উদাস দুপুর

মো. ইয়াকুব আলী :

এক. দুপুর সময়টা বড় অদ্ভুত। এই সময়টাতে সবকিছুতেই কেমন জানি স্থবিরতা দেখা যায়। ওয়ার্কিং ডে তে দুপুর দেখার সেভাবে সুযোগ হয় না কারণ নাগরিক জীবনে সকাল, দুপুর, বিকেল সবই একই রকম। মানুষ অলটাইম দৌড়ের ওপর থাকে। তাই আজ বুদ্ধি করে দুপুরের সঙ্গে কথা বলতে বসেছি।

 

আমি যেখানটিতে বসে আছি সেখান থেকে সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত আকাশ দেখা যায়। একেবারে দূরে যেখানে আকাশ আর মাটির মিতালি হয়েছে সেখানটা দেখতে অসম্ভব রকমের সুন্দর। খালি চোখে দেখে মনে হয় কোনো এক শিল্পী তার নিপুণ তুলির আঁচড়ে মাটির অংশটাকে কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু আকার দিয়েছেন।

সামনের রাস্তাটা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ দু’একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে শো শো শব্দে। অন্যান্য সময় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি থাকে কিন্তু দুপুর বলেই হয়তোবা রাস্তায় মানুষের চলাচল কমে এসেছে।

প্রকৃতিও অনেকটা স্থবির। আকাশে পাখিদের উড়াউড়ি নেই। একটা অচেনা পাখি অনেকক্ষণ ধরেই টুইট টুইট শব্দে ডেকে চলেছে কাছের কোন গাছের ডালে। বাসার সামনের খোলা জায়গায় এক জোড়া কবুতর আর একটা ঘুঘু খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত পাঁয়চারি করছে।

 

পাশেই কয়েকটা শালিক একটু থেকে থেকে ডাকছে। সূর্যটা সরাসরি আমার চোখ বরাবর উঠে আছে তাই সামনে তাকাতে হলে হাত দিয়ে চোখের সামনে আড়াল করে তাকাতে হচ্ছে। একটু পরপর মৃদু অথচ শীতল বাতাস গা টা জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সেইসাথে ঘাসেদের মধ্যে একটু দোল দিয়ে যাচ্ছে। বাতাসের দোল খেয়ে তারা আনন্দে নৃত্য শুরু করে দিচ্ছে।

অনেকক্ষণ ধরে একটা মাছি আমার আশপাশে ভনভন করছে খাবারের আশায়। দূরে একটা ঘুঘুর অবিরাম ডেকে চলার শব্দও কানে আসছে। আমি যেহেতু জানালার চোকাঠে বসে আছি যেটা লাল ইটের তৈরি তাই সূর্যের তাপের তেজটা টের পাচ্ছি। বাচ্চা দুটোকে খাইয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভাত ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি আজ দুপুরটা উপভোগ করবো বলে।

এই দুপুর অনেক কথায় মনে করিয়ে দিচ্ছে। সারিসারি ধানক্ষেত। বাতাসে ধানের কচি সবুজ পাতা নেচে বেড়াচ্ছে মাঠময়। নিড়ানি দেওয়া শুরু হয়েছে। আমার দায়িত্ব যারা ক্ষেতে কাজ করছে তাদের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যাওয়া। আমি ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চলেছি। মাথায় বড় গামলায় তাদের জন্য খাবার।

তার ওপরে যতজন মানুষ ততগুলো প্লেট রেখে সেটাকে পুরোনো লুঙ্গির পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আমি এক হাতে মাথার গামলাটা ধরে আছি যদিও মাথার ওপর গামছা পেচিয়ে সুন্দর একটা বেস তৈরি করে গামলাটা বসানো। আমার অন্যহাতে পানি ভর্তি টিনের জগ। ক্ষেতে পানির উৎস নেই। তাই আলাদাভাবে পানি নিয়ে যাওয়া হয়।

ক্ষেতে পৌঁছানোর পর ক্ষেতের পাশের বাবলা গাছের ছায়ায় সবাই মিলে একসাথে বসে খাওয়াটা উনারা সেরে নেন। আশপাশের ক্ষেত থেকেও তখন মানুষ এসে দুপুরের খাবার খান এবং তরকারি নিজেদের মধ্যে শেয়ার করেন। খাবার পর নিজ নিজ গামছা পেতে শুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেন। আর যারা নামাজ পড়েন তারা বালি দিয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে নেন।

নামাজ পড়া শেষ হলে আবার সবাই মিলে ক্ষেতে ফিরে যান। কেউ কেউ বিড়ি ধরান যেটা মাঝে মধ্যে খাবারের সঙ্গে আমাকেই আনতে হয় হাফপ্যান্টের পকেটে করে। আবার কেউ কেউ সুরেলা কণ্ঠে গান ধরেন। কোথাও কোনো তাড়া নেই। দুপুর সময়টায় আসলে অলস।

বাংলায় আমরা শুভ দুপুর বললেও ইংরেজিতে শুভ সকালের পর শুভ বিকাল থাকলেও শুভ দুপুর মানে ‘গুড নুন’ কাউকে এখনো বলতে শুনিনি। জানি না এর কারণ কি? তবে আমার মনেহয় নাগরিক ব্যস্ত জীবন দুপুরের এই স্থবিরতা মেনে নিতে নারাজ তাই হয়তো এমন সম্বোধন। কিন্তু আমার কাছে দুপুর সময়টা অসাধারণ। নিজেকে নিয়ে নিজের ভাবনার সময়।

মুহূর্তগুলো একান্তই নিজস্ব। চারদিকে কোনো ব্যস্ততা নেই। তখন মনে হয় দিনের পুরো সময়টাজুড়ে দুপুর হলেই হয়তোবা ভালো হতো। নাগরিক জীবন আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। জীবনের গতিময়তায় কখন সকাল, কখন বিকেল কখন সন্ধ্যা হয় তার কোনো ঠিক নেই। মুঠোফোনের দিনপঞ্জিতে পরবর্তীতে কয়েক বছরের পর্যন্ত কর্মসূচি ঠিক করা সেখানে দুপুরের মতো সেকেলে স্থবির মুহূর্তকে নিয়ে ভাবার অবসর কোথায়?

দুই. গরমের দিনে বাসার পেছনের বারান্দায় শান বাঁধানো মেঝেতে শুয়ে পড়লে শরীরে আরামবোধ হয়। এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে মনের মধ্যে। অনেকটা গাছের ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকার প্রশান্তির মতো। সামনেই খোলা আকাশ। নীল আকাশে সাদা মেঘেদের ভেলার অবিশ্রান্ত চলাচল। মাঝে মধ্যে একটা দুটো প্লেন বা রকেটও চলে যায় দুর দিয়ে।

শব্দ পাওয়া যায় না কিন্তু চেয়ে থাকলে বিন্দু আকৃতির প্লেন বা রকেটের দেখা মেলে। প্রতিবেশীদের বাসায় একটা তাল সদৃশ গাছ লাগানো। সেটা বেড়া পার করে আকাশ ছোঁয়ার আশায় উঁকি দিচ্ছে। দুপুরের দিকভ্রান্ত বাতাসে তার পাখা ঝাপটানোর শব্দ। একটা ঘুঘুর ডাকও শুনলাম তারপর হঠাৎ নিঃশব্দ।

আর আছে শালিকের কিচিরমিচির। হঠাৎ দুরে কুকুরের পরিচিত ঘেউ ঘেউ। কুকুরের সঙ্গে আমার জন্ম জন্মান্তরের বন্ধুত্ব। সেই শৈশবের খেলার সাথী থেকে শুরু করে সিডনির বিভিন্ন আকৃতির শিকারি কুকুর সবাই কেন জানি দ্রুতই আমাকে আপন করে নেয়।

দূরে কোনো গাছে নাম না জানা কোন একটা পাখির ছানা অবিরাম কিচকিচ শব্দ করে ডেকে চলেছে। হয়তোবা মা পাখির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। কখন মা পাখি খাবার অথবা পানি নিয়ে ফিরে আসবে। দিনে দিনে রোদের তেজ বেড়ে যাচ্ছে। বাতাসে একটা দাঁড় কাকের শ্রান্ত কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। সাথে আরও বেশকিছু নাম না জানা পাখির কলকাকলি।

ফুলের গাছগুলো রোদের তাপে নুয়ে পরেছে আর দিকভ্রান্ত বাতাসে এদিক সেদিক দোল খাচ্ছে। চারদিকে বসন্ত কালের পরিবেশ। পথে পথে জ্যাকারান্ডার সারি ক্লান্ত পথিককে বেগুনি শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। আচ্ছা দুঃখের রং কি নীল না বেগুনি? হঠাৎ হঠাৎ দু একটা কুড়াজং গাছের দেখা মিলে। গাছগুলো দেখলে মনে হয় তাদের শরীরে কেউ যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। দুপুরের দিকভ্রান্ত বাতাসে তারাও দোল খাচ্ছে।

l
অস্ট্রেলিয়ার বসন্তের অন্যতম ফুল কুরাজং

দুপুর সময়টা বড় অদ্ভুত। প্রকৃতিও হয়তোবা কিছুক্ষণের জন্য তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তাইতো দিকভ্রান্ত বাতাসের আনাগোনা। এই বাতাস কখনো এদিক আবার পরমুহূর্তেই অন্য দিকে প্রবাহিত হয়। আচ্ছা মানুষের মনও কি তখন কিছুটা দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। হঠাৎ করে তার মনেপড়ে যায় পুরনো কোন স্মৃতি অথবা মনের আয়নায় ভেসে উঠে কোন প্রিয়জনের মুখ।

এই ভাবনা ভাবতেই শীতল দিকভ্রান্ত বাতাসের কোমল স্পর্শে গা এলিয়ে আসে। চোখ দুটোও বুজে যায় নিজের অজান্তেই। হঠাৎ শুনতে পাই বাবলা গাছের ছায়ায় বসে কোন এক রাখাল তার বাশিতে সুর তুলেছেন-

‘প্রাণ সখিরে,
বাবলা বনের ধারে ধারে বাঁশি বাজায় কে
বাঁশি বাজায় কে রে সখি বাঁশি বাজায় কে
মন দিয়াছি প্রাণ দিয়াছি ভালোবাসি তারে আমি’

এর মধ্যেই হঠাৎ গায়ে ধাক্কা, ‘বাবা বাবা উঠো। বাজার করতে যেতে হবে।’ দুপুরের দিকভ্রান্ত বাতাস ঠিকই আমার মনের কথা বুঝে আমাকে আমার সবচেয়ে সুন্দর সময়ে নিয়ে গিয়েছিল ক্ষণিকের তরে কিন্তু নাগরিক ব্যস্ততা আবার ঠিকই আমাকে রুঢ় বাস্তবতার কাছে ফিরিয়ে এনেছে।

আনুক, ক্ষতি নেই। আবার কোন এক দুপুরে আবার ফিরে যাওয়া যাবে সেই সুদূর অতীতের কাছে। যেখানে দুপুরের রোদে বাবলা গাছের তলায় একদল কিশোর গামছা পেতে শুয়ে আড্ডা দেয় আর হঠাৎ হঠাৎ সুর তোলে রাশিতে।সূএ:জাগোনিউজ২৪.কম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» জনগণ প্রত্যাশা মতো গণমাধ্যমের সহায়তা পাচ্ছি না: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা

» ওমরা করার উত্তম সময় কোনটি

» মোবাইল ফোন চার্জ দিতে কত টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়?

» টি-টেন লিগে ফের ফিক্সিংয়ের গুঞ্জন!

» উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ-প্রধানমন্ত্রীসহ বিএনপির ৬২ প্রস্তাবনা

» শেখ হাসিনাসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে হেফাজতের অভিযোগ

» সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে দুই পক্ষের সংঘর্ষে যুবদল কর্মী খুন

» চিন্ময় কৃষ্ণকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে হস্তান্তর

» ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশার ৫ যাত্রী নিহত

» চশমার যত্ন

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

উদাস দুপুর

মো. ইয়াকুব আলী :

এক. দুপুর সময়টা বড় অদ্ভুত। এই সময়টাতে সবকিছুতেই কেমন জানি স্থবিরতা দেখা যায়। ওয়ার্কিং ডে তে দুপুর দেখার সেভাবে সুযোগ হয় না কারণ নাগরিক জীবনে সকাল, দুপুর, বিকেল সবই একই রকম। মানুষ অলটাইম দৌড়ের ওপর থাকে। তাই আজ বুদ্ধি করে দুপুরের সঙ্গে কথা বলতে বসেছি।

 

আমি যেখানটিতে বসে আছি সেখান থেকে সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত আকাশ দেখা যায়। একেবারে দূরে যেখানে আকাশ আর মাটির মিতালি হয়েছে সেখানটা দেখতে অসম্ভব রকমের সুন্দর। খালি চোখে দেখে মনে হয় কোনো এক শিল্পী তার নিপুণ তুলির আঁচড়ে মাটির অংশটাকে কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু আকার দিয়েছেন।

সামনের রাস্তাটা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ দু’একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে শো শো শব্দে। অন্যান্য সময় গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি থাকে কিন্তু দুপুর বলেই হয়তোবা রাস্তায় মানুষের চলাচল কমে এসেছে।

প্রকৃতিও অনেকটা স্থবির। আকাশে পাখিদের উড়াউড়ি নেই। একটা অচেনা পাখি অনেকক্ষণ ধরেই টুইট টুইট শব্দে ডেকে চলেছে কাছের কোন গাছের ডালে। বাসার সামনের খোলা জায়গায় এক জোড়া কবুতর আর একটা ঘুঘু খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত পাঁয়চারি করছে।

 

পাশেই কয়েকটা শালিক একটু থেকে থেকে ডাকছে। সূর্যটা সরাসরি আমার চোখ বরাবর উঠে আছে তাই সামনে তাকাতে হলে হাত দিয়ে চোখের সামনে আড়াল করে তাকাতে হচ্ছে। একটু পরপর মৃদু অথচ শীতল বাতাস গা টা জুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সেইসাথে ঘাসেদের মধ্যে একটু দোল দিয়ে যাচ্ছে। বাতাসের দোল খেয়ে তারা আনন্দে নৃত্য শুরু করে দিচ্ছে।

অনেকক্ষণ ধরে একটা মাছি আমার আশপাশে ভনভন করছে খাবারের আশায়। দূরে একটা ঘুঘুর অবিরাম ডেকে চলার শব্দও কানে আসছে। আমি যেহেতু জানালার চোকাঠে বসে আছি যেটা লাল ইটের তৈরি তাই সূর্যের তাপের তেজটা টের পাচ্ছি। বাচ্চা দুটোকে খাইয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভাত ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি আজ দুপুরটা উপভোগ করবো বলে।

এই দুপুর অনেক কথায় মনে করিয়ে দিচ্ছে। সারিসারি ধানক্ষেত। বাতাসে ধানের কচি সবুজ পাতা নেচে বেড়াচ্ছে মাঠময়। নিড়ানি দেওয়া শুরু হয়েছে। আমার দায়িত্ব যারা ক্ষেতে কাজ করছে তাদের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে যাওয়া। আমি ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চলেছি। মাথায় বড় গামলায় তাদের জন্য খাবার।

তার ওপরে যতজন মানুষ ততগুলো প্লেট রেখে সেটাকে পুরোনো লুঙ্গির পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আমি এক হাতে মাথার গামলাটা ধরে আছি যদিও মাথার ওপর গামছা পেচিয়ে সুন্দর একটা বেস তৈরি করে গামলাটা বসানো। আমার অন্যহাতে পানি ভর্তি টিনের জগ। ক্ষেতে পানির উৎস নেই। তাই আলাদাভাবে পানি নিয়ে যাওয়া হয়।

ক্ষেতে পৌঁছানোর পর ক্ষেতের পাশের বাবলা গাছের ছায়ায় সবাই মিলে একসাথে বসে খাওয়াটা উনারা সেরে নেন। আশপাশের ক্ষেত থেকেও তখন মানুষ এসে দুপুরের খাবার খান এবং তরকারি নিজেদের মধ্যে শেয়ার করেন। খাবার পর নিজ নিজ গামছা পেতে শুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেন। আর যারা নামাজ পড়েন তারা বালি দিয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে নেন।

নামাজ পড়া শেষ হলে আবার সবাই মিলে ক্ষেতে ফিরে যান। কেউ কেউ বিড়ি ধরান যেটা মাঝে মধ্যে খাবারের সঙ্গে আমাকেই আনতে হয় হাফপ্যান্টের পকেটে করে। আবার কেউ কেউ সুরেলা কণ্ঠে গান ধরেন। কোথাও কোনো তাড়া নেই। দুপুর সময়টায় আসলে অলস।

বাংলায় আমরা শুভ দুপুর বললেও ইংরেজিতে শুভ সকালের পর শুভ বিকাল থাকলেও শুভ দুপুর মানে ‘গুড নুন’ কাউকে এখনো বলতে শুনিনি। জানি না এর কারণ কি? তবে আমার মনেহয় নাগরিক ব্যস্ত জীবন দুপুরের এই স্থবিরতা মেনে নিতে নারাজ তাই হয়তো এমন সম্বোধন। কিন্তু আমার কাছে দুপুর সময়টা অসাধারণ। নিজেকে নিয়ে নিজের ভাবনার সময়।

মুহূর্তগুলো একান্তই নিজস্ব। চারদিকে কোনো ব্যস্ততা নেই। তখন মনে হয় দিনের পুরো সময়টাজুড়ে দুপুর হলেই হয়তোবা ভালো হতো। নাগরিক জীবন আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। জীবনের গতিময়তায় কখন সকাল, কখন বিকেল কখন সন্ধ্যা হয় তার কোনো ঠিক নেই। মুঠোফোনের দিনপঞ্জিতে পরবর্তীতে কয়েক বছরের পর্যন্ত কর্মসূচি ঠিক করা সেখানে দুপুরের মতো সেকেলে স্থবির মুহূর্তকে নিয়ে ভাবার অবসর কোথায়?

দুই. গরমের দিনে বাসার পেছনের বারান্দায় শান বাঁধানো মেঝেতে শুয়ে পড়লে শরীরে আরামবোধ হয়। এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে মনের মধ্যে। অনেকটা গাছের ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকার প্রশান্তির মতো। সামনেই খোলা আকাশ। নীল আকাশে সাদা মেঘেদের ভেলার অবিশ্রান্ত চলাচল। মাঝে মধ্যে একটা দুটো প্লেন বা রকেটও চলে যায় দুর দিয়ে।

শব্দ পাওয়া যায় না কিন্তু চেয়ে থাকলে বিন্দু আকৃতির প্লেন বা রকেটের দেখা মেলে। প্রতিবেশীদের বাসায় একটা তাল সদৃশ গাছ লাগানো। সেটা বেড়া পার করে আকাশ ছোঁয়ার আশায় উঁকি দিচ্ছে। দুপুরের দিকভ্রান্ত বাতাসে তার পাখা ঝাপটানোর শব্দ। একটা ঘুঘুর ডাকও শুনলাম তারপর হঠাৎ নিঃশব্দ।

আর আছে শালিকের কিচিরমিচির। হঠাৎ দুরে কুকুরের পরিচিত ঘেউ ঘেউ। কুকুরের সঙ্গে আমার জন্ম জন্মান্তরের বন্ধুত্ব। সেই শৈশবের খেলার সাথী থেকে শুরু করে সিডনির বিভিন্ন আকৃতির শিকারি কুকুর সবাই কেন জানি দ্রুতই আমাকে আপন করে নেয়।

দূরে কোনো গাছে নাম না জানা কোন একটা পাখির ছানা অবিরাম কিচকিচ শব্দ করে ডেকে চলেছে। হয়তোবা মা পাখির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। কখন মা পাখি খাবার অথবা পানি নিয়ে ফিরে আসবে। দিনে দিনে রোদের তেজ বেড়ে যাচ্ছে। বাতাসে একটা দাঁড় কাকের শ্রান্ত কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। সাথে আরও বেশকিছু নাম না জানা পাখির কলকাকলি।

ফুলের গাছগুলো রোদের তাপে নুয়ে পরেছে আর দিকভ্রান্ত বাতাসে এদিক সেদিক দোল খাচ্ছে। চারদিকে বসন্ত কালের পরিবেশ। পথে পথে জ্যাকারান্ডার সারি ক্লান্ত পথিককে বেগুনি শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। আচ্ছা দুঃখের রং কি নীল না বেগুনি? হঠাৎ হঠাৎ দু একটা কুড়াজং গাছের দেখা মিলে। গাছগুলো দেখলে মনে হয় তাদের শরীরে কেউ যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। দুপুরের দিকভ্রান্ত বাতাসে তারাও দোল খাচ্ছে।

l
অস্ট্রেলিয়ার বসন্তের অন্যতম ফুল কুরাজং

দুপুর সময়টা বড় অদ্ভুত। প্রকৃতিও হয়তোবা কিছুক্ষণের জন্য তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তাইতো দিকভ্রান্ত বাতাসের আনাগোনা। এই বাতাস কখনো এদিক আবার পরমুহূর্তেই অন্য দিকে প্রবাহিত হয়। আচ্ছা মানুষের মনও কি তখন কিছুটা দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। হঠাৎ করে তার মনেপড়ে যায় পুরনো কোন স্মৃতি অথবা মনের আয়নায় ভেসে উঠে কোন প্রিয়জনের মুখ।

এই ভাবনা ভাবতেই শীতল দিকভ্রান্ত বাতাসের কোমল স্পর্শে গা এলিয়ে আসে। চোখ দুটোও বুজে যায় নিজের অজান্তেই। হঠাৎ শুনতে পাই বাবলা গাছের ছায়ায় বসে কোন এক রাখাল তার বাশিতে সুর তুলেছেন-

‘প্রাণ সখিরে,
বাবলা বনের ধারে ধারে বাঁশি বাজায় কে
বাঁশি বাজায় কে রে সখি বাঁশি বাজায় কে
মন দিয়াছি প্রাণ দিয়াছি ভালোবাসি তারে আমি’

এর মধ্যেই হঠাৎ গায়ে ধাক্কা, ‘বাবা বাবা উঠো। বাজার করতে যেতে হবে।’ দুপুরের দিকভ্রান্ত বাতাস ঠিকই আমার মনের কথা বুঝে আমাকে আমার সবচেয়ে সুন্দর সময়ে নিয়ে গিয়েছিল ক্ষণিকের তরে কিন্তু নাগরিক ব্যস্ততা আবার ঠিকই আমাকে রুঢ় বাস্তবতার কাছে ফিরিয়ে এনেছে।

আনুক, ক্ষতি নেই। আবার কোন এক দুপুরে আবার ফিরে যাওয়া যাবে সেই সুদূর অতীতের কাছে। যেখানে দুপুরের রোদে বাবলা গাছের তলায় একদল কিশোর গামছা পেতে শুয়ে আড্ডা দেয় আর হঠাৎ হঠাৎ সুর তোলে রাশিতে।সূএ:জাগোনিউজ২৪.কম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com