সৈয়দ বোরহান কবীর :ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। আমাদের অহংকারের মাস। গৌরবের মাস। ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি, মার্চ- এই তিনটি মাস নিয়ে আমাদের অনেক আবেগ। এই তিন মাস উৎসবমুখর থাকে বাংলাদেশ। নানা অনুষ্ঠানে, বর্ণিল আয়োজনে আমরা স্মরণ করি আমাদের অর্জন, এগিয়ে যাওয়াকে। কিন্তু এবারের ডিসেম্বর মাসটা যেন অন্যরকম। কিছুটা অস্বস্তির, খানিকটা আতঙ্কেরও বটে। ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকার মহাসমাবেশ ঘিরে রাজনীতিতে একটা উত্তেজনা লক্ষ্য করছি। এমনিতেই দেশের মানুষ টানাপোড়েনের মধ্যে আছেন। আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এর মধ্যে ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে হুমকি-পাল্টা হুমকিতে জনগণ খানিকটা বিস্মিতও বটে। বিএনপি কিছুদিন ধরে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করছে। এ সমাবেশগুলো বিএনপিকে উজ্জীবিত করেছে। এসব সমাবেশ করে বিএনপি মনে করছে সরকার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এমনকি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকার পরে পালানোর পথ পর্যন্ত পাবে না।’ কিন্তু এরকম একশটা সমাবেশ করে কি সরকার পতন ঘটানো যায়? বিএনপির এসব সমাবেশকে কি আন্দোলন বলা যায়? এসব আন্দোলনে কি জনগণ সম্পৃক্ত হয়েছে? বাংলাদেশে আন্দোলন, সংগ্রাম সবচেয়ে ভালো বুঝতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছেন। জনগণকে উদ্বেলিত করেছেন। অধিকারহারা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। আন্দোলনের মাধ্যমেই তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। আন্দোলন সম্পর্কে ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছিলেন। ওইদিন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি ‘আন্দোলন’ কীভাবে গড়ে তুলতে হয় তা পাঠদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আন্দোলন গাছের ফল নয়। আন্দোলন মুখ দিয়ে বললেই করা যায় না। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হয়। আন্দোলনের জন্য আদর্শ থাকতে হয়। আন্দোলনের জন্য নিঃস্বার্থ কর্মী থাকতে হয়। ত্যাগী মানুষ থাকা দরকার। আর সর্বোপরি জনগণের সংঘবদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকা দরকার।
আন্দোলন গড়ে তোলার এই বুনিয়াদি শিক্ষা যদি আমরা বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি তাহলে দেশে ‘আন্দোলন’ হচ্ছে কি না তা বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে কি পেরেছে? বিএনপির সমাবেশগুলো নেতা-কর্মীদের বিরিয়ানি-খিচুড়ির উৎসব। সাধারণ জনগণ নিরাপদ দূরত্বে। বিএনপির আন্দোলনের ইস্যু কী? নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ নিয়ে কি জনগণের মাথাব্যথা আছে? বিএনপি বলছে, সরকার নাকি দেশকে দেউলিয়া বানিয়ে ফেলেছে। কদিন আগে বিএনপির মাঝে মাঝে উদয় হওয়া এক নেতা, দাঁত চিবিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার চেয়েও খারাপ।’ তাই নাকি? তাহলে শ্রীলঙ্কার জনগণের মতো বাংলাদেশের মানুষ তো রাস্তায় নামছে না। অর্থাৎ বিএনপি তাদের বক্তব্যের পক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো জনমত সৃষ্টি করতে পারেনি। ‘জনগণ আমাদের সঙ্গে’ বলে তাদের চিৎকার এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে প্রহসন। বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের দ্বিতীয় শর্ত হলো ‘আদর্শ’। বিএনপির আদর্শ কী, এ নিয়ে বিএনপির নেতাদের মধ্যেই নানা বিস্ময়। জিয়ার আদর্শ ছিল ‘রাজনীতি ডিফিকাল্ট করে দাও।’ রাজনীতিতে কালো টাকা, লুটেরা ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, স্বাধীনতাবিরোধীদের সমন্বয়ে এমন এক ককটেল জিয়া আবিষ্কার করেছিলেন যে, এখন রাজনীতি সত্যিই ডিফিকাল্ট হয়ে গেছে। সৎ নিষ্ঠাবান আদর্শবাদীদের জন্য আজ রাজনীতি এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা। এটা এখন শুধু বিএনপির জন্য নয়, সব দলের জন্য প্রয়োজন। জিয়ার পর বিএনপির নেতৃত্বে আসেন বেগম খালেদা জিয়া। বেগম জিয়ার আদর্শ ছিল ‘সবার আগে পরিবার’। ফ্যামিলি ফার্স্ট। তিনি তার গৃহবধূ বোনকে মন্ত্রী বানিয়েছেন। প্রয়াত অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ভাইকে এমপি এবং ছায়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী বানিয়েছিলেন। নিজ পুত্রকে ‘রাজপুত্র’ হিসেবে অভিষিক্ত করেছিলেন। এমনকি চাকর-বাকর, পাইক-পেয়াদাদেরও এমপি, রাজনৈতিক সচিব বানাতে কার্পণ্য করেননি। পরিবারের সবার তো বটেই এমনকি পরিবারের ফাই ফরমাশ খাটাদেরও হাজার কোটি টাকার মালিক বানিয়ে দিয়েছেন। পরিবার ভালো থাকলেই দল ভালো থাকবে। দল ভালো থাকলেই দেশ ভালো থাকবে। এটাই ছিল বেগম জিয়ার আদর্শ। এই ফ্যামিলি ফার্স্ট নীতি থেকে তারেক জিয়ার রাজত্বে বিএনপি কিছুটা সরে এসেছে। বর্তমানে বেগম জিয়া বিএনপির নামমাত্র প্রধান। আসল ক্ষমতার মালিক হলেন তারেক জিয়া। তারেক জিয়ার বিএনপির আদর্শ হলো ‘মানি ফার্স্ট’। যা কিছু কর সবার আগে টাকা লাগবে। নির্বাচন, আন্দোলন, কমিটি, লবিং, অপপ্রচার সবকিছুতেই মানি ফার্স্ট। সবার আগে টাকা। এই আদর্শ বিএনপিতে সংক্রমিত হয়েছে ভালোভাবেই। বিএনপি এখন মোটামুটি আর্থিক দিক থেকে আত্মনির্ভরশীল দলে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরাই দাবি করেন যে, টাকা না দিলে বিএনপির কোনো পর্যায়ের কমিটিতেই থাকা যায় না। কিছুদিন আগে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ছাত্রদলের কমিটি ঘোষিত হয়েছিল। পদবঞ্চিতরা কে কত টাকায় কোন পদ পেয়েছেন তার এক ফিরিস্তি প্রকাশ করেছিলেন গণমাধ্যমে। টাকার অঙ্ক দেখে আমার বিশ্বাস হয়নি। এক বিএনপি নেতাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই এসব নিশ্চয়ই গুজব তাই না। গুজবে দেশটা ভরে গেছে।’ তিনি কানের কাছে মুখটা আনলেন। হাত দিয়ে আমার কানটা ঢেকে যা বললেন তাতে তো আমার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। তার মতে, বিএনপির থানা কমিটিতেও কোটি টাকার খেলা হয়। ‘মানি ফার্স্ট’ নীতিতে বিএনপি উজ্জীবিত। এ জন্য নেতারাও এখন নিজেদের দৃশ্যমান রাখতে সচেষ্ট। বিভিন্ন সেমিনার, গোলটেবিল থেকে সমাবেশে গরম বক্তৃতা দেন। তাদের কদর বাড়ে। কর্মীরা আসে। পদ চায়, সঙ্গে নগদ নজরানা। বিএনপির আদর্শ আসলে কী? বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জ্বালানি নীতি কী হবে? পররাষ্ট্রনীতি কী হবে? আর্থিক ব্যবস্থাপনার কী পরিবর্তন আনবে। ঋণখেলাপির লাগাম কীভাবে টেনে ধরা হবে। অর্থ পাচার বন্ধে বিএনপির পদক্ষেপ কী হবে? এসব নিয়ে বিএনপির কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বা কৌশলপত্র দৃশ্যমান নয়। বিএনপি নেতারা সরকারের ঢালাও সমালোচনা করছেন। সব খারাপ বলতে বলতেই বিএনপি নেতারা তাদের ক্ষমতাকালীন সময়ের দুষ্কর্মও বেমালুম ভুলে গেছেন। কিছুদিন আগে যখন বিদ্যুৎ সংকট সৃষ্টি হলো তখন তাদের নেতারা বিদ্যুৎ সংকটের জন্য সরকারকে তুলাধোনা করলেন। কিন্তু তারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন বিদ্যুতের ভয়াবহতা নিয়ে কিছুই বললেন না। এখন বিএনপি নেতারা অর্থ পাচার নিয়ে অনেক কথা বলছেন। কিন্তু বাংলাদেশে অর্থ পাচারের আবিষ্কারক যে তাদের নেতা, এই সত্যটা সাহস করে স্বীকার করলেন না। তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ বিএনপি-জামায়াত জোট জামানায়। সেই দল যখন প্রতিপক্ষকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে তখন রবীন্দ্রনাথের পঙ্ক্তি নিজের অজান্তেই ঠোঁটে এসে যায় ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি চোর বটে’। তাই আদর্শহীন একটি রাজনৈতিক দল (কিংবা ক্লাব) আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে কীভাবে, এ প্রশ্ন অনেকের। বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন সূত্রের আরেকটি অপরিহার্য উপাদান হলো নিঃস্বার্থ কর্মী। এ নিয়ে আমি বেশি কিছু লিখতে চাই না। গত শনিবার কুমিল্লায় বিএনপির সমাবেশ হলো। পত্রিকার খবরে দেখলাম, রুমিন ফারহানাসহ বিএনপির ৩০ নেতার মোবাইল চুরি হয়েছে। এটা কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কে বা কারা মোবাইল চুরি করেছে। যে দলের নেতাদের ফোন বা মূল্যবান সামগ্রী কর্মীদের কাছে নিরাপদ নয়, সেই দলের কর্মীদের আর যাই বলা হোক না কেন নিঃস্বার্থ বলা যাবে না। এখন তারা নেতাদের মোবাইল চুরি করছে। ক্ষমতায় গেলে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল সব খেয়ে ফেলবে। কাজেই আন্দোলন গড়ে তোলার বৈশিষ্ট্যগুলোকে এখন পর্যন্ত ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি একবিন্দুতে মেলাতে পারেনি। হুংকার কিংবা ধমক দিয়ে আত্মতৃপ্তি হয়। কিন্তু আন্দোলন হয় না। বিএনপি যে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ঢাকায় সমাবেশের স্থান নিয়ে অযাচিত, অপ্রাসঙ্গিক উত্তাপ ছড়ানো। নয়াপল্টনেই কেন জনসভা করতে হবে? এ ব্যাপারে বিএনপি নেতাদের ব্যাখ্যার কোনো যুক্তি নেই, জেদ আছে। যে কোনো মূল্যেই নয়াপল্টনে জনসভা করব। সরকার অনুমতি দিক না দিক পল্টনেই সমাবেশ হবে- ইত্যাদি কথা রাজনীতির ভাষা নয়। পল্টনে যে কোনো মূল্যে সমাবেশ করতে বিএনপি নেতারা বদ্ধপরিকর। তাহলে সমাবেশের অনুমতি চাইতে তারা ঢাকার পুলিশ কমিশনারের কাছে গিয়ে ফটোসেশন করলেন কেন? বিএনপির যদি এতই জনসমর্থন তাহলে সমাবেশের জন্য তাদের পুলিশের দ্বারস্থ হতে হবে কেন? যেখানে ইচ্ছা যখন খুশি সমাবেশ করবে। বিএনপি যদি সত্যি বিশ্বাস করে তাদের সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হবে। সে ক্ষেত্রে তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের সমাবেশে আরও উৎসাহিত হওয়া উচিত। তাহলে কি বিএনপি গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চাচ্ছে? ১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে ঢাকায় একটা বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে। পুলিশ কিংবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষ হবে। কয়েকজন মারা যাবেন। ব্যস, আন্দোলন বারুদের মতো জ্বলে উঠবে। এমন শর্ট-কাট পথে কি বিএনপি আন্দোলনে জয়ী হতে চায়? আমার তেমনটি মনে হয় না। আমার বরং মনে হয়, আন্দোলনের এই খেলায় বিএনপি আসলে পুতুল নাচের পুতুল মাত্র। বিএনপির আন্দোলনের সুতো অন্য কারও হাতে। কিংবা বিএনপির অবস্থা ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়া ‘গণি মিয়ার’ মতো। ‘গণি মিয়া একজন কৃষক। নিজের জমি নাই। অন্যের জমিতে চাষ করে।’ বিএনপি তেমনি অন্যের জন্য একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। কারও ঘরে ফসল তুলে দেওয়ার জন্য কেউ বা কারা যেন বিএনপিকে ভাড়া করছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরে যাক-এটাই যেন বিএনপির একমাত্র চাওয়া। আওয়ামী লীগ সরে গিয়ে তৃতীয় শক্তিকে আনার সহযোগী হিসেবে কাজ করছে বিএনপি? বিএনপির আন্দোলনের সুতো আসলে কার হাতে? বাংলাদেশ এখন গুজবের দেশে পরিণত হয়েছে। কান পাতলেই নানা গুজব শুনি। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। গত বছর ওইদিনেই র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপির সমাবেশ নিয়ে মূল মনোযোগ সবার। কিন্তু অলক্ষ্যে কি ১০ ডিসেম্বর অন্য কোনো ঘটনা ঘটবে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর কয়েকটি মূলধারার গণমাধ্যম এখন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের ব্যর্থতার গুজব এবং অর্ধসত্য তথ্য প্রচার করে সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। এই অপপ্রচার এখন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। কূটনৈতিকপাড়ায় এখন প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চা-চক্র, ককটেল পার্টি কিংবা নৈশভোজের জমজমাট আয়োজন। সুশীলদের মলিন মুখে এখন হালকা হাসির রেখা। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে সংঘাত, হানাহানি লাগিয়ে কি কোনো তৃতীয় পক্ষ ফায়দা লুটতে চায়? আমলাদের মধ্যেও এখন সুবিধাবাদীরা নিরপেক্ষ সাজার মহড়া দিচ্ছেন। গোপনে সরকারের সমালোচনায় মুখর তারা। অতি উৎসাহী পুলিশের বাড়াবাড়ি, গায়েবি মামলা আসলে কার লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার? পর্দার আড়ালেই কি আসল খেলা চলছে? আবার কি এক-এগারোর মতো একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির নীরব আয়োজন চলছে? এই প্রশ্নগুলো আমার মাথায় এসেছে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কৌশল এবং বক্তব্য দেখে। ছয় মাস ধরেই প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক শক্তিকে সামনে আনতে চাইছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।’ প্রধানমন্ত্রী বিরোধী আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছেন। ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ যেন নির্বিঘ্নে হতে পারে তার জন্য একাধিক উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রথমত, তিনি ছাত্রলীগের সম্মেলন দুই দিন এগিয়ে এনেছেন। যেন ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশের মাঠ প্রস্তুত থাকে। বিএনপি মঞ্চ নির্মাণসহ আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী বিএনপির সমাবেশ নির্বিঘ্ন করতে পরিবহন ধর্মঘট না ডাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। তৃতীয়ত, এই সমাবেশের পাল্টা কোনো সমাবেশ না দেওয়ার জন্যও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দলের নেতা-কর্মীদের বলেছেন। শুধু বিএনপির সমাবেশের জন্য সহায়তা নয়। শেখ হাসিনা নিজেও দেশকে সুষ্ঠু রাজনীতিমুখী করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যশোরে জনসভা, আগামী ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের জনসভা তার বড় প্রমাণ। রাজনৈতিক গোলযোগে বিরাজনীতিকরণের পক্ষের মতলববাজরা যেন ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে শেখ হাসিনা সতর্ক। কিন্তু তাঁর দল কি তাঁর কৌশল বোঝে? নাকি কৌশল বুঝেও অপতৎপরতা চালাচ্ছে? আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যখন পরিবহন ধর্মঘট না ডাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তখন জাসদ থেকে আমদানিকৃত ‘গরু ও ছাগল চিনলেই ড্রাইভার হওয়া যায়’ এমন তত্ত্বের আবিষ্কারক এক নেতা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে ধর্মঘটের নেপথ্যে মদদ দিচ্ছেন। এই ধৃষ্টতা তিনি কীভাবে দেখান? এই সাহস কোত্থেকে তিনি পান। এখনো আওয়ামী লীগের কিছু নেতা দেখে নেব, খেয়ে ফেলব বলে যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছেন কার স্বার্থে? এক-এগারো এসেছিল সুশীল এবং পশ্চিমার কিছু দেশের পরিকল্পনায়। কিন্তু এর বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের কিছু সুবিধাবাদী, আদর্শ বিবর্জিত নেতার হাত ছিল। সেই সময় রাজনীতির মাঠে যারা সবচেয়ে যুদ্ধংদেহি ছিলেন এবং এক-এগারোতে তারাই সংস্কারপন্থি ভাঁড় সেজেছিলেন। এখনো কি ওই অতি উৎসাহীরা একই খেলা খেলছেন? ১০ ডিসেম্বর কী হবে? ২০০৪ সালের এপ্রিলে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুল জলিল ট্রাম্পকার্ড তত্ত্ব হাজির করেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন ৩০ এপ্রিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতন হবে। এ জন্য আওয়ামী লীগ লাগাতার বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছিল। ২১ এপ্রিল হাওয়া ভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ছিল। কিন্তু পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে বনানী ও গুলিস্তান অবরুদ্ধ করে রাখে। ২৫ এপ্রিল স্পিকারের কাছে স্মারকলিপি দেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা। ট্রাম্পকার্ড তত্ত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও বিচলিত হয়েছিল। এ সময় তৎকালীন সরকার গণগ্রেফতার শুরু করে। ২৪ এপ্রিল থেকে আওয়ামী লীগ গণঅনাস্থা কর্মসূচি পালন করে। ২৮ এবং ২৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগ ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার থাকে বহাল তবিয়তে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল ছিল বড় কৌতুক। এরকম কৌতুকের জন্ম দিয়েছিলেন বেগম জিয়াও। ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে সরকারকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে চেয়েছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন গোপালগঞ্জ নামই পাল্টে দেবেন। ২০১৪-এর আন্দোলনে বেগম জিয়া ‘গৃহত্যাগ’ নাটক মঞ্চস্থ করেন। ২০১৩-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বেগম জিয়া লাগাতার অবরোধের ডাক দেন। ‘ফিরোজা’ থেকে বেরিয়ে আসেন গুলশানে দলীয় কার্যালয়ে। ঘোষণা করেন তিনি ঘরে ফিরবেন না। এ সময় বেগম জিয়ার আন্দোলন নিয়েও অনেক কথাবার্তা হয়েছিল। আতঙ্কিত মানুষের সংখ্যাও কম ছিল না। কিন্তু বেগম জিয়ার ‘গৃহত্যাগ’ নাটক ফ্লপ হয়। আজ অবধি বিএনপি ওই লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করেনি। বেগম জিয়ার ওই আন্দোলন বর্তমানে বিএনপির সমাবেশ নাটকের চেয়েও বড় পরিসরে ছিল। আন্দোলনের ব্যাপ্তিও ছিল ভয়ংকর। গাড়িতে গান-পাউডার দিয়ে মানুষ পোড়ানো। আগুন-সন্ত্রাস। নাশকতা। কী হয়নি সে সময়? কিন্তু সেই সময় সরকারের পতন হয়নি। তাই এবারও বিএনপির ঢাকা সমাবেশে কোনো দৈব বিপ্লব হবে না, এটা অনুমান করা যায়। আন্দোলন কোনো স্বপ্নে পাওয়া তাবিজ নয়। যা দিয়ে মুহূর্তেই মনের বাসনা পূরণ হবে। কিন্তু ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এখন ক্ষুধার্ত। তাই সরকারকে ১০ ডিসেম্বর লালকার্ড দেখানোর ঘোষণা দিয়েছে। এই লালকার্ড কি ট্রাম্পকার্ডের মতোই হবে? কিন্তু ১০ ডিসেম্বর ষড়যন্ত্রের টানেল খুলে দিতে পারে। তৃতীয় শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ তৈরির সূচনা হতে পারে। বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত ১০ ডিসেম্বর সহিংসতাকে উসকে দেয়। আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে থাকা হাইব্রিড, সুবিধাবাদী এবং ষড়যন্ত্রকারীরা যদি বিএনপির সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়, তাহলে ষড়যন্ত্র ভয়ংকর হয়ে উঠবে। ১০ ডিসেম্বর রাজনীতিতে সহিংসতার আগুন লাগলে, সে আগুন সব খানে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত কুশীলবরা। তাই, শেখ হাসিনার নির্দেশনা মানতে হবে আওয়ামী লীগকে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সতর্কতার সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। না হলে বিরাজনীতি এবং অপরাজনীতির ষড়যন্ত্রের কাছে হেরে যাবে রাজনীতি এবং গণতন্ত্র। বিএনপি সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ কি পারবে দূরে থাকতে?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
[email protected] সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন