সিরাজগঞ্জের হোসেনপুরে কাঠের গুঁড়া আর ময়দার মিশ্রণে তৈরি হচ্ছিল পাউরুটি, কেকসহ বিভিন্ন বেকারি পণ্য। কল্পনা বেকারি নামের এক প্রতিষ্ঠানে দিনের পর দিন চলছে এসব ভেজাল খাবারের কারবার। গত ৭ নভেম্বর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অভিযানে উঠে আসে ভেজাল মেশানোর এ চিত্র।
সারা দেশে চলছে ভেজালের জমজমাট ব্যবসা। সেমাই, সরিষার তেল, গুঁড়া মসলা, সাবান, শ্যাম্পু, কসমেটিকস, গুঁড়া দুধ, শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল। নকলের ভিড়ে আসল পণ্য চেনাই দায় হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের মোড়ক হুবহু নকল করে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে এই ভেজাল সিন্ডিকেট। অভিযান, গ্রেফতার, সাজাতেও থামছে না ভেজাল পণ্যের দৌরাত্ম্য।
ঘি তৈরির প্রধান উপকরণ দুধ হলেও সয়াবিন ও ডালডা দিয়ে তৈরি হতো নকল ঘি। পরে এসব ঘি বিএসটিআইয়ের লোগো লাগিয়ে নামিদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজারজাত করা হতো। গত ১৮ অক্টোবর ভেজাল ঘি তৈরির মেশিন ও ডালডাসহ যাত্রাবাড়ী থেকে দুজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিএমপির ডিবি ওয়ারী বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ‘একটি চক্র সংঘবদ্ধভাবে ভেজাল ঘি উৎপাদন করে বাজারজাত করছিল। এই ভেজাল ঘি কেনায় শিশুসহ সব বয়সী মানুষের জীবন হুমকিতে পড়ছে, তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
রাজধানীজুড়ে নকল কারখানায় পানি বোতলজাত করে ‘মিনারেল ওয়াটার’ নামে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া অপরিপক্ব ফল পাকাতে, মাছ সংরক্ষণে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে কৃষিপণ্যেও বিষাক্ত রাসায়নিক (কেমিক্যাল) মেশানো হচ্ছে। নকল কারখানার মালিক ও ভেজাল পণ্য বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে একাধিক সরকারি সংস্থা অভিযান চালালেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও কোনো নজির নেই। ধরা পড়ার পর জরিমানা ও কারখানা সাময়িক বন্ধ হলেও একই ধরনের অপকর্মে তারা আবার লিপ্ত হয়। গ্রাম পর্যায়ের মুড়ি প্রস্তুতকারক থেকে শুরু করে কিছু ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যেও ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে অভিযানে। মাছ, শাক-সবজিতে ফরমালিন, বিষাক্ত জেলি, প্লাস্টিক ও কীটনাশক; ভোজ্য তেলে অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট, মসলায় রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া; মুড়িতে ইউরিয়া, বোতলজাত পানিতে কলেরার জীবাণু, গরুর দুধে সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে। নেই খোলা কোনো সয়াবিন বা পাম তেল। বিক্রেতারা বলছেন, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তিন দফা তেলের দাম বেড়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ের তেলগুলো ভিন্ন ভিন্ন রেটের। একেক দোকান একেক দামে এসব তেল কেনায় বিক্রিও করতে হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দামে। এটিই দামে তারতম্যের কারণ। এদিকে খুচরা বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। তিন দিন আগেও এ চিনির দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা কম ছিল। আর প্রতি কেজি খোলা আটা ৬৫ টাকার নিচে মিলছে না। যা গত সাপ্তাহে ৫৮ টাকা ছিল। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্য মতে, আটার দাম মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১২ দশমিক ১৫ শতাংশ। খোলা ময়দার দামও কেজি প্রতি ৭ টাকা বেড়েছে। গত সপ্তাহে যেখানে ৬৮ টাকা ছিল এ সপ্তাহে তা ৭৫ টাকা হয়েছে। টিসিবি বলছে, মাসের ব্যবধানে ময়দার দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ। বাজারের দোকানিরা বলছেন, প্যাকেটজাত আটার সরবরাহ কিছুটা কম। এক সপ্তাহ আগে খুচরা ব্যবসায়ীরা ডিলারদের কাছ থেকে যেসব আটা ও ময়দা সংগ্রহ করেছেন, সেগুলোই বিক্রি করছেন দোকানিরা। অনেক দোকানে তাও পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে পাইকারি বাজারে খোলা আটা-ময়দার চড়া দামের কারণে অনেকে রাখছেন না। রাজধানীর কয়েকটি তরকারির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলু, মুলা ও বেগুন বাদে বেশিরভাগ সবজিই এখন কিনতে হচ্ছে প্রতিকেজি ৫০ টাকার ওপরে। এর মধ্যে কয়েকটি সবজির দাম ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। কয়েকদিনের ব্যবধানে বেশকিছু সবজি কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। প্রকারভেদে পাতাকপি ও ফুলকপিও বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। শসা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। লম্বা বেগুন প্রতি কেজি ৬০ টাকা, গোল বেগুন ১০০ টাকা, টমেটো ১৪০ টাকায়, প্রতিকেজি শিম ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাল কুমড়া ও লাউ আকারভেদে প্রতিটি ৬০-৭০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া কেজিতে ৩০-৪০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০, পটোল ৬০, পেঁপে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০-৭০ টাকা, কচুর লতি ৮০ ও ধুন্দুল ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। দেশি পিঁয়াজের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা প্রতিকেজি। কয়েকটি বাজারে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগি এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। সোনালি মুরগি ৩০০ টাকা আর দেশি মুরগি ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংস কেজিতে ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা এবং খাসির মাংস ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারগুলোতে প্রতিকেজি কাঁকরোল ৬০ থেকে ৭০ টাকা, চিচিঙ্গা, ঝিঙে, ঢেঁড়স ও পটোলের কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা। কাঁচা মরিচ দাম কিছুটা কমে ৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা কলার হালি ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে শীতের আবহ থাকায় লেবুর দাম নাগালের মধ্যে রয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ক্রেতারা বিরক্ত। যাত্রাবাড়ী বাজারে কথা হয় ক্রেতা হালিম রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আজ যে দামে কিছু কিনছি, কোনো কারণ ছাড়াই কাল সেটা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে প্রতিনিয়ত সবকিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু আয় তো বাড়ছে না। বাজার মনিটরিং না থাকায় ক্রেতাসাধারণ বিপাকে পড়েছেন। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন