নঈম নিজাম :শরৎ বাবু এখন আর মহেশের খোলা চিঠি পান না। মহেশ এখন ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইউটিউবের গুজব নিয়ে ব্যস্ত। সারাক্ষণ তার চোখ মোবাইল ফোনে। আবেগ-অনুভূতির সেই যুগ আর নেই। ডিজিটাল দুনিয়া মানুষের ভিতরটা কেড়ে নিয়েছে। মনের ধার এখন আর কেউ ধারে না। হৃদয় খুঁড়ে কেউ ভালোবাসা জাগায় না। বুকের গহিন বনে লুকিয়ে থাকা কষ্টের কথা জানান দেয় না চিঠির আদান-প্রদানে। কবির লেখনীতে রানারের রাত-বিরাতে ছুটে বেড়ানো আসে না। সিনেমা হলে উত্তম-সুচিত্রা, রাজ্জাক-কবরী দেখে কারও চোখে আসে না জল। এ যুুগের শাবানাদের জন্য গ্লিসারিন কিনে রাখতে হয় না সিনেমার পরিচালককে। ওটিটির যুগে বদলে গেছে গ্লিসারিনে কান্নার দৃশ্য। ডিজিটাল দুনিয়াতে শরৎ বাবুর মহেশের জীবনও বদলে গেছে। খোলা চিঠির প্রয়োজনীয়তা নেই। এ যুগে, এই সময়ে কষ্ট করে কে যাবে ডাকঘরে? ঘরে বসেই ভিডিওতে গেম খেলা যায়। মোবাইল ফোনে সব জানা যায়। আপনজনদের পাঠানো যায় মেসেজ। দরকার হলে অফিসের কাজে মেইল করা যায়। গুজব, অন্যের বিরুদ্ধে কুৎসা শোনা যায়। আবেগ-অনুভূতির কোথাও বালাই নেই। এখন কষ্ট করে সাদা কাগজের দিস্তা খরচ করে লিখতে হয় না কিছু। ঘর থেকে বের হলে এক শ একটা সমস্যা। ঘুরে বেড়ানোর স্থান নেই। ঢাকা সিটির পার্কগুলো বেদখল। হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। সেদিকে কারও চোখ নেই। সিটি করপোরেশন ব্যস্ত ডিজিটাল দুনিয়ার গল্প শোনানো নিয়ে। বাক্সবন্দি হচ্ছে এখনকার শিশু-কিশোররা। আদর-আহ্লাদে অভিভাবক সন্তানকে কিনে দেন মোবাইল ফোন। সন্তান কী করছে ডিজিটাল দুনিয়াতে, অভিভাবক খবর রাখেন না। মহেশের হাতেও এখন আধুনিক স্মার্টফোন। আজকাল শরৎ বাবুকে এসএমএস পাঠায় মহেশ। ফেসবুকে দেয় স্ট্যাটাস। যাকে অপছন্দ করে তার চৌদ্দগুষ্টির বারোটা বাজিয়ে দেয় কুৎসা রটিয়ে। শরৎ বাবু এসব দেখে হতাশ হন। জবাব কীভাবে দেবেন, তিনি যে ফেসবুক ব্যবহার জানেন না। টুইটার-ইনস্টাগ্রাম বোঝেন না। তিনি শুনেছেন, সামাজিক মাধ্যমে আবেগ-অনুভূতির মূল্য নেই। মুহূর্তে মনের সঙ্গে পথ বদল হয়। কেউ দেবদাস হয় না। পার্বতীর জন্য আক্ষেপ করে না। চন্দ্রমুখীদের নিয়েই ভালো থাকে। নিজেকে বিলীন করে কৃত্রিমতায়।
মানুষের অনুভূতি এখন স্থিতিশীল নয়। মধ্যবিত্তের বাড়িতে একদা শরৎ বাবুর দুই খানা বই রাখার চল ছিল। ফালগুনী মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন সংগ্রহ করতেন বাড়ির গিন্নি। সময় বদলে এলো হুমায়ূন-মিলন যুগ। শহুরে মানুষ হুমায়ূন রাখতেন। কারও বাড়িতে থাকত সুনীল, সমরেশ, বুদ্ধদেব, মিলন, শংকর। সেই দিনগুলোও বিলীন হচ্ছে। এখনকার তরুণ কবিরা জানেন না রেখায়নের আড্ডার কথা। পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন তরুণীর বুকে ঝড় তোলে না। শুভংকরের বড্ড বেশি সিগারেট খাওয়া নিয়ে আক্ষেপ নেই। আমাদের চারপাশটা খুব দ্রুত বদলে গেছে। কফি হাউসের আড্ডার মান্না দের যুগ শেষ। ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে সৈয়দ হক, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরীরা আর কোনো দিন যাবেন না। ঢাকা ক্লাবের কোনায় এখন দেখা যায় না অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কবি-স্থপতি রবিউল হুসাইনকে। রফিক আজাদ নব্বইয়ের দশকে সাকুরা ছেড়েছিলেন। কলকাতা শহরে সুনীল, শক্তিকে নিয়ে মধ্যরাত অবধি ঘুরে বেড়ানো বেলাল চৌধুরী চলে গেছেন। বুদ্ধদেব গুহ জলে-জঙ্গলে সময় কাটান না। সবাই চলে গেছেন চিরতরে। আর ফিরবেন না। সেই কলকাতা নেই। ঢাকাও হয়ে উঠছে অচেনা। পরিবর্তনের ঢেউ দুই বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিতে। মানুষের মন বদলে গেছে। পথের ঠিকানা বাঁক নিয়েছে মরুর পথে। ডিজিটাল দুনিয়া জীবনের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। চারপাশের সবকিছুতে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। চলার পথে পাশের মানুষটাই হুট করে হয়ে ওঠেন বিশ্বাসঘাতক। নিষ্ঠুরতা থেকে সবাই আনন্দ নেয়। মনের সুখে ক্ষতি করে উপকারকারীর। ভালো কিছুর প্রশংসা করতে পারে না।
মানুষের ভিতরটা বুঝতেন শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তখন তিনি থাকতেন কলকাতায়। রাজনীতি ও পেশায় সমানভাবে ভালো করেছেন। তাঁর বাড়িতে মানুষ যেত নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য। বিশেষ করে পূর্ববাংলার মানুষই বেশি যেত। তিনি সবার দুঃখ-কষ্টের কথা শুনতেন। বেশির ভাগ সময় দুই হাত বাড়িয়ে সহায়তা করতেন। একদিন খেয়াল করলেন, যাকে যত বেশি সহায়তা করছেন তিনি তত বেশি বিরোধিতা করছেন। সাহায্য গ্রহণকারীরা ভুলে যান উপকারের কথা। তারা হেঁটে হেঁটে কুৎসা রটান। ব্যথিত হলেন শেরেবাংলা। তবে সাহায্য বন্ধ করলেন না। তিনি নিয়ম বদল করলেন। সাহায্য দেওয়ার সময় বাড়তি কিছু টাকা দিতেন। তারপর বলতেন, তুমি যা চেয়েছ তার বেশি দিলাম। তোমার উপকার করেছি। বাকি জীবনে আমার অনেক ক্ষতি করবে তুমি। কুৎসা রটাবে। মিথ্যাচার করবে। গুজব রটাবে। সুযোগ পেলেই বাঁশ দেবে। বাঁশ কেনায় অর্থের সংকট যাতে না হয় তাই আগাম দিয়ে রাখলাম কিছু টাকা। বাঁশটা আমার দেওয়া টাকায় কিনে নিও। শেরেবাংলা আইনজীবী ছিলেন। রাজনীতি করেছেন। মানুষের ভিতরের নেতিবাচক অবস্থান বুঝতেন। যাযাবর লিখেছেন, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়েছে আবেগ। দৃষ্টিপাতের লাইনে লাইনে দিল্লির বদলে যাওয়া জীবনের চিত্র। হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে সেদিন মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম, ‘ঠিকানা না রেখে ভালোই করেছ বন্ধু, না আসার কোনো কারণ সাজাতে হবে না তোমায় আর… বানানো কাহিনি শোনাতে হবে না কথা দিয়ে না রাখার।’ ঠিকানা রাখলেই সমস্যা। মনের ভিতরের কথাগুলো জানান দিতে হয়। বলতে হয় অনেক কিছু। ভিতরে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে আসে। বিশাল আকাশটা মেঘে ঢেকে গেলে সবকিছু অন্ধকার মনে হয়। নিশীথ রাত শেষে ভোরের আলো এলে সবকিছু বদলে যায়। অনেক সময় আলোকরশ্মির জন্য অপেক্ষাটা হয় দীর্ঘতর। প্রকৃতি তার নিজস্ব রহস্য নিয়ে চলে। মানুষ সেই রহস্য ভেদ করতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষক গাড়ি চালাচ্ছিলেন। গাড়ির সামনে চাপা পড়লেন পথচারী রুবিনা। শিক্ষক গাড়ি থামালেন না। আহত নারীর দেহ আটকা পড়ল গাড়ির নিচে। সেই দেহ নিয়ে দীর্ঘ পথ ছুটে চলল গাড়িটি। ভয়াবহ নিষ্ঠুর এক দৃশ্য অবলোকন করল মানুষ। রাজধানীর শাহবাগে ঘটেছিল দুর্ঘটনাটি। ৪৫ বছর বয়সী রুবিনা গেল বছর ডিসেম্বরে স্বামীকে হারিয়েছিলেন। সন্তানের দেখাশোনা নিজে করতেন। এবার নিষ্ঠুরতার বলি হলেন তিনি। রুবিনার সন্তানের কাছে ডিসেম্বর মাসটি বিভীষিকার। গাড়ির চালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজাহার জাফর শাহ কেন গাড়িটি থামালেন না? রুবিনা আক্তারের আর্তনাদ তাঁর কানে একবারের জন্যও গেল না কেন? কেন এমন বর্বর দৃশ্য দেখতে হলো নগরবাসীকে? গাড়ির নিচে আটকেপড়া একজন মানুষকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো শাহবাগ থেকে নীলক্ষেত। রাস্তার মানুষের আর্তনাদ আর চিৎকার কানে যায়নি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের। গাড়ির ওপর হামলে পড়ে তাঁকে থামতে বাধ্য করতে হয়েছিল। কোথায় আছি আমরা? কোথায় যাচ্ছি? কী শিখছি জীবনের চলার পথে? পরের কাহিনি আরও নিষ্ঠুর। গাড়িটি নীলক্ষেতে থামানোর পর লোকজন চালককে বের করলেন। সবাই ব্যস্ত হলেন তাঁকে মারধর করতে, দুর্ঘটনার ছবি, সেলফি তুলতে। কেউ গেলেন ফেসবুক লাইভে। একবারও ভাবলেন না আহত নারীটির কথা। কারও মাথায় এলো না, আগে আহতকে হাসপাতালে নেওয়া জরুরি। দরকার পুলিশে খবর দেওয়া। আমার দাদি বলতেন, কারও ঘর পোড়া যায়, কেউ খায় আলুপোড়া। দাদিকে বলতাম, বুঝিয়ে বল। তিনি বলতেন, ঘরের সঙ্গে ভিতরে থাকা আলুও পুড়ে গেল। মানুষ এলো। হায় হায় করল। কেউ পোড়া আলু নিয়ে ব্যস্ত হলো খেতে। রুবিনার দুর্ঘটনাও তা-ই ছিল। সবাই ব্যস্ত মারধর, ভাঙচুর, মোবাইলে ফটো তোলা, লাইভ করা নিয়ে। ব্যতিক্রমী এক যুবক ঘটনাস্থলে এলেন। চিৎকার করে রিকশা থামানোর চেষ্টা করলেন। এক রিকশাচালককে বললেন, ভাই থামুন, আহত মানুষটিকে হাসপাতালে নিতে হবে। রিকশাচালক থামলেন না। আরও দ্রুত চালিয়ে গেলেন। এ সময় কেউ একজন একটি ভ্যান নিয়ে এলেন। সেই ভ্যানে ধরাধরি করে আহত নারীটিকে তোলা হলো। রিকশা থামানোর চেষ্টা করা ছেলেটির সঙ্গে যোগ হলেন আরেকটি মেয়ে। কেউ কাউকে চেনেন না। তারা দুজন আহত নারীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। রক্তের জন্য ছোটাছুটি করলেন। চিকিৎসকরা ওটিতে গেলেন। ফিরে এসে ঘোষণা দিলেন, শি ইজ নো মোর। ডুকরে কেঁদে উঠলেন ভ্যানগাড়িতে করে আসা অচেনা মেয়েটি। ছেলেটিরও চোখে জল। সাংবাদিকরা ছুটে এলেন খবর নিতে। কেউ দাঁড়ালেন না সাহায্যের হাত নিয়ে। ব্যতিক্রম তারা দুজন। আহত নারীকে কয়েক ঘণ্টা আগেও জানতেন না তারা। শুধু পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বুকভরা মানবিকতায়।
ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মানুষ চেনা কঠিন। সেই শিক্ষকের তো গাড়িটি থামিয়ে আহত নারীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি হয়তো গাড়ি থামাননি মানুষের ভয়ে। গাড়ি থামালে মানুষ দোষ কার বের করতে পুলিশ ডাকত না। আহত নারীকে হাসপাতালে নিতে খুঁজত না অ্যাম্বুলেন্স। সবাই ব্যস্ত হতো চালককে পেটানো, গাড়িতে আগুন ধরানো নিয়ে। অস্বাভাবিক মানুষের আনন্দ নিষ্ঠুরতায়। ভরসা কোথাও নেই। আর নেই বলেই গণপিটুনির নামে মানুষ হত্যার উৎসব হয়। বাড্ডার সেই নারীটির কথা আমরা ভুলে গেছি। বাবাহারা সন্তানকে ভর্তি করতে মা গিয়েছিলেন স্কুলে। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে নিরীহ সেই নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এ যুগে এই সময়ে ঢাকা শহরে এমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে। বাড়ছে হিংসা-বিদ্বেষ। মাঝে মাঝে মন খারাপের গাড়িতে চড়ে বসি। জীবনের এই অধ্যায়ে মনে হচ্ছে- আমরা কোথায় ছিলাম, কোথায় যাচ্ছি? হৈমন্তী গেয়েছেন, ‘এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি, মাটিতে যে আজ স্বর্গ এসেছে নামি…’। মাটিতে স্বর্গ আসবে তা ভাবি না। স্বাভাবিকতা হারিয়ে যাবে কেন? গুজব, মিথ্যাচার, নষ্টামি ভর করেছে। বেপরোয়া নোংরামি গ্রাস করেছে সমাজ। পৃথিবীকে নরক বানানোর প্রতিযোগিতা চলছে। সাইবার জগতে চলছে লাইক-শেয়ারের প্রতিযোগিতা। দুনিয়াটাকে শেষ করার ভাবনা। সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই। নোংরাদের চোখে কোথাও ভালো কিছু নেই। ফুলের পাপড়িকে জুতায় পিষেই তারা আনন্দ পায়। একবারের জন্যও পজিটিভ চিন্তা করতে পারে না। ভয়াবহ করোনা কিছুই শেখায়নি। বাড়িয়েছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। হিংসুটেদের নিষ্ঠুর উল্লাসে কাঁপছে দুনিয়া। চট্টগ্রামে একটি ছোট্ট শিশুকে কেটে টুকরো টুকরো করা হলো। কারও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। মানুষ এতটা ভয়াবহ হয় কী করে? এখন মৃত মানুষের বাড়িতে গিয়ে সবাই খাওয়া-দাওয়ার গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠে। অনেকে ব্যস্ত হয় শোকের পোশাকের ফ্যাশন নিয়ে। আলাপ করে দুনিয়াদারি নিয়ে। কেউ তোলে কবরের সেলফি! মৃত মানুষের আত্মার প্রার্থনাটুকুও ঠিকভাবে হয় না। আত্মীয়-পরিজনের ফিসফিস চলে সম্পদের পরবর্তী বণ্টননামায়। অদ্ভুত এক জগৎসংসারে বাস। জানি না সবকিছুর শেষ কোথায়!
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন । সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন