বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : সর্বগ্রাসী করোনা বিপর্যয়ের এক লম্বা সময় পর ৩০ আগস্ট মঙ্গলবার পিতার সমাধিতে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম। এ যাত্রায় পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে প্রথম যাওয়া। টিভি ক্যামেরায় যেভাবে ঝকঝকে তকতকে পদ্মা সেতু দেখি বাস্তবে অতটা নয়। আমার সাদামাটা স্ত্রী নাসরীন সিদ্দিকী সেতু পার হয়েই বলেছিলেন, ‘কই, গাড়ি-ঘোড়ার তেমন চাপ কোথায়?’ আসলেই ঢাকার উত্তরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে যে চাপ, ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহের রাস্তায় যে যানজট তার ১০ ভাগের ১ ভাগও নেই। তবে ধীরে ধীরে চাপ বাড়বে, গাড়ি-ঘোড়া বাড়বে, মানুষের যাতায়াত বাড়বে। তবে পদ্মা সেতুর পরিচালনা তেমন জুতসই মনে হলো না। যারা টোল নিচ্ছেন তারা দক্ষ নন, যারা পাহারা দিচ্ছেন তারাও না। অনেকের তেমন স্বাভাবিক বিচার- বিবেচনাও নেই। দেশ ভ্রমণে এক সাইকেল আরোহী সাতকানিয়ার কে এম বেলাল উদ্দিন ফেরিওয়ালা সেতু উদ্বোধনের সময় টুঙ্গিপাড়ায় পিতার সমাধিতে যাওয়ার পথে তাকে সেতুতে যেতে দেওয়া হয়নি। ৩০ তারিখ টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরেই তার চিঠি পেলাম। আমার কাছে খুব একটা ভালো মনে হয়নি। একজন মানুষ যদি পায়ে হেঁটে দেশ ভ্রমণ করে, সাইকেলে চড়ে কিংবা রিকশায় অথবা গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি কিংবা মোষের গাড়ি তাহলে তাকে আলাদা মর্যাদা দেওয়া দরকার। যে সাইকেলে দেশ ভ্রমণ করছে সে পদ্মা সেতু পেরোতে গেলে তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে সেতু পার করা উচিত। নিত্যযাত্রী আর দেশ ভ্রমণকারী এক নয়, এ বোধটা কারও মধ্যে নেই। যাওয়ার পথে দেখলাম, আমাদের সঙ্গে ৪০-৪৫টি গাড়ি ছিল। আরও এদিক-ওদিক থেকে বেশ কিছু গাড়ি এসেছিল। টোল পার হয়ে আমরা সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক এক করে বাকি গাড়িগুলো টোল দিয়ে এসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল। কতবার যে পিএসএস নামের এক সিকিউরিটি কোম্পানির ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা ‘দাঁড়ানো যাবে না, চলে যেতে হবে’ এমনি নানা কথা বলছিল। কথার মধ্যে তেমন মাধুর্যও ছিল না। বয়সী মানুষ কখনোসখনো বিরক্ত লেগেছে আবার মনে হয়েছে না-বুঝরা কী করবে। সব কিছুতেই তো গোড়ায় গলদ। টোল প্লাজা পেরিয়ে দাঁড়াতে ফেরার পথে বেশি বিরক্ত করেছে। সেনাবাহিনীর দু-তিন জন সদস্যও ছিল তাতে। সর্বোচ্চ পদাধিকারী ল্যান্স নায়েক। সিকিউরিটি গার্ডের না-বুঝদের চাইতে সেনাবাহিনীর সিপাহিদের কিছুটা বুঝমান মনে হচ্ছিল। পদ্মা পার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লোকজন বলছিল, ‘নেতা, পদ্মায় সেনাবাহিনীর পাহারা কেমন যেন মনে হয়।’ আমারও কথাটা মনে ধরেছে। পদ্মার এপার-ওপার ক্যান্টনমেন্ট করে সেনাবাহিনী থাকলে সেটা খারাপ নয়, অনেকটাই ভালো কথা। পদ্মার তাজা মাছ ও বিশুদ্ধ বাতাসে সেনাবাহিনীর সদস্যদের স্বাস্থ্য যে অনেক ভালো হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেতুতে সেনাবাহিনীর পাহারা দেওয়া কেন যেন মনে হয় খুব একটা সম্মানজনক নয়। সেনাবাহিনী কেন সেতু পাহারা দেবে? সেনাবাহিনীর কাজ দেশের শৌর্যবীর্য রক্ষা, সেনাবাহিনীর কাজ বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশ রক্ষা। চোর ফেরানো সেনাবাহিনীর কাজ নয়। সেতু পাহারা, কোনো গোডাউন পাহারা এসব সেনাবাহিনীর কাজ হতে পারে না। এসবের জন্য আরও কত বাহিনী আছে। দরকার পড়লে পদ্মা সেতুর জন্য একটা বাহিনী করা যেতে পারে। যাদের কাজ হবে শুধু পদ্মা সেতু দেখা, প্রয়োজন হলে আরও ১০টি সেতু দেখা। কিন্তু সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করে তেমন কোনো কাজের কাজ হয়নি।
টুঙ্গিপাড়ায় পিতার সমাধিতে ফাতিহা পাঠ ও দোয়া করছেন লেখক
অনেকবার বলেছি আমাদের দেশ এখন ঘোড়া রোগে আক্রান্ত। কেউ কারও কথা শোনে না। ভালো কথা কেন যেন অনেকের কানে পীড়া দেয়। বছরখানেক আগে যখন যমুনায় রেলব্রিজ শুরু হচ্ছিল তখন বলেছিলাম, একই খরচে যমুনার স্টিল গার্ডারের রেলব্রিজের ওপর অনায়াসে একটি সড়কপথ বানানো যেতে পারে। শুধু কংক্রিট খরচ হয়তো বেশি লাগবে। তাতে মূল সেতুর ১৫-২০ শতাংশের বেশি খরচ পড়ত না। যে স্ট্রাকচার তাতেই চলে যাবে। লোড বেয়ারিং ক্যাপাসিটিতেও কোনো সমস্যা দেখা দেবে বলে মনে হয় না। পদ্মা সেতুতেও একটা গজখমি বেকুবি লক্ষ্য করে এলাম। ৬০ ফুটের ওপরে প্রস্থ পদ্মা সেতু। সেতুর ওপর চারটি লাইন থাকলেও যেখানে দুই পাশে ১০-১০ বিশ ফুট খালি থাকার কথা সেখানে শুধু একটি লাইন টানা হচ্ছে। ৫-১০ বছর পর পদ্মার এক লাইন রেল এক মারাত্মক বিষফোঁড়ার সৃষ্টি করবে। সেতুর দুই পাশে গাড়ি-ঘোড়ার মতো রেলের জট হবে। চারটি লাইন না হোক অনায়াসে দুটি লাইন টানা যেত। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বোনকেই বা কী বলি! সব হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরামর্শক। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের আলো-হাওয়া জলবায়ু কারও কোনো কিছুর ওপর কোনোরকম ভরসা নেই। সবাই আছে পণ্ডিতি নিয়ে। এতটা সুন্দর একটা জিনিস অসুন্দর অকার্যকর করতে না পারলে যেন কারও আশ মেটে না।
সমাধিতে যাওয়ার পথে দুই জায়গায় খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। একদল পাচ্চর বাহাদুরপুর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি শফিকুল ইসলাম দেলোয়ারের বাড়িতে, আরেক দল খেয়েছে ভাটিপাড়ার কাছে সাম্পান রেস্টুরেন্টে। পাচ্চর বাহাদুরপুরে ছিল সখীপুরের প্রায় সবাই। বাড়িঘরে কেউ থাকে না। দেলোয়ারের অসমাপ্ত দোতলা দালান, পাশে তার চাচার চমৎকার ছোট্ট বাড়ি। পুবে পশ্চিমে প্রায় ৩-৪ বিঘা বিরান ভূমি। বাড়িঘরে ওরা যায় না। কিন্তু আমার সেখানে গিয়ে ভীষণ ভালো লেগেছে। মা মারা যাওয়ার পর কোনো দিনই হয়তো ওরকম সুস্বাদু ভাত খাইনি। নির্বাসনে থাকতে সাভারের গিয়াস ও নালিতাবাড়ীর গোপাল অসাধারণ ভাত রাঁধত। মনে হলো তার চাইতেও ভালো। বড় বড় চাল মনে হলো গোনা যাবে। কিন্তু ভাতে হাত দিলেই কেমন একদম মিশে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে কত জায়গায় গিয়ে আধ ফোটা ভাত খাই, কোনো কোনো জায়গায় আবার কাদা হয়ে যায়। ভাতও যে একটা অসাধারণ কিছু তা অনেককে বোঝাতে পারি না। তাই বুক ভরে গিয়েছিল পাচ্চরে বাহাদুরপুর দেলোয়ারের চাচির হাতের রান্না ভাত খেয়ে। বড় ভালো লেগেছে। বুকের সবকটি কপাট খুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, আল্লাহ যেন তাঁকে এই অসম্ভব সুন্দর ভাত রাঁধার জন্য তাঁর ছায়াতলে রাখেন, বেহেশতবাসী করেন।
ভারত উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহামানব ফরায়েজি আন্দোলনের রূপকার হাজী শরীয়তুল্লাহর বাড়ি বাহাদুরপুর। মনে হচ্ছিল তাঁর মাজার জিয়ারত করা আমার পরম সৌভাগ্য। হাজী শরীয়তুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ মহসীন দুদু মিয়া ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পথিকৃৎ। এ রকম একটি পুণ্যভূমি পিতার সমাধিতে যাওয়ার প্রাক্কালে দর্শন করে কবরে ফাতিহা পাঠ করে অভাবনীয় আনন্দ অনুভব করেছি। বর্তমান গদিনশিন পীর ছিলেন না। মাওলানা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ হাসান আগে থেকেই অনুষ্ঠান থাকায় বাইরে ছিলেন। কিন্তু তাঁর লোকজন অমায়িক আচরণ করেছেন। এটাওটা খাওয়াতে চেয়েছিলেন। আসলে এখন আর তেমন বাইরে এটাওটা খেতে পারি না। খুব একটা খাইও না। তবু অফিস বারান্দার সিঁড়িতে বসেছিলাম। এখন আমার মাটিতে বসতে একটু অসুবিধা হয়। তবু সেই পবিত্র স্থানে সিঁড়ির সামনে বসতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ৫-৬ মিনিট বসে থেকে চলে এসেছিলাম দেলোয়ারের বাড়িতে। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে মাদরাসার লোকজন ফল-ফলারি, হাবিজাবি অনেক কিছু নিয়ে এসেছিল। সেগুলো নিয়েই টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে গিয়েছিলাম এবং পরে অনেকে মিলে বহু যত্নে দেওয়া তাদের খাদ্যসামগ্রী খুবই তৃপ্তিসহকারে খেয়েছি।
সবাই বলে টুঙ্গিপাড়া এখন আর তেমন দূর না। হয়তো সত্যই তাই। কিন্তু পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে আমাদের প্রথম যাত্রা খুব একটা স্বচ্ছন্দ হয়নি। পিতার সমাধিতে যাওয়ার পথে বেলা সাড়ে ৩টায় গোনাপাড়া গোলচত্বরে চরবয়রা গোনাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তা অবরোধ করেছিল। কড়কড়ে রোদে ছেলেমেয়েগুলো ঝলসে যাচ্ছিল। রাস্তা আগলে অনেকক্ষণ স্লোগান দিচ্ছিল। অনেকক্ষণ পর আমি নিজেও বাচ্চাদের মধ্যে গিয়েছিলাম। তাদের কোনো হুঁশ ছিল না। তাদের এক দাবি, গভর্নিং বডি তাদের হেডমাস্টারকে অপমানিত লাঞ্ছিত করেছে। তারা তার বিচার চায়। প্রায় ১৫ মিনিট তাদের চিৎকার শুনে চোখের পানি দেখে বলেছিলাম, পিতার সমাধিতে যাব। আমাদের একটু রাস্তা দাও। বাচ্চাদের মধ্যে তেমন আকারবিকার দেখিনি। তারা তাদের হেডমাস্টারের অপমান নিয়ে সত্যিই ব্যথিত। ফিরে এসে গাড়িতে বসলে কিছুক্ষণ পর তারা হয়তো বুঝতে পারে এবং আমাকে চিনতে পারে। স্কুল কমিটির সভাপতি খন্দকার মহিউদ্দিন এসে বলেন, আমি চেষ্টা করছি আপনাদের যাওয়ার। এ সময় বাচ্চারাও এসে বলে আমরা আপনার গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি। ছেলেমেয়েদের বলেছিলাম, আমার গাড়ি ছাড়লে কী হবে, সঙ্গে ৪০-৫০টি গাড়ি। তা-ও ছাড়তে হবে। গোপালগঞ্জের ডিসি মহিলা, এসপি মহিলা। ডিসি, এসপি, ওসির সঙ্গে কথা হয়েছে। জানি না তারা ঘটনাস্থলে এসেছিলেন কি না। কিন্তু আন্দোলনকারী ছেলেমেয়েরা আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। পরদিনই নাকি কমিটির লোকজন হেডমাস্টারকে বিদায় করেছেন। অতগুলো ছেলেমেয়ের চোখের পানির কোনো মূল্য হলো না। স্কুল কমিটির লোকজনের দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা শুনলাম। ডিসিসহ অন্যদের যাকে যাকে বলা যায় ব্যাপারটা বলেছি। আমরা বেরিয়েছিলাম পিতার সমাধিতে অর্ঘ্য নিবেদনে। রাস্তার অত ঝকমারি সত্যিই ভালো লাগেনি। রাস্তা অবরোধের কারণে টুঙ্গিপাড়া পিতার সমাধিতে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়েছিল। আসরের আগে ফাতিহা পাঠ করেছি। সমাধির ইমাম মাওলানা নওয়াব আলী চমৎকার দোয়া করেন। থাকতে থাকতে দোয়া করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। খুবই স্বচ্ছন্দে দোয়াদরুদ পড়েন। প্রথম যখন গিয়েছিলাম এই ইমামের বাবা মসজিদে নামাজ পড়াতেন। এখন তিনি পড়ান। তারপর হয়তো তাঁর সুযোগ্য সন্তানসন্ততি পড়াবেন। এটাই নিয়ম, এটাই সিলসিলা। বহুদিন পর পিতার কবরে ফাতিহা পাঠ করে বড় প্রশান্তি অনুভব করেছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে এভাবে অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি। কবর ছুঁয়ে শপথ করেছি যতক্ষণ বেঁচে আছি পিতাকে সমগ্র বাংলা ও বাঙালির সম্পদে পরিণত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করব। গামছার সবাইকে পিতার কবর ছুঁয়ে শপথ করিয়েছি তারা দেশের মানুষের সেবক হবে, মালিক হবে না।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিনন