সাদিয়া হোসেন মাধুরী :
স্নিগ্ধর আজ অনেক সকাল সকালই ঘুম ভেঙে যায়। সাধারণত নয়টার আগে তার ঘুম ভাঙে না। এখন বাজে ছয়টা। অনিকার সাথে প্রায়ই ঝগড়া হয় দেরিতে ওঠা নিয়ে। অনিকার ঘুম ভাঙে ফজর ওয়াক্তে। তারপর হাঁটতে বের হয় বাবা সিরাজ শিকদারের সাথে। বাবা যেদিন সাথে না যান, সেদিন স্নিগ্ধকে অনুরোধ করে।
স্নিগ্ধ হাজার বার প্রতিজ্ঞা করেও কোনোদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। ভাবে, আজকে নিশ্চয়ই অনিকা অনেক খুশি হবে। অনিকার এতদিনের আশা পূর্ণ হবে।
স্নিগ্ধ অনিকাকে নিয়ে কেন ভাবছে। অনিকা তো এখন আর তার নেই। স্নিগ্ধর মনে পড়ে অনিকার বিয়ে হয়ে গেছে গতকাল রাতে। অনিকা এখন অন্য লোকের স্ত্রী। স্নিগ্ধ একটু গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। ভাবে, ধুর এসব ভেবে এখন লাভ নেই। ৮ বছরের ভালোবাসার সম্পর্কের ইতি টেনে যেই মেয়ে অন্য একজনের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারে, তাকে আর মনে করতে চায় না স্নিগ্ধ। রাত গেই বাত গেই এর মতো অনিকার চ্যাপ্টারও শেষ।
অনিকার বিয়ে কাল রাতে বেশ আয়োজন করেই হয়েছে। আর স্নিগ্ধ দুইটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়েছিল। ঘুমের ট্যাবলেটের কারণেই কিনা মাথাটা এখন অনেক ফ্রেশ লাগছে স্নিগ্ধের। ফ্রেশ হতে বেসিনের কাছে যায়। সব ভুলতে চায় স্নিগ্ধ। অনিকাকেও। কিন্তু ঘরের প্রতিটি কোণেই অনিকার সাথে কাটানো তার সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি আছে।
বেসিনের দেওয়ালের ওয়াল স্টিকারগুলোর দিকে নজর পড়তেই বুকটা হু-হু করে ওঠে স্নিগ্ধের। পাঁচটা বাটারফ্লাই। যেন স্বর্গ থেকে এসেছে। অনিকার পছন্দের বরাবরই তারিফ করে স্নিগ্ধ। মেয়েটার কাছে দুনিয়ার যতো আনকমন জিনিসের কালেকশন।
স্নিগ্ধর রুমের ডেকোরেশনও অনিকাই করেছিল নিজ হাতে। অনিকার হাতে একে দেওয়া বসার ঘরের পেইন্টিংগুলো চমৎকার লাগে স্নিগ্ধের। ভালো আঁকতে পারে মেয়েটা। হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরে যায় স্নিগ্ধ। দেওয়ালজুড়ে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো তার আর অনিকার বেশ কিছু সুন্দর মুহূর্তের ছবি। স্নিগ্ধ ভাবে, আজকের সকালটা একেবারেই অন্যরকম। পুরো ঘরে একটা শান্তি বিরাজ করছে। এ শান্তির মানে সে বোঝে না। বোঝে না সে কি স্বপ্নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে নাকি।
বাবা-মা মারা গেল বহুদিন হলো। কিন্তু কোনোদিন এমন সকাল আসেনি জীবনে। স্নিগ্ধ রেডি হতে রুমে প্রবেশ করে। আলমারি খুলে অবাক বনে যায়। এই লাইট ব্লু শার্টটা কে রেখে গেল তার আলমারিতে। একদম হালকা একটা আকাশি রং। একদমই নতুন। অনেকদিন হয়ে গেল ভালো শার্ট কেনা হয় না। কোচিং সেন্টারটা আর আর্ট ক্লাস মিলিয়ে কোনোরকম চলে। এত কিছু কেনার সময় কই। দাদার এই বাড়িটাই আছে থাকার মধ্যে।
তাহলে কি অনিকা? না, অনিকার তো বিয়ে হয়ে গেছে গতকাল। সে আসবে কোথা থেকে। শার্ট আর ম্যাচিং ব্লু জিন্স পরে ড্রেসিং টেবিলের কাছে আসতেই আরও অবাক হয়, একটা দামি পারফিউমের বোতল দেখে। বারবেরি, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। এগুলো কি অনিকার কাজ? ভাবে স্নিগ্ধ। তড়িঘড়ি করে বাইরে আসে। এসেই দেখে অনিকা বাইরে সিঁড়িতে বসে আছে।
আনিকা তুমি? শ্বশুরবাড়ি যাওনি?
উফ, আনিকা না, অনিকা।
হ্যাঁ বুঝেছি, তোমার আব্বা শখ করে আকারটা বাদ দিয়েছিলেন। তা শ্বশুরবাড়ি যাওনি?
শ্বশুরবাড়িতেই এসেছি।
মানে?
তোমার কি মনে হয় স্নিগ্ধ, আমার বিয়ে হয়ে গেছে?
তাই তো হওয়ার কথা।
হা হা। বাবা ওদের সাথে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা দেয়নি আমার। ছেলের ভেতর কিছু ঝামেলা আছে। বিয়ে ক্যান্সেল। বাবা বললেন, যা স্নিগ্ধর কাছে যা।
এটা বলেছে সত্যি। স্নিগ্ধর বিশ্বাস হতে চায় না। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মানুষের মন বদলাতে কতক্ষণ। চলো এখন, আমাকে সাইকেলে চড়িয়ে পুরো শহর ঘোরাবে।
মানে।
মানে তোমার মাথা, বোকা ছেলে। কেউ কিছু বলবে না স্নিগ্ধ। আজ তোমার সাইকেলে চড়লেও না। চলো তো।
স্নিগ্ধ একটু ঠাট্টার হাসি হেসে বলে, আজকে কোনো বিশেষ দিন নাকি?
এত কথা বলছো কেন? চলোই না।
বের হতে হতে স্নিগ্ধ লক্ষ্য করে, অসময়ে ডালিয়া ফুটেছে তার বাগানে। এই সিজনে ডালিয়া ফোটার কথা নয়। আশ্চর্য ব্যাপার-স্যাপার।
গ্লাডিওলাস ফুটেছে খুব সুন্দর। সাদা গোলাপ গাছটায় অনেকগুলো সাদা গোলাপ ধরেছে। আর সব কিছুতে একটা স্বর্গীয় ভাব।
সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে তারা। একদল ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে ইউনিফর্ম পরে। তাদের সবার মুখ হাসি হাসি। স্কুলে যাওয়া নিয়ে একটি বাচ্চার মধ্যেও কোনো অনীহা নেই। সবাই কি সুন্দর স্কুলে যাচ্ছে, হাসছে-খেলছে। লিটল কেয়ার স্কুলের রিতা ম্যাডাম ক্লাসে বাচ্চাদের হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেনের কিছু গল্প পড়ে শোনাচ্ছে।
পড়ানোর ফাঁকে একবার তাকিয়ে হাসিমুখে স্নিগ্ধ আর অনিকাকে ইশারা করে।
সাইকেল নিয়ে এগোতে এগোতে স্নিগ্ধ দেখে হাওয়াই মিঠাইওয়ালা জামির চাচা আজ আর বিষণ্ন মনে বসে নেই। ছেলে, বুড়ো, যুবক, যুবতি সবাই এই সাতসকালে কিনে হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে।
যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের থেকে মজার জিনিস পৃথিবীতে আর হয় না।
বস্তির ছেলেমেয়েগুলোও আজ সবাই নতুন নতুন জামা পড়েছে। ফাঁকা রাস্তায় সবাই দৌড়ে নেচে-গেয়ে বেরাচ্ছে। বস্তির বাড়িগুলো থেকে ভালো ভালো রান্নার সুবাস আসছে।
স্নিগ্ধ লক্ষ্য করে, আজ রাস্তাঘাটে কোন জ্যাম নেই। একটা অটোরিকশা, সিএনজি, রিকশা, গাড়ি কিছুই নেই। কারো কোনো তাড়া নেই, মেজাজের বালাই নেই। সবাই হাসিমুখে শান্তভাবে গল্প করতে করতে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে যাচ্ছে।
ট্রাফিক আহমেদ ভাইকে স্পষ্ট দেখছে, সে বাসায় শুয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে।
রাস্তাঘাট কী সুন্দর। কোথাও কোনো নোংরা নেই। জ্যাম, কালো ধোঁয়া নেই। সবাই হেঁটে যাচ্ছে, কেউ কেউ তাদের মতো সাইক্লিং করে যাচ্ছে।
রাস্তার দু’ধারে গাছগুলোয় কৃষ্ণচূড়া ধরেছে।
কী আশ্চর্য সুন্দর। এমন একটা দিনের জন্য স্নিগ্ধ কতদিন অপেক্ষা করেছে। যেদিন আসলেই কোনো জ্যাম থাকবে না রাস্তায়। পাড়ার রুমা আন্টি ওদের ডাকে। স্নিগ্ধ খুবই অবাক হয়, রুমা আন্টি কখনোই এমন ছিলেন না। বরং পাড়ায় কোনো ছেলেমেয়েকে একসাথে দেখলেই রুমা আন্টি সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বদনাম করতেন। কিন্তু রুমা আজিজ আজ অন্যরকম। তাদের দুজনকেই অনেকটা জোর করে নিজের বাসায় নিয়ে যান।
টেবিলজুড়ে অনেক ভালো ভালো নাস্তা দেখে অবাক হয় স্নিগ্ধ আর অনিকা।
ব্যাপার কি বলো তো? আন্টির আজ কী হলো?
আমিও বুঝতে পারছি না। অন্য সময় দেখলে বাঁকা চোখে দেখতেন। আজ ডেকে নিয়ে নাস্তা করাচ্ছেন।
স্নিগ্ধ অনিকা বসো তোমরা, নাস্তা করো। কত সুন্দর একটা সকাল আজ। বলেই রুমা আন্টি ভেতরে চলে যান।
স্নিগ্ধ লক্ষ্য করে, রুমা আন্টির ঘরেও একটা সুন্দর ঘ্রাণ। তাজা বেলি ফুলের। হচ্ছেটা কি?
অনিকা ততক্ষণে বসে পড়েছে। স্নিগ্ধ খাও।
খাওয়া শেষ করে স্নিগ্ধ সাইকেল চালিয়ে অনিকাদের বাসার সামনে আসে। অনিকার বাবা শিকদার সাহেব স্নিগ্ধকে দেখে কোনোদিনই হাসেন না। বরং চোখ-মুখ কঠিন করে রাখেন। কিন্তু আজ তার কাছে তার মেয়ের প্রেমিক এই আর্ট স্কুলের মাস্টার ছেলেটিকে ভালো লাগছে। যেন কোনো সুদর্শন গ্রিক দেবতা।
অনিকাদের বাসা ক্রস করে তারা আসে নিউ লাইফ বেকারিতে। বেকারিতেও আজ একটা অন্যরকম আমেজ। বেকারির মালিক জোসেফ আংকেল তাদের দু’জনকেই হাতের ইশারায় ডাকেন। ওরা কাছে যেতেই দুজনের হাতে দুটো আইসক্রিম ধরিয়ে দেন। ওরা টাকা দিতে চাইলেও নিতে রাজি হন না।
সাইকেল চলতে থাকে আপন গতিতে। স্নিগ্ধ এত সময় পর খেয়াল করে, জন লেননের ইমাজিন গানটা বাজছে এতক্ষণ ধরে। অনিকা শুনছো? জন লেনন। স্নিগ্ধের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে। আমরা আগে ক্লাস শেষ করে এসে নিউ লাইফ থেকে কেক, সুইসরোল, স্যান্ডউইচ কিনে সায়ানদের বাসার ছাদে বসে খেতাম আর জন লেননের গান শুনতাম।
আহ, কী দিন ছিল। এই চলো, সায়ানদের বাসায় যাওয়া যাক। মাত্র আটটা বাজে।
ওদের সাইকেল চলতে থাকে। চারপাশ থেকে মধুর সুরে বাজতে থাকে:
ইমেজিন দেয়ার’স নো হেভেন
ইট’স ইজি ইফ ইউ ট্রাই…
অনিকা শুনছো। শহরটাকে আজ একদম অন্যরকম লাগছে। যেন কাঠগোলাপের শহর।
হা হা হা। হেসে ফেলে অনিকা।
সেটা আবার কেমন?
কাঠগোলাপকে দেখলে কেমন লাগে, খুব শান্তি না?
একদম স্বচ্ছ একটা অনুভূতি, মন ভালো করে দেওয়ার মতো। স্বর্গীয় ভাব।
শহরটার অবস্থাও আজ একই রকম। একটা স্বর্গীয় ভাব, নেই কোনো দুঃখবোধ। ঠান্ডা হিমেল বাতাস এসে ছুঁয়ে যায় এই প্রেমিক-প্রেমিকাকে।
একসঙ্গে গাইতে থাকে তারা:
ইমেজিন দেয়ার’স নো কান্ট্রিস
ইট ইজন’ট হার্ড টু ডু…
মাথার কাছে একটা তীব্র শব্দে ঘুম ভাঙে স্নিগ্ধের। অ্যালার্ম ঘড়িটা সেই কখন থেকে ঘুম ভাঙাতে গলা ফাটিয়ে ডেকেই যাচ্ছে। ঘড়িটা বন্ধ করে আড়মোড়া ভেঙে ওঠে স্নিগ্ধ। ড্রেসিং টেবিলের কাছে এসে আয়নায় নিজেকে দেখে। মুখে দাড়িভর্তি। টেবিলে রাখা সাত বছর আগের পুরোনো একটি বারবেরির খালি বোতল। কিন্তু আজও সেই খালি বোতলের গায়ে স্নিগ্ধ একটি চিরপরিচিত ব্রিটিশ রোজের গন্ধ খুঁজে পায়।
বসার ঘরের পেইন্টিংগুলোর রং বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাইরের বাগানে কোনো ফুল নেই। বাগান না বলে এখন একে ঝোঁপঝাড়ই বলা চলে। অনেক দিন ধরে কেউ যত্ন নেয় না।
বাইরে ঝা ঝা রোদ। কোথায় সেই মধুর সকাল। বেলা ১২টা বাজে এখন। স্নিগ্ধ দুই দিনের বাসি মলিন শার্ট প্যান্টে বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশে।
শহরের শেষ মাথার পার্কটায় চলে আসে পুকুর পাড়ে কাঠগোলাপ গাছটার নিচে।
অনেক্ষণ চুপচাপ ঝিম মেরে বসে থাকে। গাছ থেকে একটা কাঠগোলাপ টুপ করে ঝরে তার কোলের ওপর পড়তেই সেটা তুলে নেয়।
অনিকার কথা ভাবে স্নিগ্ধ। হ্যাঁ অনিকা। বিয়ের তিনটা দিন আগেও ফোন দিয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছিল, তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। স্নিগ্ধ অনেক শক্ত থেকে বুঝিয়েছিল, মানুষের সীমাবদ্ধতা এখানেই। সে চাইলেই সবকিছু পায় না।
নতুন জীবনের শুভ কামনা জানিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিল।
স্নিগ্ধ তার সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পার করতে না পারলেও অনিকা ভেঙে চলে গিয়েছিল সব বাঁধন।
বিয়ের রাতেই সুইসাইড করেছিল। আর যাওয়ার আগে রেখে গিয়েছিল একটা চিরকুট।
‘শহরটা একদিন কাঠগোলাপের শহর হবে’
ফুলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতে শুরু করে স্নিগ্ধ-
ইউ মে সে আই’ম এ ড্রিমার
বাট আই’ম নট দ্য অনলি ওয়ান…
কোথায় সে সকাল! অনিকার মৃত্যুর সাত বছর হয়ে গেল আজ। স্নিগ্ধ ভাবে, কোনো একদিন শহরটা তার স্বপ্নের আর অনিকার চিরকুটের মতো কাঠগোলাপের শহর হবে। যেখানে আর কোনো সীমাবদ্ধতা থাকবে না। একটি অসুখী হৃদয় নিয়ে সুখী হওয়ার ভান করে বেঁচে থাকবে না আর কেউ। সেদিন হয়তো সত্যি প্রাণ ফিরে পাবে এ শহর।