হয়ে তিনজন মারা যান। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে মামলাটি ঘুরিয়ে দিয়ে অন্য দলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। কিন্তু ঘটনাটি ঘটিয়েছিল তৃণমূল। ডায়মন্ড হারবার জেলায় এক সপ্তাহে অন্তত ১০ বার বোমা মজুদের ঘটনা ধরে ফেলে প্রকৃত দোষীদের না ধরে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাদের ধরে এনে থানায় পাঠানো হচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখতে হচ্ছে কলকাতার টিভি চ্যানেলগুলোয়। ঘটনার তো বিরাম নেই। পঙ্কজ দত্ত নামে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মমতার এ কান্ডকারখানা তুলে ধরেছিলেন। এ দেশের নিয়ম অনুযায়ী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্তারা একজন করে নিরাপত্তাকর্মী পান। ঘুষ নেওয়া তো পুরনো কথা, একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে সাধারণ মানুষকে মারধর করা, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া বলতেই থাকে। পরদিনই পঙ্কজ দত্ত টিভির পর্দায় বলেন, আমি যেহেতু মমতার সমালোচনা করেছিলাম, তাই সেই রাতেই আমাকে কিছু না জানিয়ে আমার নিরাপত্তারক্ষীকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে লজ্জা ও ঘৃণাজনক ঘটনা হলো, পুলিশ নিজেদের মধ্যে বলাবলিই করে- তারা তৃণমূলের বর্ধিত অংশ, এটা তারা প্রমাণ করে দিয়েছে। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে পুলিশকে দিদির হয়ে কাজ করতে হবে। সে কাজই তারা করছে। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪৭ জন লোক পুলিশের এবং তৃণমূল দুষ্কৃতকারীদের যৌথ গুলিতে মারা গেছেন। এখন থানায় থানায় হিসাব করা হচ্ছে, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটে দিদিকে ফের জেতাতে হলে কতজনকে খতম করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গজুড়ে একটিই প্রশ্ন- পুলিশ আর কতদূর বাড়াবাড়ি করবে? পুলিশের হাতে অস্ত্র আছে। সঙ্গে আছেন দিদি ও ভাইপো। তাই গ্রামগঞ্জে সর্বত্র আওয়াজ উঠেছে- পুলিশকে কীভাবে দল থেকে আলাদা করা যায়? গোটা পশ্চিমবঙ্গে এখন একই প্রশ্ন। আমরা কোথায় চলেছি? আমরা কি সিপিএমকে হঠানোর জন্য এ পরিবর্তন চেয়েছিলাম? মমতাও তখন স্লোগান দিয়েছিলেন, বদলা নয়, বদল চাই।
পরিস্থিতি কোথায় গিয়েছে তার হাজার হাজার প্রমাণ রয়েছে। পাঠক, ভাবতে পারেন শিক্ষা বিক্রি হচ্ছে। আর দিদির মন্ত্রিসভায় দুই নম্বর মন্ত্রী বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে জেলে আছেন। তৃণমূলের দ্বিতীয় সমাজবিরোধী ডাকসাইটে নেতা অনুব্রত ম-ল এখন জেলে আছেন। বিচারব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য দিদির পুলিশ আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এমনকি কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপতিদের এজলাসে বারবার যেতে সেবা দিচ্ছে পুলিশ। বিরক্ত হয়ে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লিখে নিরাপত্তা চেয়েছেন। এ লেখা যখন লিখছি, তখনই খবর এলো প্রধান বিচারপতির চিঠি পেয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত সলিসিটার জেনারেলসহ সুপ্রিম কোর্টের তিনজন বিচারপতিকে কলকাতায় পাঠিয়েছেন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতিরা বলেছেন, তাঁরা কলকাতা পুলিশের হাতে নিরাপদ নন। প্রয়োজনে তাঁরা কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতে অনুরোধ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলিসহ সাত-আট জন বিচারপতি মমতাকে ধিক্কার জানিয়ে বলেছেন, এটা কলকাতা হাই কোর্টের ইতিহাসে লজ্জাজনক ঘটনা। দেশে দেশে সামরিক শাসন হয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন পুলিশের শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চলেছে শাসক দলই। তাই হরেকৃষ্ণ কোঙ্গারের কথাই আবার বলতে হচ্ছে, ‘পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার এক শ বারো’।
লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদি । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন