সৈয়দ বোরহান কবীর : হঠাৎ আপনার মনে হতে পারে, আপনি এখন কোন সময়ে? টাইম মেশিন কি আপনাকে ২০০৩ সালে নিয়ে গেল? কিংবা ২০০৫ অথবা ২০০৬ সালে? লাগামহীন লোডশেডিং। ডলার সংকট। জ্বালানি সংকটে শিল্পকারখানা মুখ থুবড়ে পড়ছে। পণ্যবাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির দুর্নীতির তান্ডব। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা মানুষ। এরকম একটি পরিস্থিতি পার করে এসেছি আমরা দেড় যুগ আগে। এরপর এক ঘুরে দাঁড়ানোর বাংলাদেশের গল্প। শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের এগিয়ে চলা সারা বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন রূপকথাকেও হার মানিয়েছে। উন্নয়ন মানে শুধু সেতু, কালভার্ট, রাস্তাঘাট আর বড় বড় অট্টালিকা নয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে বহুমাত্রিক। গ্রাম থেকে শহর। সর্বত্র বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উন্নয়নের কী বিপুল বৈচিত্র্য। আশ্রয়ণ। কমিউনিটি ক্লিনিক। কৃষিবিপ্লব। ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের জাগরণ। গ্রামগঞ্জে তারুণ্যের স্বাবলম্বী হওয়ার উৎসব। নানা খামারে শিক্ষিত তরুণদের সৃষ্টিসুখের উল্লাস। কর্মসংস্থানে নারীজাগরণের সাফল্য। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। উন্নয়নের কী অপূর্ব মূর্ছনা। রংধনুর সাত রঙের মতো বৈচিত্র্যময় গত এক যুগের উন্নয়ন। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি। সব ক্ষেত্রে এমন ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন বিশ্বের খুব কম দেশেই হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নগুলো একটি আরেকটির পরিপূরক এবং সহায়ক। তথ্যপ্রযুক্তি কৃষিকে দিয়েছে শক্তি। যোগাযোগ রপ্তানি বাণিজ্যে গতি বাড়িয়েছে। এভাবেই উন্নয়নের গন্তব্য প্রতিটি শাখা-প্রশাখা বিকশিত হয়েছে গত এক দশকে। এসব উন্নয়নের গন্তব্য হলো বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণ। সেই স্বপ্নযাত্রার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ উদযাপন করে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। দারিদ্র্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ঘটে বাংলাদেশের। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটে প্রিয় মাতৃভূমির। ’৭১-এর তলাবিহীন ঝুড়ি ঠিক ৫০ বছর পর বিশ্বে সাফল্যের রোল মডেলে পরিণত হয়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ব্যর্থতা, অনুজ্জ্বল, করুণার পাত্র বাংলাদেশ মাত্র এক যুগে বিশ্বে দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখা শেখে। ‘অসম্ভব’কে হাতের মুঠোয় আনা রপ্ত করে। আর এ অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার রূপকার একজনই- শেখ হাসিনা। এ অর্জন এসেছে একজন মানুষের চিন্তা, দর্শন, নীতিনিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার কারণেই। তিনি হলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বাঙালি জাতির ইতিহাস হলো ট্র্যাজেডিপূর্ণ। একটি অর্জনের তৃপ্তি উপভোগ করার আগেই আরেকটি ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হয় বাঙালি জাতি। এ জাতি যখনই একটু ভালো থাকে, তখনই সর্বনাশের ঝড় সব লন্ডভন্ড করে দেয়। আবার সেই অশুভ মেঘের ঘনঘটা। এর প্রধান কারণ বৈশ্বিক পরিস্থিতি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কিন্তু এর পাশাপাশি কিছু অর্বাচীন আবর্জনার ব্যর্থতাও কম দায়ী নয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে সুবিধাবাদী চাটুকার চক্র ক্ষমতার কেন্দ্রে ভিড়তে থাকে। আস্তে আস্তে অযোগ্য, অর্বাচীনরা দন্ডমুন্ডের কর্তা বনে যান। জীবনে আন্দোলন করেননি। দলের জন্য ন্যূনতম অবদান নেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শচর্চার বালাই নেই- এমন কিছু ব্যক্তি আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি হয়ে গেছেন। এরা এসব উন্নয়নের অর্থ বোঝেন না। এরা আওয়ামী লীগের ত্যাগের ইতিহাস জানেন না। এরা শুধু জানেন নিজের আখের গোছাতে। এদের কারণে ১৩ বছরের সব অর্জন এখন ম্লান হতে বসেছে। এদের প্রধান কাজ হলো দুর্নীতি, লুটপাট এবং জনগণকে খেপিয়ে তোলা। এই যেমন রবিবার (২৩ অক্টোবর) একটি অনুষ্ঠানে হাজির হন এ দেশের অন্যতম ভাগ্যবান ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত ‘শিল্পে জ্বালানি সংকট সমাধান শীর্ষক’ আলোচনা অনুষ্ঠানে ভুক্তভোগী শিল্পোদ্যোক্তারা তাঁকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কিছুটা আশার বাণী শোনার আশায়। এ সংকটে সরকার পাশে আছে এরকম কিছু উপদেষ্টা বলবেন, এ প্রত্যাশায়। কোথায় আশ্বাস, কোথায় পাশে থাকার অঙ্গীকার – উপদেষ্টা জানিয়ে দিলেন, ‘বিদ্যুৎ ব্যবহারে আমাদের সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। আমাদের রিজার্ভ অনেক কমে গেছে। আমাদের হাতে টাকা নেই। সামনে কী হবে এখনই বলা যাচ্ছে না।’ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলতে পারেন! তৌফিক-ই-ইলাহী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাঁকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতকে আজকে এ ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যতম দায়ী ব্যক্তি হলেন তিনি। তাঁর প্রতিটি পরিকল্পনা এবং চিন্তাভাবনার মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ বা লালসা আছে কি না সে প্রসঙ্গে আমি যাব না। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে কিছু মৌলিক প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া বাবদ এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার দায় জনগণ কেন নেবে? আবার এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনেকটিরই উৎপাদন সক্ষমতা পর্যন্ত নেই। ওপেক, ওপেক প্লাস দেশগুলো থেকে তেল ও গ্যাস কেনার বড় ও স্থায়ী সরবরাহ চুক্তি নেই কেন? মোট আমদানির ৫০ শতাংশ স্পট মার্কেট থেকে কেনার কমিশন-বান্ধব সিদ্ধান্তটি কার স্বার্থে? কাতার ও ওমানের মতো দেশ বড় গ্যাস সরবরাহ চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তখন সরকার তা গ্রহণ করেনি। অথচ এখন ওই দুটি দেশ থেকে গ্যাস পেতে কূটনৈতিক চ্যানেলে আবেদন করেছে। কিন্তু ইতোমধ্যে তারা ইউরোপে গ্যাস বিক্রি শুরু করেছে। এর দায় কার?
অবশ্য জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্যের পরদিনই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত। এরকম কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেয়নি।’ তাতে কী? বাংলাদেশ এখন সব সম্ভবের দেশ। এই উপদেষ্টাই জুনে বলেছিলেন, ‘সামনে লোডশেডিং করতে হবে।’ ১৯ জুলাই সরকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করে। অবশ্য এর কয়েক দিন আগেই ঢাকার বাইরে লোডশেডিং শুরু হয়। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বললেন, লোডশেডিং হবে দিনে। এক ঘণ্টা। এখন ঢাকা শহরেই পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং হয়। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বললেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যে লোডশেডিং কমে আসবে। অক্টোবরে বললেন, শীতের আগে বিদ্যুৎ সংকট কমার সম্ভাবনা নেই। আল্লাহ ভরসা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে প্রকাশ্য দিবালোকে বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল শিশু নওরীন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে সময় বলেছিলেন, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন।’ এখন আমাদের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন প্রকৃতির ওপর!
’৭৫-এর যে পরিবারগুলো সর্বস্ব হারিয়েছে, যে তরুণ-কিশোররা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য যৌবন উৎসর্গ করেছেন, ১৯৮২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যাঁরা রাজপথে লড়াই করেছেন, মেধা-মননের চর্চা করেছেন, ১৯৯১ থেকে যাঁরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন জীবন বাজি রেখে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের দানবীয় তান্ডবে যাঁরা বুক পেতে রুখে দাঁড়িয়েছেন, এক-এগারোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যাঁরা দল ও নেতার আদর্শের প্রশ্নে অটল ছিলেন, যাঁরা জনগণকে ভালোবাসেন, জনগণের জন্যই যাঁদের ধ্যানজ্ঞান এমন ত্যাগী, আদর্শবান নেতার সংখ্যা আওয়ামী লীগে অনেক। এঁরা নিভৃতে কাঁদেন। দেয়ালে মাথা কুটে হাহাকার করেন। এঁরা অপেক্ষায় আছেন। এখনো এই ত্যাগী-পরীক্ষিত কর্মীরা আশা করেন শেখ হাসিনা এসব আগাছা বিদায় করবেন। অর্বাচীনদের সরিয়ে দেবেন। যোগ্যদের সামনে আনার এখনই সময়। এখন আসল খেলা। মাঠে ‘এ’ টিম নামাতেই হবে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
[email protected] সূূএ :বাংলাদেশ প্রতিদিন