ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির স্বরূপ

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.) : বার্টান্ড রাসেলের ‘দ্য কংকুয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ গ্রন্থের কিছু কথা দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করছি। রাসেল বলেছেন, জনমানুষের সন্তুষ্টি এবং স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন নিয়ে রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকা খুবই কঠিন কাজ। তার চেয়ে ধর্ম গেল, ধর্ম গেল স্লোগান দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত ও মাতিয়ে রেখে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকা অনেক সহজ। কারণ, মানুষ ধর্মের নামে যত তাড়াতাড়ি উত্তেজিত ও সংগঠিত হয়, অন্য কিছুতে তা হয় না। রাসেলের এই কথার প্রতিফলন পাকিস্তানি ২৩ বছরের শাসনামলে আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি, এখনো পাকিস্তান এই জায়গাতে আছে। আর পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিও এই রোগে আক্রান্ত। ভারত মানেই হিন্দু, আর হিন্দুরা মুসলমানের শত্রু, এই স্লোগানে মানুষকে মাতিয়ে রেখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। তার পরিণতিতে পাকিস্তান একবার দ্বিখন্ডিত হয়েছে, আরও খন্ডিত হওয়ার পথে যাচ্ছে, ব্যর্থ রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে এবং এ পর্যন্ত চারটি বড় যুদ্ধে ভারতের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। বাংলাদেশের এক বড় রাজনৈতিক পক্ষ ও তাদের সমর্থকরা ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে পাকিস্তানের মতো চরম ভারতবিদ্বেষী রাজনীতিতে মত্ত। ব্যর্থ, ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্ব, সাতচল্লিশের চেতনাই তাদের রাজনীতির মৌলিক অবলম্বন। কিন্তু যখন তারা ক্ষমতায় ছিল তখনকার কার্যকলাপ এবং বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আচরণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় তাদের ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির আসল স্বরূপ কেমন। সেটাই আজকের লেখার বিষয়। বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির বড় পক্ষ বিএনপি। তারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির কারণে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক সূত্রে তৈরি হওয়া আন্তরাষ্ট্রীয় সমস্যা; যেগুলো বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার একটি সমস্যার সমাধানও বিএনপি করতে পারেনি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বিএনপির আচরণ ত্রিমুখী। তাতে প্রথমত, কাজে ও রাজনৈতিক বক্তৃতায় ভারত বিদ্বেষের চরম বহিঃপ্রকাশ, দ্বিতীয়ত, ছদ্মবেশে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রক্সি হয়ে ভারতের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সমর্থন প্রদান, আবার কখনো কখনো ভারতের কাছে নতজানু হওয়া। এই ত্রিমুখী লাজলজ্জাহীন কিছু ঘটনার উল্লেখ করি। তার আগে দুই দেশের জন্য সম্পর্কের প্রেক্ষাপটের বিষয়টি একটু উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৭১-৭২ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথে গোড়াপত্তনের বীজ ও শেকড় হিসেবে কাজ করেছে দুই দেশের মৌলিক রাষ্ট্রীয়, আদর্শের মিল, যেটি বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে মৌলিক আদর্শের ওপর ১৯৪৭ সাল থেকে ভারত পরিচালিত হয়ে আসছে যার মূল বিষয় ছিল উদার গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী মিলে এই আদর্শকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন, যার ফলে দেখা যায় ১৯৭৬ সালে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে সংযোজিত হয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শের মিল থাকলে সাধারণত দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের পথ সহজ হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তান যদি উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেত তাহলে উপমহাদেশের ইতিহাস আজ ভিন্ন হতো। আদর্শ ছাড়াও ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকতার সূত্রে উভয় দেশের জন্য কতগুলো অপরিবর্তনীয় বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি করেছে, যেগুলো উপেক্ষা করা দুই দেশের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। উপেক্ষা করা মানেই বিদ্যমান সমস্যার সঙ্গে আরও নতুন সমস্যার তৈরি এবং সম্পর্কের অবনতি হওয়া। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মৌলিক আদর্শ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে হুবহু পাকিস্তানি আদর্শে ফিরে আসে এবং উল্লিখিত বাধ্যবাধকতাকেও জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ফলে যা হওয়ার সেটাই হয়েছে। বাংলাদেশ হয়ে যায় ভারতের জন্য দ্বিতীয় পাকিস্তান।

সুতরাং ভারতও বাংলাদেশকে উপেক্ষা করতে থাকে এবং সংগত কারণেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অধিকতর চেষ্টা চালায়, যে কথাগুলো গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’র সাবেক উপ-প্রধান বি. রমন কর্তৃক লিখিত ‘কাউ বয়েজ অব র’ গ্রন্থের বিবরণীতেও উল্লেখ আছে। তবে ভারতের সে চেষ্টা কোনো কাজে আসেনি। জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কেন, কী বাধ্যবাধকতা ও দায়বদ্ধতা থেকে এমন কট্টর পাকিস্তানি আদর্শ এবং নীতি গ্রহণ করলেন ও অবস্থান নিলে তা এখনো রহস্যময়। তবে জিয়াউর রহমান নিশ্চয় বুঝেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নতি সম্ভব নয়। তাই হয়তো ডুয়েল গেম খেলার কৌশলে তিনি ভারত তোষণের চেষ্টাও করেছেন। দেখা যায় সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে জিয়াউর রহমান তিন দফা ভারত সফরে যান। কিন্তু ভারতের কংগ্রেস, অকংগ্রেস উভয় সরকারের নীতিনির্ধারকদের সামনা-সামনি হয়ে হয়তো বঝুতে পারেন তার ডুয়েল গেম সম্পর্কে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ অবহিত এবং প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। ফলে ভারতের সঙ্গে যেসব সমস্যার কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে সম্পর্কে টুঁ-শব্দ করার সাহস তিনি পাননি। দ্বিতীয় সামরিক শাসক এরশাদ হুবহু জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। চরম ভারতবিদ্বেষী রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে এরশাদই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন। ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে যায়। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নব্য বিএনপি ১৯৯১-১৯৯৬ ও ২০০১-২০০৬ মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করাতে সম্পর্ক আরও তলানিতে চলে যায়। জামায়াতের মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ প্রকাশ্যে বলেন, একাত্তরে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, ওটা ছিল ভারতের চক্রান্ত। সে সময়ে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের দেশত্যাগ প্রচন্ডভাবে বেড়ে যায়। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকায় শিরোনাম হয়, ‘বাংলাদেশের হিন্দুদের বাঁচতে হলে দেশ ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’ ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে, যার গন্তব্য ছিল আসামের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার ঘাঁটি। পরবর্তীতে উলফার প্রধান অরবিন্দ রাজখোয়া পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেছেন, নব্য বিএনপির দুই শাসনামলে অনেকগুলো অস্ত্রের চালান তারা বাংলাদেশের মাধ্যমে পেয়েছে। পাকিস্তানের মতো এরকম ভারতবিদ্বেষী নীতি গ্রহণ করার পরেও জিয়ার মতো ডুয়েল গেম খেলার অংশ হিসেবে ভারতকে তোষণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া দুবার ভারত সফরে যান। কিন্তু একটি সমস্যারও সমাধান তিনি করতে পারেননি। বরং বেগম খালেদা জিয়ার ২০০৬ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় সফরের সময় সম্পর্ক এতটাই তিক্ততায় পূর্ণ ছিল যে, সফর শেষে একটি যৌথ ইশতেহারও প্রকাশিত হয়নি, একটি ছোট সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেই সব শেষ হয়েছে। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বেলায় সম্পর্ক যত খারাপই হোক, অন্তত কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রাখা হয়। সেটিও বিএনপি করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেকশাহ ও তখন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিংহ অরোরা যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এই দুই সেনাপতির প্রত্যক্ষ বিশাল ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তাদের মৃত্যুতে একটা শোকবার্তা পর্যন্ত পাঠায়নি বিএনপি সরকার। অথচ বিএনপির ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদে পাকিস্তানি একজন জেনারেল, যিনি ১৯৭১ সালে তখন বাংলাদেশের গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার মৃত্যুতে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। এবার ভারত তোষণ ও নতজানুপরায়ণতার দুয়েকটি উদাহরণ দিই। বিজেপি সরকারের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে এলে বেগম খালেদা জিয়া সুষমা স্বরাজের হোটেলে গিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থেকে তার সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রটোকল অনুযায়ী হওয়া উচিত ছিল উল্টোটি; নতজানু ও তোষণ পরিহার করার সৎ ও নৈতিক সাহস থাকলে দুবারের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসা বা অফিসে এসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেখা করতেন।

 

২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এলে বেগম খালেদা জিয়া হোটেলে দেখা করতে যান। তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সূত্রে জানা যায়, নরেন্দ্র মোদি বেগম খালেদা জিয়াকে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন। 

এক. ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় অধিকতর তদন্ত হলে তাতে বিএনপি সহায়তা করবে কিনা? দুই. জামায়াতের সঙ্গে ভবিষ্যতে বিএনপির সম্পর্ক কেমন হবে। আর তৃতীয়ত, ২০১২ সালে ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এলে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎকার জামায়াতের হরতালের অজুহাতে বেগম খালেদা জিয়া বাতিল করলেন কেন? এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে তা জেনেও বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে সেদিন বিএনপি নরেন্দ্র মোদির সন্তুষ্টি লাভের জন্য হোটেলে দেখা করতে যান। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের মূল্য কতখানি সেটা ভারতের সব রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকগণ জানেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভারতের মতো একটি বৃহৎ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী দেশ পাকিস্তানি মতাদর্শের জিহাদিতন্ত্রের সঙ্গে আপস করে চলবে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১ বছরের মধ্যে ২৮ বছর ক্ষমতায় ছিল জিয়া, এরশাদ ও নব্য বিএনপি। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান একটি সমস্যারও সমাধান তারা কেউ করতে পারেননি। বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার অনেকগুলো কঠিন ও জটিল সমস্যার সমাধান শুধু নয়, বিদ্যুৎ, ডিজেল, পিঁয়াজ, আদা ও সব ধরনের মসলাসহ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ভারত থেকে সহজলভ্য গম আমদানি করতে পারছে। এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও পণ্য ভারত ব্যতীত অন্য দেশ থেকে আনতে হলে সংগত কারণেই খরচ অনেক বেশি পড়বে। ভিসা প্রাপ্তি অনেক সহজীকরণের জন্য বছরে কয়েক লাখ বাংলাদেশি সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের চেয়ে তুলনামূলক কম খরচে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে ভারতে উন্নতমানের চিকিৎসা নিতে পারছেন। একাত্তরে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ভারতীয় সেনারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মাটিতে যেভাবে জীবন দিয়েছে তার উদাহরণ বিশ্বে বিরল। অনেক যুক্তিপূর্ণ অজুহাত তখন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালে মাত্র তিন মাসের মাথায় সব সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে ভারত বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের পরিচয় তুলে ধরেছে। ভারতের উপরোক্ত সদিচ্ছার বিপরীতে বাংলাদেশ তার নৌ, স্থল ও সমুদ্রবন্দর আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী যথার্থ শুল্কের বিনিময়ে ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে, যাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নতি-সমৃদ্ধি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত করতে পারে এটা ভারতের অপরিহার্য প্রয়োজন। বন্ধুত্ব রক্ষায় উভয় দেশকে পরস্পরের অপরিহার্যতা ও সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করা প্রয়োজন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে আগের মতোই ভারতবিদ্বেষী কোরাস শোনা গেছে। তারা প্রশ্ন উঠিয়েছেন এই সফরের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য কী আনতে পেরেছেন এবং প্রাপ্তি কী, ইত্যাদি। দেশের মর্যাদা নিয়ে যারা গর্ব করেন তাদের পক্ষে দেশের জন্য লজ্জাজনক ও অপমানজনক হয় এমন প্রশ্ন উঠানো সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এমন একটা জায়গায় নিতে পেরেছেন, সেখান থেকে বাংলাদেশকে এখন আর কারও কাছে হাত পাততে হয় না। কারও কাছে হাত পাতা একটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে শেখ হাসিনার বড় অর্জন এই, ভারতের সব রাজনৈতিক দল, নীতিনির্ধারক ও সুশীল সমাজ উপলব্ধি করেছেন, বাংলাদেশের জন্য সুসম্পর্ক রাখা ভারতের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য, সেটি লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে উল্লিখিত ধারণা আরও শক্তিশালী হয়েছে। তারপরও সমালোচনা থাকবে এবং তা থাকা উচিত। কিন্তু বিএনপির মহাসচিব সম্প্রতি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘এর চেয়ে তো পাকিস্তানের আমলেই ভালো ছিলাম।’ সুতরাং পাকিস্তানিদের সবকিছু যাদের পছন্দ তারা ভারতবিদ্বেষী রাজনীতি করবেন সেটাই স্বাভাবিক। যা কিছু হয় তার সমালোচনা করা সহজ। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য বিকল্প মতামত ও প্রস্তাব দেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। উইনস্টন চার্চিল একবার বিরোধীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমার বন্ধুরা তাদের মতামতের জন্য মরিয়া, কিন্তু তাদের কোনো মতামত নেই এবং সত্যের জন্য তারা জীবন দিতে প্রস্তুত, যদি সত্য কোনটি সেটি তারা জানত এবং বুঝত।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]      সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ডাকাতির প্রস্তুতিকালে চার ডাকাত গ্রেফতার

» শপথ নিলেন নতুন সিইসি ও ৪ নির্বাচন কমিশনার

» দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান ফারুকের

» সেনাবাহিনীর অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার

» যেসব এলাকায় আজ রাত ৮টা পর্যন্ত গ্যাস থাকবে না

» অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশি উইমেনস চেম্বার অফ কমার্সের আয়োজন এলান গালা এন্ড চ্যারিটি ইভিনিং অনুষ্ঠিত

» ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত,আহত ২

» পাইরেসির শিকার শাকিব খানের ‘দরদ’

» এশিয়া কাপ জয়ের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ল বাংলাদেশ দল

» পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির স্বরূপ

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.) : বার্টান্ড রাসেলের ‘দ্য কংকুয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ গ্রন্থের কিছু কথা দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করছি। রাসেল বলেছেন, জনমানুষের সন্তুষ্টি এবং স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন নিয়ে রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকা খুবই কঠিন কাজ। তার চেয়ে ধর্ম গেল, ধর্ম গেল স্লোগান দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত ও মাতিয়ে রেখে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকা অনেক সহজ। কারণ, মানুষ ধর্মের নামে যত তাড়াতাড়ি উত্তেজিত ও সংগঠিত হয়, অন্য কিছুতে তা হয় না। রাসেলের এই কথার প্রতিফলন পাকিস্তানি ২৩ বছরের শাসনামলে আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি, এখনো পাকিস্তান এই জায়গাতে আছে। আর পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিও এই রোগে আক্রান্ত। ভারত মানেই হিন্দু, আর হিন্দুরা মুসলমানের শত্রু, এই স্লোগানে মানুষকে মাতিয়ে রেখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। তার পরিণতিতে পাকিস্তান একবার দ্বিখন্ডিত হয়েছে, আরও খন্ডিত হওয়ার পথে যাচ্ছে, ব্যর্থ রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে এবং এ পর্যন্ত চারটি বড় যুদ্ধে ভারতের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। বাংলাদেশের এক বড় রাজনৈতিক পক্ষ ও তাদের সমর্থকরা ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে পাকিস্তানের মতো চরম ভারতবিদ্বেষী রাজনীতিতে মত্ত। ব্যর্থ, ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্ব, সাতচল্লিশের চেতনাই তাদের রাজনীতির মৌলিক অবলম্বন। কিন্তু যখন তারা ক্ষমতায় ছিল তখনকার কার্যকলাপ এবং বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আচরণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় তাদের ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির আসল স্বরূপ কেমন। সেটাই আজকের লেখার বিষয়। বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির বড় পক্ষ বিএনপি। তারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির কারণে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক সূত্রে তৈরি হওয়া আন্তরাষ্ট্রীয় সমস্যা; যেগুলো বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার একটি সমস্যার সমাধানও বিএনপি করতে পারেনি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বিএনপির আচরণ ত্রিমুখী। তাতে প্রথমত, কাজে ও রাজনৈতিক বক্তৃতায় ভারত বিদ্বেষের চরম বহিঃপ্রকাশ, দ্বিতীয়ত, ছদ্মবেশে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রক্সি হয়ে ভারতের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সমর্থন প্রদান, আবার কখনো কখনো ভারতের কাছে নতজানু হওয়া। এই ত্রিমুখী লাজলজ্জাহীন কিছু ঘটনার উল্লেখ করি। তার আগে দুই দেশের জন্য সম্পর্কের প্রেক্ষাপটের বিষয়টি একটু উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৭১-৭২ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথে গোড়াপত্তনের বীজ ও শেকড় হিসেবে কাজ করেছে দুই দেশের মৌলিক রাষ্ট্রীয়, আদর্শের মিল, যেটি বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে মৌলিক আদর্শের ওপর ১৯৪৭ সাল থেকে ভারত পরিচালিত হয়ে আসছে যার মূল বিষয় ছিল উদার গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী মিলে এই আদর্শকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন, যার ফলে দেখা যায় ১৯৭৬ সালে ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে সংযোজিত হয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শের মিল থাকলে সাধারণত দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের পথ সহজ হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তান যদি উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেত তাহলে উপমহাদেশের ইতিহাস আজ ভিন্ন হতো। আদর্শ ছাড়াও ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকতার সূত্রে উভয় দেশের জন্য কতগুলো অপরিবর্তনীয় বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি করেছে, যেগুলো উপেক্ষা করা দুই দেশের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। উপেক্ষা করা মানেই বিদ্যমান সমস্যার সঙ্গে আরও নতুন সমস্যার তৈরি এবং সম্পর্কের অবনতি হওয়া। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মৌলিক আদর্শ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে হুবহু পাকিস্তানি আদর্শে ফিরে আসে এবং উল্লিখিত বাধ্যবাধকতাকেও জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ফলে যা হওয়ার সেটাই হয়েছে। বাংলাদেশ হয়ে যায় ভারতের জন্য দ্বিতীয় পাকিস্তান।

সুতরাং ভারতও বাংলাদেশকে উপেক্ষা করতে থাকে এবং সংগত কারণেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অধিকতর চেষ্টা চালায়, যে কথাগুলো গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’র সাবেক উপ-প্রধান বি. রমন কর্তৃক লিখিত ‘কাউ বয়েজ অব র’ গ্রন্থের বিবরণীতেও উল্লেখ আছে। তবে ভারতের সে চেষ্টা কোনো কাজে আসেনি। জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কেন, কী বাধ্যবাধকতা ও দায়বদ্ধতা থেকে এমন কট্টর পাকিস্তানি আদর্শ এবং নীতি গ্রহণ করলেন ও অবস্থান নিলে তা এখনো রহস্যময়। তবে জিয়াউর রহমান নিশ্চয় বুঝেছিলেন, ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নতি সম্ভব নয়। তাই হয়তো ডুয়েল গেম খেলার কৌশলে তিনি ভারত তোষণের চেষ্টাও করেছেন। দেখা যায় সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে জিয়াউর রহমান তিন দফা ভারত সফরে যান। কিন্তু ভারতের কংগ্রেস, অকংগ্রেস উভয় সরকারের নীতিনির্ধারকদের সামনা-সামনি হয়ে হয়তো বঝুতে পারেন তার ডুয়েল গেম সম্পর্কে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ অবহিত এবং প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। ফলে ভারতের সঙ্গে যেসব সমস্যার কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে সম্পর্কে টুঁ-শব্দ করার সাহস তিনি পাননি। দ্বিতীয় সামরিক শাসক এরশাদ হুবহু জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। চরম ভারতবিদ্বেষী রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে এরশাদই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন। ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে যায়। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নব্য বিএনপি ১৯৯১-১৯৯৬ ও ২০০১-২০০৬ মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করাতে সম্পর্ক আরও তলানিতে চলে যায়। জামায়াতের মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ প্রকাশ্যে বলেন, একাত্তরে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, ওটা ছিল ভারতের চক্রান্ত। সে সময়ে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের দেশত্যাগ প্রচন্ডভাবে বেড়ে যায়। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকায় শিরোনাম হয়, ‘বাংলাদেশের হিন্দুদের বাঁচতে হলে দেশ ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’ ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে, যার গন্তব্য ছিল আসামের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার ঘাঁটি। পরবর্তীতে উলফার প্রধান অরবিন্দ রাজখোয়া পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেছেন, নব্য বিএনপির দুই শাসনামলে অনেকগুলো অস্ত্রের চালান তারা বাংলাদেশের মাধ্যমে পেয়েছে। পাকিস্তানের মতো এরকম ভারতবিদ্বেষী নীতি গ্রহণ করার পরেও জিয়ার মতো ডুয়েল গেম খেলার অংশ হিসেবে ভারতকে তোষণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে বেগম খালেদা জিয়া দুবার ভারত সফরে যান। কিন্তু একটি সমস্যারও সমাধান তিনি করতে পারেননি। বরং বেগম খালেদা জিয়ার ২০০৬ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় সফরের সময় সম্পর্ক এতটাই তিক্ততায় পূর্ণ ছিল যে, সফর শেষে একটি যৌথ ইশতেহারও প্রকাশিত হয়নি, একটি ছোট সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেই সব শেষ হয়েছে। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বেলায় সম্পর্ক যত খারাপই হোক, অন্তত কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রাখা হয়। সেটিও বিএনপি করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেকশাহ ও তখন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিংহ অরোরা যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এই দুই সেনাপতির প্রত্যক্ষ বিশাল ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তাদের মৃত্যুতে একটা শোকবার্তা পর্যন্ত পাঠায়নি বিএনপি সরকার। অথচ বিএনপির ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদে পাকিস্তানি একজন জেনারেল, যিনি ১৯৭১ সালে তখন বাংলাদেশের গণহত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার মৃত্যুতে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। এবার ভারত তোষণ ও নতজানুপরায়ণতার দুয়েকটি উদাহরণ দিই। বিজেপি সরকারের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফরে এলে বেগম খালেদা জিয়া সুষমা স্বরাজের হোটেলে গিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থেকে তার সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রটোকল অনুযায়ী হওয়া উচিত ছিল উল্টোটি; নতজানু ও তোষণ পরিহার করার সৎ ও নৈতিক সাহস থাকলে দুবারের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসা বা অফিসে এসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেখা করতেন।

 

২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এলে বেগম খালেদা জিয়া হোটেলে দেখা করতে যান। তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সূত্রে জানা যায়, নরেন্দ্র মোদি বেগম খালেদা জিয়াকে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন। 

এক. ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় অধিকতর তদন্ত হলে তাতে বিএনপি সহায়তা করবে কিনা? দুই. জামায়াতের সঙ্গে ভবিষ্যতে বিএনপির সম্পর্ক কেমন হবে। আর তৃতীয়ত, ২০১২ সালে ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এলে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎকার জামায়াতের হরতালের অজুহাতে বেগম খালেদা জিয়া বাতিল করলেন কেন? এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে তা জেনেও বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে সেদিন বিএনপি নরেন্দ্র মোদির সন্তুষ্টি লাভের জন্য হোটেলে দেখা করতে যান। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কের মূল্য কতখানি সেটা ভারতের সব রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকগণ জানেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভারতের মতো একটি বৃহৎ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী দেশ পাকিস্তানি মতাদর্শের জিহাদিতন্ত্রের সঙ্গে আপস করে চলবে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১ বছরের মধ্যে ২৮ বছর ক্ষমতায় ছিল জিয়া, এরশাদ ও নব্য বিএনপি। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান একটি সমস্যারও সমাধান তারা কেউ করতে পারেননি। বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার অনেকগুলো কঠিন ও জটিল সমস্যার সমাধান শুধু নয়, বিদ্যুৎ, ডিজেল, পিঁয়াজ, আদা ও সব ধরনের মসলাসহ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ভারত থেকে সহজলভ্য গম আমদানি করতে পারছে। এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও পণ্য ভারত ব্যতীত অন্য দেশ থেকে আনতে হলে সংগত কারণেই খরচ অনেক বেশি পড়বে। ভিসা প্রাপ্তি অনেক সহজীকরণের জন্য বছরে কয়েক লাখ বাংলাদেশি সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের চেয়ে তুলনামূলক কম খরচে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে ভারতে উন্নতমানের চিকিৎসা নিতে পারছেন। একাত্তরে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ভারতীয় সেনারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মাটিতে যেভাবে জীবন দিয়েছে তার উদাহরণ বিশ্বে বিরল। অনেক যুক্তিপূর্ণ অজুহাত তখন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালে মাত্র তিন মাসের মাথায় সব সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে ভারত বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের পরিচয় তুলে ধরেছে। ভারতের উপরোক্ত সদিচ্ছার বিপরীতে বাংলাদেশ তার নৌ, স্থল ও সমুদ্রবন্দর আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী যথার্থ শুল্কের বিনিময়ে ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে, যাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও উন্নতি-সমৃদ্ধি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত করতে পারে এটা ভারতের অপরিহার্য প্রয়োজন। বন্ধুত্ব রক্ষায় উভয় দেশকে পরস্পরের অপরিহার্যতা ও সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করা প্রয়োজন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে আগের মতোই ভারতবিদ্বেষী কোরাস শোনা গেছে। তারা প্রশ্ন উঠিয়েছেন এই সফরের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য কী আনতে পেরেছেন এবং প্রাপ্তি কী, ইত্যাদি। দেশের মর্যাদা নিয়ে যারা গর্ব করেন তাদের পক্ষে দেশের জন্য লজ্জাজনক ও অপমানজনক হয় এমন প্রশ্ন উঠানো সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এমন একটা জায়গায় নিতে পেরেছেন, সেখান থেকে বাংলাদেশকে এখন আর কারও কাছে হাত পাততে হয় না। কারও কাছে হাত পাতা একটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে শেখ হাসিনার বড় অর্জন এই, ভারতের সব রাজনৈতিক দল, নীতিনির্ধারক ও সুশীল সমাজ উপলব্ধি করেছেন, বাংলাদেশের জন্য সুসম্পর্ক রাখা ভারতের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য, সেটি লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে উল্লিখিত ধারণা আরও শক্তিশালী হয়েছে। তারপরও সমালোচনা থাকবে এবং তা থাকা উচিত। কিন্তু বিএনপির মহাসচিব সম্প্রতি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘এর চেয়ে তো পাকিস্তানের আমলেই ভালো ছিলাম।’ সুতরাং পাকিস্তানিদের সবকিছু যাদের পছন্দ তারা ভারতবিদ্বেষী রাজনীতি করবেন সেটাই স্বাভাবিক। যা কিছু হয় তার সমালোচনা করা সহজ। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য বিকল্প মতামত ও প্রস্তাব দেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। উইনস্টন চার্চিল একবার বিরোধীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমার বন্ধুরা তাদের মতামতের জন্য মরিয়া, কিন্তু তাদের কোনো মতামত নেই এবং সত্যের জন্য তারা জীবন দিতে প্রস্তুত, যদি সত্য কোনটি সেটি তারা জানত এবং বুঝত।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]      সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com