ফাহিমা আক্তার সুমি: ধানমণ্ডির ৭ এর একটি বাসায় একাই থাকতেন ব্যবসায়ী মহসিন খান। স্ত্রী এবং ছেলে থাকেন অস্ট্রেলিয়া। মেয়ে স্বামীর সংসারে। মহসিন খানের মেয়ের জামাতা জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রিয়াজ। বুধবার রাত পৌনে ১০টায় ফেসবুক লাইভে এসে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন মহসিন খান। তার এই আত্মহত্যার ঘটনাটি নাড়িয়ে দিয়েছে সবাইকে। একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সদস্যের এমন মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা আলোচনা। কেন তিনি আত্মহত্যা করেছেন তার অনেকটা ফেসবুক লাইভে বলে গেছেন মহসিন খান।
এ ছাড়া একটি সুইসাইডাল নোটও রেখে গেছেন। নোটে তিনি কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন। সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের আত্মহত্যার পেছনে শুধু ব্যক্তিই দায়ী নয়। এর পেছনে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। যার যে দায়িত্ব সেটা পালন না করার কারণে বা বন্ধন ছিন্ন হওয়ার কারণে এমন সব ঘটনা ঘটে। মহসিন খানের আত্মহত্যার ঘটনাটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রবীণদের জন্য আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বোধের বিষয়টি।
মনোচিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, যাপিত জীবনে চারপাশের ‘লস ইভেন্ট’ তাকে বিষণ্নতায় আক্রান্ত করেছে। এই ধরনের মানুষকে কখনো একাকী রাখতে নেই। একদিকে ব্যবসায় লস, একদিকে বন্ধুর প্রতারণা বা টাকা মেরে দেয়া, আর্থিক দুর্গতি বা টাকা-পয়সার চিন্তা, অন্যদিকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, একাকী থাকা ধীরে ধীরে তাকে চরম বিষণ্নতায় নিয়ে গেছে। এ অবস্থায় যেকোনো মানুষের ব্রেনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ, সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যায়। তখন সে সবকিছু নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে। পজেটিভ কোনো চিন্তা করার ক্ষমতা প্রায় পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থায় স্বজনদের উচিত তার পাশে দাঁড়ানো। তাকে চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করা। তারা এই সামাজিক দায়িত্বটা পালন করেছেন বলে মনে হয় না। আত্মহত্যা সামাজিক ও পাবলিক হেলথ সমস্যা। এই দুইটির মিশ্রণে ঘটে গেছে বিয়োগান্তক ঘটনা। সেজন্য সামাজিক চিকিৎসার পাশাপাশি ব্যক্তির মনোচিকিৎসা দরকার। তাহলে আমরা সমাজে পরবর্তীতে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা রোধ করতে পারবো। এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। যখন কেউ একাকী থাকে বা বিভিন্ন সমস্যায় ভোগে তখন সামাজিক সমস্যা পারিবারিক পরিমণ্ডলে বা সমাজ থেকে সমাধান করতে হবে। শারীরিক সমস্যা চিকিৎসক দ্বারা, এবং পারিবারিক সমস্যা পরিবার দ্বারা সমাধান করতে হবে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতায় একটি মানুষকে সব সমস্যা থেকে মুক্ত করা যায়। আত্মহত্যার চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত রাখা যায়। কেউ আত্মহত্যা করলে তার জন্য কান্নাকাটি করে লাভ নেই। এ কাজ বেঁচে থাকতে করা উচিত। যখন সে একাকী হয়ে গেছে, বিষণ্ন ও নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে, তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে চিকিৎসা দেয়া উচিত ছিল।
তিনি বলেন, দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী এ ধরনের আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছে। হতাশায় যারা ভোগে তারা বিষণ্নতার ঝুঁকি থেকে পরিকল্পিত আত্মহত্যার চিন্তা করে।
যখন মানুষ একাকী হয়ে যায়, আর্থিকভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে যায়, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়, বিষাদ রোগে আক্রান্ত হয় তখন তার ভেতর থেকে আত্মহত্যার ইচ্ছা চলে আসে। তখন এ সকল মানুষের পাশে স্বজনদের দাঁড়াতে হবে। বন্ধু, সহকর্মী, সকলকে পাশে দাঁড়াতে হবে। সেটি হবে সবচেয়ে মানবিক কাজ। এবং তার শারীরিক সমস্যাগুলো চিকিৎসকরা দেখবেন। ছেলেমেয়ে দূরে থাকলে তাদের ইমোশনাল জগৎ অন্যরকম হয়ে যায়। এক ধরনের পরিবর্তন চলে আসে। জেনেটিক কানেকশনের জন্য যে ভালোবাসার একটি বন্ধন আমরা যুগ যুগ ধরে দিয়ে এসেছি সেই বন্ধন বিলীন হয়ে যায়। তিনি মৃত্যুর আগে বলে গেছেন আমার মৃত্যু হলে কেউ আসবে না। লাশ হয়ে সাতদিন পড়ে থাকলেও কেউ টের পাবে না। এটি ভয়ঙ্কর চিন্তা ছিল। এমন কঠিন চিন্তা তার মাথায় এসেছে। অনেক কষ্টের পরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, প্রতিটি মানুষের জীবনের ধরন ভিন্ন। একাকিত্ব, হতাশা এরকম নানা ধরনের সমস্যা থাকে। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ যাদের আর্থিক দিক থেকে কোনো কষ্ট নেই সবদিক থেকে তারা স্বাবলম্বী। কিন্তু তাদের সঙ্গ বা বন্ধনের দিক থেকে একটি শীতল অবস্থায় রয়েছে। মহসিন খানের আত্মহত্যার পেছনের কারণ হলো তার সন্তান, পরিবার দূরে থাকা। পরিবার থেকে সে বিচ্ছিন্ন এবং নিজেও ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তাকে সঙ্গ দেয়ার মতো কেউ ছিলেন না। এটা মানসিকভাবে তিনি মেনে নিতে পারেননি। মেনে না নেয়ার পেছনে দেখা যায়, আমাদের দেশে অধিকাংশই জীবনের একটি বড় সময় অর্থের পেছনে ছুটে এবং আর্থিক স্বাবলম্বী এবং সক্ষমতার উজ্জ্বল সময়টা বিনিয়োগ করে। কিন্তু সেই অর্থের যোগ্যতার উন্নতি করতে গিয়ে বন্ধন অথবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের জায়গা থেকে আমরা দূরে সরে যাই। সেখান থেকে ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হয়। তখন পরবর্তী সময়ে সন্তানরা নিজের কর্ম ও অন্য পরিস্থিতির কারণে হোক অনেক সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কিন্তু যে ব্যক্তি একটি পরিবার তৈরি করলেন, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলেন সে একটি সময় গিয়ে দেখেন, অর্থ ছাড়া তারপাশে আর কেউ নেই তখন তিনি এটি মেনে নিতে পারেন না। তার মধ্যে একটি দুঃখবোধ ও বেদনা কাজ করে।
আত্মহত্যার দায় যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে তার একার নয়, এই দায় পরিবার, রাষ্ট্রের, সমাজের। একজন ব্যক্তির পরিচয় পারিবারিক পরিচয়, পেশাগত পরিচয় এই বিষয়গুলো ছাপিয়ে একজন ব্যক্তির যে মূল পরিচয় ব্যক্তি হিসেবে সেই জায়গায় গিয়ে আমরা সবাই মিলে একজন আরেকজনকে কতটা ভালো রাখতে পারছি মানুষিকভাবে, সামাজিকভাবে বা শারীরিকভাবে তা খবর রাখা। প্রফুল্লতা নিয়ে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে সেই জায়গাগুলো কিন্তু আমাদের এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ হলো আমরা শুধু অর্থের পেছনে ছুটছি। আমাদের পরিবার ও সম্পর্কগুলোর পরিচর্যায় সময় দিতে পারছি না। এগুলোতে আমাদের আগ্রহ কিংবা অনীহার একটি সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। যে হতাশায় একাকিত্বের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে সে মনে করছে আমার বোধহয় আর কেউ নেই। আমাকে দেখার মতো কেউ নেই। সে তখন মনে করে এমন জীবন রাখার চেয়ে না রাখা আরও ভালো। সে তখন আত্মহত্যার মুখোমুখি হয়।
তিনি বলেন, আত্মহত্যা যদি প্রতিরোধ করতে চাই সেক্ষেত্রে এ ধরনের বয়সী বা সমস্যায় ভোগা মানুষদের স্বজনদের সহচার্যে রাখা প্রয়োজন। এই কারণে বন্ধনের প্রতি সুদৃষ্টি ও গুরুত্ব দেয়া উচিত।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আত্মহত্যা মানুষ মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে করে। যখন হতাশা, দুঃখ জীবনের ওপর ভর করে তখন আর মানুষ জীবন উপভোগ করে না। এরপরই মানুষ আত্মহত্যার চিন্তা করে। এর পেছনে দুই ধরনের কারণ ভর করে, একটি হচ্ছে বাইরের কারণ, অর্থাৎ তার পারিপার্শ্বিক আত্মীয়-স্বজন, নিজের ব্যক্তি জীবন এগুলো তার ভেতরে অন্তর্গত এক ধরনের দুঃখবোধ তৈরি করে। তার সন্তান এবং ব্যক্তিগত জীবন সবকিছু নিয়েই এক ধরনের অসুখী মনোভাব তৈরি হয়েছিলো। একদিকে যেমন নিজের উন্নতি করা এবং সন্তানদের উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেয়ার স্বপ্ন। অন্যদিকে জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে, আনন্দ এগুলো সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা। ফলে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। এই আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে কিন্তু সেটিই তৈরি হয়েছে। তিনি একা থাকতেন একদিকে করোনার কারণে বিচ্ছিন্নতা, অন্যদিকে একাকী জীবন-যাপনের যে অভ্যাস সেটি সন্তানরা থাকে দূরে এবং অর্থনৈতিকভাবে অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলে তার মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। মানুষের ভালো থাকার জন্য শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যকে মাথায় রেখে শুধু শারীরিক যত্ন না এর সঙ্গে মানসিক পরিচর্যাও থাকতে হবে। যদি সেটি না রাখা যায় তাহলে এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। সূএ:মানবজমিন