নূরে আলম সিদ্দিকী: বলা বাহুল্য, লবণ ছাড়া তরকারি একেবারেই বিস্বাদ, কোনোভাবেই মুখে রোচে না। বোধ করি, ওষুধের চাইতেও লবণ ছাড়া তরকারি খাওয়া যেমন কষ্টকর, তেমনি সক্রিয়, সৃজনশীল, অর্থবহ ও কার্যকর বিরোধী দল ছাড়া একটি রাষ্ট্র ঠিকঠাক চলতে পারে না। যদি এমন অবস্থায় উন্নয়নের দামামা বাজানো হয় তবু কোথায় যেন একটা অস্বস্তি, অতৃপ্তি ও না পাওয়ার বেদনা চিনচিন করে বাজে। আমাদের প্রজন্মের যারা, তারা ১৯৬২ সাল থেকে আইয়ুব শাহির সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছি। যৌবনের একটা বিশেষ সময় কারাগারের নিঃসঙ্গ যন্ত্রণার মধ্যে অতিবাহিত করতে হয়েছে। যন্ত্রণা হলেও সেটা সুখকর ছিল। কারণ আমাদের দুই চোখে ছিল গণতন্ত্র উদ্ধারের অগ্নিদৃপ্ত শপথ। আমরা চেয়েছিলাম সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গণতন্ত্র ছিনিয়ে আনতে। আমাদের বিশ্বাস ছিল সেটি আমরা পারব এবং পেরেছিও। আজকের ছাত্র রাজনীতি অনেকটা লক্ষ্যভ্রষ্ট বলে মনে হয়। সাংগঠনিক কলহ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বের মন জোগানোর আবর্তেই আজকের ছাত্র-যুব সমাজের সমস্ত প্রয়াস। সেখানে জাতীয় কল্যাণে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে কি না তা প্রতিভাত হয় না। উদ্ধত চিত্তের উত্তোলিত মুষ্টিবদ্ধ হাত মিছিল থেকে আকাশের দিকে উত্থিত হয় না। মিছিলের মুখগুলো স্লোগানে স্লোগানে গণসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে ওঠে না। সবকিছুতেই যেন কেমন একটা নিষ্প্রভ, নীরব, নিস্তব্ধ আকুতি।
ছাত্রলীগ আমার আত্মার স্পন্দন, হৃদয়ের ধড়কানি। আমার উদ্ধত যৌবনে কি নিবিড় আন্তরিকতায় ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম, তা ভাবলে আজও হৃদয়ে এক অদ্ভুত শিহরন জাগে। সেই ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের এক কর্মী হিসেবে শানিত চিত্তে উদ্বেলিত মানসিকতায় পথচলা শুরু। ছাত্রলীগের অমিতবিক্রম নেতা সর্বজনাব শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মণি, কে এম ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী, আবদুর রাজ্জাক- এঁদের শানিত চিত্তের উত্তপ্ত সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। রাজনীতির দীর্ঘ পথপরিক্রমণে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচিটি আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়েছিল স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার আন্দোলনে উত্তরণের দৃপ্তপ্রত্যয় হিসেবে। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আমাদের চেতনার আবর্তে ছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দিয়েছিলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির রূপরেখা নির্ণয়ে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির প্রদীপ্ত আঙ্গিকে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির যে চেতনাটি মুখরিত হয়েছিল, সেটিই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে যে চেতনাটি অঙ্কুরিত হয়, কালের স্রোতধারায় বিশ্বাসের প্রবাহে সেটি একটি স্বাধীন সত্তায় রূপ নেয়। যেটি নানা ঘাত-প্রতিঘাতে আন্দোলনের স্রোতধারায় বাঙালির স্বাধীনতার চেতনায় সূর্যস্নাত রূপ পরিগ্রহ করে। ছাত্রলীগের একটি প্রকৃত কর্মী হিসেবে সবকিছু ছাপিয়ে নিজেকে বাঙালি হিসেবে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগত।
’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলনের মহালগ্নে আমার চেতনা উন্মুক্ত করে দেয় মনু মিয়ার মৃত্যুকালীন প্রত্যয়ী সেই ঘোষণা। মৃত্যুর আগে বেদনাহত কাতর কণ্ঠে সে যখন আমাকে বলেছিল, ‘আলম ভাই, মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে বলবেন আমি বাংলার জন্য জীবন দিয়ে গেলাম।’ তাঁর মৃত্যুকালীন এই উক্তি আমার চেতনাকে প্রত্যয়ে রূপ দেয়। স্বায়ত্তশাসন নয়, এমনকি স্বাধিকারকেও ছাপিয়ে বাঙালির পরিপূর্ণ স্বাধীনতার চেতনাটি গভীরভাবে আমাকে উজ্জীবিত করে। ১৯৬৬ সালের ৯ জুন আমি গ্রেফতার হই। কারারুদ্ধ হওয়ার পর মুজিব ভাইয়ের পাশের সেলেই আমার ঠাঁই স্থির করে কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারে অবরুদ্ধ হওয়ার কোনো ক্লেষ-যন্ত্রণা তো নয়ই, যখনই জানতে পারলাম কারাগারের বিশ সেলে আমার কারাগারের ঠিকানা নির্ধারণ করা হয়েছে, তখন আমার চিত্ত উৎফুল্ল হলো, সমস্ত মনপ্রাণ উচ্ছ্বসিত হলো। কারণ আমাকে জানানো হয়েছিল, পাশের একটি বৃহৎ সেল, যাকে দেওয়ানি বলা হতো, সেখানে মুজিব ভাই অবরুদ্ধ আছেন। আমি কারাগারে গিয়ে মুজিব ভাইয়ের কাছে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলাম, ছয় দফার একজন নির্ভীক ও নিষ্কলুষ কর্মী হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেছি বলেই ভাগ্য আমাকে বাংলার সবচাইতে বিশ্বস্ত নেতৃত্বের কাছে কারাগারে ঠাঁই করে দিয়েছে। মুজিব ভাই ছাত্রলীগ নেতৃত্বের ওপর প্রচণ্ডভাবে আস্থাশীল ছিলেন। কারারুদ্ধ হওয়ার পরও ছাত্রলীগের একটি কর্মীর হৃদয়ের উচ্ছলতা দেখে তিনি ভীষণ বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। হাস্যোজ্জ্বলভাবে আমাকে তাঁর বক্ষে টেনে নিয়ে আলিঙ্গন করলেন এবং প্রচণ্ড কৌতূহলে আমার ডান হাতটি টেনে নিয়ে আমার হস্তরেখার ওপর জ্যোতিষীর মতো তীক্ষè দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমি কিছুই জিজ্ঞেস না করলেও তিনি বললেন, প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে। তারপর জেলখানা সয়ে যাবে।
সে ধাক্কায় তিন বছরের অধিক সময় কারাগার সয়ে গিয়েছিল। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ১৯টি মাস আমি মুজিব ভাইয়ের সান্নিধ্যে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। সে কত কথা, কত টুকরো টুকরো স্মৃতি, কত স্মৃতিচারণা; যা আজও অনুভূতিকে শিহরিত করে, হৃদয়কে আপ্লুত করে। কর্মীর প্রতি নেতার হৃদয়ের মধ্যে যে একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি অনিবার্যভাবে বিরাজ করে, কারাগারে মুজিব ভাইয়ের সান্নিধ্যে সেটি উপলব্ধি করেছিলাম।
এখানে জনান্তিকে জানিয়ে রাখা ভালো, সেই ১৯৬৬ সালের কারা অন্তরালের শেখ মুজিব তখনো বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি। তখন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ আমার পরম শ্রদ্ধেয় নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক এঁরা সবাই ’৬৬-এর পর কালক্রমে কারারুদ্ধ হন। আমি অসংকোচে একটা কথা বলতে পারি, তখনকার কারাগার আমার কাছে রাজনীতির পাঠশালা ছিল। সেদিন আমি কারা অভ্যন্তরের রাজনীতির পাঠশালা থেকে যে পাঠ নিয়েছিলাম, তা ছিল- রাজনৈতিক জীবনে দেশ ও মানুষের মুক্তি, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্যে বা ক্ষমতার মোহে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার আকর্ষণে রাজনীতি করা বাঞ্ছনীয় নয়। কারাগারের অভ্যন্তরে মুজিব ভাই আমাকে প্রায়ই বলতেন, বাংলার মুক্তি আমি দেখে যেতে পারব কি না জানি না। কিন্তু তোরা তো আছিস। স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত সৈকতে তোরা ঠিকই নোঙর করতে পারবি, ইনশা আল্লাহ। কত টুকরো টুকরো স্মৃতি আজও মানসপটে ভেসে ওঠে। একদিন দেওয়ানিতে রাজনৈতিক আড্ডা হচ্ছিল। নেতার সামনে ছাত্রলীগের দুই অবিসংবাদিত নেতা মোয়াজ্জেম ভাই ও বাকী ভাই উপস্থিত ছিলেন। আমি, একটি নিবিষ্ট কর্মীও ছিলাম। ওই রাজনৈতিক আড্ডায় মোয়াজ্জেম ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বল তো আলম, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বাগ্মী কে? আমি বোকার মতো বলেছিলাম, নূরে আলম সিদ্দিকী। মুজিব ভাই ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালে আমি নিজেকে শুধরে নিয়ে বলেছিলাম, ছাত্রদের মধ্যে এবং আমার প্রজন্মের। সামগ্রিকভাবে ছাত্রদের মাঝে বললেও বিভ্রাট তৈরি হতো। মোয়াজ্জেম ভাই ভীষণ তেজস্বী বাগ্মী ছিলেন। তাই আমার প্রজন্ম বলে কথাটি শুধরে নেওয়াতে খুব সুন্দরভাবে বিড়ম্বনা এড়াতে পেরেছিলাম। মুজিব ভাই সহাস্যে বলেছিলেন, মোস্ট ইন্টেলিজেন্ট এস্কেপ।
আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ করলাম, এবার ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষিত হলো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে। তিনি ছাত্রলীগের কমিটি পাঠ করে সাংবাদিকদের শোনান! এটা আমার কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়েছে। আমাদের জমানায় কাউন্সিলেই ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষিত হতো। রাতের পর রাত অতিবাহিত হতো। সাবজেক্ট কমিটি থেকে কাউন্সিল পর্যন্ত সর্বত্রই কমিটি নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা, তর্কবিতর্ক এমনকি প্রচণ্ড উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কাউন্সিলেই কমিটি গঠিত এবং ঘোষিত হতো। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কোনো পর্যায়েই ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করতেন না। এটা অভিপ্রেত ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধু কমিটির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতেন। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর মতামত ছাত্রলীগ নেতৃত্ব গঠনে চাপিয়ে দেননি। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব গঠনে আওয়ামী লীগের প্রভাব যত বিস্মৃত হবে, ততই ছাত্রলীগের স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা বিস্তৃত হবে। ছাত্রলীগ অবশ্যই আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করবে, একসঙ্গে আন্দোলন করবে কিন্তু ছাত্রলীগ কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন নয়। ছাত্রলীগের নিজস্ব গঠনতন্ত্র আছে, স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য আছে এবং সার্বভৌম সত্তায় তারা রাজনৈতিক পথনির্মাণ করেছে, সে পথ ধরে আওয়ামী লীগ সাফল্যের সৈকতে পৌঁছেছে। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব গঠনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অভিমত থাকতে পারে, পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে কিন্তু ছাত্রলীগের নিজস্ব গঠনতন্ত্র সমুন্নত রাখতে হলে সরাসরি আওয়ামী লীগ কর্তৃক ছাত্রলীগ নেতৃত্বের বিনির্মাণ ও ঘোষণা কোনোভাবেই অভিপ্রেত নয়। এটি ছাত্রলীগের স্বকীয় সত্তাকে বিবর্ণ করে।
আমাদের সময়ে ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে পরামর্শ ও তুমুল তর্কবিতর্ক চলত। তখন ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত একটা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য। যখন অনেক তিক্ত আলোচনা ও তর্কবিতর্ক, যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মধ্য দিয়ে একটা নিরেট পর্যবেক্ষণের ভিতর দিয়ে একটা কমিটি বেরিয়ে আসত এবং কাউন্সিলেই সেই কমিটি ঘোষিত হতো, তখন তুমুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্য দিয়ে কাউন্সিল ওই কমিটিকে বরণ করে নিত। এ যেন মরা গাঙে জোয়ার আসার মতো। সে কি প্রাণের উচ্ছ্বাস, হৃদয়ের সে কি উদ্বেলিত বহিঃপ্রকাশ! আমি যখন সভাপতি নির্বাচিত হই, তখন এই ঘটনাপ্রবাহের দিগন্তবিস্তৃত বৈভব অবলোকন করেছি। তর্ক হয়েছে, মতবিরোধ হয়েছে; কিন্তু কখনো সংঘর্ষ হয়নি। রাজনৈতিকভাবে দুটি মতাদর্শ ছিল। একটি গণতান্ত্রিক ধারার, আরেকটি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে সশস্ত্র বিপ্লবের। ব্যক্তিগত নেতৃত্বের প্রশ্নে নয়, একটি আদর্শের মতানৈক্যের ধারায় তখন আমাদের নেতৃত্ব সুসংগঠিত হতো। গণতান্ত্রিক ধারার প্রতিনিধি ছিলাম আমি এবং সমাজতান্ত্রিক ধারার শাজাহান সিরাজকে একত্র করেই ’৬৯-এর শেষের দিকে ছাত্রলীগের কমিটি বিনির্মাণ করা হয়। সেই মতপার্থক্যের একেকটি অধ্যায় নিয়ে একেকটি গ্রন্থ রচনা করা যায়। কি কার্যনির্বাহী কমিটিতে, কি বর্ধিত সভায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা হচ্ছে তো হচ্ছেই। সেই একেকটি সভা অনেক সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে ৭২ ঘণ্টাও চলেছে। ভাবতে অবাক লাগে, সে সময় কী করে না ঘুমিয়ে এত দীর্ঘ সময় সভায় পৌরহিত্য করেছি! ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের অনেকেই পালাক্রমে বিশ্রাম নিতেন কিন্তু আমার সভা থেকে সরার কোনো উপায় ছিল না। আশঙ্কা ছিল, আমি সরে গেলেই সত্তরের নির্বাচন বর্জন করে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেওয়ার পক্ষে সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয়ে যেত। বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। ’৭০-এর নির্বাচনকে স্বাগত জানানোর প্রস্তাব ছাত্রলীগ গ্রহণ করবে, এটাই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা ছিল। আমি অনেক সময় রাগে-দুঃখে অভিমানে বঙ্গবন্ধুর কাছে বলতাম, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার যে কমিটিকে আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই কমিটির কাছ থেকে নির্বাচনকে আলিঙ্গন করার প্রস্তাব পাস করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। তবু আল্লাহর শোকর- ধৈর্য ও সততার বিজয় হয়েছে। ছাত্রলীগ কোনো প্রতিবিপ্লবী পদক্ষেপে শেষ পর্যন্ত সম্পৃক্ত হয়নি। ’৭০-এর নির্বাচনকে প্রাণখোলা সমর্থন প্রদান করে প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগই ’৭০-এর অবিস্মরণীয় বিজয় আনতে পেরেছে।
ছাত্রলীগ স্বাধীনতা এনেছে। সেই স্বাধীনতাকে সুসংহত করার দায়িত্ব ছাত্রলীগ পালন করেছে। আজও সেই ছাত্রলীগের অপরিসীম দায়িত্ব শেষ হয়নি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ৫১ বছর পেরিয়ে এসেছে। আজ নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব স্বাধীনতার নির্যাস আপামর জনতার মধ্যে পৌঁছে দেওয়া। আর এ পথপরিক্রমণের অগ্রদূত হবে ছাত্রলীগ। এই চলমান শুভযাত্রার পতাকা বহন করবে ছাত্রসমাজ এবং তারও নেতৃত্ব দেবে ছাত্রলীগ।
গত ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা উত্তাপ-উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। অন্তত এমন একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি সূচিত হবে, যেখানে সরকার পতন না হলেও সরকারকে একটু নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করা হবে। এটা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিজয় সেটা আমি বলব না, তবে নিঃসন্দেহে বিরোধী দলের কর্মসূচি গ্রহণ ও প্রয়োগে বিরাট একটা ব্যত্যয় ও বিভ্রাট ছিল বলে উল্লেখ করলে অত্যুক্তি হবে না। নয়াপল্টনে সভার অনুমতি না দিয়ে সরকার যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের মহাসমাবেশ করার আহ্বান জানাল, তখন প্রস্তাবটি তাদের লুফে নেওয়া সংগত ছিল। এটা বিএনপি নেতৃত্বকে তাদের চিন্তার আবর্তে রাখতে হবে। বিএনপি লড়াকু কর্মীসমৃদ্ধ দল নয়, বরং এটাকে হোয়াইট কলার দল বলে অভিহিত করা যেতে পারে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা নির্বাচনকেন্দ্রিক ক্ষমতার লক্ষ্যে রাজপথে থাকার উড়োঝাপটা প্রচেষ্টা নিলেও সেই প্রচেষ্টায় দম থাকে না। কেন জানি না, রণক্লান্ত সৈনিকের মতো তাদের বিপর্যস্ত ও হতাশাগ্রস্ত মনে হয়। বেগম খালেদা জিয়া নানা রোগে আক্রান্ত। সত্যিই তিনি আজ রোগাক্রান্ত, নিস্তেজ ও নিষ্প্রভ। তাঁকে রাজপথে নামিয়ে আনা তো অনেক দূরের কথা, রাজনৈতিক নৈমিত্তিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করানো আজ বাস্তবে অসম্ভব এবং তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তো গরম পানিতে পা দিতেই নারাজ। উত্তপ্ত রাজপথে গণমিছিলের অগ্রভাগে তাকে এক দিনের জন্যও দেখা যায়নি। রাজনীতিতে ত্যাগ-তিতিক্ষা নির্যাতন-নিগ্রহ মোকাবিলা ছাড়া আন্দোলন সামনের দিকে অগ্রসর হয় না এবং আন্দোলন করতে হলে নেতৃত্বকেও অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, নির্যাতন-নিগ্রহকে আলিঙ্গন করতে হয়। আমি আমার যৌবনের পাদপীঠে পল্টন ময়দানসহ শাশ্বত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে উদাত্ত ও অমলিন কণ্ঠে বলতাম, মেঘে মেঘে ঘর্ষণ না লাগলে যেমন বিদ্যুৎ চমকায় না, মেহেদিকে না পিষলে যেমন তার রং বের হয় না, জলদগর্জন না হলে যেমন ময়ূর পাখনা মেলে না, তেমনি নির্যাতন-নিগ্রহ সহ্য করা ছাড়া সাহসী নেতৃত্ব তৈরি হয় না এবং লড়াকু সংগঠন গড়ে ওঠে না। ক্ষমতায় যাওয়া এক কথা আর অধিকার অর্জনের আন্দোলনের সফলতা ছিনিয়ে আনা আরেক কথা। এই বিএনপির কাছ থেকে আওয়ামী লীগ তাদের উত্থাপিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করেছিল। সেই যোগসূত্রে বিএনপিও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে পারবে, তাদের সাংগঠনিক অবকাঠামোয় ততটুকু দম আছে বলে মনে হয় না। সভায় ও মিছিলে রাজপথের উত্তাল তরঙ্গমালায় দোল খেতে খেতে আওয়ামী লীগ কর্মীরা উচ্ছ্বসিত হয়, উদ্বেলিত হয় তাদের হৃদয়। তারা কারাগারে যেতে আতঙ্কিত হয় না। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই, ক্ষমতাসীন অবস্থাতেই বিএনপির জন্ম। সমাজের সচ্ছল জনগোষ্ঠী বিএনপিকে লালন করে ও সমর্থন করে। নির্বাচনেও তাদের ভোটার সংখ্যা অনেক। তাই তাদের সমগ্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্বাচনভিত্তিকই হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগের দেখাদেখি আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি কোনো অর্জন ঘরে তুলতে পারবে না। অথচ নির্বাচনের মধ্যে তাদের সম্ভাবনা অপার। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দাবি তাদের জন্য বিশাল ফলপ্রসূ। আন্দোলনের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখতে পারলে, জনমতের চাপে প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য হলে নির্বাচনের ফল তাদের পক্ষে আশাপ্রদ হবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। আওয়ামী লীগের লড়াকু কর্মী বেশি, তবে নির্বাচনে বিএনপির জয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটাই নিষ্ঠুর বাস্তব, নিরেট সত্য। এখানে উদ্ধৃত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষার অগ্রদূত ইয়াহিয়া খানের প্রদত্ত ইএলএফওর প্রাচীর ভেঙে ১৯৭০-এর নির্বাচনে শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই নয়, সারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। যদি জানত এ বিজয় অর্জন নির্বাচনের মাধ্যমে সম্ভব, তাহলে তারা নির্বাচনই দিত না। যে-কোনো টালবাহানায় তারা নির্বাচনটিকে এড়িয়ে যেত এবং এ বিশাল বিজয়ের শক্তিদৃপ্ত আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হতো না।
লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন