মেজর আখতার (অব.) : ১১ আগস্ট সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করার একটি মাহেন্দ্রক্ষণ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সঠিক ও বিচক্ষণ কর্মসূচি না নেওয়ার ব্যর্থতায় সে সুযোগটি অনেক দিনের জন্য অধরা হয়ে গেল। যে-কোনো কাজ শুরু করার সুযোগ সব সময় পাওয়া যায় না। অনেকেই বলেন, সব শুভকাজের লগ্ন থাকে। সেই লগ্ন কোনো কারণে পিছিয়ে গেলে সফলতা দূরে চলে যায়। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের আহ্বানে ১১ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলে একটি মহাসমাবেশ হয়েছিল যেখানে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ ঘটে। এর পাঁচ দিন আগে অর্থাৎ ৬ আগস্ট সরকার জনগণকে চ্যালেঞ্জ করে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয়। ডিজেল ও কেরোসিন লিটারে ৩৪, পেট্রোলে ৪৪ ও অকটেনে ৪৬ টাকা বাড়ানো হয়। সরকারের এ অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণ খেপে উঠেছিল। সবাই আশা করেছিল ১১ আগস্ট নয়াপল্টন থেকে একটি বৃহৎ আন্দোলনের ডাক দিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বাতিল না করা পর্যন্ত বিরোধী দল নয়াপল্টনের রাস্তা ছাড়বে না। কিন্তু সারা দিনের সব প্রত্যাশা সন্ধ্যায় টকট্ আউট হয়ে বেলুনের মতো চুপসে গেল। কারা যেন খুবই পরিকল্পিতভাবে সব উত্তাপে পানি ঢেলে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিল যাতে সেই উত্তাপ আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ে। এখানে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা নিয়ে নতুন জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। প্রথমটি হলো, টক্ট আউট যার অর্থ হলো কথা বলেই বিষয়টিকে শেষ করে দেওয়া। এ কথাটি সংসদীয় একটি কার্যক্রম। সংসদে কোনো ঘটনা মাটিচাপা দেওয়ার জন্য সরকার অত্যন্ত সুকৌশলে টকট্ আউট চালটি ব্যবহার করে। বিরোধী দলের চাপে গুরুতর জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ের আলোচনা ও প্রস্তাব নিতে সংসদের সভা মুলতবি করে ২ ঘণ্টার জরুরি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। ওই ২ ঘণ্টার অর্ধেক বা কখনো কখনো বেশি সময় বিরোধী দলকে দেওয়া হয়। তবে সব মিলে ২ ঘণ্টার বেশি সময় আলোচনা হতে পারবে না। এ নির্দিষ্ট ২ ঘণ্টার মধ্যেই আলোচনা করে যে -কোনো একটি প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত অনুমোদন করাতে হবে। ২ ঘণ্টা অতিক্রম হয়ে গেলে আলোচনাটি কোনো প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত ছাড়াই টকট্ আউট হয়ে গেছে বলে আলোচনার সমাপ্তি টেনে দেওয়া হয়। এখন আলোচনাটি টকট্ আউট করার একটি সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ আছে। সরকার আলোচনাটি বিরোধী দল দিয়ে শুরু করায়। কখনো কখনো আবার নিজেদের আপন বিরোধী দল দিয়েও শুরু করায়। শুরুতে আলোচনায় প্রচুর উত্তেজনা সৃষ্টি করানো হয় তাতে সংবাদমাধ্যম খুব সক্রিয় হয়ে ওঠে। আলোচনাটি জমে উঠলে অনেক সংসদ সদস্য বিশেষ করে বিরোধী ও আপন বিরোধী সদস্যরা খুবই সক্রিয়ভাবে সে আলোচনায় অংশ নিয়ে ২ ঘণ্টা পার করে দেন। তারপর স্পিকার অত্যন্ত বেদনা নিয়ে ঘোষণা দেন যে আলোচনাটি কোনো প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত ছাড়াই টকট্ আউট হয়ে গেছে। এই হলো টকট্ আউটের মোজেজা। তাই অনেকে বলাবলি করছে, ১১ আগস্ট পল্টনের জনসভায় ব্যাপক জনসমাবেশ ছিল, টানটান উত্তেজনা ছিল, গরম গরম বক্তৃতা ছিল কিন্তু সভা শেষে জনগণের প্রত্যাশিত কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। সমাবেশটি কেন জানি টকট্ আউট হয়ে গেল বলে অনেকের কাছে মনে হলো। কিন্তু জনগণ বুঝে গেল বিরোধী দলের নেতৃত্বে ব্যাপক দুর্বলতা যার কারণে এ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার ক্ষমতা সুদূরপরাহত। জনগণের কাছে মনে হচ্ছে বিরোধী দল যেন সরকারের রিমোট কন্ট্রোলে নিয়ন্ত্রিত অতি ভদ্র ও অনুগত একটি শক্তি, যারা সরকারের প্রয়োজনেই লোক দেখানো বিরোধিতা করে!
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, জনরোষ বেলুন ফুটা করে চুপসে দেওয়ার মতো। হঠাৎ করে বিনা নোটিসে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। এ অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সম্মিলিত বা একক কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক দল প্রতিরোধ গড়ে তুলবে বলে জনপ্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। যারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল স্বল্প নোটিসে এবং সরকারের বাহ্যিক বিধিনিষেধ অবজ্ঞা করে নয়াপল্টনের ১১ আগস্টের সমাবেশ। সমাবেশে আগত সবার মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের চেহারা জ্বলজ্বল করছিল। প্রায় সবার মাথায় বিভিন্ন রঙের পট্টি বাঁধা ছিল যাতে আন্দোলনে কে কত সক্রিয় তা যেন ফুটে ওঠে। সবার চোখে-মুখে ছিল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার তীব্র আকাক্সক্ষা। সবার মধ্যে আন্দোলনে থাকার শপথ নেওয়ার তীব্র প্রত্যাশা ছিল। সমাবেশ বক্তব্যের চেয়ে সমবেতদের স্লোগানে ছিল বেশি মুখরিত। সবাই স্লোগানে স্লোগানে আন্দোলনে থাকার দৃপ্ত প্রত্যয় ব্যক্ত করছিল যা রহস্যজনকভাবে মঞ্চ থেকে বারবার থামিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। মঞ্চ থেকে বিভিন্ন নেতা বড় নেতাদের নির্দেশে সমবেতদের ধমকিয়ে চুপ করিয়ে দিচ্ছিলেন যাতে তাদের পূর্বপরিকল্পিত ও নির্দেশিত বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে তাদের নির্দেশদাতাদের শোনাতে পারেন! মঞ্চের প্রায় সব বক্তাই হম্বিতম্বি করে জোর গলায় তাঁদের বক্তব্য দেন সরকারকে উদ্দেশ করে, কিন্তু সামনে সমবেতদের উদ্বুদ্ধ বা অনুপ্রাণিত করার জন্য তেমন কোনো বক্তব্য বা কর্মসূচি দিতে দেখা যায়নি। যার ফলে সভার মাঝামাঝি সবাই হতাশ হয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে বাদাম খেতে ব্যস্ত হয়ে যায় এবং অনেকে হতাশ হয়ে আস্তে আস্তে সমাবেশ থেকে চলে যেতে থাকে। যে-কোনো সমাবেশের সবচেয়ে ক্ষতিকর ও হতাশ চিত্র ফুটে ওঠে যখন চলমান সমাবেশ থেকে সমবেত কর্মীরা চলে যেতে থাকে বা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সমাবেশকে বড় করে দেখাতে গিয়ে বাদাম চিবোতে বসে যায়। অভিজ্ঞতা বলে, যখন ভাড়া করা লোকদের এনে কোনো সভা-সমাবেশ করানো হয় তখন সভা শুরু হওয়ার অর্ধেক সময়ের পর অনেক ভাড়াটিয়া চলে যেতে শুরু করে। তখন আবার অনেককে ধরে রাখার জন্য সভাস্থলে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে বসিয়ে দিয়ে তাদের বাদাম-চানাচুর, ঠান্ডা ইত্যাদি দিয়ে মনোরঞ্জন করাতে হয়। সভার ব্যাপকতা ধরে রাখার জন্য সভার পেছন দিকে এভাবে ভাড়াটিয়াদের বসিয়ে দেওয়া হয়। এটি বহুদিনের চেনা চিত্র। এ চিত্র দেখে সবাই বুঝতে পারে সভার অবস্থা এবং সভার ফলাফল কী হবে! যখন কোনো সভাস্থলে এ চিত্রটি ফুটে ওঠে তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বুঝে নেয় যে সমাবেশটি একটি নির্জীব সভা যেখান বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। তখন সরকারের বাহিনী সভাটি নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হতে দেয় এবং সব ধরনের সহযোগিতা করে। সমাবেশে উপস্থিত গোয়েন্দারা তখন সরকারের টেনশন কমিয়ে দেন। সবাই শান্তিপূর্ণভাবে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যায় এবং নেতারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে কে কত কড়া বক্তৃতা দিয়েছেন তার ফিরিস্তি ঘরের বউকে শোনান। বহু প্রত্যাশিত ১১ আগস্টের সমাবেশটির এমনই একটি হতাশাজনক ও ষড়যন্ত্রমূলক সমাপ্তি ঘটে। ফুলে ফেঁপে ওঠা জনগণের প্রত্যাশাকে খুবই পরিকল্পিতভাবে সরকারের গোপন মদদে ১১ আগস্টের সমাবেশটিতে ফুটো করে দেওয়া হয় যাতে তা আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যেতে পারে। তাই জনরোষ স্তিমিত করার জন্য ১১ আগস্টের সমাবেশটি বেলুন ফুটা করার পিন হিসেবে কাজ করেছে। তৃতীয়টি হলো, উত্তাপে পানি ঢেলে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ১১ আগস্টের আগে জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল তা এখন স্তিমিত হয়ে গেছে। সে সুযোগ ১১ আগস্টের সমাবেশটি করে দিয়েছিল তা কাজে না লাগিয়ে উপজেলাভিত্তিক সভা-সমাবেশ করার কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে তা যে সরকারকে সময় ও তার অবস্থা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের পরিকল্পনাতেই করা হয়েছে তা এখন জনগণের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য না হলে পৃথিবীর কোনো সরকারই রাজধানীতে বিরোধী পক্ষকে বড় কোনো রাজনৈতিক সমাবেশ করতে দেয় না এবং দেবেও না। রাজধানীতে রাজনৈতিক বিরোধী শক্তির শক্ত অবস্থানের মানেই হলো সরকার যে দুর্বল তা তুলে ধরে। যে-কোনো রাজনৈতিক দলের আজীবনের আরাধ্য সাধনা হলো রাজধানীতে তাদের অবস্থান তুলে ধরা। সেখানে যদি ১১ আগস্টের মতো একটি সমাবেশ করে কোনো রাজনৈতিক দল গ্রাম বা উপজেলায় ফিরে যায় তাহলে জনমনে স্পষ্টতই ধারণা জন্মে ওই দলের নেতৃত্ব সরকারের কবজায়! ১১ আগস্টে নয়াপল্টনে সমাবেশে সরকার বাহ্যিকভাবে কোনো বাধা সৃষ্টি বা কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। এখানে জনগণের কাছে বাহ্যিক বিধিনিষেধ বলা হচ্ছে এজন্য যে, অতীতের মতো ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথাকথিত পূর্বানুমতি না নিয়ে ১১ আগস্টের সমাবেশটি করা হয়েছিল। এ ছাড়া নয়াপল্টনের সমাবেশে আসার জন্য পথে সরকারের রাজনৈতিক কর্মীরা কোনো বাধাও সৃষ্টি করেননি। যদিও ওইদিন রাস্তায় মোবাইল কোর্ট দিয়ে বাসের অতিরিক্ত ভাড়া চেক করতে নামিয়ে দিয়ে কার্যত বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল যাতে সাধারণ মানুষ সমাবেশে না আসতে পারে। সরকার ওইদিনের সমাবেশে বিএনপির লোকদের আসতে কোনো বাধা দেয়নি। সমাবেশ করতেও কোনো বাহ্যিক বাধা দেয়নি। সমাবেশটি নির্বিঘ্নœ করতে সরকার পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। সরকারের চিহ্নিত চাপাবাজ মন্ত্রীরাও কোনো আওয়াজ তোলেননি। সরকারের সব মহলে সমাবেশটিকে সহায়তা করার লক্ষণ দৃশ্যমান ছিল। তাই সমাবেশটি সরকারের পক্ষে খুবই সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছিল এবং জনগণের কাছে মনে হয়েছে সরকারকে আরও সময় ও সুবিধা দেওয়ার জন্য বিরোধী দল রাজধানী ছেড়ে নতুন করে আন্দোলন খেলা খেলতে গ্রাম তথা উপজেলায় চলে যাওয়ার নির্দেশ সমাবেশে ঘোষণা করে আরও পরিষ্কার করে দিল! না হলে কেন বা কী উদ্দেশ্যে রাজধানী ছেড়ে একটি পরিপক্ব, যৌক্তিক ও জনস্বার্থমূলক আন্দোলন উপজেলায় নিয়ে যাওয়া হলো তা না বোঝার ক্ষমতা মনে হয় জনগণের নেই! তবে উপজেলার তথাকথিত আন্দোলন নিয়ে সরকার যেভাবে খেলছে তাতে এটি পরিষ্কার যে আগামী দুই বছর বাধ্য করতে না পারলে সরকারবিরোধী দলের কোনো বড় সমাবেশ ঢাকা বা তার আশপাশে হতে দেবে না। সরকারের দুর্বল হওয়ার লক্ষণ আপাতত আর দেখা যাচ্ছে না। ১১ আগস্টের সমাবেশ সুনিপুণভাবে সমাপ্ত করে বিরোধী দল সরকারকে আপাতত বিপন্মুক্ত করে দিয়েছে বলে জনমনে ধারণা জন্মেছে। এখন বিরোধী দল উপজেলায় ফিরতি লিগ খেলার আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। সরকারের সামনে এখন নতুন খেলা হলো আগামী নির্বাচন নির্বিঘ্নে করিয়ে নেওয়া। সরকারের পুরোপুরি কবজায় আছে দেশের সব বিরোধী দল। কারও এতটুকু ক্ষমতা নেই সরকারের বিজয়রথ থামাবে। বিদেশি কোনো শক্তি বা পক্ষও বিরোধী দলের সঙ্গে থাকার সম্ভাবনা নেই। তারাও যেন জেনে গেছে এ দেশে সরকারের বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। সবাই সরকারের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। জেল-জুলুম, নির্যাতন মোকাবিলা করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো কোনো রাজনৈতিক নেতা দেশে নেই। সবাই সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপনে আঁতাত করে বসবাস করছে। প্রায় সব নেতার মাথার ওপরে দুর্নীতির মামলার খড়্গ ধরে রাখছে- একটু এদিক-সেদিক হলে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। আবার কাউকে কাউকে জেলেও আরাম-আয়েশে রেখে প্রতিনিয়ত ভয় দেখাচ্ছে, কথার বাইরে গেলে এবার কাশিমপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে! বর্তমান বিরোধী দল কোনো আন্দোলন যে করতে পারবে না তা সরকারের কাছে খুবই পরিষ্কার।
আন্দোলন ছাড়া বিরোধী দলের কোনো বিকল্পও নেই। এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে না পারলে বিরোধী দলের সামনে কোনো রাজনীতি নেই। নির্বাচন করে জয়লাভ করলেও এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে একচুলও হটানো যাবে না। বর্তমান সংবিধান এ সরকারের পূর্ণ কবজায়। সংবিধানের একটি ভয়াবহ অংশ হলো অনুচ্ছেদ-১২৩ (৩)-এর শর্ত যা নিম্নরূপ : ১২৩ (৩) সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে: তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না। তার মানে খুবই পরিষ্কার যে চলমান সরকার মেয়াদ সমাপ্ত না করা পর্যন্ত নতুন সরকার কার্যভার গ্রহণ করতে পারবে না। এখন বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে যে-কোনো নির্বাচনেই জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো ইসলামী দল যদি জয়ী হয় তাহলে বর্তমান সরকার কি ক্ষমতা দেবে বা দিতে বাধ্য এমন কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কি আছে? এ প্রশ্নের সুরাহা বা ফয়সালা না করে নির্বাচনে যাওয়া মানেই সরকারের ফাঁদে ইচ্ছাকৃত পা দেওয়া হবে। সরকারকে ক্ষমতায় রেখে বর্তমান সংবিধানের আওতায় সরকারের পাতানো নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারলেও ক্ষমতায় যেতে হলে অবশ্যই মরণপণ আন্দোলন করতে হবে। এ সরকারের পেছনে আছে ভারত তার ভৌগোলিক স্বার্থের কারণে, আছে চীন তার কায়েমি ও ব্যবসায়িক স্বার্থে, রাশিয়া তার নতুন বাজারের খোঁজে, যুক্তরাষ্ট্র তার রোহিঙ্গা স্বার্থে, ইউরোপিয়ানরা তাদের বাজার টিকিয়ে রাখার জন্য, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার মুসলমান রাষ্ট্রগুলো সস্তায় শ্রমিক নেওয়ার স্বার্থে। তারা সবাই বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে। আগামীতেও এ সরকারকে বাদ দেওয়ার কোনো আলামত তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলের পক্ষে দু-একটি কথা বলে তারা বিরোধীদের হাতে রেখে শান্ত রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু পারতপক্ষে ক্ষমতার পরিবর্তন হতে দেবে না। পরিবর্তন আনতে হলে জনগণকে নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামতে হবে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, ন্যায়বিচার, দুর্নীতিমুক্ত সরকার নিশ্চিত করতে এবং সর্বোপরি বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত ও তারেক রহমানকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে হলে দলমত নির্বিশেষে বিরোধী দলের সামনে সর্বোচ্চ ত্যাগের বাসনা ও প্রস্তুতি নিয়ে একটি চূড়ান্ত আন্দোলনের বিকল্প নেই। একটি মরণপণ আন্দোলন করতে না পারলে এ সরকার আরও বহুদিন ক্ষমতায় থাকবে। খালেদা জিয়া বন্দি আবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করবেন। হয়তো সেদিন তাঁর জানাজায় মানুষের ঢল নামবে তবে সে জানাজায় আমি যাব না, তার অনুমতি জীবিত দেশমাতার কাছে আমি নিয়ে রেখেছি। যাঁকে জীবিত মুক্ত করতে পারলাম না তাঁর জানাজায় যাওয়ার কোনো অধিকার আমাদের কারও নেই।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন